‘আমার জীবনে অনেক বৈচিত্র্য আছে যেটা নিয়ে লেখা যেতে পারে’


বিতস্তা ঘোষাল কবি, গল্পকার ও অনুবাদক। জন্ম ৫ জানুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। ইতিহাসে এম এ, লাইব্রেরি সায়েন্সে বিলিস। কলেজে সাময়িক অধ্যাপনা। অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’-র সম্পাদক। ভাষা সংসদের কর্ণধার। ‘বাংলা আকাডেমি’, ‘একান্তর কথা সাহিত্যিক’, ‘চলন্তিকা’ পুরস্কারপ্রাপ্ত। বিতস্তার প্রকাশিত বই ২৭টি। তাঁর কবিতা হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া ও ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। তার প্যাশন নাচ। মনিপুরী, লোকনৃত্য ও রবীন্দ্রনৃত্যর জন্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের অনুষ্ঠানেও সম্মানিত। তার আত্মজীবনী ‘দশমশ্রেণির অকথিত কথামালা’ এবং অনুবাদ ‘মাই স্টোরি’ পাঠক মহলে খুবই প্রশংসা লাভ করেছে। যোগসূত্রের ঈদ আয়োজনে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুখেন্দু দাস।

সুখেন্দু: আপনাদের বাড়িতে সাহিত্য আলোচনা কেমন হতো?
বিতস্তা: আমাদের বাড়িতে বাবার সাহিত্যচর্চা নিয়ে কখনও তেমনভাবে আলোচনা হয়নি। বাবার কাছে যেসব সাহিত্যিকরা আসতেন তাদের বাবা যে নামে ডাকতেন সেই সূত্র ধরে আমরাও পরিচিত হতাম দাদা-কাকু-জেঠু বলে। এমনকি বাবাও তাদের সঙ্গে এভাবেই পরিচয় করাতেন, তোমার দাদা-কাকা-জ্যেঠু বলে। ফলে আমরা কোনোদিন জানতে পারিনি যে তিনি কোনও বিখ্যাত মানুষ বা সাহিত্যিক বা পলিটিশিয়ান বলে। তখন আমি পাঁচ-ছ বছরের।একবার আমাদের বাড়িতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত আর উৎপলকুমার বসু এসেছিলেন। আমাদের বাড়ির উপরে একটি ঠাকুরঘর ছিল।অতিথিরা সেখানেই আসতেন। আমরা একতলার একটি ঘরে থাকতাম। বাবা চা দেওয়ার জন্য ডাক দিলেন। সেদিন আমি চা নিয়ে গেছিলাম।তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমি চিনতাম না।তখনকার দিনের পত্র-পত্রিকাতে সাহিত্যিকদের ছবি দেওয়া থাকতো না।

বাবা প্রণাম করতে বললেন, আমি প্রণাম করলাম। তিনি নাম জিজ্ঞেস করলেন, আমি নাম বললাম। সুনীলমামা জিজ্ঞেস করলেন- লিখিস নাকি? আমি বললাম-না।বললেন, সারাদিন কি করিস? আমি বললাম, পড়াশুনা করি, খেলাধুলা করি আর নাচ করি। তিনি বললেন, খেলাধুলা করতে পারাটা খুব ভালো, কিন্তু এখনতো আমি আর পারি না। আমার কী মনে হল বললাম, খেলবে তুমি? বাবা ইশারায় চলে যেতে বললেন। কিন্তু সুনীল মামা বললেন, একটু বড় হয়ে যা, তারপর খেলবো। তিনি যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এটা আমার জানাই ছিল না। পরে যখন একটু বড় হলাম (তৃতীয়-চতুর্থ শ্ৰেণিতে পড়ি তখন), দেশে পড়ছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্ভবত পূর্ব-পশ্চিম, মা এসে বললেন এটা তোমার পরীক্ষায় আসবে না।আরও একটু বড় হয়েছি, ক্লাস সেভেনে পড়ি, বাবা তখন সব জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতেন।

ত্রিভোলি পার্কে বেগবাগানের একটি বাড়িতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা দেওয়া হবে, তখনকার দিনে টিপ মালা ইত্যাদি পরিয়ে দেওয়ার জন্য বাচ্চাদের দরকার হতো, আমি ওকে মালা পরিয়ে সংবর্ধনা জানাতে গেছি, তাকে দেখে হেসেই মরে যাই, এ আবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হল কী করে! কিছুদিন আগেই তো খেলার কথা হচ্ছিল! ওকে দেখে বলেই ফেললাম, তুমি তো আচ্ছা লোক, কিছুদিন আগে বলল, খেলতে আসবে, তারপর খেলতেই এলে না …আবার অনুবাদ পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে যিনি আছেন, সেই অন্নদাশঙ্কর রায় আমাদের খুব কাছের একজন ছিলেন। তাঁর স্ত্রী লীলা রায় আমাকে ঝিনুক বাটিতে করে দুধ খাইয়েছেন।

আমার মাও তাঁদের বাড়িতে প্রায়ই যেতেন, কিন্তু দীর্ঘদিন আমি জানতাম না যে, তিনিই অন্নদাশঙ্কর রায়। এরকমই আমাদের বাড়িতে প্রণব মুখোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও আসতেন।ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন আমার ঠাকুরদার ক্লাসমেট বিশ্বভারতীতে। কিন্তু এদের নিয়ে আলাদা কোনো আলোচনা বা গুরূত্ব আমাদ্দ্র বাড়িতে ছিল না। অনেক পরে যখন কঙ্কাবতীদির মাধ্যমে অম্লান দত্ত, শিবনারায়ণ রায়,শঙ্খ ঘোষ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুনীল মামা, উৎপল কুমার বসু, দিব্যেন্দু জ্যেঠু, প্রমুখর সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিত হয়েছি।

সুখেন্দু: অনুবাদ পত্রিকার সম্পাদক বা ব্যক্তি বৈশম্পায়ন ঘোষাল–তাঁকে কীভাবে দেখেছেন?
বিতস্তা: অনুবাদ পত্রিকার সম্পাদক বৈশম্পায়ন ঘোষাল এটা দীর্ঘদিন জানতামই না,তবে বুঝতে পারতাম আমার বাবা কিছু একটা, কারণ প্রায়-দিনই আমাদের বাড়িতে বিভিন্ন অতিথি আসতেন লাল আলো নীল আলো লাগানো গাড়িতে চেপে। আমরা জানতাম আমার বাবা একটি স্কুলের শিক্ষক, সকাল দশটায় যেতেন, দুটোয় চলে আসতেন, তারপরে আবার অফিস আছে। এই অফিসটা কি অফিস সেটা অনেকদিন জানতাম না। ১৯৮১ সালে বাবা আনন্দ পুরস্কার পেলেন; সেই পুরস্কার পাচ্ছেন অনুবাদ পত্রিকার জন্য, অনেক সাংবাদিক এসেছেন ঘরে, সাংবাদিকরা কভারেজ নিচ্ছে, পাড়া-প্রতিবেশীরা আলাপ-আলোচনা করছেন, তখন বোঝা যাচ্ছে যে বাবা কিছু একটা করেছেন। কিন্তু তার আগে পর্যন্ত আমরা দুই বোন মিলে অনেক গবেষণা করেছি যে বাবা কী করেন? তখন ডাকাত বা ডিটেকটিভের বই পড়ছি-ভাবতাম বাবা কি এরকমই কিছু! বোন একদিন গম্ভীর মুখ করে বলল ডাকাতরা এত সুন্দর দেখতে হয় না। কিন্তু ডাকাতরা তন্ত্র-সাধনা করে, আমার বাবা রোজ সকালে তন্ত্র-সাধনা করেন, কালী সাধনা করেন। আবার বাবার সঙ্গে আমি শ্মশানে যেতাম। ফলে এই কনফিউশনগুলো ছিল। আসলে আমাদের কাছে বাবা বাবাই ছিল।

কিন্তু আনন্দ পুরস্কার লাভ করার পর থেকে অনেক কিছু পাল্টে গেল। বাবা তখন প্রচুর সেমিনার ওয়ার্কশপে যেতে থাকলেন; বাবার সঙ্গে আমাদের সময়টা অনেক কমে যেতে থাকল।এর মধ্যেই বাবা অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছেন, ফলে সিডিউল আরও টাইট হয়ে গেছিল। অনেক পরে বুঝতে পারি যে বাবার কাজটা শুধু সাহিত্য নিয়ে ছিল না বাবার মুল কাজটা ছিল সাংস্কৃতিক সংহতি এবং ঐক্য নিয়ে। ১৯৮৯-এর পর (ম্যাসিভ হাৰ্ট এটাক হয়েছিল) থেকেই বাবা অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিলেন, তখন কালিপদ কাকু(দাস) অফিসের দায়িত্ব সামলাতেন।

সুখেন্দু: আপনি হিন্দি বা অসমিয়া ভাষা কীভাবে শিখলেন?
বিতস্তা: আমি তো মণিপুরী নৃত্য করতাম।সেই সূত্রে আমাকে মণিপুরী ভাষা শিখতে হয়েছিল।তখন মণিপুরী লেখা বাংলা ভাষাতে হতো,এখন যদিও পাল্টে গেছে। কিন্তু উচ্চারণগুলো আলাদাই ছিল। একসময়ে গুরুজি আমাকে একটা রাধাকৃষ্ণের শ্লোককে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় লিখতে বলেছিলেন। আমি তো হিন্দি জানতাম না, মাকে বললাম, মা খুব ভালো হিন্দি জানতো। ভাষা সংসদ এনজিওর একটি প্রজেক্ট ছিল হিন্দি ভাষা শেখানো। ১৯৮৭-এ আমি তাতে যুক্ত হই। তখনকার সহসম্পাদক কালীপদকাকু এই শেখার রাস্তাটি আমাকে করে দিয়েছিলেন। রবিবার করে শ্যামনগরে একটা স্কুলে পড়তে যেতাম আর বাকিটা মা দেখিয়ে দিতেন।

পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা শিখেছি। সেখানে ট্রানশ্লেসনে অকাদেমি পুরস্কৃত ননী জেঠুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি আমাদের হিন্দিশিক্ষক ছিলেন। ননী জ্যেঠু অনুবাদ পত্রিকাতে প্রথম সংখ্যা থেকেই লেখালেখি করতেন। আমার বাবা বারবার বলতেন যে নিজের দেশকে জানতে গেলে অন্ততপক্ষে তিন-চারটে ভারতীয় ভাষা জানা উচিত। পরে ফোক ডান্সে বিহুর নাচে আমাকে অসমিয়া ভাষা শিখতে হয়েছে, প্রবাদপ্রতিম শিল্পী গুরু বটু পালের কথায়।তবে একটা ভাষাকে, তার সাহিত্যকে পুরোপুরি জানতে গেলে যতটা জানা উচিত আমি ততটা জানি না।পড়তে পারি। বলতে গেলে আটকে যায় অনভ্যাসের ফলে।

