লকডাউনের সন্ধ্যাগুলো ॥ সাইফ বরকতুল্লাহ


অন্ধকার সমস্ত পথ শেষে
একটি নক্ষত্র জেগে থাকে
কুড়োনো বিকেল, ফুরিয়ে যাওয়া
গঞ্জিকার ধোঁয়ার পর যেটুকু মেঘআলো
অবশিষ্ট থাকে মধ্যরাত্রে
সেখানেও ফুটে থাকে একটি ফুল।
সমস্ত জানলা, দরজা, দালান
ঝমঝম করে ভেঙে পড়লেও-
পড়ে থাকে একটুকরো ছেঁড়া পাতা
উড়ে উড়ে শিশিরের মতো পড়ে টুপ্ ।
ওই তারা ওই ফুল ওই পাতা
ছেঁড়া সব স্বপ্ন জুড়ে গেলে
বেজে উঠে সংগীত একটাই-
ভা লো বা সা
এক আলোকিত নিঃশব্দ কুসুম।
[ নেমে যাব পরের স্টেশনে, গার্গী সেনগুপ্ত ]

ইউটিউবে গার্গী সেনগুপ্তের এই কবিতা শুনতে শুনতে অফিসের সময় শেষ হয়ে গেলো। ঠিক তখন সন্ধ্যা। ডেস্ক গোছানো শেষে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো। পনেরো মিনিট হাঁটার পর পাশে থেকে ডাক শোনা যাচ্ছে,
-‘উত্তরা, খিলখেত, এয়ারপোর্ট..। ‘উত্তরা, খিলখেত, এয়ারপোর্ট.. একশ টাকা’।

তখন সময় সন্ধ্যা সাতটা। রাস্তায় গাড়ি নেই। লোকজনও নেই। একদম জরুরি কাজ ছাড়া কেউ বাইরে বের হচ্ছে না। কিছু রিকশা, ভাড়ায় চালিত মোটারসাইকেল আর সামান্যসংখ্যক সিএনজিচালিত অটোরিকশা। লকডাউন থাকায় অনেকটা সুনসান। একশ গজ দূরে চেকপোস্ট। দীপন সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠে গেলো। মিরপুর-১০ পৌঁছার পর আরও দুজন যাত্রী উঠল। একজন নারী, একজন পুরুষ। সিএনজি চলছে। রাত বাড়ছে। রাস্তায় সুনশান। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটরসাইকেল শা শা করে যেতে দেখা যাচ্ছে। দীপন আর ওই দুই যাত্রী সিএনজির পেছনের সিটে পাশাপাশি বসা। দীপন নারী যাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন
-কই যাবেন?
-উত্তরা।
-কী করেন?
-চাকরি।
-লকডাউনে যাতায়াত করছেন কীভাবে?
-আর বইলেন না, প্রতিদিন অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। সিএনজিতে এভাবে ভেঙে ভেঙে আসি। কি করবো! চাকরি তো করতে হবে।
-ঠিক বলছেন, আমাদের মতো মানুষরা অসহায়।
-হুম..।
-আপনি কী করেন (নারী যাত্রীর প্রশ্ন)?
-আমিও জব করি (দীপন)। আমাদের মতো যারা অফিসগামী, তাদের সুখ নেই।
ক্রিং..ক্রিং..ক্রিং। ফোন বাজছে। সিএনজি চলছে।

ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোনটা রিসিভ করেই ওপাশের ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথন শুরু।
-কী করো?
-অফিস থেকে বাসায় যাচ্ছি।
-আমার মন, শরীর খারাপ।
-খারাপের কি আছে। কয়েকদিন আগে আমার অ্যান্ড্রয়েড ফোনসহ টাকাপয়সা সব ছিনতাই হলো। এটা তো আমার জানের উপর দিয়েও হতে পারত, পারতো না। কিন্তু হয়নি। হয়তো এটাই নিয়তি। রমজান মাস চলছে। তোমার আম্মুকে ফোন দাও। দোয়া করতে বলো। ভালো লাগবে।
-কিন্তু চাকরির কী হবে?
-কি আর হবে। মলে কনফিডেন্ট রাখ। চাকরিটা যেন টিকে থাকে। লকডাউনে কতজনই তো বেকার হয়ে গেছে। তুমি চিন্তা করোনা। অফিসে আগের চেয়ে বেশি কাজ করার চেষ্টা করো। বস দেখবে, তোমার ওপর খুশি।
– তোমার কাছে টাকা আছে? যাচ্ছ কীভাবে?
-হ্যাঁ, স্যালারি এখনো হয়নি। কলিগের কাছ থেকে কিছু টাকা নিলাম। জানো তো, ছিনতাইকারী সব নিয়ে গেছে।
-আমাকে জানাওনি কেন?
-টেনশন করবে যে।
-ধুর!! তুমি যে কি!
– সমস্যা নেই। তুমি তো সেলারি এখনো পাওনি।
-আর কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে?
-এই তো বিশ্বরোড পার হচ্ছি।
-ওকে যাও। ঠিকমতো খেয়ে নিও।

