নীলগর্ভ নারীর মনোজটিলতার বয়ান ॥ শাকিলা আক্তার পাঁপড়ি


উপন্যাস পড়ছিলাম।উপন্যাসের পাতায় পাতায় শব্দের মোড়কে হাতের আঙুল ধরে নিয়ে যায় এক নারী।নাম-সুরভি শরীরে, মনে যন্ত্রণার চোরাস্রোতে ভেসে যেতে যেতে সে তার হাসি হয়ে হাসা, সুর হয়ে বাজা ছোট্ট মুখের শিশু কন্যা আস্থার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সন্তানের সান্নিধ্য থেকে খুটে খুটে হাজারো সুখের সন্ধানে পাঠক আমাকে মাতিয়ে রাখে সুরভি।

মা-মেয়ের খুনসুটি, বর্ণহীন ব্যথা, স্নেহের স্পর্শ সন্তানের নিবিড় মমতার কাছে আমাকে নুইয়ে দেয় আরও। তবুও হাঁ করে গিলতে আসা কুহক রাত যত গভীর হতে থাকে, প্রাপ্তির ভেলভেটে মোড়া এ জীবন নগন্য লাগতে থাকে সুরভির।এই বিষাদের পাশে স্বামীর নির্লিপ্ততা কিংবা কেবল দায়িত্ব সর্বস্ব আচরণ হাহাকারের পাথারে ভাসিয়ে দেয় সুরভিকে। বিশেষ এক কারণে।গর্ভের গভীরে নীল বেদনার হুটোপুটি সে কারণ। সে বেদনা ২২ সপ্তাহের ভ্রুণ হারানোর যন্ত্রণা।হারানোর অক্ষমতাকে পুঁজি করে চতুর্পাশে নীলচে বিষবাষ্পের আঁচে নিষ্পেষিত হবার যন্ত্রণা।

নিজস্ব মনস্তত্ত্ব টালমাটাল হবার সময়টায় মানুষ সম্ভবত নিজেকে সবচেয়ে একা করে ফেলে নিজেই।পাশের মানুষ কাছের নয় ভেবে নিজেই নিজেকে বঞ্চিত করে আরো খানিকটা।ঋদ্ধ লেখকের ভাষায়, ‘নিজের মধ্যে একলা যাপন করে’।

অপরিণত ভ্রুণ হারানো এমন একজন মায়ের আত্মা নিংড়ানো উপলব্ধির নির্যাস ‘নীলগর্ভ’। আমাদের সমাজের অজস্র নারীর বলতে না পারা নিগূঢ় যন্ত্রণার শাব্দিক প্রকাশের উপন্যাস ‘নীলগর্ভ’।

উপন্যাসের মাঝপথে এক লাইনে এসে লেখক গভীর জীবনবোধের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।বোধটা এই-‘ব্যক্তিগত নির্জনতায় মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত থাকা শোভন’।

জীবনের যত গ্লানি, অপমানের ডাকনাম ‘বেদনা’ রেখেছি সবগুলো স্কুলের অ্যাসেম্বলির মতো সারিবদ্ধভাবে এসে দাঁড়িয়েছে হৃদপিণ্ডের কাছে।জানান দিচ্ছে হাজিরা। ভাবছিলাম, সঙ্গত একটুখানি বোধের সাথে অপরিচিত থেকে যাবার অজ্ঞাত অপরাধে কী নির্মম জীবন কাটায় মানুষ!

ফিরে আসি প্রিয় সুরভিতে।শোকের ব্যঞ্জনার বর্ণনা দিতে দিতে কথক সুরভি তার বন্ধু অপর্ণাকেও পাঠকের প্রিয় চরিত্রের কাতারে নাম লিখিয়ে দেয় সুনিপূণভাবে। সুরভি-আস্থার মতো অপর্ণা-আর্য এর জন্যেও মন সকাতরে প্রার্থনা করে উঠে।

সমস্ত শঙ্কা মিলেমিশে গলার উপরিভাগ জাপটে ধরে আমার কর্ণকুহরে কেউ যেন ফিসফিস করে বলতে থাকে ‍‍‌কত অপর্ণা চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হে’।এই দীর্ঘশ্বাস পাঁজর কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলে।উপড়ে ফেলতে পারি না।কিছুতেই পারি না।

বন্ধুত্বের শেকড়ে শুদ্ধ অনুভব বুনে দেবার, উদার হবার উপায় কী নান্দনিক রূপে চিনিয়ে দিলেন লেখক! উপন্যাসে অল্প ব্যাপ্তির চরিত্র যারা এসেছে, তারা দারুণভাবে মানানসই ছিলো পুরো প্রেক্ষাপটের সাথে। অতি কথন কিংবা অতিরঞ্জন কিছু পৃষ্ঠাসমূহ জুড়ে ছিলো না কোথাও।

শব্দ চয়নে দুর্দান্ত রকম পারদর্শীতা, বাক্যের সমৃদ্ধ গঠনশৈলী, ভাবনার মাধুর্যে লেখক সাদিয়া সুলতানা বরাবরই আমার প্রিয় লেখক। লেখকের যে কোনো লেখা পড়ার জন্য পড়ি না আমি।পড়ি শেখার জন্য। নীলগর্ভ তেমনই আরেকটি উপন্যাস।

অগণিত প্রতিকূলতা উৎরে আমাদের বিপন্ন জীবনে কখনো এমন মুহূর্ত আসে যখন স্বজনের আলিঙ্গনের মতো নিবিড় কিছু পৃথিবীতে বিরল হয়ে পড়ে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত মানুষের মনে হতে থাকে, সে বিস্তীর্ণ জলপ্রপাতের নিচে স্নান করছে। ধুয়ে যাচ্ছে পালাতপুরীতে লুকিয়ে থাকা দুঃখসমগ্র।গর্ভের নীল বেদনা সে পরশ পাথরেও মুছে যায় না। বড়জোর মলিন হয় কেবল।

নীলগর্ভ
সাদিয়া সুলতানা
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশনী: জলধি, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
পৃষ্ঠা: ১৪৮
দাম: ৩৫০টাকা