সুখেন্দু:আপনার লেখালেখি কীভাবে শুরু হলো?
বিতস্তা: আমার স্বপ্ন ছিল, আমি একজন নৃত্যশিল্পী হবে। প্রত্যেক বড় নৃত্য শিল্পীর একটি স্বপ্ন থাকে যে খাজুরাহতে নৃত্য করবে। খাজুরাহকে ধরা হয় নৃত্য শিল্পীদের একটি বড় মঞ্চ। আমারও সেরকমই একটি স্বপ্ন ছিল। তবে বাস্তবটা অন্য হয়েছে। আমার কম বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। আমার বরের (সনাতন)ও তখন একেবারেই অল্প বয়স, সে জোকা-তে আই-আই-এম-এ এম বি এ করতে চলে গেল, আমি এর মাঝখানে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলাম। তারপর এমএ-তে ফাস্ট ক্লাস থেকে পেলাম ৫ নম্বর কম। ওকে পড়াতে গিয়ে আমার নম্বর গেল কমে। ওর সেলসের কাজে ছিল অমানবিক পরিশ্রম- সকালে বের হতো, ফিরত সেই রাত বারোটায়। আমাকে বাবা রবীন্দ্রভারতী থেকে বিলিস (লাইব্রেরি সায়েন্স) পড়তে বলেছিলেন। কিন্তু আমার ঝোঁক ছিল জার্নালিজম নিয়ে পড়ার (বাবার অমতে)। পরে দুটো নিয়ে কিছুদিন ক্লাস করেছিলাম। বাবা জানতে পেরেছিল-তাই জার্নালিজম আর পড়া হলো না। অন্ধ্র ইউনিভারসিটিতে ইন্টার্নসিপে গেলাম। বাড়ি এসে জানতে পারলাম ও চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। বাবা, ওকে ‘ল’ পড়তে বলল।সে তাই পড়ল।

তার মাঝে আমি কনসিভ করলাম। বিয়ের আগে থেকে আমার মণিপুরী নৃত্যশিল্পী হিসেবে নাম হয়েছে। কিন্তু বিয়ের পর সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। আমার বন্ধুরা একে একে বিভিন্ন কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে গেল। ফলে আমি সদ্য সন্তান নিয়ে কিছুটা ডিপ্রেসেনে চলে গেলাম।আমার বরাবরই ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। তখন একটা অফার এলো একটা কলেজে পড়ানোর (২০০৪), অনেক দূর ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছি। আমার তখন একটু খোলা-হাওয়ার দরকার ছিল, আমি কাউকে না-জানিয়ে চাকরিতে যুক্ত হলাম।

এর মাঝের যে ডিপ্রেশন ছিল তা কাটানোর জন্যই আমি ডায়েরি লিখতে শুরু করলাম। প্রতিদিনের কথা বাদেও অনেক জীবন্ত চরিত্রই আমার নজরে আসত। (যেমন ফুলমতি, তাঁর স্বামী অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়)। একদিন সনাতন এসে বললো, তোমার তো দেখছি অনেকগুলো ডায়েরি ভরে গেল।
আমি বললাম- তুমি কি করে দেখলে?
– ওই মা বলে, তুমি দিন রাতই লেখ। আমি তিতিরদিকে (কঙ্কাবতী দত্ত) বলেছি, মনা (বিতস্তা) কী সব লেখ্ একটু দেখে দেবেন তো? মনা তো আর আমাকে দেখাবে না… তাই তিতিরদি বলেছে তোমাকে ডায়েরি নিয়ে দেখা করতে।
আমি খুব উৎসাহ নিয়ে চলে গেলাম কঙ্কাবতীদির কাছে দেখা করতে। তিনি চাইলেন, আমি রেখে এলাম। পুজোর আগে মালিনী পত্রিকার সম্পাদক মায়াদি আমাকে জানালেন যে, কঙ্কাবতীদি কাছ থেকে নিয়ে আমার গল্প ছাপতে চান। প্রণবানন্দ ব্রহ্মচারী মহারাজের আশ্রমের শারদীয়া ‘আশ্রম সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকাতে। যেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও লেখেন। ২০০৪-এ সেখানেই প্রকাশিত হয় ‘ফুলমতির আত্মকথা’।এটা একটি জীবন্ত ঘটনা-কলেজ স্ট্রিটে রাজাদার কাছে জানতে পেরেছিলাম। পরের লেখাটা সান্ধ্য ‘প্রতিদিন’-এ প্রকাশ পেয়েছিল।

এর আগে ২০০৩-তে সনাতন অনুবাদ পত্রিকার অফিসের একদিকে চেম্বার করল। ২০০৩-এ আমি সেই অফিসে এলাম (তার আগে একবার এসেছিলাম যখন ওর সঙ্গে প্রেম করতাম)। সনাতন আমাকে পত্রিকার ঘরের চাবি খুলে বলেছিল, তুমি এতদিন অহঙ্কার করতে যে যেখানে যাও বাবার বিশাল ক্ষমতা দেখতে পাও, গাড়ি ছাড়া কোথাও ঘোরনি, যার জন্য এতকিছু, আজ দেখো তার কি অবস্থা। কোথাও গিয়ে কথাটা ধাক্কা দিয়েছিল আমার। খুব কষ্ট হলো। বাবাকে গিয়ে বললাম, কিন্তু বাবা রাজি ছিলেন না। কারণ তখন পত্রিকা অনেকটাই তার পুরনো গৌরব থেকে পিছিয়ে গেছিল। আমি এই চ্যালেঞ্জটা নিলাম। প্রথমে আমি অ্যাডভারটাইজমেন্টের, ও বিপণনের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। তার সঙ্গে প্যাপিরাসের অরিজিতকাকুর কাছ থেকে পত্রিকার পেজমেকার পেজ সেটআপ ইত্যাদি শিখেছিলাম।লেখালিখি,অনুবাদ এসবও চলছিল। ২০১০ সাল থেকে পুরোপুরি সম্পাদনার দায়িত্ব নিলাম।

সুখেন্দু: লেখালেখি সূচনার পর আপনি কি ঠিক করলে এবার সাহিত্যকর্মের সূচনা করা যাক?
বিতস্তা: কঙ্কাবতীদির উৎসাহে আমার গল্প বের হয়। তবে এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ২০০৮ এ গল্প-সংকলন বের হল। এর আগে ‘কেতকী’ পত্রিকার মহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায় রীতিমত জোরজবস্তি আমাকে দিয়ে কবিতা লেখাতে শুরু করলেন। অশোক রায়চৌধুরি ‘কফি হাউস’ বলে একটি পত্রিকা করতেন, তিনি জোর করে আমাকে দিয়ে অণুগল্প লেখাতে শুরু করলেন। সেখান থেকে সিটিভিএন চ্যানেলে আমার একটি গল্প সেরা গল্পের পুরস্কার পেল। সতীনাথ মুখোপাধ্যায় সে গল্প পাঠ করলেন স্টুডিওতে। ২০০৬ সালে মায়াদি বললেন, আমি ‘মালিনী’ পত্রিকা বের করবো, তোর একটা উপন্যাস চাই।তখন আমার কলেজেও পড়ানোর চাপ। আবার সরকারের একটি প্রজেক্টের (২০০৫-২০০৮) সঙ্গে যুক্ত-গ্রামে গ্রামে কম্পিউটার বসানোর প্রজেক্ট। তখন আমার মনে হলো, আমি তো অনেক জার্নি করি, সেটাই একটা উপন্যাসের রূপ নিতে পারে।লেখা হলো‘ঝিলাম একটি নদীর নাম’।

পত্রিকা উদ্বোধনের দিনে অনেক সাহিত্যিক এসেছেন। সেদিন সুনীল মামা আমার নাম দেখে জানতে চেয়েছিলেন-এই মেয়েটি কে যে লিখেছে- ঝিলাম একটি নদীর নাম; মায়াদি তখন বললেন, সুনীলদা একদম অন্যরকম উপন্যাস, নারাণদাকে (তাঁর স্বামী) পড়তে দিয়েছিলাম, সেও জানিয়েছেন। সুনীলমামা জানতে চাইলেন, বিতস্তা মেয়েটি কে? সুনীলমামা কিন্তু আমাকে চেনেন। কঙ্কাবতীদির বাড়িতেও অনেকবার দেখা হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তি বিতস্তার সঙ্গে লেখিকা বিতস্তাকে হয়ত মেলাতে পারছেন না। পরে আমাকে ডাকা হল। সুনীলমামা আমাকে দেখে বললো, এ আবার লেখিকা কবে থেকে হল?সেটা খুব মজার ঘটনা ছিল।

