মায়াবন বিহারিণী (পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব) ॥ আরিফুর রহমান


আঁকা: সমর মজুমদার

তারপর মাত্র ঘণ্টা তিনেকের আয়োজনে মনা ও আকাশের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। অনেকটা ঘরোয়াভাবেই।দুই পরিবারের সবারই ইচ্ছে আছে কয়েকদিন পর ঘটা করে ওদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজনের।

মেয়েকে গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার পর থেকেই বারান্দায় বসে আছেন মনা-র বাবা-মা। তাদের মনে বিষাদের ছায়া।

হঠাৎ মকবুল হোসেন খানের ফোনে মনার ফোন থেকে কল এলো। দুজনেই অবাক হলেন।তবে প্রথমবার কলটা রিসিভ করলেন না মনার বাবা।অনেক সময় অসাবধানতাবশত কল চলে আসে, এটা ভেবে।কিন্তু আবার কল এল এবং তিনি ফোন তুললেন, হ্যালো মনা, কোনো সমস্যা মা?

না বাবা। আসলে একটি কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছিলাম। আচ্ছা বাবা, আমাদের বংশের একটি অংশ ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপারে আছে না? ঠিক কোন জায়গায় বলতে পার?

মকবুল হোসেন খান চমকে উঠলেন। তোমাকে এই কথা কে বলল? আর এখন এই প্রশ্ন কেন মা?
বাবা, তোমার কাছে কিছু জানতে চাইবার এই এক সমস্যা, উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করে বসো। মা-কে দাও প্লিজ!

রাহেলা খানম ফোন ধরে কাঁপা গলায় বললেন, হ্যালো।তিনি কাঁদছেন!
হ্যাঁ মা, খেয়েছ কিছু? বাবা খেয়েছে? আচ্ছা মা, কবরের কাছে গেলে কী দোয়া পড়তে হয় যেন? ভুলে গেছি।তুমি আবার বাবার মতো উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করো না।আসলে আমার দাদা শ্বশুর মশাইয়ের কবর বৈঠক ঘরের পাশে।ওই কবরের পাশ দিয়েই বাড়িতে ঢুকতে হয়।তো কবরের কাছাকাছি এসে দোয়াটি খুব মনে করবার চেষ্টা করলাম, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না! বলো মা।
আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর।
ঠিকাছে মা, রাখি। মনা ফোন রেখে দিল।
ওর বাবা-মার বিস্ময়ের সীমা রইল না!

ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের উত্তরপ্রান্তে যে বাজার তাতে একজনকে পাওয়া গেল রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে।মনা লোকটির সামনে গাড়ি থামাতে আকাশকে ইশারা করল।বলল, ওনাকে জিজ্ঞেস কর সৈয়দ বাড়িতে যেতে হবে কোনদিক দিয়ে।

লোকটি চার চাকার গাড়ি দেখে সম্ভ্রমের সাথেই বলল, একটু আগাইলেই দেখবেন একটা রাস্তা পশ্চিমে গেছে।ঐ রাস্তা দিয়া দুই-তিন মিনিট আগাইলে একটা মজ্জিদ পাইবেন।হের পিছনের বাড়িই সয়দ বাড়ি। আপনেরা কার ইষ্টি?

ভাই, ওই পূর্ণ…ডিসি অফিসে চাকরি করত।বলল মনা।
ও পুন্ন! হে ত’ মইরাই গেছে! ও ত’ সয়দ বাড়ির পোলা না, নাতি আছিল। ঐ বাড়ির দক্ষিণ মাথায় দেকবেন একটা ছোট্ট বাড়ির উডানে দুইডা কবর আছে। একটা অর দাদার আর একটা অর।অর মা আছে বাড়িত’। হয়ত শুনবেন কানতাছে!

একজনের কাছ থেকে এতগুলো তথ্য পাবে ওরা আশা করেনি।আকাশ তো ভেবেছিল এতরাতে বাড়ি খুঁজে বের করাই সম্ভব হবে না।
তালুকদার বাড়ি থেকে ওরা বেরিয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে।অথচ এটা ওদের ফুলশয্যার রাত!

হুটহাট করে এবং ঘরোয়া আয়োজনে বিবাহ হয়েছে বলে বাড়িতে অতিরিক্ত কোনো লোকজন ছিল না।আতাউর রহমান তালুকদার ও মিতা হক, দুজনেই কয়েক ঘণ্টার পরিশ্রমে ভীষণ ক্লান্ত ছিলেন তাই এগারোটা নাগাদ ঘুমিয়ে পড়েছেন।সেই সুযোগে আকাশকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছে মনা।বরের গাড়ির চাবিটা সে আগেই সরিয়ে রেখেছিল! রেন্ট-এ কারের লোকটি, আকাশের বন্ধু, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও চাবি না পেয়ে বলে গেছিল, ডুপ্লিকেট চাবিসহ সকালে এসে গাড়ি নিয়ে যাব।

আকাশ বাসরঘরে মনার হাতে চাবি দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি গাড়ির চাবি লুকিয়ে রেখেছ কেন?

এটা ওর শাস্তি।দুষ্টুমির ছলে বলেছিল মনা।তোমার হাঁদারাম বন্ধুর মনোযোগ রাস্তার চেয়ে বেশি লুকিং গ্লাসে ছিল কেন? তাছাড়া এই রাতে লং ড্রাইভে যাব, এটা আমার বহুদিনের দুর্দমনীয় ইচ্ছে!

