মায়া ॥ সালমা তালুকদার


সৈয়দ মোহাম্মদ জাকিরের ‘মায়া’ শীর্ষক একক প্রদর্শনী। ছবি: লেখক

সৈয়দ মোহাম্মদ জাকিরের ‘মায়া’ শীর্ষক একক প্রদর্শনীর উদ্ভোধন হয় গত ২২ জুলাই ২০২৩, বেঙ্গল শিল্পালয়ে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক লালারুখ সেলিম, শিল্পী ও শিল্প লেখক মুস্তাফা জামান এবং শিল্পী মাহবুবুর রহমান।

শিল্পী মন বড় অদ্ভুত। না চাইলেও অনেক গভীরে তার মন প্রবেশ করে। এটা আটকানোর মত ক্ষমতা অনেক সময় তার নিজের হাতেও থাকে না। শিল্পী কখনো একা কোথাও বিচরণ করেন না। তার সাথে সর্বক্ষণ তার দ্বৈত স্বত্বা সঙ্গী হিসেবে থাকেন। কথা বলেন। সঙ্গ দেন। কখনো কখনো শিল্পীর অদ্ভুৎ অবাস্তব চিন্তাকে আরও বেশি সক্রিয় করে তুলতে সহযোগিতা করেন। গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করতে প্রতিনিয়ত তাকে তাড়না যোগান। আর তাতে করে শিল্পীর মধ্যেও বেশ একটা তাড়াহুড়ো দেখা দেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তার ভেতরের বিচিত্র চিন্তার বহিঃপ্রকাশ না ঘটছে তিনি শান্ত হন না।

প্রদর্শনীটি যার তিনি সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির। উন্মুক্ত স্থানে কাজ করতে ভালোবাসেন। ল্যান্ডআর্ট, পারফরম্যান্স-আর্ট, ইন্সটলেশনসহ দৃশ্যশিল্পের নানা মাধ্যমে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে তিনি কাজ করছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এশিয়ান বিয়েনাল, জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী, ছবিমেলাসহ বিভিন্ন প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন।

জলবায়ু সংকট, মানবিক পৃথিবীর আবশ্যিকতা তিনি তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন পুনঃব্যবহারযোগ্য উপাদানে নির্মিত ইন্সটলেশন, ভাস্কর্য ও ড্রইংয়ের সমন্বয়ে।

নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী সৈয়দ মোহাম্মদ জাকির। স্বতঃস্ফুর্ততা শিল্প সৃষ্টিতে তাঁকে উদ্দীপিত করে। ফেলে দেওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া সহজলভ্য বস্তুকে উপাদান হিসেবে গ্রহণ করেছেন শিল্পী। এসব বস্তুর সাথে রেখাচিত্র যুক্ত করে জাকির কখনো স্বাধীনভাবে বিচরণ করেন কল্পনার জগতে। বাস্তব অভিজ্ঞতার মিশেলে আধ্যাত্বিকতা, জাগতিক ও মহাজাগতিক সময়ের স্বরুপ, গতিশীলতা, বস্তুজগতের অভিজ্ঞতায় ভর করে তাঁর অনুসন্ধানী মন শিল্পকে আধার হিসেবে গ্রহণ করেছে।

রাস্তাঘাটে কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসের মধ্যে প্রাণ খুঁজে পেয়ে এদের একত্রিত করেছেন। তার শিক্ষা কাজে লাগিয়েছেন। আমিও রাস্তাঘাট থেকে গাছের ডাল হতে শুরু করে অনেক কিছু কুড়াই। কিন্তু আমার পক্ষে শৈল্পিক রুপ দেওয়া কঠিন। খুব ইচ্ছে করলো তার এই কাজের পেছনে তার চিন্তা-ভাবনা জানতে। তিনি আসলেন দেরি করে। আমি চারবার খোঁজের পর তাকে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এদের জোগাড় করেছেন কি মনে করে। সুন্দর করে শান্ত কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘যেখান থেকে এনেছি সেখান থেকে তুলে এনে অন্য জায়গায় রেখে দেখতে চেয়েছি। অন্য পরিবেশে তাকে কেমন লাগে অথবা কিভাবে মানিয়ে যায়।’

তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন এদের সবার প্রাণ আছে। এবং এরা নতুন পরিবেশে নতুন ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে।

জাকির বলেন, এই প্রদর্শনী আমার সমসাময়িক চিন্তা, পর্যবেক্ষণ, দীর্ঘদিনের শিল্পচর্চা ও শিল্পভাবনার কিছু বিষয়ের দৃশ্যরুপ। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে করা কাজ ও কাজের বিষয়, ফর্ম ও চিন্তার সূত্র মূলত প্রকৃতি, মানুষ, দৈনন্দিন যাপিত জীবন, আশেপাশের নানাবিধ বস্তু, প্রতিচ্ছবি ও গল্প থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা। প্রকৃতি-গতি, মহাজাগতিক মহাযাত্রা, সময় ও স্পেসের রহস্য থেকে উদ্ভুত জিজ্ঞাসা ও এসবের সঙ্গে মানুষের আন্তঃসংযোগ বিষয়ে আমার অনুসন্ধান ও ভাবনা আমার কাজের অনেকটাজুড়ে।

তিনি বলেন, আমার উপস্থাপনায় কিছু ত্রিমাত্রিক বস্তু বা অবজেক্ট, কিছু আকার, উপাদান, আঙ্গিক আছে, যার অধিকাংশ উপাদান হঠাৎ খুঁজে পাওয়া, পরিত্যক্ত জিনিসপত্র এবং নগরের দৈনন্দিন প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে এসেছে। উপড়ে ফেলা গাছের শেকড় বা কেটে ফেলা ডাল আমি সংগ্রহ করেছি এবং এসব উপাদান ও বস্তুকে নিজের মতো করে রুপান্তর ঘটিয়েছি। এখানে পৃথিবীর ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্কিত সংকেত আছে। আমি সময়ের মাত্রাকে এড়িয়ে কিছু দৃশ্যকল্প অবতারণার চেষ্টা করেছি। গুরুত্বহীন বস্তুকে গুরুত্ব দিয়েছি, পরিচিত ফর্মকে অপরিচিত আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছি।