অমৃতা-ইমরোজ: বিখ্যাত দুজনের শর্তহীন প্রেমকাহিনি ॥ শামিমুর রহমান


আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে
কোথায়, কেমন করে, কখন
আমি জানি না
আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে
তোমার কল্পনার দ্যুতি হয়ে
তোমার ক্যানভাসে ঠাই নেব
তোমার আঁকা ছবির এক রহস্যময় রেখা হয়ে
আলোর রেখার মত নীরবে তোমাকে দেখে যাব, মিশে যাব
তোমার ক্যানভাসের রঙে
আবার হবে দেখা তোমার সঙ্গে
তোমার শরীর থেকে জলবিন্দু মুছে দিতে
উচ্ছসিত ঝরনা হব আমি
ঝরে পড়ব তোমার ওপরে
একবিন্দু জলের মতন
আর কিছুই আমার জানা নেই
এটা শুধু জানি
সময় হবে আমার সহায়
জানি আমি, দেহের বিনাশ হলে
লয় পায় সবই
স্মৃতির সুতোয় বোনা
পল অনুপলগুলি ছুঁয়ে
আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে।

কবিতাটি পড়ছিলাম আর অমৃতা প্রীতম এর ‘ম্যায় তুমহে ফির মিলুঙ্গি’ কবিতাটি প্রিয়া মালিকের কণ্ঠে ইউটিউবে শুনছিলাম।একটি প্রেমের কবিতা কতটা আবেগময় হয়, কতটা হিরণ্ময় হয়ে ওঠে কবিতাটি তার একটি প্রমাণস্বরূপ।

অমৃতা প্রীতম ভারতবর্ষের একজন অবিস্মরণীয় কবি।দেশভাগের গভীর ছাপ পড়েছে তাঁর লেখায়, যারা তার লিখিত ‘পিঞ্জর’ উপন্যাসটি পড়েছেন কিংবা চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই সেটি উপলব্ধি করবেন।পাঞ্জাবের এই কন্যা নিজের জীবনটাকে কবিতার মতো উপলব্ধি করেছেন।

আলোচ্য বইটি তার কবিতা কিংবা উপন্যাস নিয়ে নয়।এটি অমৃতা এবং ইমরোজকে নিয়ে লেখা এক অমর প্রেমগাঁথা।অমৃতা তাঁর সময়ের এক বিখ্যাত কবি।প্রাক্তন স্বামীর ঘর ছেড়েছেন, আর এক বিখ্যাত কবি সাহির লুধিয়ানভির প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন, অনেকদিন প্রেম করলেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেননি।অমৃতা তাঁর কবিতার বইয়ের ইলাস্ট্রেশনের জন্য কাকতালিয়ভাবে পরিচিত হন ইমরোজের সাথে।সেই পরিচয় নির্ভরতার জন্ম দেয়, আর সেখান থেকে সৃষ্টি হয় এক আমৃত্যু বন্ধুতার, এক অমোঘ বন্ধনের, এক প্রেমময় নিবিড় সম্পর্কের যা আমৃত্যু বজায় থেকেছিল।

এই বইটি সেই অমর বন্ধুতা এবং প্রেমের স্বাক্ষর। তবে বইটি লেখা হয়েছে অন্য একজন মানুষের চোখ দিয়ে, অন্তর দিয়ে।কবি যশপ্রার্থী উমা ত্রিলোক একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে এক দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের সূচনা করেন অমৃতা এবং ইমরোজের সঙ্গে।অমৃতার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সাক্ষী ছিলেন তাঁদের এই প্রেম এবং বন্ধুতার।আবেগের দিক থেকে অমৃতা সবসময় হয়ত বিচক্ষনতার পরিচয় দিতে পারেননি, সে কারণে জীবনভর সমাজের কটূক্তি শুনেছেন, সমালোচনার তীর বিদ্ধ করেছে তাকে তবে তাঁর প্রতি ইমরোজের অনুরাগকে তিনি তাঁর মনে জায়গা দিয়ে কিঞ্চিত ভুল করেননি।এক ছাদের নিচে চল্লিশ বছর অমৃতা এবং ইমরোজ একসাথে প্রেমময় জীবন অতিবাহিত করেছেন কিন্তু বিয়ে করেননি।অমৃতার জীবনে প্রেম এসেছে কয়েকবার।কিন্তু ইমরোজ অমৃতা ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি।অমৃতার গর্ভে ইমরোজের কোন সন্তান হয়নি কিন্তু এ নিয়ে ইমরোজ কোন অনুযোগ করেননি।

