মোহাম্মদ নূরুল হক: কবিতায় বাস্তবতার সীমারেখাকে লঙ্ঘন করেননি ॥ রিপন আহসান ঋতু


কবি মোহাম্মদ নূরুল হক একজন ঘুমহীন শব্দচাষী। যার যাপিত হৃদয় চষে অক্ষরের ফুল হয়ে ফুটে আছে কাব্যগ্রন্থ মাতাল নদীর প্রত্মবিহার, স্বরচিত চাঁদ, উপ-বিকল্প সম্পাদকীয় এবং লাল রাত্রির গান। সুবাস হয়ে ছড়িয়ে গেছে তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ- সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য, সমালোচকের দায়, অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য, সাহিত্যের রাজনীতি, সমকালীন সাহিত্যচিন্তা, কবিতার সময় ও মনীষার দান এবং আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন ও অন্যান্য। রুঢ় বাস্তবতার চিত্র হতে উৎসারিত ক্ষমাহীন চোখ মুক্তির নেশায় যখন টলমল তখন লেখালেখি হয়ে উঠলো তাঁর তীর্থযাত্রা। শিল্পের প্রতি একছত্র দায়বদ্ধতা নিয়ে শব্দের মাঝে হারিয়ে ফেলেন নিজেকে। হৃদয় ভাঙার ব্যথা নিয়ে পাঠক নামের আয়নার সামনে দাঁড়ালেন আর মুহূর্তেই কেটে গেল ৪৫ বছর।

১৯৭৬ সালে আজকের এই দিনে নোয়াখালিতে জন্ম কবি মোহাম্মদ নূরুল হকের। নিজের জন্মদিন নিয়ে তিনি লিখেছেন,‘বাবা বলতেন, জুনের জাতক নাকি জেদি হয়!/ ভাইয়ের মধ্যে আমি বড়, আর আমারই জন্ম এই অভিশপ্ত জুনে!/ ফলত ছোট ভাইয়েরা আমার দিকে তাকাতো ভর্য়াত চোখে/ভীষণ কম্পমান তাদের চোখের তারা!’ এভাবেই আত্মানুসন্ধানের মিশেলে তাঁর কবিতা যেন নার্সিসাসের স্বীকারোক্তি হয়ে ওঠে আমাদের সামনে। কবিতার প্রতিটি লাইনে বিস্ময়বোধের সঙ্গে ক্রমেই জড়িয়ে যায় লেখকের বোধ এবং বিপন্নতার স্পষ্টছাপ। তিনি অনুভব করেন, ‘খুনি তো হতে চাইনি, প্রেমিকও হতে পারিনি কারও, কিন্তু আমি এক রোখা কি না/বুঝে ওঠার আগেই দেখি- আমি একা হতে হতে হয়ে গেছি পৃথিবীর একমাত্র নির্বান্ধব বেকুব জাতক।’

মোহাম্মদ নূরুল হক তাঁর কবিতায় বাস্তবতার সীমারেখাকে কখনো লঙ্ঘন করতে চাননি। চেয়েছেন নিজের চেনা জানা পৃথিবীকে হত্যা করতে। কাব্যলগ্নীর যূপকাষ্ঠে রক্তাক্ত ভূমিকা পালন করতে চেয়েছেন তিনি। মিথ্যার অন্তরে লুকিয়ে থাকা সেই সত্যকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন, যা মানুষকে পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখে। তিনি একজন তাড়িত মানুষ। তাঁর লেখালেখি পড়লে বোঝা যায়, মুখ থুবড়ে পড়া পৃথিবীর কাছে তাঁর কোনো বিশেষ দাবি নেই। তিনি শুধু চেয়েছেন, ‘আমার কথা বলবো শঙ্কাহীন/ কিসের কারা, কিসের শেকল ভয়/ জন্মস্বাধীন পাখির মতো আমি/ ভালোবাসার আকাশ করবো জয়।’ তাঁর সমস্ত বিদ্রোহের উৎসে আছে ভালোবাসা, সৌন্দর্যবোধ এবং জ্ঞানের প্রতি তৃষ্ণা, এই পৃথিবীতে যার নিতান্তই অভাব। তিনি তাই নিজের মতো করে নাশকতা চালিয়েছেন লেখালেখিতে। এক মেকি এবং মুখোশ পরা সভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছেন প্রবন্ধে আর কবিতা দিয়েই গড়ে তুলতে চেয়েছেন প্রতিরোধ, খুঁজে নিতে চেয়েছেন হারিয়ে যাওয়া মনুষ্যত্বকে।

কবি তাঁর যুগের সমস্ত অসামঞ্জস্যকে ধারণ করেছেন সচেতন ভাবেই। তাই তাঁর কবিতায় মানুষের অন্ধকার দিকগুলিই উঠে এসেছে বেশী করে, ‘আহা! মানুষের ভিড়ে, কার স্বামী ভেসে যায়- রক্তের গঙ্গায়/দ্যাখো-দ্যাখো আজ কোন মায়ের চোখ নদী হয়ে যায়!’

