আমাকে লেখক বানিয়েছে আমার জীবনের ফাঁদ।মানুষের জীবন ফাঁদ ছাড়া কিছু নয়: নুসরাত সুলতানা


অলঙ্করণ: লংরিড

নুসরাত সুলতানা। দ্বিতীয় দশকের কবি এবং গল্পকার।তাঁর কবিতায় যেমন রয়েছে উপমা, উৎপ্রেক্ষা আর গভীর বোধের সম্মিলন।তেমনি গল্পেও রয়েছে দারুণ ন্যারেটিভস সমৃদ্ধ দৃশ্যকল্প এবং চিত্রকল্প।১ মার্চ তার জন্মদিন।এ উপলক্ষে লেখালেখি, সংস্কৃতিচর্চা এবং সাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফ বরকতুল্লাহ।

সাইফ: কথাসাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন?
নুসরাত সুলতানা: দ্বিতীয় মেয়াদে লিখতে শুরু করি ২০১৭ সালে।মাকে হারিয়ে তখন মানসিক ভারসাম্যহীন।তখন লিখতে শুরু করি কবিতা। প্রথম কবিতাও মাকে নিয়ে।২০১৮ সালে প্রথম গল্প লিখি।খুব কাছের একজন বলেছিলেন-তুমি গল্প লিখতে পারবে না।তাঁর এক মেয়ে বন্ধু ফেসবুক সাহিত্য গ্রুপে বেশ জনপ্রিয় গল্পকার।সেই তখন থেকে জিদ চেপে যায়।কী গল্প লিখতে পারবো না! এসব কারণ ছাড়াও গল্পের প্রতি দিন দিন সমর্পণ বেড়েছে তার শিল্প সম্ভারের কারণে।আসলে কথাসাহিত্য ছাড়া সমাজ এবং সম্পর্ককে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কতটা সম্ভব!

সাইফ: ছোটোবেলা থেকেই লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল কী?
নুসরাত সুলতানা: নাহ।একেবারেই লেখক হতে চাইনি।পাঠক ছিলাম। বরং অনেক লেখা মাথায় আসত আমি লিখতাম না।আর সুনীলের প্রেমিকা মার্গারেট মাতিয়্যুর মতো আমিও ভাবতাম-এত লেখকরা লিখে গেছেন।আমার আর লেখার কী দরকার? বরং আমি পড়ি।আমাকে লেখক বানিয়েছে আমার জীবনের ফাঁদ।মানুষের জীবন ফাঁদ ছাড়া আর কিছু নয়।

সাইফ: আপনি যখন গল্প লেখেন, তখন ঠিক কোন বিষয়টির প্রতি বেশি মনোযোগ দেন?
নুসরাত সুলতানা: ভাষায় নিজস্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করা, দৃশ্যকল্প, চিত্রকর কল্প, ন্যারেটিভস এবং চরিত্রের শক্তিশালী দিকগুলো যেন দৃশ্য কল্পের ভেতর প্রতিফলিত হয়।আরও একটা বিষয় খেয়াল রাখি-সেটি হলো নদীর মতো গল্পটার যেন একটা পরিভ্রমণ থাকে।গল্পের সাথে পাঠকের মননের যেন একটা সুগভীর পরিভ্রমণ সংঘটিত হয়।

সাইফ: আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন।লিখতে গিয়ে অনেকের লেখাই পড়েছেন।একটি সার্থক লেখার গুণাবলী কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন? গল্প লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক কী?
নুসরাত সুলতানা: সার্থক লেখা যেমন সেই জনপদের ইতিহাস, জনজীবন, সংস্কৃতিকে নিংড়ে বেড়ে ওঠে তেমনি তার শিল্পগুণে হয়ে ওঠে বৈশ্বিক।আরও একটা বিষয় হলো-উত্তীর্ণ একটা লেখায় যেমন আপনি সমকালকে নিবিড়ভাবে পাবেন।তেমনি তার আবেদন থাকবে চিরকালীন।

দ্বিতীয় বিষয়ে আসি, গল্প লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক মনে হয়-গল্পটাকে বোঝা।গল্পের সময় এবং সংস্কৃতিকে মূর্ত করে তোলা ভাষা এবং দৃশ্য কল্পের ভেতর।লেখকের নিজস্ব জীবন দর্শন চরিত্রের জীবনাচরণের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা।

সাইফ: পুরস্কার নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে।আপনি পুরস্কারকে কোন চোখে দেখেন?
নুসরাত সুলতানা: পুরষ্কার লেখককে লেখক হয়ে উঠতে বাধাগ্রস্ত করে। প্রতিষ্ঠা লেখকের জন্য নয়।গুরুত্বহীন অনেক পুরষ্কার পেয়ে পেয়েও লেখক নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করেন এবং আত্মতুষ্টিতে ভোগেন।যা নিজেকে ভাঙার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।লেখক হওয়ার জার্নিটা আমৃত্যু।বহমানতাই শিল্পের গন্তব্য।তবে গ্রহণযোগ্য পুরষ্কার লেখককে আত্মবিশ্বাস যোগায়।কিন্তু প্রায় সব পুরষ্কারই তার স্বচ্ছ্বতা এবং গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।