সিএনজি চলছে। কথোপকথন শেষ। পাশের যাত্রী তার কথাগুলো খেয়াল করছিল। হঠাৎ দীপনের মোবাইলে ফোন এলো। রিসিভ করতেই আইরিন আপুর কণ্ঠ।
-‘দীপন, আচ্ছা একটা বিষয়ে তোমাকে ফোন দিলাম। শোনো, আমার ল্যাপটপে জুমে সাউন্ড প্রবলেম হচ্ছে। আমার কথা অন্যরা শুনতে পায় না। আমি শুনতে পাই তাদের কথা। এটা কি আমার ল্যাপটপ সমস্যা না অন্য কোনো প্রবলেম? তুমি বলতে পার’।
-‘আচ্ছা,আপু কাল অফিসে গিয়ে আমাদের অফিসের আইটি বসের সঙ্গে বিষয়টি আলাপ করে জানাব। তবে এটা সাউন্ড সিস্টেমের কোনো ঝামেলা হতে পারে’। এরপরই কলটা কেটে গেলো। নেটওয়ার্ক প্রবলেম।

দুই.
গতকাল থেকে রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। সারাদিন অফিস করে এসে ইদানীং রান্না করা আর ভাল্লাগে না। ধুর! এরচেয়ে না খেয়ে থাকা ভালো। কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করে, ফ্রেশ হয়ে আবার বের হলো দীপন। রাত তখন দশটা বাজে। এই লকডাউনে কোথাও হোটেল খোলা নেই। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আলীর গলিতে একটা চায়ের দোকান দেখতে পেলো। পেটে খিদে আছে। কিন্তু ভাত তো পাওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে একটা বন রুটি আর চিনি ছাড়া রং চায়ের কথা বলল চা দোকানদারকে। চারপাশে ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগছে। লোকজন নেই বললেই চলে। বিশ ত্রিশ বছর বয়সী দুইজন চা খাচ্ছে আর সিগারেট টানছে। মেইন রোড দিয়ে পুলিশের গাড়ির শব্দ শোনা গেলো। চা খাওয়া ওই দুজন তরুণ আলাপ করছে,
-‘ওই চাচা (চা দোকানী) হুনো, ঢাকা শহরে থাকার চেয়ে মরা ভালো। যত করোনা খালি ঢাকাতেই খবর পাই। গেরামে করোনার কোনো খবর পাই না তো’।
-‘ হ বেডা, এইডা ভালো কইছস। বেচাকেনা নাইক্কা। এই সারা দিনে তিন চারশ বেচচি। কেমনে চলতাম। গেরামেই যাওয়া লাগব মনে হইতাছে’।

হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। দীপন বনরুটি আর চা দ্রুত খেয়ে বাসায় দৌড় দিলো।

ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ বিছানায় পায়চারি করার পর টিভিটা অন করলো। বিবিসিতে তখন রাতের প্রাইমটাইম নিউজ চলছে। খবরের কয়েকটি শিরোনাম দেখেই টিভি আর দেখতে ইচ্ছে হলো না। আবার বিছানায়। লাইট অফ করে হোয়াটসঅ্যাপে নোটিফিকেশগুলো চেক করা শুরু করলো দীপন। মেজাজ চরম খারাপ। অফিসে বস মেসেজ দিয়ে রেখেছেন
-‘দীপন, কাল একটু তাড়াতাড়ি চলে আসবেন। এমডি স্যারের সঙ্গে মিটিং আছে।’
দীপন কোনো রিপ্লাই না দিয়ে ডরোথিকে ফোন দিলো।
-হ্যালো ডরোথি, কোথায় আছ?
-এই তো বাসায় ফিরছি।
-এখনো বাসায় পৌঁছাওনি?
-আজ একটু দেরি হয়ে গেলো। লকডাউন। গাড়ি পাওয়া যায় না। কলিগের গাড়িতে যাচ্ছি বাসায়।
-ও, গুড গুড।
-ঠিক আছে, যাও। বাসায় গিয়ে ফোন দিও।
-ওকে, বাই।

