অসম্ভব এক যুদ্ধ ॥ দিলরুবা আহমেদ


অলঙ্করণ: কাজী জহিরুল ইসলাম

সোহেলী বলে সে যুদ্ধ করতে যাবে। প্রায়ই বলে। এদিক ওদিক চেয়ে রণবীর প্রায়ই ভাবে কোন যুদ্ধে যেতে চায় এই মেয়ে!! এই দেশে তো কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে না। অন্য কোন দেশে গিয়ে এ যোগ দিবে নাকি কোন যুদ্ধে! কিছুই বলা যায় না। লাইনঘাট খুজে নিয়ে অনেক মেয়েই তো চলে যাচ্ছে বহুদিকে। এত কম দিনের পরিচয়ের কারনে বেশি কিছু সে বুঝেও উঠতে পারছে না। তবে এই মেয়েকে বোঝার আকাঙ্খায় এর সামনে পিছনে ঘুরে মরছে সে দিন রাত।

অবাক হয়ে একদিন দেখলো সোহেলী হাত ভেঙে এসে হাজির হয়েছে। জানতে চাইলো,
যুদ্ধে গিয়েছিলে! হাত ভেঙেছো কিভাবে?
সোহেলী চোখ বড় করে বলে,
হ্যাঁ, অস্ত্র চালাতে গিয়ে হাত ভেঙেছে।
রণবীর যথার্থই শঙ্কিত হয়।
কি বলছো?
যা বলছি পরিস্কার বাংলায় বলছি।বুঝতে পারছো না কেন!
তুমি কি জান তুমি কি বলছো? ভাবছো? করছো?
বীণা যুদ্ধে প্রাণ নাহি দেব, দেব না। যুদ্ধ চাই। আরেকটা যুদ্ধ চাই।
তোমার সমস্যাটা কি?
আমার সমস্যা তুমি।
আমি কি করে তোমার সমস্যা হই।
শোন ছেলে তুমি যে ভাবছো প্রতিদিন সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে, এটা খুবই ভয়ঙ্কর কোন পরিকল্পনার দিকেই সম্পর্ক এগিয়ে নিচ্ছে।
আমি তোমাকে নিয়ে ভাবছি না।
তুমি ভাবছো।
না ভাবছি না।
তাহলে রোজ আমার কলেজ যাওয়ার পথে এসে দাঁড়িয়ে থাক কেন, এই গাছ তলায়?
কাল থেকে আর থাকবো না।
না এসে পারবে না।
পারবো।
তাহলে না এসে দেখিয়ে দাও।
আাচ্ছা সেটা সম্ভব না। অসম্ভব।
তাহলে মানছো তুমি না এসে পারছো না। কারণ তুমি ভাবছো আমাকে নিয়ে।
হ্যাঁ, ঠিক।
তুমি জান আমরা দুটো ভিন্ন ধর্মের মানুষ।
জানি।
হুম, তাহলে কিভাবে কি?
জানি না। আর শোন তুমি তো পরের গলি দিয়েও কলেজ যেতে পার। তা না গিয়ে এই পথ দিয়ে যাও কেন?
তোমার দাঁড়িয়ে থাকা চেক করার জন্য। দেখি দাঁড়িয়ে আছ না বসে আছ।
শুয়ে থাকবো কাল থেকে।
আমি তার উপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যাব।

এই মফস্বল শহরে দেখেছো কোন মেয়েকে সাইকেল চালিয়ে যেতে? করছো তো তাই। আবার জলজ্যন্ত একটা ছেলের উপর দিয়ে চলে যেতে চাও!
আমি তো আমিই। সব পারি।
এত পারা ঠিক না।
তবে তাহলে যে মেয়ে হেঁটে হেঁটে কলেজ যায় তার পথের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তো কই দেখি না তোমায়, হে যুবক।
হৃদয়হীনা যুবতী, তোমার হাত কি সাইকেল থেকে পড়ে ভেঙেছে?
হুম, তাই।
তাই হবে। আর বলে কিনা যুদ্ধে যাবে। যুদ্ধের ভয় দেখায়।
তোমার নামটা যেন কী? রণবীর না! তাহলে? যুদ্ধই তো, নয় কি? রণ এবং বীর। রণবীর। তুমি মানেই তো যুদ্ধ। পরিবারের সাথে। ধর্মের সাথে, সমাজের সাথে।
পারবে তো জয়ী হতে এই রণে, এই ভাবনায় আছ তাই না?
আসলেই ভাবনায় আছি।
ভাবতে থাক।

এই বলেই সোহেলী সাইকেল চালিয়ে সাই করে বের হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
আজও সোহেলী সাইকেল চালিয়ে সাই করে আবারও পার হয়ে গেল, দাঁড়ালো না, জবাবও দিল না তার ডাকের।
অথচ সব সময় সোহেলী বকবকানো শেষে ছুটে বেরিয়ে কিছু দূর গিয়ে পেছন ফিরে চেয়ে ওড়না ওড়ায়। বলে,
এই যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ। সকল বন্ধনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ ঘোষণা করবো আমি। ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের আলাদা করে রাখতে পারবে না দুই পরিবার। যুদ্ধ চাই যুদ্ধ চাই। তোমার আমার মিলন মানে একটা মহা যুদ্ধের শুরু থেকে সমাপনী পর্যন্ত সব কিছু এবং সব কিছুর পরের অধ্যায়। পারবে তো ততদিন টিকে থাকতে!
রণবীরও হেসে বলতো, পারবো।