এই বইটিতে তাঁদের জীবনের অনেক খুঁটিনাটি উঠে এসেছে।এবং অবশ্যই সেই বিখ্যাত গল্পটি, যেখানে খুশবন্ত সিং অমৃতাকে জিজ্ঞেস করছেন, তাঁদেরকে পার্টিতে কিংবা অন্য কোথাও খুব একটা দেখা যায় না কেন, কি করেন তাঁরা সারাদিন বাসায়, একসাথে, একা? অমৃতা উত্তর দেন, গল্প।এই গল্প করার দৃশ্যগুলি কেমন, কি নিয়ে গল্প হয়, খুঁনসুটি চলে? যখন কোন কথা হয়না তখন তাঁদের প্রেমের অবয়ব কেমন হয় সেগুলিই উমা বলেছেন এই বইতে।তাঁরা দুইজন থাকেন দুই ঘরে কিন্তু দরজা সবসময় খোলা ঠাকে।ইমরোজ অতিথি আপ্যায়ন করেন নিজের হাতে চা বানিয়ে।বাড়ির সবকিছুর মধ্যে এক প্রেমময় সুস্থির বিন্যাস টের পান উমা।কোথাও কোন বাহুল্য নেই, আছে ইমরোজ কর্তৃক অনেকগুলি পেইন্টিং যার মধ্যে অমৃতার উপস্থিতি যেন খুব স্বাভাবিক।যেন তিনি সারাজীবন একটিই ছবি অমৃতার ওপর ভর করে এঁকে চলেছেন।একটি মানুষকে সারা জীবন কিভাবে ভালোবাসতে হয় সেটি কি ইমরোজ আমাদের দেখিয়ে দেন? অথচ কেমন আড়ালে থাকা মানুষ তিনি, সর্বসমক্ষে আসেন না, অমৃতা কোন অনুষ্ঠানে গেলে বাইরে পারকিং লটে বসে থাকেন।এ নিয়ে কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই।অসুস্থ অমৃতার পোশাক পাল্টে দিচ্ছেন, বিছানা পরিষ্কার করে দিচ্ছেন। তারপরেও কোথাও যেন ক্লান্তি নেই।অমৃতা যেদিন মারা যান, তিনি স্থির দাঁড়িয়ে থাকেন আড়ালে, দূরে। উমাকে পরে বলেন, অমৃতা আছেন তাঁর পাশেই, সুরভী হয়ে।

এটি এমন একটি বই যার সমালোচনা কি করবো বুঝে পাইনা।বইটি মূল ইংরেজিতে পাঠ করাও যেতে পারে নিশ্চয়ই।এখানে দিলওয়ার হাসান কর্তৃক অনুবাদ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আমার সাবলীল মনে হয়েছে।বইটি প্রকাশ করার জন্য বাতিঘর এবং দীপঙ্কর দার ধন্যবাদটুকু প্রাপ্য। এই প্রেমের আখ্যান বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের জন্য দরকার ছিল।

বইটি পড়ে মনে হলো, অমৃতা এবং ইমরোজ একে অপরকে কমপ্লিমেন্ট করেন ভালো।অমৃতা স্বাধীনচেতা, প্রতিবাদী, আবেগপ্রবণ অপরদিকে ইমরোজ শান্ত, সুস্থির, সচেতন।হয়ত এই কারণে তাঁদের প্রেম, বন্ধন, বন্ধুতা টিকে গিয়েছিল এবং সময় আর সমাজের বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কাছে তাঁরা নতি স্বীকার করেননি।এই লড়াই করার মতন শক্তি ও সাহস তাঁরা তাদের সম্পর্কের ভেতর থেকে খুঁজে পেয়েছিলেন।

অমৃতা- ইমরোজ একটি প্রেমকাহিনি, ভাষান্তর: দিলওয়ার হাসান, বাতিঘর প্রকাশন, ২০২৩, পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১৫৯, দাম ৩২০ টাকা।