সুখেন্দু: ‘একা এবং রঙিন হলুদ বিকেলের গল্প’ কীভাবে শুরু হলো?
বিতস্তা: ‘একা’ গল্পটা ছিল বাবার সঙ্গে কাটোয়া হয়ে আজিমগঞ্জ ভ্রমণের কথা। এর সঙ্গে আরও পনেরোটা গল্প ছিল। আমি যা লিখতাম মা সেগুলো ডায়েরিতে কপি করে রাখতো। সেই ডায়েরির কপি প্যাপিরাসের অরিজিতকাকুকে দেখিয়েছিলাম। তারপর প্রায় ভুলেই গেছি।হঠাৎই কাকু জিজ্ঞেস করলেন, উৎসর্গ কাকে করবি? তিনিই গ্রন্থের নামটি দিয়েছেন। আমি অনেক ভেবে দেখলাম- আমার মা, মায়াদি আর কঙ্কাবতীদি ছাড়া আমার লেখা সম্ভবই হত না। তাই তাঁদেরই উৎসর্গ করলাম।প্রথম দিন দশকপি পেয়েছিলাম। আনন্দে আমার চোখ ভিজে গেছিল জলে।

সুখেন্দু: আপনার উপন্যাস নিয়ে কিছু বলেন?
বিতস্তা: আমার আত্মজীবনীকেন্দ্রিক রচনা ‘দশমশ্রেণির অকথিত কথামালা’। এর সম্পর্কে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম কমলা দাসের কাছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার জীবনে অনেক বৈচিত্র্য আছে যেটা নিয়ে লেখা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, লেখার কাছে সৎ থাকবে। আসলে গ্রাম, শহর, মফস্বল, বাবার অধ্যাত্ম, সাহিত্যের অনুষঙ্গ, বিস্তৃত পরিবার, আমার জীবনের নানা কাণ্ড কারখানা সব এর সঙ্গে যুক্ত। বাবা চলে যাবার পর আমি এটা লিখেছি–কিছুটা অবসাদে। শৈব্যাভারতীতে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও সম্পাদক জানিয়েছিলেন,তাদেরপত্রিকাতে প্রথম কোনো নারীর আত্মজীবনী প্রকাশিত হচ্ছে। আজকাল থেকে প্রস্তাব আসে বইটি করার। সত্যম রায়চৌধুরি স্যারের সঙ্গে আগেই পরিচয় হয়েছিল বিজ্ঞাপন আনতে গিয়ে। তাঁর উৎসাহে আজকাল থেকে এর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অনুবাদগ্রন্থ কমলা দাসের ‘রক্ষিতা ও অন্যান্য গল্প’।পরে আত্মজীবনী প্রকাশ পেল।

এর আগে আমার দুটো উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ‘ঘেরাটোপের নীল অতলে’ ও ‘ছিন্ন পালের কাছি’। দুটিই বের হয়েছিল প্যাপিরাস থেকে। এখনো অবধি আত্মজীবনী ও দুটি উপন্যাস–কালাপানীর নির্জনতা, নিমগ্ন এ প্রাণে(একান্তরে প্রকাশিত) বাদ দিয়ে সব উপন্যাসই প্রায় ‘মালিনী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে।তারপর গ্রন্থ হয়েছে। ‘একান্তর’ পত্রিকার অরূপদা (আচার্য) আমাকে দিয়ে নানান লেখা লিখিয়েছেন।বলতে গেলে আজ যে আমি সাহিত্যের সব শাখাতেই যাতায়াত করি এটা ওনার আমার উপর আস্থা রাখার ফল। কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রথম পুরস্কারও আমি একান্তর থেকেই পেয়েছি।এই প্রাপ্তি আমার কাছে সেই সময় নোবেল পুরস্কারের সমতূল্য মনে হয়েছিল।

