বইমেলার স্মৃতি ॥ প্রবীর বিকাশ সরকার


গ্রাফিক্স: লংরিড

ঠিক ৪০ বছর আগের প্রকাশনা! জাপানে আগমনের আগের বছর যতখানি মনে পড়ে, আমরা কতিপয় তরুণ মিলে আজকাল প্রকাশনী নামে একটি সংস্থা গঠন করেছিলাম।মূল উদ্যোক্তা ছিল উদীয়মান শিল্পপতি সৈয়দ ফয়েজ আহমেদ।তার সঙ্গে ছিলাম কবি রেজা সেলিম, কবি বাবুল ইসলাম, কবি মমীম শাহাগীর, স্বপন সেনগুপ্ত এবং আমি।

কুমিল্লা অনন্য, অগ্রসর শিক্ষা, সৃজনশীলতা আর রাজনৈতিক ঘটনার পথিকৃৎ।বিশেষ করে সাহিত্য ও সঙ্গীতের অনেক দিকপাল বৃহত্তর কুমিল্লার মুখ উজ্জ্বল করেছেন বিগত শতবর্ষে।

বিগত শতকের বিশের দশকে কুমিল্লা শহরের একদল দুরন্ত মেধাবী তরুণ এমন এক সাহিত্য আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আজও গবেষণার বিষয়।আর সেই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল “পূর্ব্বাশা” সাহিত্য সাময়িকীকে কেন্দ্র করে।সম্পাদক ছিলেন কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য।তাকে সহযোগিতা করেছেন তারই বড়দা অজয় ভট্টাচার্য্য। যিনি প্রভূত সুনাম অর্জন করেছিলেন গীতিকার, মঞ্চাভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার এবং শিক্ষক হিসেবে কলিকাতায়।তাদের সমসাময়িক কুমিল্লারই সৃষ্টিপাগল কৃতী সন্তান সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেববর্মণ, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, গীতিকার সুবোধ পুরোকায়স্থ, সঙ্গীতজ্ঞ দীলিপ সিংহ, কবি ও সাহিত্যিক অজিতকুমার গুহ, অধ্যাপক সুধীর সেন, সুধা সেন, নারায়ণ চৌধুরী, ধুর্যটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কাজী মোতাহার হোসেন, মিন্নাত আলী, অসিত চৌধুরী, পরিমল দত্ত, কুলেন্দু দাশ প্রমুখ।

সেই যুগে সংবাদপত্র ত্রিপুরা হিতৈষী সম্পাদনা করেছেন ঊর্মিলা সিংহ, ব্যবসায়ী দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য প্রকাশ করতেন বণিক নামে পত্রিকা।

সাংবাদিকতায় রজত নন্দী, ফজলে রাব্বী, গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, আহমেদ নূরে আলম, আবদুল ওহাব, মোহাম্মদ উল্লাহ আফতাবুর রহমান, প্রদীপ সিংহ রায়, রেজাউল করিম শামীম, আবুল হাসনাত বাবুল, শাহজাহান চৌধুরী, গাজী মোহাম্মদ ইউনুস প্রমুখ অগ্রসর ভূমিকা রেখেছেন। পরবর্তীতে আজিজুর রহমান মোমীন, শান্তনু হাসান খান, জসীমউদ্দিন অসীম ব্যাপক কাজ করেছে।শান্তনু আমার “মানচিত্র” কাগজেও কিছু প্রতিবেদন লিখেছিল।

শিল্পকলায় সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রেখায়নখ্যাত রাগীব আহসান চৌধুরী, আইনুল হক মুন্না কুমিল্লার অবিস্মরণীয় প্রতিভা।
কলিকাতার স্বনামধন্য চলচ্চিত্রকার সুশীল মজুমদার, দাগু বর্ধন, সালাউদ্দিন, এস এম শফি তো কিংবদন্তি আজ।গীতিকার মাজহারুল আনোয়ার কুমিল্লার গৌরব।

