ওলগা তোকারজুকের উপন্যাস ‘এখন মনোযোগ দাও’ ॥ অনুবাদ ফজল হাসান


এখন মনোযোগ দাও
মূল: ওলগা তোকারজুক
অনুবাদ: ফজল হাসান

একবার নম্র ও ভদ্র এবং এক বিপজ্জনক পথে, একমাত্র লোকটি তার গতিপথ ধরে হেঁটেছিল মৃত্যুর উপত্যকা।ইতোমধ্যে আমি এমন এক বয়সে পৌঁছেছি এবং অতিরিক্তভাবে এমন একটি অবস্থায় আছি, যেখানে অবশ্যই আমাকে সবসময় বিছানায় যাওয়ার আগে পা ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হয়। কেননা রাতে যদি আমাকে অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে স্থানান্তরিত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

আমি যদি সেই সন্ধ্যায় আকাশের ঘটনা দেখার জন্য ক্ষণজীবী পতঙ্গদের পরীক্ষা করতাম, তাহলে আদৌ আমি বিছানায় যেতাম না। এদিকে আমি খুব দ্রুত গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়েছিলাম; পানীয় সুরভিত করার জন্য আমি হপের সাহায্য নিয়েছিলাম এবং দুটি ঘুমের বড়িও খেয়েছিলাম। সুতরাং যখন আমি মধ্যরাতে দরজায় হিংস্র, উচ্ছৃঙ্খল এবং অশুভ-অশনি সংকেতের মতো জোরে আঘাত করার শব্দ শুনে জেগে যাই, তখন আমি নিজেকে আস্বস্ত করতে পারছিলাম না।

আমি লাফ দিয়ে উঠলাম এবং অস্থিরভাবে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ ঘুমের রেশ কাটিয়ে আমার নিদ্রাহীন ও নড়বড়ে শরীর সজাগ অবস্থায় আসতে পারছিল না। আমি দুর্বল বোধ করছিলাম এবং আমার মাথা চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করেছিল। মনে হয়েছিল আমি হয়তো জ্ঞান হারাতে চলেছি। দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের ঘটনা সম্প্রতি আমার মধ্যে ঘটতে দেখা যাচ্ছে এবং আমার অসুস্থতার সঙ্গে সম্পর্কিত। অগত্যা আমাকে বসে থাকতে হয়েছিল এবং আপনমনে বেশ কয়েকবার নিজেকে বলতে হয়েছিল যে, আমি বাড়িতে আছি, রাত হয়ে গেছে, কেউ দরজায় কড়া নাড়ছে; কেবল তখনই আমি আমার স্নায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।

আমি যখন অন্ধকারে চপ্পল খুঁজছিলাম, তখন শুনতে পাচ্ছিলাম যিনি দরজায় আঘাত করছিলেন তিনি এখন বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং বিড়বিড় করছেন। নীচের তলায় বৈদ্যুতিক মিটার রাখার খোপের মধ্যে আমি মরিচের স্প্রে রাখি, যা চোরাশিকারিদের মোকাবিলা করার জন্য ডিজি আমাকে দিয়েছিল। এ মুহূ্র্তে সেই মরিচের স্প্রের কথা মনে পড়ল। অন্ধকারের মধ্যে আমি ঠান্ডা অ্যারোসোল আকৃতির মতো পরিচিত স্প্রে খুঁজে পেয়েছি। তাই নিজেকে সশস্ত্র ভেবে আমি বাইরের বাতি জ্বালাই। তারপর আমি পাশের ছোট জানালা দিয়ে বারান্দার দিকে তাকাই।