সুখেন্দু: কমলা দাসের বিতর্কিত মাই স্টোরি অনুবাদের নেপথ্যকাহিনি কী ছিল?
বিতস্তা: মাই স্টোরি প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের চিত্রা প্রকাশনীতে। ২০১০ সালের প্রথমদিকে কমলা দাসের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।অনুবাদপত্রিকার বিজ্ঞাপনের জন্য সাহিত্য অকাদেমি-তে রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েছিলাম। রামকুমারদা আমার কথা শুনে বললেন, তুমি অনুবাদ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত অথচ অনুবাদ করো না, এটা আবার কেমন কথা হলো? তিনি আমাকে তিনজন সাহিত্যিকের নাম বলেছিলেন-কর্তার সিং দুগগল, কমলা দাস, ইন্দিরা রয়সম গোস্বামী। তিনি বলেছিলেন, এদের বইগুলো তোমার পড়া ও অনুবাদ করা উচিত। তিনি এদের ঠিকানাও আমাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলায় ইন্দিরা রয়সম গোস্বামীকে নিয়ে অনেক কাজ হয়েছিল। তাই তাকে নিয়ে আমি কাজ করতে চাইনি। অরিজিৎ কাকু আমাকে কর্তার সিং দুগগাল নিয়ে কাজ করতে বলেছিলে। একদিন দুজ্ঞল সাহেবকে ফোন করি। আমাদের পরিচয় হলো, তিনি আমাকে অনেকগুলো বই পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো থেকে কিছু গল্প অনুবাদ করে আমি ওকে পাঠিয়েছিলাম। ২০১১ তে সেগুলো বই হয়ে বের হয়।

দুগগলের পরে আমি হাত দিই কমলা দাস। কেন জানি না এই নামটা আমাকে খুব টানছিল। আমি ভেবেছিলাম দাস মানে বাঙালি, কিন্তু মালায়লাম লেখিকা এটা মাথাতে আসেনি। কোথাও একটা সফট মাইন্ডও ছিল,তাছাড়া রামকুমারদার থেকে ফোন নাম্বার ও মেল আইডি নিয়ে আমি ওনার সঙ্গে কথাও বলেছিলাম। তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন। আমি আমার বাবার পরিচয়, পত্রিকার নাম জানিয়েছিলাম। ফলে এক ঘণ্টার মধ্যেই আবার ফোন আসে। তিনি পরিষ্কার বাংলায় ভাঙা উচ্চারণে কথা বললেন, বাবার সম্পর্কে জানতে চাইলেন, কেমন আছেন, তারপর তিনি জানতে চাইলেন আমি কি চাই। আমি জানালাম যে তাঁর গ্রন্থের আমি অনুবাদ করতে চাই।তখন তিনি তিনটি বই পাঠালেন যেগুলো ইংরেজিতে তাঁর নিজের অনুবাদে করা। তার মধ্যে অন্যতম ছিল মাই স্টোরি।

অনুবাদ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল যে তাঁর সঙ্গে আমি খুব একাত্ম বোধ করছি; যেন তাঁর লেখার সমস্ত বক্তব্যগুলি আমার জানা। অনুবাদ খানিকটা শুরু করে আমি আবার ম্যাডামকে ফোন করি, তখন তিনি অসুস্থ। তাও অনুমতি পত্র পাঠিয়েছিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম আর অনুবাদ করব না।

