ক্ষুধা ॥ রোখসানা ইয়াসমিন মণি


মেয়েটা গাছের ছায়ায় দাঁড়ালো।ছোট একটা ব্যাগ হাতে রাখা।ওখান থেকে রুমালের মতো একটি কাপড় বের করে মুখ মুছলো।মেয়েটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।তার মাথা একটু হেলে আছে। অর্পি ঠিকমত তার মুখদেখতে পাচ্ছে না।তবে সে এদিক সেদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। কদিন থেকে গরম পড়ছে খুব।বোশেখ প্রায় শেষ হতে চললো।অথচ ঝড়বৃষ্টি নেই।

বোশেখ মাস এলে আকাশ কালো করা কালবৈশাখির রূদ্র আচরণে সবাই ভীত হয়ে পড়ে। অথচ মাসটি প্রায় শেষ। না আছে ঝড় না আছে বৃষ্টি।

অর্পি একটি ফুড বেভারেজ কোম্পানিতে জব করে।ওদের কোম্পানি হোল সেলার।সে এখানকার অ্যাকাউন্টেন্ট।সারাদিন কত বস্তা খাদ্যশস্য বিভিন্ন এজেন্সিকে সাপ্লাই করা হয় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখতে হয় তাকে।

ইদানীং নতুন আরেকটি ডিমান্ড জুটেছে।টিসিবি কর্তৃক সরকারকে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা।মাঝে মাঝে সরকার তাদের গোডাউন ইউজ করে।সরকারের খাদ্যশস্য মজুত রাখার জন্য। ইদানীং সরকার মজুতের পরিবর্তে তাদের থেকে খাদ্য কিনছে।টিসিবি এসব খাদ্য ভর্তুকি দিয়ে জনগণকে কমমূল্যে দিচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর অর্পির অফিস বন্ধ হবে।একটু তারাহুড়োর মধ্যে যাচ্ছে সে।আজ টিসিবির অনেক বড় সরবরাহ আছে।এগুলোর দ্রুত হিসেব সারতে হবে। এগুলো শেষ হলেই আজকের জন্য কাজ শেষ।তারওপর টিসিবি ওদের গোডাউন থেকে পূর্বের সাপ্লাই নিতে পারেনি।লকডাউনের জন্য।এখন ওগুলো খালাস হলে এগুলো বের করতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহ লকডাউনের কারণে কাজে স্থবিরতা এসেছিলো। কোন গতি নেই।এখনও লকডাউন।তবে আজ গোডাউন থেকে পুরনো মাল বের করতে না পারলে ওদের নতুন চালানের এলসি আটকে থাকবে।

টিসিবি যেদিন চাল ডাল তেল আটা নুন পেঁয়াজের জন্য গাড়ি নিয়ে আসে তখন বাইরে মানুষের ভিড় হতে থাকে।ওরা চায় গোডাউন থেকেই এসব নিয়ে যেতে । দূর দুরান্ত থেকে মানুষেরা ব্যাগ,বস্তা নিয়ে চলে আসে।তার আগে গাড়িতে মাল না ওঠা পর্যন্ত কোন মানুষকে আশেপাশে দেখা যায় না।

যখন খাদ্যশস্যে গাড়ি মজুত হয়ে যায় আর গোডাউন ছেড়ে কিছুদূর এগিয়ে যায় তখন কোথাথেকে এত মানুষ আসে! অনেকটা রেলজংশনের মত।রেলগাড়ি না আসা পর্যন্ত প্লাটফর্মে কাউকে দেখা যায় না।যেই না গাড়ি হুইসেল বাজাতে বাজাতে প্লাটফর্মে ঢুকে অমনি মাটি ফেটে, পাতাল ফুঁড়ে মানুষের দল পিঁপড়ের মত জংশনে ছুটতে থাকে। ট্রেন ধরার জন্য।অথচ এর আগে এই মানুষগুলো কই থাকে?

অর্পির কাজ শেষ হয়।সে ওঠে। নিচে নামতেই টিসিবির গাড়ির শব্দ। তার আগে চারটি গাড়ি চলে গেছে খাদ্য বোঝাই করে।এতক্ষণ ওদের গোডাউনের সামনে মানুষের আনাগোনা ছিলো না।এখন প্রচুর মানুষ।খাদ্যশস্য বোঝাই হবার আগেই মানুষের লাইন।