তিন.
এমডি স্যারের সঙ্গে মিটিং শেষ করে লাঞ্চ করতে করতে বিকেল চারটা বেজে গেলো। আজ আর অফিসে অন্যকোনো কাজ করতে ইচ্ছে করছে না। বসকে বলল
-স্যার, আজ একটু তাড়াতাড়ি যেতে চাচ্ছি।
-ওকে।

অফিস থেকে বের হয়ে রমিজ চাচার দোকানে গেল।
-ওই চাচা, কি খবর? চিনি ছাড়া দুধ চা দাও। চায়ের পাতি একটু কড়া করে দিও।
-ঠিক আছে মামা।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। জিন্সের পেন্টের পকেট থেকে বের করতেই দেখে ডরোথির ম্যাসেজ।
-‘দীপন সন্ধ্যায় ড্রিম পার্কে পসিবল হলে চলে এসো। কথা আছে’।

তখন ঠিক সন্ধ্যার পর। চারদিকে নীরব। আবহাওয়া বেশ গরম। দীপন চলে এলো পার্কে। পার্কের ছোট্ট রেস্টুরেন্টে একটা অংশ খোলা। লকডাউনের কারণে সীমিত পরিসরে চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এমনিতেই করোনার ভয়ে লোকজনও কম আসে। করোনার আগের সবসময় জমজমাট থাকত এই রেস্টুরেন্ট। বিশেষ করে লুচি আর গরুর চাপ এই রেস্টেুরেন্টের জনপ্রিয় আইটেম। ডরোথি প্রায়ই খেতে চলে আসে এখানে। আজও এসেছে। ওরা মুখোমুখি বসল। খাবার অর্ডার দিলো। এরই মধ্যে ফোন এলো দীপনের। ফোন রিসিভ না করেই ডরোথির সঙ্গে কথা বলা শুরু করলো।
-দীপন বলল,আজ মনটা এত খারাপ।
-ডরোথি জিজ্ঞেস করল, কেন?
-যখন আসতেছিলাম, রিকশায় উঠার আগে পাশে আরেকটি রিকশা। ওই রিকশার ড্রাইভারকে দেখলাম, মুখটা মলিন, বিষণ্ন মনে রিকশার সিটে বসে আছে। তাকে দেখে এত খারাপ লাগল, ভুলতে পারছি না। আসার পর মনে হলো তাকে কিছুটা হেল্প করলাম না কেন!!।
-ও, ঠিক, ওদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। আসলে করোনা সবকিছু বদলে দিয়েছে। মানুষের জীবনধারাও বদলে গেছে। কফি খাবা?
-খেতে ইচ্ছে করছে না।
-আর কি খবর বলো।
-কোনো খবর নাই। অফিসের কাজের চাপে চেপ্টা।
-আরে ধুর! তোমার শুধু অফিস অফিস..। চাকরিটা চেঞ্জ করো।
-এই প্যান্ডামিক অবস্থায় কোথায় চাকরি পাব বলো? এখানে কষ্ট হলেও ভালো আছি। সেলারি নিয়মিত পাচ্ছি। তোমরা তো হোম অফিস করছো। আরামে আছ। আমার প্রতিদিন অফিস করা লাগে।
-বুঝলাম।
-বিয়ে কবে করবা? এভাবে আর কত ?
-ধুর! বিয়ে। পত্রিকায় দেখছো না, করোনার সময় বিয়েশাদি, বাচ্চা না নেওয়ার জন্য রিপোর্ট বের হচ্ছে। করোনার ঝুঁকি।
-তুমি বিয়ে করছো না কেন? শুধু আমাকে বলো। তুমিও করে ফেলো। হা হা হা।
এ সময় রেস্টুরেন্ট কর্মচারী এসে বলল, ‘স্যার, আমাদের সময়সীমা বেধে দেওয়া। দ্রুত শেষ করলে ভালো হয়। ধন্যবাদ স্যার’। দীপন ঘড়ির দিকে তাকাল, তখন সময় রাত আটটা। ওরা বের হয়ে এলো।