সেই থেকে আকাশের অবাক হওয়ার শুরু।যা এখনো চলছে! ও এখনো স্পষ্ট করে জানে না যে, মনা ফুলশয্যার রাতে ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে! কে এই পূর্ণ? সৈয়দ বাড়ির সাথে খান বাড়ির কী সম্পর্ক?

মসজিদের পেছনে একটি বড়ো বাড়ি দেখে ওরা বুঝল এটাই সৈয়দ বাড়ি।সারিবদ্ধ অনেকগুলো ঘর।কোনোটি ইটের আবার কোনোটি টিনের, কিন্তু সবগুলোতেই বনেদিয়ানার ছাপ আছে।

দক্ষিণে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সরু একটি পায়ে হাঁটা পথ দেখতে পেল ওরা। গাড়ি থেকে নেমে সেই পথ ধরে দুজন হাঁটতে লাগল।

পথের লোকটির বর্ণনা অনুযায়ী সৈয়দ বাড়ির শেষপ্রান্তে গিয়ে সত্যি ছোট্ট একটি বাড়ি দেখতে পেল ওরা।বাড়ির বাইরের উঠোনে দুটো কবর, পাশাপাশি, শান বাঁধানো।দেখে আক্ষরিক অর্থেই কেঁপে উঠল মনা।ধীরপায়ে কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে।ওর পাশে আকাশ।
ওপরের আকাশে তখন লুকোচুরি চলছে টুকরো টুকরো মেঘে আর পূর্ণিমার চাঁদে! ফাল্গুনী পূর্ণিমায় হঠাৎ মেঘেদের আনাগোনা! আকাশের উত্তরকোণে ধীরে ধীরে জমছে মেঘ, মনখারাপের মতো!

মনা জানে না, ওর প্রিয় বন্ধু পলি, যার রক্ষণশীল একটি পরিবারে বিয়ে হয়েছিল, ওর আবারও একটি ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে।কিন্তু ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন চেয়েছিল এবার ছেলে হোক! ফলে ওকে নানান কথা শুনতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত! এই মুহূর্তে পলি দাঁড়িয়ে আছে বাসার বারান্দায়। ওর দুচোখ ছাপানো অশ্রু-ই কি তবে জমছে আকাশে?

মনা এ-ও জানে না, পাখির ডানা পাওয়া ঝুমা-টা এখন নেশাগ্রস্ত স্বামীর সঙ-সার সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে উঠেছে।তবে কি ওর দীর্ঘশ্বাস-ই মেঘেদের উড়িয়ে নিচ্ছে আকাশের উত্তরকোণে?

মনা এখনো টের পায়নি, বরকে নিয়ে যার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মোনাজাত করছে তার মা নিঃশব্দে কাঁদছেন ওদের ঠিক পেছনের ঘরে শুয়ে! তার অন্তরের আহাজারি কি মেঘেদের কানে বোধন মন্ত্র জপছে?

মোনাজাত শেষে মনা ওপরের দিকে তাকাল।দেখল, পূর্ণ উঠে যাচ্ছে মহাশূন্যে! ও হাত নাড়ছে! প্রতিত্তোরে মনা-ও হাত নাড়ল।
আকাশ তালুকদার কিছুটা বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি ওপরের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছ কেন?

ওর খুব মনখারাপ! সেই মনখারাপ থেকেই বিরক্তির উৎপত্তি হয়েছে! মনখারাপ মনার কারণেই।ফুলশয্যার রাতে এই এতদূর সে এসেছে মনার রহস্যময় কথার জালে ফেঁসে। ভেবেছিল এখানে এসে সেই রহস্যের জট খুলে একটি দুর্দান্ত গল্প সে পেয়ে যাবে। এখন দেখছে রহস্য-টহস্য কিছু নয়, মনা এখানে এসেছে পূর্ণ-র কবরে দোয়া করতে! কে ছিল এই পূর্ণ? কোনো পীর-দরবেশ? ও জানে না!

মনা আকাশের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই মুহূর্ত থেকে তুমি পরিপূর্ণভাবে আমার!…. চলো, মেঘ জমেছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে।

ওরা পূর্ণদের বাড়ি থেকে সরু পথটায় নামতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো! কিন্তু ওরা ছুটে গেল না! আগের মতোই ধীরপায়ে হেঁটে ভিজতে ভিজতে গাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।

বৃষ্টির কয়েকটি ফোঁটা মনার মুখমণ্ডল স্পর্শ করতেই ওর মনে হলো, এটা অসময়ের বৃষ্টি নয়, কারোর আশীর্বাদ যেন ঝরে পড়ছে ওদের ওপর! ও ওপরের দিকে তাকাল। নাহ্, কেউ নেই!

হঠাৎ একরাশ শূন্যতা ওকে জাপটে ধরল এবং তক্ষুণি ওর কপালের ঠিক মাঝখানটায় একটা আদুরে স্পর্শ জেগে উঠল! সে জানে এই মায়ার পরশ ওর জ্যেঠিমা ময়নামতির! মুহূর্তেই শূন্যতা উধাও, আর মনার হৃদয়জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল প্রশান্তি! যার আবেশে ওর চোখ বুঁজে এল।
তখনই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল মনা, কিন্তু আলোভরা দুটো হাত চট করে ওকে ধরে ফেলল।

/সমাপ্ত/