ঘরের বাইরে জমাট বাঁধা তুষার ছিল এবং আমার প্রতিবেশিও ছিলেন। আমি তাকে ওডবল নামে সম্বোধন করি। তিনি নিজেকে পুরোনো ভেড়ার চামড়ার কোটের ভেতর লুকিয়ে রেখেছিলেন। আমি মাঝে মাঝে তাকে বাড়ির বাইরে কাজ করার সময় ভেড়ার চামড়ার সেই কোট পরে থাকতে দেখেছি। কোটের নীচে আমি তার ডোরাকাটা পাজামা এবং পায়ে ভারী হাইকিং বুট দেখতে পাচ্ছিলাম।
‘দরজা খুলুন,’ প্রতিবেশি ভদ্রলোক বললেন।

তিনি আমার লিনেনের তৈরি ঘুমের পোশাকের দিকে আশ্চর্য্যান্বিত দৃষ্টি মেলে সরাসরি তাকালেন (আমি এমন কিছু পরিধান করে ঘুমাই, যা প্রফেসর এবং তার স্ত্রী গত গ্রীষ্মে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন, যা আমাকে অতীত এবং আমার যৌবনের দিনগুলোর এক আশ্চর্য ফ্যাশনের কথা মনে করিয়ে দেয়। এভাবেই আমি ব্যবহারিক এবং সংবেদনশীল বিষয়কে একত্রিত করি) এবং আমার অনুমতি ছাড়াই তিনি ভেতরে প্রবেশ করেন।

‘দয়া করে পোশাক পাল্টিয়ে নিন। বিগ ফুট মরে গেছে।’
কিছুক্ষণের জন্য আমি হতবাক হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। কোনো কথা না বলে আমি আমার লম্বা তুষার বুট এবং কোটের আলনা থেকে হাতের নাগালে প্রথমে উলের যে জামা খুঁজে পেলাম, তাই তুলে নিয়ে গায়ে জড়ালাম। বাইরে বারান্দার বাতি থেকে বিচ্ছুরিত আলোর মধ্যে তুষার ক্রমশ নিদ্রাহীন ঝরনায় পরিবর্তিত হচ্ছিল। আমার পাশে ওডবল নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে লম্বা, পাতলা এবং পেন্সিলের কয়েকটি খোঁচায় স্কেচ করা চিত্রের মতো লাগছিল। প্রতিবার যখন তিনি নড়াচড়া করেন, ততবারই তার শরীর থেকে তুষার ঝরে পড়ছিল, যেমন পেস্ট্রির ফিতা গলিয়ে চিনির আইসিং ঝরে পড়ে।

‘মরে গেছে বলতে আপনি কী বুঝাচ্ছেন?’ দরজা খুলে আমি অবশেষে জিজ্ঞেস করি। আমার গলার ভেতর শক্ত হয়ে যায়। কিন্তু ওডবল উত্তর দিলেন না। তিনি সাধারণত খুব বেশি কথা বলেন না। অবশ্যই তার রাশিচক্রে একটি সংযত চিহ্ন থাকতে হবে। আমি মনে করি সেই চিহ্ন তার মকর রাশিতে অথবা কাছাকাছি অন্য রাশিতে কিংবা শনির বিপরীতে আছে। তবে তা বুধও হতে পারে–যা তার মধ্যে গূঢ়গম্ভীর ভাব সৃষ্টি করেছে।

আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি এবং তৎক্ষণাৎ পরিচিত ঠান্ডা ও ভেজা বাতাসের আলিঙ্গণে আচ্ছন্ন হয়ে যাই। সেই বৈরী আবহাওয়া প্রতি শীতে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, পৃথিবী মানবজাতির জন্য তৈরি করা হয়নি এবং কমপক্ষে অর্ধেক বছর আমাদের দেখিয়ে দেয় যে পরিবেশ আমাদের জন্য কতটা প্রতিকূল। জমাট বাঁধা তুষার আমাদের গালে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করছিল এবং আমাদের মুখ থেকে বাষ্পের শুভ্র মেঘ বেরিয়ে আসছিল। বারান্দার আলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিভে যায় এবং আমরা প্রায় সম্পূর্ণ অন্ধকারে তুষারের ওপর দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। তবে ওডবলের হাতে বাতি ছিল, যার আলো তার ঠিক সামনে একটি চলমান জায়গায় গাঢ় অন্ধকারকে ভেদ করছিল। তার পেছনে আমি ঝাপসা অন্ধকারে হোঁচট খাই।
‘আপনার কাছে কী ফ্ল্যাশলাইট নেই?’ তিনি জিজ্ঞেস করেন।
অবশ্যই আমার একটি ফ্ল্যাশলাইট ছিল। তবে সকালে আমি কোথায় যে রেখেছি, তা বলতে পারব না। ফ্ল্যাশলাইটের একটি বৈশিষ্ট্য যে, তাদের কেবল দিনের বেলায় দেখতে পাওয়া যায়।