এরপর একদিন জয়ঢাক পত্রিকার সম্পাদক ও লেখক দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য জানালেন, বাংলাদেশের অন্যতম লেখক সাযযাদ কাদির কমলা দাস সম্পর্কে খুব আগ্রহী, আমি তাঁকে তোমার কথা বলেছি। ক’দিনের মধ্যেই সাযযাদ কাদির দা (বাংলাদেশে আজ আমি যতটুকু পরিচিতি পেয়েছি সবটাই তাঁর জন্য) ফোন করেন এবং কমলা দাসের মাই স্টোরির পাণ্ডুলিপিটা চান, যা চিত্রা প্রকাশনীতে প্রকাশিত হবে। এটি ২০১৫ সালের কথা। তখন আমার মাত্র চারটি অধ্যায় হয়েছে, আবার তখন কমলা দাস মারাও গেছেন। ফলে ধ্বন্দে পড়লাম। অনেক মালায়লাম শব্দ নিয়েও আমার সমস্যা হত, বুঝতে পারতাম না। অবশেষে সেটির ২৭টি অধ্যায়ের অনুবাদ হল। যদিও উপন্যাসে ৫০টি অধ্যায় ছিল। তবে আমি ওই ২৭টি অধ্যায়েরই পারমিশন পেয়েছিলাম।২০১৬ তে চিত্রা প্রকাশনী থেকে মাই স্টোরি বেরোলো।

সুখেন্দু:আপনি প্রকাশনার দিকে কীভাবে এলেন?
বিতস্তা: আমি কখনোই ভাবিনি যে প্রকাশনা করব। বাবার প্রকাশনা সংস্থা নীল-সরস্বতী বাবার আসা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। অনুরাধাদি তখন পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি একটি বই বের করেছিলেন এবং প্রকাশনা সংস্থার নাম দিয়েছেন ভাষা সংসদ। তখন ভাষা সংসদ ছিল একটি এনজিও। সেটি দেখে আর একজন এলেন জেএনইউ-এর ইকনমিক্স-এর হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট সুভাষ বসু। তিনি আমাকে বললেন, তিনি একটি বই করতে চান আমাদের প্রকাশনা থেকে। আমাদের তো কোন প্রকাশনা সংস্থাই নেই। অতএব হবে না। কিন্তু তিনি শোনার পাত্র নন। পরে তিনি সমস্ত আয়োজন করে ভাষা সংসদকে প্রকাশনা করার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন। আমি জানালাম, যদি আপনার প্রকাশকের দরকার পড়ে তাহলে প্রকাশক আছে।

আমি প্যাপিরাসের কথা বললাম। তিনি শুনতে নারাজ। তার দুটি বই প্যাপিরাস প্রেস থেকে মুদ্রিত হলো, কিন্তু ভাষা সংসদের লোগো ব্যবহার করে, রীতিমতো ভাষা সংসদ প্রকাশনা সংস্থা হিসাবে। লোগো বানালেন অরিজিতকাকু। এরপর থেকেই ভাষা সংসদ এনজিও থেকে প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। আমরা বের করলাম আনন্দ ঘোষ হাজরার ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে’, সোমক দাসের ‘বাদুড়’, জগত দেবনাথের ‘সমিধা’, অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দশটি সেরা বিদেশি ছোটগল্প’ প্ৰভৃতি। প্রকাশক হিসেবে আমি লক্ষ্য করার চেষ্টা করি অনেক কম পয়সায় কীভাবে একটি বইকে সুন্দর ভাবে সকলের সামনে নিয়ে আসা যায়। নতুনদের গুরূত্ব দিই। রাইটারস রয়ালটির কথাও বলি। আমার মনে হয় প্রকাশক হিসেবে এটাই আমার ইউএসপি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর পরিচিতি
সুখেন্দু দাস। বর্তমানে চুঁচুড়ায় স্থায়ী বাসিন্দা। লেখালেখি করছেন ও ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। বর্তমানে অনুবাদ-চর্চা ও বাংলা পার্টিশন বিষয়ক কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।