তাদের উত্তরসূরি হিসেবে পরবর্তীতে আত্মপ্রকাশ করেছেন কথাসাহিত্যিক সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, কবি জহিরুল হক দুলাল, অধ্যাপক, গবেষক ও সাহিত্যিক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক, অধ্যাপক ও পাঠ্যপুস্তক রচিয়িতা শেখর রঞ্জন সাহা, কবি তিতাস চৌধুরী, কবি ও সাহিত্যিক স্বপ্না রায়, কবি আনোয়ারুল হক, কবি হরিপ্রসাদ সেন, কবি শওকত আহসান ফারুক, কবি হাসান ফিরোজ, কবি ফখরুল হুদা হেলাল, কবি ফখররুল ইসলাম রচি, কবি ও তুখোড় গল্পকার সৈয়দ আহমাদ তারেক, কবি নেলী ইসলাম, কবি বাবুল ইসলাম, কবি কাপালিক সরকার, কবি বাদল বৈরাগী, কবি কামাল হাসান, কথাসাহিত্যিক অরুণ চৌধুরী, কবি আবুল হাসনাত বাবুল, কবি নীরু শামীম ইসলাম, কবি গাজী মোহাম্মদ ইউনুস, কবি ফরিদ মুজহার, কবি নাজমা আক্তার, কবি নুরুন্নাহার শিরীন, কবি মোহাম্মদ আলী, কবি মুস্তাক আহমেদ শিমুল, কবি বিজন দাস, কবি সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়, কবি তসলিমা শিরীন, কবি আজিজুর রহমান মোমীন তথা কমল মমীনসহ আরও অনেক।

একঝাঁক তরুণ ছড়াকারও স্বাধীনতার আত্মপ্রকাশ করেছিল কুমিল্লায়। খ্যাতিমান টিভি ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত ছড়াকার হিসেবে কুমিল্লা থেকেই উত্থান ঘটেছে বলে জানি। ছড়াকার, সংগঠক ও কবি আবু হাসান শাহরিয়ারও কুমিল্লায় ছিলেন একসময়। কথাসাহিত্যিক শহীদ আখন্দও কুমিল্লায় সাহিত্যচর্চা করেছেন।বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং কবি বুদ্ধদেব বসু কুমিল্লার ইতিহাসের সঙ্গে অকাট্য সম্পর্কযুক্ত।

স্বাধীনতার পর নাট্যচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ফখরুল হুদা হেলাল, শাহজাহান চৌধুরী, হাসান ফিরোজ প্রমুখ। কুমিল্লায় নাট্যচর্চা ব্রিটিশ আমলেই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল।

একাধিক সাহিত্য ও সঙ্গীত সংগঠন, শিক্ষালয় ছিল কুমিল্লার অহংকার। আমরা জ্যোস্নার প্রতিবেশী, আমি তুমি সে, জাগৃতি, বিনয় সাহিত্য সংসদ প্রভূত সুনাম অর্জন করেছে। বিগত শত বছরে কতশত সাহিত্য সংকলন কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত হয়েছে তার হিসেব নেই!

এই ধারাবাহিকতায় আমরাও একটি প্রকাশনা আন্দোলন শুরু করেছিলাম। যদিও বন্ধুবর ফয়েজ আহমেদ লেখক নয়, কিন্তু সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং প্রকাশনা ক্ষেত্রে তার অসীম আগ্রহ ঈর্ষণীয়।তারই আর্থিক সহযোগিতায় প্রকাশিত হয়েছিল আমার প্রথম কবিতার বই এবং আরো পাঁচজন কবিতা সংকলন।এই দুটি গ্রন্থের প্রচ্ছদ এবং অঙ্গসজ্জা করেছিলেন কবি বাবুল ইসলাম।এরপরে মমীন শাহাগীরের সম্পাদনায় একটি অসামান্য সাহিত্য সংকলন “পরাজয় তোমাকে নিষেধ” প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে একরঙা, অফসেট প্রেসে মুদ্রিত। সেটাই সম্ভবত কুমিল্লার প্রথম কবিতা সংকলন অফসেটে মুদ্রিত। সংকলনটির প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছিলেন কুমিল্লার খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী মাসুক হেলাল।

আজকাল থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়েছে ধর্মসাগর দিঘির দক্ষিণ পাড়ে। বৈশাখের প্রথম সকালে কবিতা পাঠের আসর। একবার কবি আল মাহমুদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কবিতা পাঠ করেন কুমিল্লার নবীন-প্রবীণ অনেক কবি। এ উপলক্ষে একটি সুদৃশ্য কবিতা পোস্টারও প্রকাশিত হয়েছিলো “তোমার ছায়াকে ঘিরে” যার একপাশে কবিতা এবং অপর পাশে অংশগ্রহণকারী কবিদের ছবি। স
ম্পাদনা করেন কবি রেজা সেলিম।এটার ডিজাইনও শিল্পী মাসুক হেলালের।