বিগ ফুটের কটেজটি রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে ছিল, যা অন্যান্য বাড়িঘরের চেয়ে ওপরে অবস্থিত। সারা বছর ধরে বসবাস করার জন্য তিনটি কটেজের মধ্যে সেটি ছিল একটি। শুধু তিনি, অর্থাৎ ওডবল, এবং আমি শীতের ভয় ছাড়াই সেখানে থাকতাম; অন্যান্য সমস্ত অধিবাসীরা অক্টোবরে তাদের কটেজগুলো বন্ধ করে দিত, পাইপ দিয়ে পানি নিষ্কাশন করত এবং তারপর শহরে ফিরে যেত।

এখন আমরা আংশিকভাবে পরিষ্কার করা রাস্তাটি ছেড়ে চলে এসেছি। রাস্তাটি আমাদের জনপদ ধরে চলে গেছে এবং প্রতিটি বাড়ির দিকে যাওয়ার পথে ভাগ হয়েছে। গাঢ় বরফের মধ্যে একটি পথ বিগ ফুটের বাড়ির দিকে চলে গেছে এবং সেটা এতই সংকীর্ণ যে, শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এক পা আরেক পায়ের পেছনে রাখতে হয়।

‘দৃশ্যটি সুন্দর হবে না,’ আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ওডবল সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই সময় তার মাথায় আটকানো বাতির আলো এসে আমাকে ক্ষণিকের জন্য অন্ধ করে দিয়েছিল।

আমি অন্য কিছু আশা করিনি। তিনি কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকেন। তারপর অনেকটা নিজেকে ব্যাখ্যা করার মতো করে বললেন: ‘আমি তার রান্নাঘরের আলো দেখে এবং কুকুরের স্পষ্ট ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। তুমি কী শোনোনি?’
না, আমি শুনিনি। আমি হপস এবং ভ্যালেরিয়ানের ক্রিয়ায় বেঘোরে ঘুমিয়েছিলাম।
‘কুকুরটি এখন কোথায়?’
‘আমি তাকে এখান থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছি। সে আমার বাড়িতে আছে। আমি তাকে খাইয়েছি এবং মনে হয় এখন শান্ত হয়েছে।’
আরও এক মুহূর্তের নীরবতা নেমে আসে।
‘তিনি সবসময় আলো নিভিয়ে দিতেন এবং বিদ্যুতের খরচ বাঁচানোর জন্য তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতেন। কিন্তু এবার আলো জ্বলতে থাকে। আলোটি বরফের বিপরীতে একটি উজ্জ্বল রেখার মতো দেখাচ্ছিল। আমার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছি। তাই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম যে, হয় সে মাতাল হয়ে গেছে নতুবা কুকুরের ক্ষতি করছে, কারণ কুকুরটি অদ্ভূত স্বরে চিৎকার করছিল।’

এক সময় আমরা একটি খামার বাড়ি অতিক্রম করি। কিছুক্ষণ পরে ওডবলের ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে দুই জোড়া উজ্জ্বল চোখ। চোখ দুটির রঙ হালকা সবুজ এবং ফকফকা।
‘দেখুন, অই যে হরিণ,’ আমি একটু জোরে ফিসফিস করে বললাম এবং তার কোটের হাত চেপে ধরলাম। ‘তারা বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। তারা কী ভয় পায় না?’

