বইমেলার স্মৃতি ॥ রুমা মোদক


গ্রাফিক্স: লংরিড

একটু আধটু লেখক লেখক ভাব আসার পর বইমেলায় গিয়ে আমার খুব অস্বস্তি হয়।

ছাত্রজীবনে বইমেলা যখন শুধু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সুনির্দিষ্ট ছিলো। টিএসসি মোড় থেকে লাইন ধরে স্টল থাকতো।সেখানে গমগম স্বরে কবিতা পড়তো মাহী আর শিমুল।কোথাও রেকর্ডারে বাজতো, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…গান,একসময় তো ‘ফিলিপ্স টপ টেন’ এর হিন্দি গান বিরামহীন বেজে চলতো।

একাডেমিতে ঢোকার মূল গেইটের বাইরে সব পাইরেসি বইয়ের দোকান। তখন সবে সুনীল সমরেশকে চিনতে শিখেছি আমরা।পূর্ব-পশ্চিম, গর্ভধারিণী সব বই মিলতো গেইটের বাইরের স্টলে।চুরি, মালা,শোপিস কতকিছুর পসরা সাজিয়ে রাস্তাজুড়ে বসে থাকতো দোকানীরা…আসল বইমেলা একাডেমি চত্বরে।

চত্বরের ভেতরে দলেবলে ঘুরে বেড়াতেন হুমায়ুন আহমেদ,ছাত্ররা শ্লোগান দিতো তসলিমার বিরুদ্ধে।স্টলে বসে থাকতেন নির্মলেন্দু গুণ।আর আগেরদিন বিচিন্তা পত্রিকায় মেয়েদের সাজগোজের বিরুদ্ধে কড়া কলাম লিখে পরদিন সেজেগুজে স্টলে বসে থাকতেন তসলিমা নাসরীন। মিছিল এলে ঝপ করে নামিয়ে দেওয়া হতো স্টলের পর্দা।

তখন কে লেখক আমরা চিনতাম, কে কবি আমরা জানতাম।তখন সবাই লেখক,সবাই পাঠক, সবাই ক্রেতা নয়।বইমেলায় তারাই যেতেন যারা বই কিনেন এবং পড়েন।

এখন যে এই হুমড়ি খাওয়া ভিড়, তা ভালো হোক বা মন্দ তখন বইমেলার চেহারা এমন বাজারি ছিলো না।ছোট ছোট টেবিলে লিটল ম্যাগসহ কতো অভিনব ধারণার বই যে মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হতো! সেগুলো আকারে যেমন অভিনব,বিষয় বৈচিত্র‍্যেও।আর ছিলো কবিতা কার্ড, পংক্তি উদ্ধৃত করা কবির চেহারার স্কেচ আঁকা পোস্টার।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া নতুন ছেলে-মেয়েদের সীমিত বাজেটে এগুলোর ছিলো বিশাল চাহিদা।প্রথম প্রেমে পড়া ছেলেটির জন্য।ভালো লাগা মেয়েটির জন্য।

একবার আমি উপহার পেয়েছিলাম রুদ্র মোহম্মদ শহীদুল্লাহর ” আমি সেই নতমুখ…”। কুয়েত মৈত্রী হলের ৫১২ নং রুমের দেয়ালে লাগানো ছিলো বেশ কয়েকদিন।

তখন মেলা ছিলো বাড়ির উঠানের মতো,গোল্লাছুট খেলার মতো আপন।কেবলই নিজস্ব ভালোলাগার।সবার হয়ে যাওয়া আড়ম্বরপূর্ণ হুল্লোড়ে আমি এখন বইমেলায় যেতে খুব অস্বস্তি বোধ করি।

নিজেকে লেখক ভাবার সাধ এই মেলা থেকেও যে সংক্রামিত হয়েছিলো একদিন,অস্বীকার করি না

@ লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া