দুটি প্রকাশনাই সেই সময়ে কুমিল্লার সাহিত্য-সংস্কৃতিসংশ্লিষ্ট সবার কাছে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।

১৯৮৪ সালে আমি জাপানে চলে এলে সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তবে এরপরও আরও কয়েক বছর আজকাল টিকেছিল। কবি বাবুল ইসলামের সম্পাদনায় “একটি গল্প অনেক কবিতা” নামে ডিমাই সাইজের বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। একটি আমার সংগ্রহে ছিল অনেক বছর। একবার ফেইসবুকে লিখেওছিলাম এটা নিয়ে যতখানি স্মরণে আছে।

উল্লেখ্য যে, আজকালের সব প্রকাশনার একক প্রকাশক ছিল ফয়েজ আহমাদ কাদেরী। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সাহিত্য জগতের বাইরে থাকা এমন মানুষ কুমিল্লায় আর দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে ফয়েজ কুমিল্লা থেকে একটি ব্যয়বহুল কালার ফ্যাশন ম্যাগাজিন প্রকাশ করে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।একটি মফস্বল শহরে সম্পূর্ণ রঙিন গ্লোসি পেপারে ফ্যাশন ম্যাগাজিন প্রকাশ করা শুধু পরিশীলিত রুচিবোধই নয়, দুঃসাহসিক পদক্ষেপও বটে! প্রকাশের আগে হঠাৎ করেই একদিন তার সঙ্গে কান্দিরপাড়ে দেখা! সালটা ২০১৩ কি? আমি তখন কুমিল্লায় এবং মাসিক “কিশোরচিত্র” ট্যাবলয়েড শিশুপত্রিকা প্রকাশ করছি। পত্রিকাটি দেখে সে উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। বলল সে একটি ফ্যাশন ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে যাচ্ছে কুমিল্লা থেকে পরামর্শ আর লেখা দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য। আমি চমকে উঠলাম! আমি বললাম, ফ্যাশন ম্যাগাজিন মানেই ভালো কাগজ, রঙিন ছাপা এবং নান্দনিক ডিজাইন না হলে নয়! সেসব কি করতে পারবি? ফয়েজ বরাবরই অত্যন্ত জেদি! বলল, সে ব্যাপারেই আলাপ করব। তোর তো অনেক অভিজ্ঞতা আছে।

একদিন বাসায় গিয়েছিলাম। গ্রীষ্মকাল ছিল। বিয়ার পান করতে করতে তার ফ্যাশন ম্যাগাজিন নিয়ে আলাপ এবং আজকালের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে জমজমাট আড্ডা দিয়েছিলাম। তার “কারুকাজ” ফ্যাশন ম্যাগাজিনে আমার দু-তিনটি লেখা প্রকাশ করেছিল। আধুনিক প্রকাশনায় ফয়েজ আহমাদ কাদেরী কুমিল্লায় সে পথিকৃৎ। সমগ্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও অগ্রণী স্বীকার করতেই হবে।

আজকাল প্রকাশনী আন্দোলনের বিস্মৃত ইতিহাস উন্মোচিত হলো গতকাল যখন অগ্রজ কবি, ছড়াকার, শিল্পী এবং সংগঠক ফখরুল ইসলাম রচিভাই এই দুটি ছবি আমাকে পাঠানোর মধ্য দিয়ে।

কুমিল্লার দুজন কবির কাছে বিস্তর পুরনো প্রকাশনা সংগৃহীত আছে বলে আমার বিশ্বাস। আর আছে রামমালা গ্রন্থাগারে। এসব সংগ্রহ করে রচিভাই যদি একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করেন কুমিল্লার অতীত এবং বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য যে কুমিল্লায় কোনো সাহিত্য সংগ্রহশালা নেই। ফলে সংরক্ষণের অভাবে বহু সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক প্রত্নসম্পদ হারিয়ে যাচ্ছে।

তথ্যঋণ: মমীন শাহাগীর ও শান্তনু হাসান খান

@ লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া