হরিণীরা প্রায় তাদের পেট পর্যন্ত উচ্চতা বরফের মধ্যে দাঁড়িয়েছিল। তারা শান্তভাবে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল, যেন আমরা তাদের একটি আচার অনুষ্ঠান সম্পাদনের মাঝখানে ধরে ফেলেছি এবং যার অর্থ আমরা বুঝতে পারি না। তখন অন্ধকার ছিল। তাই আমি বলতে পারছিলাম না যে, তারা একই যুবতী হরিণী যারা শরৎকালে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে এখানে এসেছিল, নাকি তারা নতুন অন্য কেউ। সত্যি, কিন্তু কেন তারা শুধু এক জোড়া? অন্য সময় অন্তত চারটি ছিল।
‘বাড়ি যাও,’ আমি হরিণীদের বললাম এবং হাত নাড়তে শুরু করলাম। তারা শরীর ঝাঁকাল, কিন্তু নড়ল না। তারা দৃষ্টির সমস্ত পথ পেরিয়ে সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের দিকে শান্তভাবে তাকিয়েছিল। আমার দেহের ভেতর কাঁপুনির ঢেউ বয়ে গিয়েছিল।
ইতোমধ্যে ওডবল অবহেলিত কুটিরের বাইরে তার বুট থেকে বরফ সরানোর জন্য পা দিয়ে ভূমিতে আঘাত করছিল। ছোট জানালাগুলো প্লাস্টিক এবং কার্ডবোর্ড দিয়ে বন্ধ ছিল এবং কাঠের দরজাটি কালো তারের কাগজ দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল।

হল ঘরের দেওয়ালে চুলার জন্য জ্বালানি কাঠের টুকরা থরেথরে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। সেসব কাঠের টুকরা ছিল বিভিন্ন আকৃতির। ঘরের ভেতরটি ছিল কুৎসিৎ, নোংরা এবং অবহেলিত। সেখানে পুরো সময়জুড়ে স্যাঁতসেঁতে, কাঠ এবং মাটি-আর্দ্র এবং ভয়ানক গন্ধ বিরাজ করছিল। বছরের পর বছর পুরানো চিটচিটে দেওয়ালের গায়ে ধোঁয়ার দুর্গন্ধ জমেছিল।

রান্নাঘরের দরজা সামান্য খোলা ছিল এবং আমি বিগ ফুটের দেহটি মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলাম। আমার দৃষ্টি তার দিকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে অন্য দিকে চলে যায়। আমি পুনরায় সেদিকে তাকানোর মাঝে কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়। এক ভয়ংকর দৃশ্য ছিল।
বিগ ফুট বাঁকানো অবস্থায় এক উদ্ভট ভঙ্গিতে শুয়েছিল। তার হাত ছিল নিজের ঘাড়ের ওপর, যেন সে কলার টেনে তোলার জন্য লড়াই করছিল এবং যা তাকে চিমটি কাটছিল। আমি সম্মোহিতের মতো ধীর পায়ে আরো কাছে গেলাম। আমি দেখলাম তার খোলা চোখ টেবিলের নিচে কোথাও একটা নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির হয়ে আছে। তার নোংরা খাটো জামা গলার কাছে ছেঁড়া। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল দেহটি যেন লড়াইয়ে হেরে গিয়ে নিজেই ঘুরে গিয়েছে এবং তাকে হত্যা করা হয়েছে। দৃশ্যটি দেখে আমি ভয়ে আমার শরীরের মধ্যে ঠান্ডা অনুভব করেছিলাম–আমার শিরায় রক্ত জমে গিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছিল বিগ ফুট যেন আমার দেহের গভীর অভ্যন্তরে চলে গিয়েছে। গতকালই আমি তার দেহটি জীবিত অবস্থায় দেখেছি।
‘হায় ঈশ্বর,’ আমি বিড়বিড় করি, ‘কী হয়েছিল?’
অডবল কাঁধ ঝাকান।
‘আমি পুলিশের কাছে যেতে পারি না, কারণ এখানে চেকোস্লোভাকিয়ার নেটওয়ার্ক।’

