সংসার ॥ কাজী লাবণ্য


-আম্মা! পানি গরম হইছে। সবকিছু রেডি করছি, বাবুর গোসলটা দিয়া দিবেন? সকাল সকাল উঠানে বড় গামলাতে পানি রোদে দেওয়া হয়। সুমনা মাঝে মাঝে আঙুল দিয়ে উষ্ণতা পরখ করে দেখে। বারোটা বেজে গেছে। দিনের গায়ে চনমনে রোদের ছটা। যার আলোয় চিলতে উঠোন ঝলমল করছে। পানিও গরম হয়ে গেছে।
-আচ্ছা, ঠিকাছে আসছি। সুমনার শাশুড়ি জবাব দেয়। জবাবে কি কিছুটা নির্লিপ্তভাব ছিল কি না সুমনা চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না। শাশুড়ি এসে বাবুকে কোলে নিয়ে, আদরের চুমু দিয়ে পেতে রাখা মোড়ায় বসে। নাতিকে নিজ হাঁটুর উপরে দক্ষ হাতে উপুড় করে নেয়। সাবান মাখা নরম কাপড়ে বাবুর তুলতুলে ছোট্ট শরীরটা আলতো ডলতে ডলতে বলে-
-শোন মা, ছয়মাস পার হয়া গেল। তুমি আইজও বাবুর গোসল শিখলা না! এই দেখ ভালো করি দেখি শিখি নেও। আমি নানান তাল বেতালে থাকি, সময় পাই না। তাছাড়া আমার এই কোমরের বিষ বেদনাটাও খুব বাড়ছে বাহে!

সুমনা কেবল শুনে যায়। উত্তর দেয়না। শাশুড়ির নানানতাল বেতাল যে কি নিয়ে তা কি আর সুমনা জানেনা! নাকি বোঝে না! বাবুর সুগন্ধি সাবানের মিষ্টি ঘ্রাণটাও আর ওর ভালো লাগে না।
গোসল শেষে বাবুকে নিয়ে সুমনা নিজেদের ঘরে আসে। বাবু দুধ পান করবে, করতে করতে ঘুমিয়ে পড়বে। ঘরে ঢুকল সুমনার স্বামী শাকিল। বাড়ির মেজো ছেলে। একটু আগে সে ঘুম থেকে উঠেছে। নাস্তা খেয়ে বাইরে গিয়েছিল, সুমনা জানে ধোঁয়া টানতে গিয়েছিল।
-তুমি বাবুর বিছানায় বসবা না। তোমার মুখে গন্ধ আছে। শাকিল কোন কথা না বলে, একটু এপাশ ওপাশ করে আবার বেরিয়ে যায়।

সুমনার শাশুড়ি মানে রাহেলা বেগম রানু ভেজা শাড়ীর পানিটুকু নিংড়ে, ঝেড়ে ঝুড়ে, বাবা জর্দাসহ মস্ত একটা পানের খিলি মুখে পুরে ঢুকে পড়ে রান্না ঘরে। আজ শোলমাছ দিয়ে শিদল রান্না হবে। বাড়ির সবাই এ তরকারির ভক্ত। ভক্ত মানে মহাভক্ত। সাথে শুকনা মরিচ পুড়ে লাল লাল করে আলুভর্তা আর ঘন মাষকলাইয়ের ডাল। ছোট মেয়ে রিমি আছে বড়বাবুর কাছে, ও বসে বসে ওর জামায় পুথি বসাচ্ছে। দুই চুলার একটাতে বড়বাবুর মুরগির তরকারি বসায়। আরেকটাতে শিদলের কড়াই।রান্নার ভাপ চুলার উপর পাক খেয়ে উড়ে যায় জানালাপানে। ছোট মুরগি কষাতে কষাতেই রান্না হয়ে যায়। এদিকে শোলমাছের তরকারিও হয়ে আসে।একচিমটি ভাজা জিরার গুঁড়ো, একমুঠো ধনেপাতা ছিটিয়ে দিয়ে, শিদলের কড়াইনামিয়ে রেখে ডাল বসিয়ে দেয়।সেদ্ধ আলুগুলো ছাল ছিলে রাখে। মইরোর মা আগেই মরিচ পুড়িয়ে রেখেছে।