গত দিন পাশ থেকে বুড়ামিঞা এক চাষা ঠাকুরদাদা ধান ক্ষেত থেকে বলে উঠেছিলেন,
নাতনী, এতই যদি যুদ্ধ করবার সখ মুক্তিযুদ্ধের আগে কেন জন্মাইলা না। স্বাধীনতা কাকে বলে দেখতা। আমরাও একটা নারী যোদ্ধা পাইতাম।
আমার মায়ে জন্মাইছিলো। ১ বছরের ছিল। ঐ ধান ক্ষেতে তাকে কুকুরের সাথে পাওয়া গেছিল গো দাদা। কেও জানে না সে কোথাকার ধন। কার জন। কার কে। সে হিন্দু না মুসলিম তাও কেও জানে না। মুসলমান নানা-নানী পালছিল তাই মুসলিম হইছে। খৃষ্টান পাললে খৃষ্টান হইতো। আমিও তখন নান হইতে পারতাম। সাদা কালো গাউন পরে পাদীদের আর নানদের মতন ঘুরে বেড়াইতে খুব মন চায়।
এখন হজুর হ। মহিলা হুজুর, ইমাম হ।
ওহ্ আল্লাহ এই গ্রাম দেশে মহিলা ইমাম হুজুর চলবো না।
রণবীরও বলে উঠেছিল,
শুনেছিলাম কানাডায় কোন মসজিদে ঈদের নামাজের ইমাম হয়েছিলেন এক মহিলা।
সে তো বিদেশে। বিদেশ বিদেশই। দূরের কথন বাতিল।
বলেই মুখ ঝামটা দিয়েছিল সোহেলী।

আজ সোহেলী দাঁড়ায়নি তার পাশে বা তার ডাকে, মুখ ঝামটা দিতেও ধীরে পাশ দিয়ে পাশ কাটেনি। সাইকেল চালিয়ে সোজা দাদুর পাশে গিয়ে থেমেছে। দাঁড়িয়ে দাদুর সাথে কথা বলছে । আড় চোখে তাকে দেখছে হয়তোবা। বোঝা যাচ্ছে না। সেও হেঁটে এসে ধান ক্ষেতের পাশে দাঁড়ালো।
দাদু এই ছেলে কবে আমাকে ফলো করা ছাড়বে বলতে পার।
যখন তোমরা এক হবা তখন।
বলে ফোকলা দাঁতে দাদু হাসলেন।
সোহেলী রণবীরের দিকে ফিরতেই রণবীর একটা হাসি দিয়ে চোখ টিপলো। চেয়ে আছে রমনীয় রমনী,তবে চোখ কুচকে। সাইকেলের ব্যাক পেডেল চেপে কাছে আসছে। মেয়েটার সব ব্যাপারেই সাহস বড় বেশি। এসে না আবার ধমকাতে শুরু করে!!
কিন্তু কাছে এসে বললো,

আজ মসজিদে যাবা। গিয়া মুসলমান হবা। চার রাকাত দু-রাকাত করে ফরজ থেকে নফল সব নামাজ যদি পড়ে শেষ করে ফেলতে পার তাহলে পরশু সকালে এই পথে এসে দাঁড়াবা। না হলে কোন দিনও যেন আর তোমারে না দেখি। বুঝলা!!
বলেই ১৯ বছরের সোহেলী সাঁই সাঁই করে ছুটলো কলেজের দিকে।
যেন কেমন করে সোহেলী জানে আর কোনদিনও দেখা হবে না রণবীরের সাথে।
একবার পেছন ফিরে চাইতে গিয়েও চাইলো না।
জানে রণবীর হা করে চেয়ে আছে।

সে তাকালেই অনেক হাহাকার উড়ে ধেয়ে আসবে তার কাছে। একদিনের নোটিশে কেও ধর্ম ছাড়বে না। ধমকেও না। সোহেলী জানতো সে কি নিয়ে যুদ্ধ করবে, কিন্তু অপরদিকে যে মা! নিজের মায়ের সাথে, কিভাবে ? মা-কে দেখেছে আপনের খোজে ধাঁধাঁয় থাকতে জীবনভর। অসহায় বিধবা মায়ের দাবি তার কাছে রণবীরের থেকে অনেক উপরে।
এবার তার দাবিতে রণবীর যদি রণে ভঙ্গ দেয় তবে সে আর কি করতে পারে! মন বলছে দেবে, তার মনও বুঝ মেনে যাবে তাহলে। চলে যাক কোথাও, দূরে। জোরে আরও জোরে সাইকেলের পেডেলে চাপ দিতে থাকলো। সেই না হয় চলে যাবে বহু দূরে।