আমি পকেট থেকে সেল ফোন বের করি এবং টেলিভিশন-৯৯৭ থেকে আমার পরিচিত নম্বরটি চাপি। অতি শিঘ্রই স্বয়ংক্রিয় চেক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। এখানে তাই হয়। জাতীয় সীমানার প্রতি কোনো শ্রদ্ধা ছাড়াই সংকেতটি ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। কখনো অপারেটরদের মধ্যে বিভাজক লাইন আমার রান্নাঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থেমে থাকে এবং কখনো কখনো তা বেশ কয়েক দিন ধরে ওডবলের বাড়িতে বা ছাদে বন্ধ থাকে। এ ঘটনার প্রকৃত ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই কঠিন।
‘আপনার বাড়ির পেছনের পাহাড়ের ওপরে উঠে যাওয়া উচিত ছিল,’ দেরি হলেও আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম।
‘তারা এখানে এসে পৌঁছার আগে দেহটি কাঠের তক্তার মতো শক্ত হয়ে যাবে,’ ওডবল এমন এক সুরে কথাটা বলেছিলেন, বিশেষ করে এ কারণেই আমি তাকে অপছন্দ করি, যেন তার কাছে সমস্ত উত্তর জমা ছিল। তিনি তার ভেড়ার চামড়ার কোটটি খুলে একটি চেয়ারের পিছনে ঝুলিয়ে রাখলেন। ‘আমরা তাকে এভাবে ছেড়ে যেতে পারি না। তাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। তার ওপর তিনি আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন।’

আমি যখন গোবেচারা বিগ ফুটের বাঁকানো শরীরের দিকে তাকালাম, তখন আমার বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে পড়েছিল যে কেবল গতকালই আমি লোকটিকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম। আমি তাকে পছন্দ করতাম না। আমি তাকে অপছন্দ করতাম, তা বলার জন্য কথাটা হয়তো খুবই হালকাভাবে বলা হল। তার পরিবর্তে আমার বলা উচিত ছিল যে, আমি তাকে ঘৃণ্য এবং ভয়ানক বলে মনে করেছি। আসলে আমি তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করিনি। এখন সে তার নোংরা দাগযুক্ত অন্তর্বাস পরে মেঝেতে শুয়ে আছে। তার দেহ ছোট এবং চর্মসার, নিস্তেজ এবং নিরীহ। শুধু একটি বস্তুর টুকরা, যা কিছু অকল্পনীয় প্রক্রিয়া যেন কোনো এক ভঙ্গুর বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং যা অন্য সবকিছু থেকে আলাদা। আমাকে দুঃখিত এবং ভীত করে তুলেছিল, এমনকি তার মতো এমন জঘন্য ব্যক্তিও মৃত্যু আশা করে না। পৃথিবীতে মৃত্যুকে কে আশা করে? একই ভাগ্য আমার জন্যও অপেক্ষা করছে এবং ওডবল ও বাইরের হরিণ; একদিন আমরা সবাই লাশ ছাড়া আর কিছুই হব না।
আমি কিছুটা সান্ত্বনা পাবার আশায় ওডবলের দিকে তাকালাম, কিন্তু ইতোমধ্যে তিনি আলুথালু বিছানা তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বিছানাটি তৈরি করা হচ্ছিল একটি জরাজীর্ণ ভাঁজ খোলা খাটের ওপর। তাই নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। একসময় আমার মনে হয়েছিল যে, এভাবে বিগ ফুটের মৃত্যু হয়তো কোনো ভালো কিছু হতে পারে। তাকে জগাখিচুড়ি জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং তার কাছ থেকে অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীরা মুক্তি লাভ করেছে।

ওহ হ্যাঁ, অকস্মাৎ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, মৃত্যু কতটা ভালো জিনিস হতে পারে, কতটা ন্যায্য এবং কতটা নির্ভেজাল, যা জীবাণুনাশক অথবা ভ্যাকিউয়াম ক্লিনারের মতো। আমি স্বীকার করি যে, আগে যা ভেবেছিলাম, আমি এখনো তাই মনে করি।

বিগ ফুট আমার প্রতিবেশী ছিল। আমাদের বাড়ির দূরত্ব ছিল মাত্র অর্ধেক কিলোমিটার। তবুও তার সঙ্গে আমার কোনো কিছু করার মতো সীমিত সংখ্যক জিনিস ছিল। সৌভাগ্যবশত তার পরিবর্তে আমি তাকে দূর থেকে দেখতাম–তার ক্ষুদ্র, নমনীয় কিন্তু শক্ত কাঠামো। সবসময় একটু অস্থির মানুষটি ভূমির ওপর চলাফেরা করতেন। তিনি এগিয়ে যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করতেন এবং প্রায়শই তার অপরিবর্তনীয় কথাগুলো মালভূমির বাতাসের শব্দের সঙ্গে আমার কানে এসে পৌঁছত। তার শব্দভাণ্ডারে প্রধানত অভিশাপ বিষয়ক শব্দ জমা থাকত, যার ওপর তিনি কিছু সঠিক বিশেষ্যকে আঘাত করতেন।

তিনি এই ভূখণ্ডের প্রতিটি খুঁটিনাটি অংশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, কারণ মনে হয় তিনি এখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কোডজকোর চেয়ে বেশি দূরে যাননি। এছাড়া তিনি বনাঞ্চল ভালোভাবে জানতেন–বিশেষ করে অধিক অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি কোন অংশ ব্যবহার করতে পারেন, তিনি কী এবং কার কাছে বিক্রি করতে পারেন। সেসব জিনিসের মধ্যে ছিল মাশরুম, ব্লুবেরি, চুরি কাঠ, জ্বালানোর জন্য ডালপালা, ফাঁদ, উঁচুনিচু ও আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালানোর বার্ষিক প্রতিযোগিতা, শিকার ইত্যাদি। বনজঙ্গল ছোট্ট এই অপ-দেবতাকে লালন-পালন করেছে। সুতরাং বনকে সম্মান করা তার উচিত ছিল, কিন্তু তিনি তা করেননি। কোনো এক আগস্টে, যখন খরা ছিল, তিনি পুরো ব্লুবেরি জমিনে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমি অগ্নি নির্বাপক অফিসে ফোন করেছিলাম, কিন্তু খুব বেশি কিছু বাঁচানো যায়নি। আমি কখনোই জানতে পারিনি কেন তিনি কাজটি করেছিলেন।

গ্রীষ্মকালে তিনি একটি করাত নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন এবং ফল ভর্তি গাছ কাটতেন। যখন আমি বিনীতভাবে তাকে উপদেশ দিয়েছিলাম, যদিও আমার রাগ সংযত করা কঠিন বলে মনে হয়েছিল, তখন তিনি সহজ ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন: ‘গোল্লায় যাও, তুমি একটা বয়স্ক বুড়ি ।’ কিন্তু কথার মধ্যে তার চেয়েও বেশি অসভ্যতা ছিল। অতিরিক্ত নগদ আয় করার জন্য সে সবসময় চুরিচামারি এবং ছিঁচকে চুরির মতো তুচ্ছ কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখত; যখন গ্রীষ্মকালে বাসিন্দারা উঠোনে ফ্ল্যাশলাইট বা গাছ কাঁটার কোনো বড় কাঁচি রেখে যেত, তখন বিগ ফুট তাৎক্ষণিকভাবে সেসব জিনিসপত্র হাতিয়ে নিত এবং পরে শহরে বিক্রি করত। আমি মনে করি ইতোমধ্যে তার বেশ কয়েকটি শাস্তি পাওয়া উচিত ছিল, এমনকি তাকে কারাগারেও পাঠানো দরকার ছিল। আমি জানি না কিভাবে সে সবকিছু নিয়ে পালিয়ে গেল। সম্ভবত কিছু দেবতা তার ওপর নজর রেখেছিল; কখনো কখনো তারা ভুল দিক থেকে দৃশ্যমান হয়।

আমি এটাও জানতাম যে, তিনি সম্ভাব্য সব উপায়ে শিকার করেছেন। তিনি বনকে তার নিজের ব্যক্তিগত খামারের মতো আচরণ করেছিলেন–সেখানে যা কিছু ছিল, তা ছিল তার নিজস্ব সম্পত্তি। তিনি ছিলেন একজন লুটেরা।
তার জন্য আমি অনেক নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছি। সেসব নির্ঘুম রাতে আমি অসহায়ের মতো বিছানায় শুয়ে থাকতাম। অনেকবার আমি পুলিশকে ফোন করেছিলাম– শেষ পর্যন্ত টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে উত্তর দেওয়া হলে আমার আবেদন বিনীতভাবে গ্রহণ করা হত, তবে অন্য কিছুই ঘটত না। বিগ ফুট তার স্বাভাবিক কাজকর্মে চলে যেত। তখন তার বাহুতে থাকত একগুচ্ছ ধনুক এবং সেগুলো অশুভ শব্দ করত। ছোট, মন্দ ভূতের মতো, দুষ্টু এবং অকল্পনীয়। তিনি সর্বদা সামান্য মাতাল থাকতেন এবং সম্ভবত তা তার বিদ্বেষপূর্ণ মেজাজকে প্ররোচিত করত। তিনি হাতে একটি লাঠি নিয়ে বিড়বিড় করে গাছের গুঁড়িতে ক্রমাগত আঘাত করতেন, যেন তিনি তার চলার পথ থেকে সেগুলো সরিয়ে দিতে চাইতেন। তখন তাকে দেখে মনে হত তিনি মৃদু নেশাগ্রস্ত। অনেক সময় আমি তার চলার পথ অনুসরণ করতাম এবং প্রাণীদের ধরার জন্য তার পাতা তারের ফাঁদ সংগ্রহ করে জড়ো করতাম। ফাঁদ এমনভাবে পাতা হত যে, সেসব ফাঁদে আটকে গিয়ে প্রাণীরা মাঝ আকাশে ঝুলে থাকত। অনেক সময় আমি মৃত প্রাণী, যেমন খরগোশ, ভোঁদর এবং হরিণ, খুঁজে পেয়েছি।

‘আমাদের অবশ্যই তাকে খাটে স্থানান্তরিত করতে হবে,’ ওডবল বললেন।
প্রস্তাবটি আমার ভালো লাগেনি। আমি তাকে ছুঁতে পছন্দ করতাম না।
‘আমি মনে করি আমাদের পুলিশের জন্য অপেক্ষা করা উচিত,’ আমি বললাম। কিন্তু ওডবল ইতোমধ্যে ভাঁজ খোলা খাটে জায়গা করে নিয়েছে এবং তিনি তার সোয়েটারের হাতা গুটিয়ে নিয়েছেন। তিনি তার সেই ফ্যাকাশে চোখ দিয়ে আমার দিকে তির্যকভাবে তাকান।
‘আপনাকে এ অবস্থায় খুঁজে পাক, আপনি তা চান না, তাই না? এমন উদ্ভট অবস্থায়। এটা অমানবিক।’
ওহ হ্যাঁ, মানুষের শরীর অবশ্যই অমানবিক। বিশেষ করে মরা মানুষ।
এটা কী ভয়ানক আত্মবিরোধী ছিল না যে, এখন আমাদের বিগ ফুটের বিশাল শরীরের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে, যা দিয়ে তিনি আমাদের এই চূড়ান্ত সমস্যায় ফেলেছেন? আমরা যারা তার প্রতিবেশি ছিলাম, তিনি তাদের কখনো সম্মান করতেন না, এমনকি কখনো পছন্দ করতেন না এবং কখনো যত্ন নেননি?