সাইফ: বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা যেমন বেড়েছে, তেমন সাহিত্যের চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে।এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
নুসরাত সুলতানা: চোর একটা টেক্সট চুরি করতে পারে।লেখকের মনন, মেধা, প্রজ্ঞা চুরি করতে পারে না।চাঁদ কখনো সূর্যের মতো উত্তাপ ছড়াতে পারে না।তাই চোরের কাজ চোর করুক, লেখকের কাজ লেখক করুক।

সাইফ: সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কখনো কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তারা কারা? কিংবা সেই প্রভাবের ধরনটি কেমন হতে পারে?
নুসরাত সুলতানা: খুব ছোটবেলায় নজরুলকে অনেক পড়তাম।তারপর রুদ্র, রফিক আযাদ, সুকান্ত ভট্টাচার্য এরপর ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করি-শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শংখ ঘোষ, বিনয় মজুমদার, জীবনানন্দ এদের। এতো গেলো কবিদের কথা।গল্প বা উপন্যাসের কথা যদি বলি-রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প, উপন্যাস খুব পড়েছি।তিন বন্দোপাধ্যায়ের প্রত্যেকেই খুব প্রিয়।এদের ভেতর মানিক আমাকে খুব কষ্ট দেয়।যখনই ভাবি মানিকের মতো হতে পারব না তখনই বুকের ভেতর কষ্ট হয়। তারপর আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল্লাহ্ কায়সার, আলাউদ্দিন আল আযাদ,শহিদুল জহির, সৈয়দ শামসুল হক, জাকির তালুকদার এদের প্রচুর পড়েছি।আমার লেখক মানসে এদের প্রভাব অবশ্যই আছে।

আরও স্পষ্টত বলতে গেলে আমার মনে হয়, মানিক বন্দোপাধ্যায়, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস, শহিদুল্লাহ কায়সার, জাকির তালুকদার এরা আমার লেখক মানসকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছেন।সেই প্রভাব চিন্তায়, মননে এবং গল্প বলার ঢংয়ে।

সাইফ: আপনি তো কবিতাও লিখছেন।কিন্তু দেখা যাচ্ছে কথাসাহিত্যে আপনার আগ্রহ বেশি।কবি না কথাসাহিত্যিক-কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?
নুসরাত সুলতানা: আমি লিখি সকল প্রাণের বেদনার অবমুক্তি।লিখি উদীয়মান সূর্যের কথা, গর্ভজাত ফসলের কথা আর বহমান জীবন নদীর ধারা। কোনো পরিচয়েই অস্বাচ্ছন্দ্য নেই।পাঠক তার অভিরুচি অনুযায়ী পড়বে।

সাইফ: আপনার সমসাময়িক ও অনুজদের মধ্যে কার কার গল্প আপনাকে আকৃষ্ট করে কিংবা কাকে কাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
নুসরাত সুলতানা: অনেকের লেখাই তো পড়ি।এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ইশরাত তানিয়া, মোস্তফা অভি, নাহার তৃণা।আনিফ রুবেদ ভিন্ন স্টাইলের গল্প লিখেন।আব্দুল আজিজের গল্পের সাথে বেশ ভালো বোঝাপড়া আছে।ইসরাত জাহান আগের চেয়ে ভালো করছেন।সাইফ বরকতুল্লাহর গল্প বলার ঢং অন্যদের চেয়ে আলাদা।আরও অনেকের লেখাই পড়ি এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

সাইফ: আপনার কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে? বইগুলোর বিষয়বস্তু কী?
নুসরাত সুলতানা: এ পর্যন্ত (২০২৪) আমার সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে। চারটি কবিতা, দুটি গল্প এবং একটি গদ্য।বিষয় তো অবশ্যই মানুষ।

সাইফ: তরুণদের মধ্যে যারা লিখতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ-
নুসরাত সুলতানা: অবশ্যই পড়াশোনা করা জরুরি।নিজের ইতিহাস, সংস্কৃতি, উত্তীর্ণ সাহিত্য সব খুব ভালো করে পড়তে হবে।সেই সাথে বিশ্ব সাহিত্যের ক্লাসিকগুলো যতটা পড়া যায়।সময়কে পর্যবেক্ষণ করতে হবে খুব মনযোগের সাথে।সাথে প্রয়োজন মানুষ এবং প্রকৃতি।প্রস্তুতি ছাড়া লিখতে আসা উচিত নয় কোনোভাবেই।লেখালেখি কোনো লুডু খেলা নয়।

সাইফ: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
নুসরাত সুলতানা: সাহিত্য জীবন আর সময়ের প্রতিচ্ছবি।সময় যেমন বহমান তেমনি নিগুঢ় পর্যবেক্ষকও।যা ধরে রাখার যোগ্য তা ঠিকই ধরে রাখে।সব কলহ এড়িয়েও কিছু ভালো কাজ যেমন এখনো হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবে।প্রত্যেকে তার কাজটি করে গেলেই মোক্ষ মিলবে।

সাইফ: আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
নুসরাত সুলতানা: আপনাকেও অজস্র ধন্যবাদ।