নূরুল হকের কবিতা পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনি কোন শৌখিন কবিতা লিখতে চাননি। তাঁর কবিতায় আছে একধরনের পাগলামি। পাগলামি ছাড়া যে জীবনের মৌলিক সত্যের কাছে পৌঁছানো যায় না এটা হয়তো নূরুল হক অনেক আগেই বুঝতে পেরেছেন। ফলে তাঁর কবিতায় কৃত্রিম শিক্ষা, এবং শিক্ষিত ও মুখরোচক শব্দের প্রতি কোন আনুগত্য আমি খুঁজে পাইনি। আরো একটি কবিতার কিছু অংশ পড়ে নেওয়া যাক: ‘একটি বৃক্ষের মাথা কত উঁচু হলে/পথচারী আর আকাশ দেখে না? /এই প্রশ্ন মাঝে-মধ্যে নিজেকে করেছি।’ তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় এমন সব প্রশ্ন যাকে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় খুব মামুলি প্রশ্ন। অথচ এই মামুলি প্রশ্ন বিশেষ অর্থবহ হয়ে ওঠে যখন পরের তিনটি লাইন পড়া হয়, ‘একটি ক্লান্ত দুপুর কেঁপে-কেঁপে ওঠে পথিকের তৃষ্ণা/ পথে একা দাঁড়িয়ে আছেন আকাশ ছোঁয়া রবীন্দ্রনাথ/ আমাদের বটবৃক্ষ/ অফুরান ছায়া তার ডালে।’

যেহেতু কবিতায় জীবনের দরকারি ও পরিত্যক্ত সব কিছুই স্থান পায় তাই কবিতায় তুলে ধরা জীবন সম্পর্কে প্রত্যেক কবিরই বিশেষ এবং স্বতন্ত্র চেতনা থাকা আবশ্যক। যে চেতনা হকের কবিতায় দেখা যায়। তাঁর কবিতায় নেই কোন কৃত্রিম ধোঁয়াশা বা তত্বের আড়ালে চমক দেবার প্রচেষ্টা। নূরুল হক যেন মানুষের চারিপাশের চিন্তাকে নিয়েই খেলছেন সব সময়, ‘মানুষের কত গল্প থাকে/ কারও বন্ধুর গল্প- কারও কারও পূর্বপুরুষের বীরত্বের গাথা- সমুদ্রজয়ের কথা!/ আমার কোন বন্ধু নেই/ না সচিবালয়ে না পুলিশে-আর্মি-র‍্যাবে / তাই আমার কোনো গল্প থাকে না/এসব আড্ডায়।’

তার কবিতায় শব্দের অপ্রতুলতা নেই- কিন্তু ইচ্ছাকৃত কৃপণতা আছে। এ যেন সেই নিজের সাথেই চ্যালেঞ্জ, সীমিত শব্দেই যদি বলতে পারা যায়, তাহলে অযথা শব্দ খরচ কেন! আধুনিক কবিতা নিয়ে অনেকে আক্ষেপ করেন যে আজকালকার কবিতায় ছন্দ না জেনে, ছন্দ না বুঝে শুধু গদ্য কবিতা লেখে! তাদের জন্যও আশ্বাস- ছন্দের দখলে নূরুল হক সেই অনায়স দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে ছন্দময় কবিতা। মূলত সে ছন্দ কবিতায় যা চেয়েছে তাই পাঠককে খুলে দিয়েছে অনুরূপ ভাবেই, ‘চিরকাল বাউল ছিলাম/ এখনো তেমন/রাত্রিকে বেসেছি ভালো/নদীকে যেমন।’ তিনি বুঝতে পারেন, কবিতা এমন এক ভাষায় লিখতে হবে, যা মানুষের মর্মলোককে সরাসরি বিদ্ধ করবে। কবিতা আমাদের ক্ষয়িষ্ণু, অনিশ্চিত, জটিল, আর্ত জীবনের এক প্রাণময় অবস্থা। কবিতা জীবনকে ‘জাস্টিফাই’ করে ব্যক্তিকে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য নির্দেশ দেয়, জীবনকে দুর্দান্ত করে তোলে। নূরুল হকের ভাষায়, ‘কবিতা ক্ষুধার্ত নদী ঢেউ তোলে গাঙুড়ের থরোথরো দেহে।’

মোহাম্মদ নূরুল হক নিজের স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য আর মুক্তির নেশায় একদিন যে তীর্থযাত্রা শুরু করেছিলেন, সে যাত্রায় পুরো এক জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন আর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তিনি সেই উদ্যত কালো অক্ষরের থাবার সামনে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে বলছেন, ‘কবিতা কি শ্রাবণের মেঘ; চাইলেই ধরা দেবে টিনের চাতালে?’ কবির এই স্বগোক্তির মধ্যেই দিয়েই বোঝা যায় কবিতা জীবনব্যাপী চর্চার বিষয়। কবিতার এই যাত্রা কেবলই কবির একা হয়ে যাওয়ার যাত্রা। আমরা দেখি মোহাম্মদ নূরুল হক কবিতার পথের এই অনন্ত যাত্রায় ক্রমশই একা হয়ে গেছেন আর নিজের হৃদয়কে রক্তাক্ত করে একের পর এক স্বীকারোক্তি দিয়েছেন এইভাবে, ‘আমি এখন মৃত্যুর বারান্দায় বসে আঁকি জলজলিরিক/ এখানে মাতাল নদী পুড়ে যায় শ্রাবণের হাওয়ায়-হাওয়ায়।’