ওরা একেকজন একেকজনকে ঠেলেঠুলে ধাক্কাধাক্কি করে সামনে যাবার চেষ্টা করছে।কার আগে কে নেবে এই প্রতিযোগিতা। যে ছেলেগুলো বস্তা গুনে গুনে ট্রাকে তুলছে ওদের বৃথা চিৎকারে মাথা ঠিক রাখার জো নেই। একটি ছেলে বলছে, এই আপনারা দূরে যান।সরে দাঁড়ান।নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন।এখন করোনা।দূরে যান,দূরে যান।মুখের মাস্ক কই? যাদের মাস্ক নাই তারা কিছু পাবেন না বলছি।

লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। ঠেলাঠেলি চাপাচাপিতে বুঝার জো নেই পৃথিবীতে করোনা আছে।এ এক কঠিন যুদ্ধ।অর্পি যুদ্ধরত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।প্রতিটি মানুষগুলোর এক আর্তি।খাদ্য দাও। অর্পি লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো দেখে।আহারে!

কতরকমের মানুষ? সস্তায় চাল ডালের জন্য সেই কখন থেকে ওরা অপেক্ষা করছে, কার আগে কে সামনে দাঁড়াবে তারই প্রতিযোগিতা চলছে।এই লাইনের ভেতর সে কিছু পুরুষকে দেখতে পেলো, মুখ ঢেকে রেখেছে। কিছু মহিলারাও শাড়ি ওড়নার ভাঁজে নিজের মুখ আড়াল করে আছে।কিছু আছে ঢাকাঢাকির তোয়াক্কা নাই।লাইনে থেকে চাল ডাল পেতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে বিতরণকারীদের বকছে।কিছুক্ষণবাদে চাল ডাল বিতরণ শুরু হলো।যে ছেলে এসব বিতরণ করে তারসাথে একজন মহিলার বচসা লেগে গেলো।মহিলার মাস্ক নেই।এখন সে এই মহিলাকে এসব দেবে না।তার একটাই জবাব।বিতরণের আগে সে এনাউন্স করেছে।এখন তার যে কথা সেই কাজ।

মহিলাও কম যায় না।সে বলছে,বাবা মাস্ক নাই বইল্যা চাইল ডাউল দিতাসো না।করুনায় ধরবো কইরা? বাজিরে,তার আগেরথন আমার পেটে রাক্ষইস্যা খিদা হান্দাইয়া গেছে।এইটারে দৌড়াইয়া দিতে পারবি? এইটারে যদি খেদাইতে পারস আমি আর কোনোদিন তর সামনে আসুম না! তুই করোনারে ডরাস ক্যান? তোরে ধরবো?ওরে ব্যাটা, যার পেটে এমুন ক্ষুধা হেতেরে করোনাও ডরায় বুঝলি? করোনা আমার গতরে ঢুইক্কা আমার ফুসফুসটারে টোকাইয়া পাইবো না। ক্ষুধায় আমার কলিজা ফুসফুস চিমাইয়া গ্যাছে বুঝছোস? এহন দে,যা দিবার দে।তোর টেকা তোরে বুজাইয়া বাইত যাই।আর খারাইয়া থাকবার পারি না।

অর্পির বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস আসে।খিদা আর করোনার কাছে মানুষ কত অসহায়! ক্ষুধার্ত মানুষগুলো জ্বালা বোঝে। ক্ষুধার সাথেই ওদের যত সংগ্রাম।ওরা করোনা চেনে না।বোঝে না।ওরা জানে লড়াই শুধু একটির সাথে আর সেটি হলো ক্ষুধা।এই লকডাউন ওদের কর্মহীন আর বেকার করে দিয়েছে।এখন পারলে ওরা একটা টাকা বাঁচিয়ে চলতে চায়।কিন্তু ওই এক টাকা যে বাঁচাবে ওটাই বা আসে কোত্থেকে? টাকা আয় করা কি সহজ কাজ?

অর্পি ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যায়।এগিয়ে যেতেই ওর বুক ছ্যাঁত করে ওঠে।হঠাৎ একটু আগে দেখা সেই মেয়েটি।ক্লান্ত শ্রান্ত ঘামে ভেজা মুখ আড়ালে ছিলো বলে চিনতে পারেনি। মুখে শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।ও যেভাবে আঁচলে মুখ ঢেকে আছে অর্পির চেনার কথা না।তবুও সে চিনে ফেলেছে।বহুদিনের পরিচিত মুখ বলে কথা।চোখাচোখি হতেই মেয়েটি মাথা নিচু করে ফেললো।অর্পি কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না।ওর কাছে যাবে নাকি পিছিয়ে আসবে বুঝতে পারছে না।যাব যাবো না করতে করতে অবশেষে সে এগিয়েই গেলো।গিয়ে মেয়েটিকে ঝাটকা দিয়ে বললো,আপনি আরজু ম্যাডাম না? এখানে কেনো? মেয়েটি থতমত খেয়ে অর্পির হাত চেপে ধরে বল্লো,প্লিজ, আপা কাউকে বলবেন না।না পারতে লাইনে দাঁড়িয়েছি।আর পারছি না।

