মায়াবন বিহারিণী (পর্ব-১৫) ॥ আরিফুর রহমান


আঁকা: সমর মজুমদার

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-১৫): ছাদে বসে গল্পগুজব করবার জন্য ইংরেজি ইউ আকৃতির একটি বেদী আছে।তার-ই একপ্রান্তে বসে আছেন মানুষটা,পাশে ভাঁজ করে রাখা ওয়াকার।

মনা তার কাছাকাছি যেতেই তিনি গমগমে গলায় প্রশ্ন করলেন, ভয় পেয়েছিলে কেন?
মনা টের পেল মানুষটা পূরণ নয়।সে বড় খান সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! যাকে দেখে যমুনাপারের সব মানুষ ভয় পেতেন, সম্মান করতেন। তিনি খান বাড়ির বাইরের উঠোনে বের হলে ছোট বড় কোনো মেয়ে মানুষেরই সাহস হতো না বাইরে থাকে, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তো দূরের কথা! এসবই সে ওর বাবা-দাদার কাছ থেকে শুনেছে।অথচ সেই মানুষটির সামনে সে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং আত্মবিশ্বাসী গলায় বলছে, ভয় পাইনি তো, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেছিল!
হুম, ভাগ্যিস…!

আমার বহুদিনের ইচ্ছে আপনাকে সামনাসামনি দেখবার, জ্যেঠিমাকেও।
সে তো তোমার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে।
মনা পেছন ফিরে দেখল, ময়নামতি দাঁড়িয়ে আছেন আর চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠেছে তার সৌন্দর্যে! ও মুগ্ধ হয়ে গেল এবং কয়েক পা এগিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল নির্ভয়ে! তিনিও পরম মমতায় খান বাড়ির চতুর্থ প্রজন্মের এই গুণবতী মেয়েটিকে বুকে টেনে নিলেন।তিনি জানেন মেয়েটি দেখতে অনেকটা তারই মতো।তাই তো মনার প্রতি অন্যরকম একটা টান তিনি অনুভব করেন।আর মেয়েটির বড়ো বড় বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে যান।

ময়নামতি ওকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ছেলেটিকে ভালোবাস?
কোনো উত্তর না পেয়ে তাকিয়ে দেখলেন মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে! ওকে বুকে নিয়েই তিনি স্বামীর পাশে বসলেন ময়নামতি।
বড় খান সাহেব অত্যন্ত স্নেহপূর্ণ চোখে মনাকে দেখছেন।আর ময়নামতি অতীতের পাতায় জমা হওয়া ধুলো ঝাড়তে লাগলেন।

খুব ছোটোবেলায় মনা একবার ওর মা-র পেছন থেকে পুকুরে পড়ে গেছিল।ফুটফুটে ছোট্ট যে মেয়েটা রাহেলা খানমকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলেছিল, ‘আন্নি, মনা পলে গেতে’ সে খান বাড়ির বা তার আশেপাশের বাড়ির কারোর মেয়ে ছিল না! একটু পরই আর ওকে খুঁজে পায়নি কেউ!

প্রাইমারিতে পড়বার সময় একবার একটি দ্রুতগতির বাইক মনাকে প্রায় চাপা দিয়ে ফেলেছিল।লোকটার বাঁ পায়ের ভেতরে এখনো পঙ্গু হাসপাতালের রড রয়ে গেছে! অবশ্য তার মেয়েকে বাঁচাতে গিয়ে আহত হওয়া লোকটিকে মকবুল হোসেন খান দশ কাঠা ধানী জমি লিখে দিয়েছেন।

সে রাতে ডাকাতদের কবলে পড়া মনাদের নৌকায় যখন ডাকাত দলের সর্দার বলেছিল, ‘খুন করে ফেলবে’ তখন মনা যে আগুন চোখে তাকিয়ে ডাকাতদের নাস্তানাবুদ করেছিল, তার উৎস কী? তারপরই তো প্রচণ্ড ভয়ে আকাশের মাথা থেকে বিয়ের ভূত পালিয়ে গেছিল।আর গ্রামে ফিরে আকাশের বন্ধুরা রটিয়েছিল মনার সাথে জ্বিন-ভূত আছে! তবে একটু বদনাম ছড়ানোর মাধ্যমে হলেও ওকে যে সমূহ সর্বনাশ থেকে রক্ষা করা গেছিল তাতে স্বস্তি পেয়েছিলেন ময়নামতি ও বড় খান সাহেব।

মাত্র দ্বাদশে পড়ুয়া খান বাড়ির একটি মেয়ের পরিবারের অমতে পালিয়ে বিয়ে করা, সর্বনাশই! আর বদনামের রং, সেতো মাসখানেকের মধ্যেই ফিকে হতে শুরু করেছিল মনাকে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা ও পড়াশোনা করতে দেখে।

ময়নামতির পাশে বসে প্রসন্ন দৃষ্টি রেখে মনাকে দেখছেন বড়ো খান সাহেব।তিনি ভাবছেন ছেলেটির কথা, যাকে মনা ভালোবাসে বলে মনে হচ্ছে তাদের। তারই রক্ত! মনার মতো ওর শরীরেও বইছে খান বংশের রক্ত।

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল।বড় খান সাহেব শহরের কাছাকাছি পশ্চিমদিকের একটি গ্রামে এসেছিলেন একজন সাধু-সন্ন্যাসীর দর্শনে।ওই ধরনের মানুষের প্রতি তার আলাদা একটা টান ছিল।শুনেছিলেন সাধুবাবা ছদ্মবেশী নন, প্রকৃতপক্ষেই সংসার ত্যাগী মানুষ।তিনি তখন আস্তানা গেড়েছিলেন সেই গ্রামের বড় দীঘির পারে।

খান সাহেব যখন সেখানে পৌঁছেছিলেন তখন সাধুবাবা মাছ ধরছিলেন দীঘির পানিতে খালি হাত ডুবিয়ে! তাকে পারে উঠতে দেখে বলেছিলেন, ব্যাটা, তুইও আমারই লাইনের লোক।তোর সাথে জমবে ভালো।আরও ভালো হবে তুই যদি তোর ছায়াসঙ্গীকে বাইরে রেখে আস্তানায় ঢুকিস।
তারপরের দুটো দিন সাধুসঙ্গ উপভোগ করে বিদায় বেলায় বড় খান সাহেব শুনেছিলেন, তোর ফিরতি পথ/রূপবতীর আগুন লেগে/পুড়বে মনোরথ!/হায় হায়!পুড়ল মনোরথ।
চলবে…