আমার মতে মৃত্যুকে বস্তুর বিনাশ দিয়ে অনুসরণ করা উচিত। এটাই হবে শরীরের জন্য সবচেয়ে ভালো সমাধান। এভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেহগুলো সরাসরি কৃষ্ণ গহ্বরে ফিরে যাবে, যেখান থেকে সেগুলো এসেছিল। সকল আত্মা আলোর গতিতে আলোর মধ্যে ভ্রমণ করবে। তবে আত্মার মতো যদি কোনো জিনিস থাকে।

প্রচণ্ড বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে আমি ওডবলের কথা মতো কাজ করেছিলাম। আমরা বিগ ফুটের দেহটি পা এবং হাত দিয়ে ধরেছিলাম এবং খাটের ওপর রেখেছিলাম। আমি অবাক হয়ে দেখেছিলাম যে, মৃত দেহটি ভারী ছিল, তবে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় ছিল না। বরং তার পরিবর্তে ঠ্যাঠার মতো শক্ত ছিল, অনেকটা শর্করাযুক্ত বিছানার লিনেনের মতো এবং মাত্র ইস্ত্রী করা হয়েছে। আমি তার মোজাও দেখেছি, অথবা তাদের জায়গায়-নোংরা ছেঁড়া কাপড় যা দিয়ে তার পা মোড়ানো ছিল এবং এখন তাতে ধূসর আর দাগ লেগে আছে। আমি জানি না কেন, কিন্তু সেই মোড়ানো কাপড়ের দৃশ্য আমার বুকে, ডায়্যাফ্র্যামে, এমনকি আমার পুরো শরীরে এত জোরে আঘাত করেছিল যে, আমি আর কান্না ধরে রাখতে পারছিলাম না। তিরস্কারের সঙ্গে ওডবল আমার দিকে শীতল এবং ক্ষণস্থায়ী দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল।

[পাদটীকা: মূল লেখায় নেই, তবে পাঠকের সুবিধার্থে দেওয়া হলো–অনুবাদক ]
১।হপ– হপ উদ্ভিদ হুমুলাস লুপুলাসের ফুল (যা বীজ শঙ্কু বা স্ট্রোবাইলসও বলা হয়)। এগুলো প্রাথমিকভাবে তিক্ত, স্বাদযুক্ত এবং স্থায়িত্ব এজেন্ট হিসেবে পানীয়তে ব্যবহার করা হয়।এছাড়া এরা ফুলের এবং লেবু-জাতীয় ফলের স্বাদ ও সুগন্ধি সরবরাহ করে।হপস অন্যান্য পানীয় এবং ভেষজ ওষুধে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়।

সূত্র: ‘এখন মনোযোগ দাও’ (ইংরেজিতে ‘নাউ পে অ্যাটেনশন’) অংশটি ওলগা তোকারজুকের ‘ড্রাইভ ইয়োর প্লাউ ওভার দ্য বোনস্ অব দ্য ডেড’ উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়। পোলিশ ভাষা থেকে উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অ্যান্টোনিয়া লয়েড-জোনস্। উল্লেখ্য, অনূদিত অংশটি উপন্যাসের চুম্বক অংশ (এক্সসার্প্ট) হিসেবে লন্ডন ভিত্তিক ‘ফিটজক্যারাল্দো এডিশনস’ ব্লগে ও ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত ‘বুকব্রাউজ এলএলসি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।তবে লেখাটি ‘বুকব্রাউজ এলএলসি’ ম্যাগাজিন থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।