সংসার অচল হয়ে গেছে।আপনার ভাইয়ের চাকরি নেই।কোম্পানির চাকরি।লকডাউনে ওদের কোম্পানি লাটে উঠেছে।আমার কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে।কয়েকটা টিউশনি করে কোনমতে বেঁচে আছি।যে কটা টাকা পাই আমরা দুবোন আর ভাইটি এসে লাইনে দাঁড়াই।সস্তায় তিনজনে যা পাই তাতে টেনেটুনে মাস চলে। আজ ভাই আসতে পারেনি।তাকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি, কিছুদিনের জন্য। স্কুল কলেজ বন্ধ। এখন গ্রামে ধানকাটা শুরু হয়েছে শুনেছি।ওকে বলেছি, পড়ালেখা করতে হবে না।গ্রামে গিয়ে ধান কেটে কিছু পয়সা নিয়ে আসো।তাতে কিছুদিন বাঁচা যাবে।ভাই আমার কখনো ধান কাটেনি।কি করছে কে জানে? আপা,পেট যদি লাজ শরম চিনতো? পেটের শরম নাই,আমার শরম আসে কই থেকে? যতবার এখানে আসি, মুখ ঢেকে রাখি।কেউ যেন না দেখে। আজ ঠিকই আপনি দেখে ফেলেছেন।আপা, আল্লাহর দোহাই লাগে কাউকে কিছু বলবেন না।এমন যে অবস্থা! না পারি ভিক্ষা করতে,না পারি এখানে লাইনে আর দশজনের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে, কি শরমগো আপা,কি শরম! কারে বলি?

অর্পি, আরজুর হাত ধরে রাখে কিছুক্ষণ। তারপর ওদের লাইন সামনে একটু একটু করে এগোচ্ছে বলে অর্পি আরজুর হাত ছেড়ে দেয়।অর্পি,আরজুকে বলে, আপা,আপনি নিশ্চিত থাকুন।কেউ জানবে না।আপনার মত আরো বহু মানুষ এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।আর আপনিতো ভিক্ষা নিচ্ছেন না।ত্রাণও না।আপনি কিনে নিচ্ছেন।আপনার টাকা দিয়ে আপনি খাদ্য কিনে নিচ্ছেন।এতে লজ্জার কি আছে?

আরজু এটা শুনে বলে,আপাকি বলেন? আমাদের পরিবারের কোন মেয়ে আজ পর্যন্ত এভাবে ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি করে খাবার কিনে নাই।দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এসেছি।আজ ক্ষুধা আমাদের কোথায় দাঁড় করালো।হয়তো সামনে আর টাকা থাকবে না।তখন পেট বাঁচাতে ত্রাণের জন্য আসতে হয়নাকি ভিক্ষে করতে হয়, কে জানে? কি আছে কপালে তা ভেবে এখনই মরে যাই।আপা,জীবন বড় বেদনাদায়ক। অর্পি এবার কি বলবে, কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না।তবুও স্বান্ত্বনার জন্য বললো,আপা ভাববেন না।এরকম দিন থাকবে না।একদিন সব আগের মতো হয়ে যাবে।একটু ধৈর্য ধরুন।আরজু,আঁচলের কাপড় দিয়ে আরো কষে কপাল ঢেকে বললো,আপা তাই যেনো হয়।

অর্পি রাস্তায় চলে আসে।তার হয়ত চাকরি আছে।এজন্য সবাই ভাবে তার দিন ভালোমত যাচ্ছে। কিন্তু আরজুর মত তারও কেউ না কেউ আজ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।সস্তায় খাদ্যদ্রব্য কিনার জন্য ।এই লাইনে অর্পি দাঁড়ায়নি বলে কেউ জানে না, আরজুর মত তারও শরম আছে।সেও তার মুখটি ঢেকে রাখতে পারত।আজ অর্পির মুখ ঢেকে নেই।কিন্তু আরজুর থেকে আরো পাঁচছয়জন পেছনে খালি ব্যাগ বস্তা নিয়ে তার দুইভাইবোন মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে।অর্পি রাতেই ওদের টাকা দিয়ে এসেছে।আজ অর্পি আরজুর হাত ধরে স্বান্ত্বনা দিয়ে এসেছে।অথচ এই হাতগুলো যেনো ওর ভাইবোনেরই হাত।আরজু যদি জানতো,তার মতো অর্পিও ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছে।