মুভি রিভিউ: নীহারিকা কী নারীবাদের স্বর নাকি উত্তর ॥ শীলা রায়


নীহারিকা মুভির একটি দৃশ্য।ছবি: সংগৃহীত

‍‘সেদিন সমুদ্র ফুলে-ফুলে হল উন্মুখর মাঘী পূর্ণিমায়
সেদিন দামিনী বুঝি বলেছিল-মিটিল না সাধ।’-বিষ্ণু দে’র দামিনী এভাবেই বলে উঠেছিল যা বলার।শচীশের পিছনে বৃথা ছুটে মরা দামিনীর তীব্র যন্ত্রণাই যেন বিষ্ণু দে’র কবিতায় চরম ভাব নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।রবীন্দ্রনাথের নারীবাদেরই সমকালীন প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন কি বিষ্ণু দে? পক্ষ-বিপক্ষ মতামত সেই যুগ থেকে এই যুগেও বহমান…।

তেমনই এক আখ্যান তৈরি করে দিতে পারে সাম্প্রতিক ইন্দ্রাশিস আচার্য পরিচালিত সিনেমা ‘নীহারিকা’। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের তুলনামূলক কম আলোচিত উপন্যাস ‘ভয়’-এ দীপার যে আখ্যান ও পটভূমি তৈরি হয়েছিল, ইন্দ্রাশিস আচার্য তারই এক সমকাল দর্শন করালেন।সেকালে নারী আজকের প্রেক্ষিতে অনেকটাই পর্দানশীন ছিল।তবে আধুনিকতা তখন ঢুকতে শুরু করেছিল।তাই অন্ধকার শৈশব পেরিয়ে নব্য যৌবনে সমাজ বহির্ভূত হাতছানিতে ক্ষণিকের স্বস্তি খুঁজে পাওয়া, মায়ের মৃত্যুর পরে বাবার মেয়েকে অবহেলায় দূরে ঠেলে দেওয়া, দীপার নিজের মামার প্রতি অলক্ষ্য আকর্ষণ তৈরি হওয়া, আর মামার সেই আবেদনে প্রছন্ন তাড়িত হওয়া থেকে নিজেকে সমাজ বদ্ধ জীব তৈরি করে আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে নিজেকে চালিত করা পর্যন্ত- ঔপন্যাসিক লিখতে পেরেছিলেন।আর সেই আশির দশককে একবিংশর পরিচালক করে তুললেন সমকালীন। আক্ষরিকভাবে একে উত্তর আধুনিকই বলা যায়।

তিনি অস্বীকার করলেন না উপন্যাসের সময়কে।তাই ইন্টারনেট, মোবাইল, হালফিলের রিলের বাইরে রাখলেন প্রেক্ষাপট।শুধু চিত্রনাট্যকে গাঁথলেন সমকালে।কিভাবে? ক্রাফটিং আর ডায়লগের মুন্সিয়ানা সেখানেই।আর তাকে সঙ্গত করতেই প্রয়োজনীয় আবহসঙ্গীত।জীবন সেকালেও উচ্চকিত ছিল না, সিনেমায় তাই কোনো স্বরই জীবনের স্বাভাবিক স্তর থেকে উচ্চকিত নয়।ভাগ্নীর প্রতি তৈরি হওয়া কামনা সমাজের স্বীকৃতিতেই তাই পূর্ণতা খোঁজে।সেই সময়েও অলক্ষ্যে যার বুঝতে পারার সে সব বুঝে যায়।তাই ‘মলয় বাতাসে’র মুক্ত রূপকে সে অনুভব করতে পারে না, জীবনের বাতাস সেখানে দ্বার রুদ্ধ হয়েই থাকে।নীরবে জিতে যায় এক মুক্ত নারী মন, যে শুধু প্রকৃতির সঙ্গে প্রেমকে মিলিয়ে নিয়ে এক স্বভাবভীরুকে মৃত্যুতে প্রেমের আস্বাদ পাইয়ে দেয়। আর তারপরেই নিরুচ্চারিত সুর বেজে ওঠে সিনেমায় ‘আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস, দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরস মাস’।মামীর মৃত্যুকে মামার এই চিন্তাধারা প্রশ্ন তোলে… যার জন্য প্রেমের এই অভিঘাত তীব্র হল তবে কি সব অবহেলা কি তারই প্রাপ্য?!

যে নারীবাদের চর্চায় এখন জেন এক্স উত্তাল তারা বঞ্চিতের জন্য উচ্চকিত লড়াইয়ের কথা বলবে।হক ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হবে।এখানেই উপন্যাস থেকে উত্তর আধুনিক হয়ে জিতে যায় সিনেমা।আসলে সে বলে সমসময়ের থেকেও এগিয়ে থাকা চিরন্তনের কথা।প্রেমের জয় শুধুই অনুভবে, সেখানে কোনো মানুষ নয় জয়ী শুধুই অনুভূতি।আর তাই জীবনের সব ঝড় পেরিয়ে, সমাজ, মানুষ, আকাঙ্ক্ষা, অভীপ্সা চিনে নিয়ে মামার কাছে করা শেষ আবেদনেও যখন দীপা প্রত্যাখ্যাত হয়, আর কোনোও কথা তারপরে থাকে না।আসলে তা হতে পারে না, তাই সিনেমাতেও নেই।

নীহারিকা সমাজের ভয়ের কথা বলে আসলে জিতিয়ে দেয় নারীবাদকে, একলা বাঁচতে চাওয়া সব নারীকে।তাই মামার ছোঁয়া বুঝতে পেরেও মামার দোলাচলকে দীপা ভুত দেখার ভয়ের সঙ্গে তুলনা করে।ভেতরের আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখতে না পেরে যা সমাজের অধিকারে প্রাপ্ত তার কাছেই দাবি করে ফেলে মামা, মন্দ্র স্বরে মামী প্রশ্ন করে ওঠে ‘এতদিন পরে, হঠাৎ’! ভীষণ স্বাভাবিক এক সামাজিক বাঁচাকে এভাবেই প্রশ্ন করে সিনেমা, প্রশ্ন করে নারীবাদ।মামা গিটারে সুর তুলে নিলেও দীপার গানে গলা মেলাতে পারে না, রঙ্গন প্রবল পুরুষ হতে চেয়েও নারীত্বের তীব্রতায় হার মানে।মামার পালিয়ে যাওয়ার চিঠি পড়ার সময় ক্যামেরা ট্র‍্যাক ব্যাক করে না, চার্জ করে, আর দীপার চোখ শুধু ভিজে ওঠে, জল পড়ে না, খানিক ঝাপসা হয়।

সিনেমা বারবার প্রান্তরে ক্যামেরা প্যান করে যেন প্রকাণ্ড পৃথিবীতে এক নারীর তীক্ষ্ণ অস্তিত্বকে হিসহিস স্বরে অনুভব করাতে চায়।দোতলা বাড়িতে একলা মেয়ের নিঃস্ব অস্তিত্বে দূরে মাদলের সুর জীবনের বহমানতাকে বয়ে নিয়ে চলে।সন্তানের শোকে স্থবির মায়ের মুখে স্থির থাকা ক্যামেরার পিছনে শিশুর কলতান সময়ের চলমানতার আবহ গেঁথে দেয়।

এই প্রকাণ্ড পৃথিবীতে একটা মেয়ে একলা, ভীষণভাবে একলা, নীহারিকার ক্যামেরা, মিউজিক, শব্দ, ডায়ালগ বারবার সে কথা বলে আসলে তৈরি করে এক চিরকালীন নারীবাদের আখ্যান।কারণ নয় ফলাফল আসলে কী, তার রূপ কেমন, কেমনই বা তার বাস্তবচিত্র ইন্দ্রাশিসের সিনেমা বারবার সেই কথাই বলতে চেয়েছে।বিলুরাক্ষসের সোহিনীও তো আপসহীন আগ্রাসী কর্পোরেটের এক অসমাপ্ত আখ্যানের কথাই মনে করায়। পিউপার মৌ কি মেয়ে আপোস করতেই শিখিয়েছিল নাকি সেও একদিন দীপা হয়ে উঠবে, জানার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে নীহারিকা। অনেক উত্তর পার্সেলের নন্দিনী দিয়েছিল, তবে দীপা যেন মিলিয়ে দিল সেকাল একালকে।নীরবে একা দাঁড়াল এক প্রতিবাদী নারীস্বর হয় সবকালের সব বাদকে সেই আদি অকৃত্রিক প্রশ্ন করে, শত বিপ্লবেও কী একাকীত্ব ঘোচে? হাতের উপর থাকে হাত?

আলাদা করে অনুরাধা, মল্লিকা, শিলাজিতের কথা বললে নীহারিকার অভিঘাত ধাক্কা খাবে… একালের সেই সব নারী যারা আসলে একলা উড়ানের কাণ্ডারি নীহারিকা তাদের সবার নারীত্বের গাথা… যার বিচার হবে সমকালে নয় সমকালোত্তর কালে।