চার.
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে সরাসরি কিচেনে ঢুকলো দীপন। এক মগ রং চা বানিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে টিভিটা অন করলো। সিএনএন চ্যানেলে খবরে দেখােেচ্ছ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন শীথিল হচ্ছে। যুক্তরাজ্য সরকার আগামী দুই মাস পরই কোভিড মুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা দেবে। খবরটা শোনেই দাঁড়িয়ে গেলো দীপন। কোভিডের কারণে গত বছর লন্ডন যেতে পারেনি। ডরোথির সঙ্গে লন্ডনে একমাসের ট্যুর ছিল। লকডাউন আস্তে আস্তে উঠে গেলে এবার যাওয়া যাবে। চা খাওয়া শেষ করেই ডরোথিকে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠাল এই খবরটি। বাইরে তখন বাতাস বইছে। বিদ্যুৎ চলে গেলো। দীপন জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

সুন্দর সকাল। আবহাওয়া দারুণ। রোদটা বেশ মিষ্টি। আকাশে সাদা মেঘ উড়ছে। আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে দীপনের। সকাল দশটায় এমডি স্যারের একটা কাজ করার কথা ছিল। যখন ঘুম থেকে ঘুম থেকে উঠেছে তখন অলরেডি পৌনে দশটা বাজে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে দীপন ছুটলো অফিসের উদ্দেশে।

ক্রিং.. ক্রিং.. ক্রিং..।
-হ্যালো দীপন তুমি কই?
-স্যার, আসছি। পথে।
-ওকে, দ্রুত আস।
-ওকে স্যার। ডোন্ট ওরি।
আবারও ফোন। রিসিভ করতেই ডরোথির কণ্ঠ।
-আজ সন্ধ্যায় পার্কে এসো। লন্ডন ট্যুারের প্ল্যানটা এগিয়ে নিতে হবে। লকডাউন শীথিল হচ্ছে। বিমান চলাচলও শুরু হয়ে যাবে।
-কথাগুলো শুধু শুনল দীপন। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। এর মধ্যে এখন ডরোথির এসব মোটেও মাথায় নিচ্ছে না দীপন। ওকে বলে ফোনটা কেটে দিল দীপন।

পাঁচ.
প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ। একটু দেরির জন্য স্যার এভাবে বকাবকি করবে,বিষয়টি দীপনকে খুবই মর্মাহত করেছে। কিন্তু কি করার। করোনা মহামারি যা অবস্থা করেছে তাতে হাজার গালি দিলেও হজম করা ছাড়া উপায় নেই। সন্ধ্যার পর অফিস থেকে বের হয়ে ফোন দিল ইশরাতকে। স্কুল বন্ধু ইশরাত। এখন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ম্যানেজার। যখনই বিষণ্ন লাগে, সে সময় ইশরাতের সঙ্গে কথা বলে দীপন। ওর মোটিভেশনাল স্পিচে দীপন হালকা হয়ে যায় মন খারাপের সময়ে। দীপনের জীবনটা স্রােতের প্রতিকূলে প্রবাহমান নদীর মতো। নদী বললে অবশ্য কম বলা হবে, বলা যায় সমুদ্র। ছোটবেলায় মা বাবাকে হারিয়ে বড় হয়েছে চাচার কাছে। কলেজ জীবন কেটেছে লজিং বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হোস্টেলে থাকলেও চরম কষ্টে অনার্স লাইফ কেটেছে। এই সময়গুলোতে পাশে থেকে সবকিছু আগলে রেখেছে ইশরাত। তা না হলে আজকের দীপন হয়ে উঠা সম্ভব হতো না। ইশরাতের এই সহযোগিতা দীপন কখনো ভুলে যায়নি। এখনো জীবনের সবচেয়ে আপন যে।
-তুমি কোথায়?
-পাঁচ মিনিট পর তোমাকে ফোন দিচ্ছি। অফিস থেকে বের হবো। একটু বিজি।
-ওকে। আমি আসছি..।
-ওকে।

শরীর হঠাৎ খারাপ লাগছে। ইশরাতকে মেসেজ পাঠালো
-‘আজ আসছি না। শরীর খুবই খারাপ।’
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাসার উদ্দেশে চললো দীপন। রাস্তা ফাঁকা। রিকশা চলছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে তখন রাত। রিকশা যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।