আবুল হাসনাত স্মারক বক্তৃতা ॥ হাসনাত ভাই না থাকলে তাদের লেখক হয়ে ওঠা হতো না


স্মারক বক্তৃতা দেন মফিদুল হক।ছবি: যোগসূত্র

গত শতকের ষাটের দশক এই অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি ব্যতিক্রমী সময়।কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তখনকার মানুষদের। সেই পথের অন্যতম পথিক কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক আবুল হাসনাত।বহুমুখী কর্মগুণী এই মানুষকে মূলত নির্মাণ করেছে ষাটের দশক।

শুক্রবার (২৯ জুলাই ২০২২) বিকেলে ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে ছিল আবুল হাসনাত স্মারক বক্তৃতা। ‘আবুল হাসনাত এবং ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ শিরোনামে লিখিত বক্তৃতা দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক।

তিনি বলেন, ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক জাগরণের পটভূমিকায় আবুল হাসনাতকে বিবেচনায় নিলে আমরা এই মানুষকে জানতে পারব।এই সময়ে তাকে খুঁজতে হবে নিভৃতে, পর্দার অন্তরালে, মঞ্চের পেছনে, যেখানে তিনি স্বচ্ছন্দ, তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট ও জীবন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে।

মফিদুল হক বলেন, কাজের ক্ষেত্র যদি বিবেচনা করি, তবে প্রথমে দেখি ছাত্র ইউনিয়নে তার ভূমিকা, আন্দোলন তখন নানাভাবে বিস্তৃতি পাচ্ছে, আর প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে তার সম্পৃক্ততা ও ভূমিকা।সেই সঙ্গে আছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তি, একুশের সংকলন প্রকাশ, মঞ্চে কিংবা খোলা ময়দানের সংগীত–নৃত্যানুষ্ঠান, যা পরে সংস্কৃতি সংসদ ঘিরে অর্জন করে বিশিষ্টতা ও বিশালতা।

ব্যক্তি আবুল হাসনাত প্রসঙ্গে মফিদুল হক বলেন, আবুল হাসনাতের উপস্থিতি ও ভূমিকা কতভাবে যে চারপাশের মানুষকে ছুঁয়ে যেত, তার আনুষ্ঠানিক প্রকাশ বিশেষ মিলবে না। অপরের মনের গহিনে তিনি জায়গা করে নিতে পারতেন তার সব কুণ্ঠা ও দ্বিধা সত্ত্বেও।

অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার অবদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাঙালির জাতীয় চেতনা নিয়ে অসাম্প্রদায়িক সাম্যমূলক দেশ গড়ার যে প্রয়াস, সেটা স্বাধীন বাংলার উদ্ভবের মধ্যে বিজয় অর্জন করল। কিন্তু একে সার্থক করে তুলতে যে বহুবিধ আয়োজন জরুরি ছিল, স্বাধীন দেশে পরম নিষ্ঠায় তা পালন করেছেন আবুল হাসনাত।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বক্তব্য দেন আবুল হাসনাতের স্ত্রী নাসিমুন আরা হক। তিনি বলেন, কাজটাকে সে খুব গুরুত্ব দিত।তার লক্ষ্য ছিল, দেশে একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারা গড়ে তোলা এবং তার কাজের ভেতর দিয়ে জাতির মননকে সমৃদ্ধ করা, রুচিশীল মানুষ গড়ে তোলা। সাহিত্য সম্পাদনার মধ্য দিয়ে সেই কাজই সে এগিয়ে নিয়েছে। তখনকার সংবাদ–এর সাহিত্য সাময়িকী মানুষের কাছে ভীষণ গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। তার প্রয়াণের পর অনেকেই স্বীকার করেছেন, হাসনাত ভাই না থাকলে তাদের লেখক হয়ে ওঠা হতো না।

রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, একটা সময় পর্যন্ত আমাদের সংস্কৃতি রাজনীতির চেয়ে অগ্রসর ছিল। ১৯৫২ সালের আন্দোলনটি ছিল ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন। তখন সংস্কৃতিই রাজনীতিকে পথ দেখিয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের ওপর সংস্কৃতিকর্মীদের প্রভাব ছিল। সেটা সম্ভব হয়েছে আবুল হাসনাতদের মতো মানুষদের কারণে।

আবুল হাসনাত সবাইকে জড়িয়ে রাখতে চাইতেন উল্লেখ করে বরেণ্য চিত্রকর রফিকুন নবী বলেন, আবুল হাসনাতকে নানা ভূমিকায় পাই। হাসনাত চাইতেন সবাইকে জড়িয়ে রাখতে, সবাইকে নিয়ে কাজ করতে। পরিচয়ের পর থেকে আমাকে দিয়ে পোস্টার আঁকিয়ে নিতেন তিনি। মৃত্যুর আগে হাসপাতালের বিছানা থেকেও কালি ও কলমের নতুন সংখ্যার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি ছবি এঁকে দিতে বলেছিলেন।

স্মারণ অনুষ্ঠানের শুরুতে বুলবুল ইসলাম গেয়ে শোনান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ ও ‘বন্ধু, রহো রহো সাথে’ গান দুটি। ধন্যবাদ জ্ঞাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কালি ও কলম সম্পাদক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, হাসনাত ভাই একজীবনে অনেক জীবন ধারণ করেছিলেন। তার একটা সংগ্রামী সত্তা ছিল, সম্পাদক হিসেবে স্বকীয়তা ছিল। পর্দার আড়ালে থেকে তিনি কাজ করে যেতেন। সকলের পিঠে হাত রাখতেন যাতে তারা নিজস্ব অঞ্চলে সৃষ্টিশীলতায় স্বাক্ষর রাখতে পারে।

স্মারক বক্তৃতার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, কথাসাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ, আনিসুল হক, দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।