বাঙালি আসলে সাহিত্য বোঝে না, রবীন্দ্রনাথ বঙ্গজীবনে সাহিত্য এনেছেন: ব্রাত্য বসু


[ ব্রাত্য বসু একজন নাট্যকার, নাট্য পরিচালক, অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ।তার এই সাক্ষাৎকারটি ২৪ জুন ২০২২ ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।আনন্দবাজারের সৌজন্যে সাক্ষাৎকারটি যোগসূত্রের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।]

প্রশ্ন: আপনি জানতেন আপনাকে জীবনানন্দের মতো দেখতে?
ব্রাত্য বসু: (প্রশ্ন শুনে অবাক) নাহ! একেবারেই না। জীবনানন্দ বহুবার পড়েছি।কিন্তু আমায় কোনও দিন তার চরিত্রে অভিনয় করতে হবে ভাবিনি।খুব শক্ত কাজ।

প্রশ্ন: কেন?
ব্রাত্য বসু: জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবন বেশির ভাগটাই অধরা।যা তথ্য পাই, তা শুধু বাইরের।কিন্তু মানুষটার ভেতরে যাওয়া, সমুদ্রের গভীরে যাওয়া খুব কঠিন ছিল।সেটা আমি আমার মতো করে করার চেষ্টা করেছি।জীবনী পাঠ করলাম।কিন্তু আমাকে খুব সাহায্য করল শাহাদুজ্জামানের লেখা ‘একজন কমলালেবু’ বইটি।বিশেষত তার বোনের সঙ্গে যে সম্পর্ক; স্ত্রী লাবণ্যের সঙ্গে অবনিবনা; সমসাময়িক লেখকদের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখা; একটা অবরোধের মধ্যে বাস করা- এগুলো বিশদে জানতে পেরেছি।যা চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে খুব কাজে লেগেছে।

প্রশ্ন: ‘ঝরা পালক’ ছবিতে কি আপনার সামনে নতুন জীবনানন্দ এলো?
ব্রাত্য বসু: বলতে পারেন।ওর স্ত্রী লাবণ্যকে আরও জানলাম।সে অর্থে আমি তাকে বাহবাই দেব।পৃথিবী থেকে প্রত্যাখাত, অসফল একজন মানুষকে আগলে রেখেছেন তিনি।তার চাকরি চলে গেছে।ছাত্রমহলেও তিনি জনপ্রিয় নন।মুখচোরা এমন একজনের সঙ্গে থাকা, মাঝে মাঝে থাকতে না পেরেও সহ্য করা-এটা কম কথা নয়।মাঝে মাঝে স্ত্রী পেরেও উঠতেন না।এই জায়গাটা দেখলাম।আর বুঝলাম, জীবনানন্দ আত্মহত্যা করেছিলেন।তার মৃত্যু কোনও দুর্ঘটনা নয়।সমস্ত সমাজ তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল।যেহেতু তিনি অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ, তাই সমাজের স্থূলতা, ক্রূরতা, অসাড় নিষ্ঠুরতা এই সংবেদনশীলতাকে বোঝার উপযোগী ছিল না।সমাজের বয়েই গেছে।এইটা ছবি করতে গিয়ে বোঝা গেলো।

প্রশ্ন: আর আজকের জীবনানন্দ?
ব্রাত্য বসু: এই সময় তো আরও খারাপ অবস্থা।আজ যে জীবনানন্দ, তার পক্ষে মানিয়ে নেওয়াই অসম্ভব ব্যাপার।

প্রশ্ন: বাঙালির কাছে কবি মানেই মুখচোরা, নরম, কিছু কবিতা নিয়ে চলা জীবন…
ব্রাত্য বসু: আরও আছে।বাঙালির কাছে তিনিই কবি, যিনি তার জীবৎকালে কবিতা প্রকাশ করবেন না।পরে তার কবিতার পাণ্ডুলিপি প্রকাশ পাবে।বাঙালি আসলে গড় অর্থে কোনও সাহিত্য বোঝে না। মাঝখানে একটা লোক চলে এসেছিলেন- রবীন্দ্রনাথ! তিনি এই সাহিত্যের বাতাবরণ তৈরি করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথ আমার মতে ‘কিংবদন্তী’, তবে প্রভাবসঞ্চারী নয়।

প্রশ্ন: মনে হয় না রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন…
ব্রাত্য বসু: একেবারেই নয়।রবীন্দ্রনাথ জ্যান্ত।তবে তিনি নিজে এই বাঙালি জাতির মতো সংখ্যালঘু তৈরি করেছেন।তিনি নিজেও অবশ্য লড়াই করে সংখ্যালঘু হয়েছেন।এই সংখ্যালঘুদের অবস্থা ভালো নয়। কারণ, সংখ্যাগুরু মাত্রেই ভোঁতা।

প্রশ্ন: ‘ঝরা পালক’ কাদের ছবি?
ব্রাত্য বসু: এই ছবি সংখ্যালঘুদের দেখার ছবি।যারা ধ্বস্ত, সাহিত্যপ্রেমী। এই সমাজের মূল স্রোতে চলতে না পারা লোক এই ছবি দেখবে।এই ছবি মার-খাওয়া মানুষের কথাই বলে।

[ সংক্ষেপিত ]