সুমনা বের হয়ে আসে। সে আলুগুলো পিষেভর্তা করে সেগুলোতে সরিষার তেল ও পেঁয়াজ মেখে একেবারে টেবিলে রেখে আসে। এরপর ভাত বসিয়ে দেয়। ডাল বাগার দিতে হবে।
-মা তুমি রান্না ঘরের বাকি কাম কাজ সেরে গোসলে যাইও। আমি দেখি ঐ লাল মুরগিটা উসমাতি হইছে ওটাকডিম দিয়ে ওমে বসায় দেই।
-আচ্ছা মা, যান। রাহেলা বেগম হরিণ পায়ে গিয়ে বড়বাবুকে একবার দেখে এক খিলি পান মুখে দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে যায়। সেখানে একপাশে চালডাল সহ যত রকমের হাড়ি কড়াই, বস্তা, আরেকপাশে হাঁস মুরগি, কোয়েলের খাঁচা। মাঝে মাঝে রাহেলা বেগম খড়ির উনুনে রান্না করে সেই খড়ি টড়ি ইত্যাদির ভাঁড়ার ঘর এটি। সেচৌকির নিচ থেকে দশটি হাঁসের ডিম বের করে আনে। মসজিদের পেছনের বাড়ির নুরানী খালার কাছ থেকে মুরগির ডিম বদল দিয়ে হাঁসের ডিম এনেছে। নিয়েছে পনেরটা বদলে দিয়েছে দশটা। গোল একটা মাটির মালসায় আগে থেকেই কাঠের গুঁড়ো রেডি করা ছিল, সেটাতে ডিমগুলি সাজিয়ে রাখে। তার উপর মুরগিটাকে বসিয়ে দেয়। ব্যস, কিছুদিন পরেই দশটা না হোক আটটা বাচ্চা তো ফুটে বের হবে। ভাগ্য ভালো হলে দশটাও হতে পারে।বাড়ির পেছনে একটা খাল আছে।সেখানে যতটা পানি তারচেয়ে কচুরিপানা বেশি। হাঁসগুলো সেখানেই বড় হয়ে যাবে। বড়ছেলে বড়বৌমা হাঁসের মাংস ভীষণ পছন্দ করে। তাছাড়া বড় ছেলে বড় বৌমা যখন আসে, ফিরে যাবার সময় অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে ওদের প্রিয় হাঁস ভুনা করে সাথে দিয়ে দেয় রাহেলা বেগম। জবাই করার মত হাঁস আছে দুটো। আর কয়েকটা আছে এখনও ছোট, খাওয়ার উপযোগী হয় নাই।

বাড়িতে বেশকিছু মুরগিও আছে। এছাড়া কোয়েল পাখি পোষে। সেগুলি ডিম দেয়। কেউ পছন্দ না করলেও দুটা খাশিও আছে। বাড়ির পেছনে সামান্য কিছুটা জমি আছে, সেখানে লাউ, সিম, কুমড়োসহ নানান সবজির গাছ আছে। এই লতাগাছগুলি উঠে গেছে আম, কাঁঠাল বা জলপাই গাছের শাখায় শাখায়। লাউ, কুমড়ো, শিম পাড়তে হলে ছোটছেলে তুহিনের দ্বারস্থ হতে হয় অথবা মইরোকে বলা ছাড়া উপায় থাকে না। ওই পেছনের চিলতে জমিতে কাঁচামরিচ, টমেটো, ধনেপাতাও হয়।গাছ পালা ছায়া ঢাকা জায়গা। আম গাছের ডালে কাকের সংসারও আছে, বাবুইয়ের বাসার মত নৈপুণ্য নেই তবুও বাসা। ওরা ডিম পাড়ে, তা দেয়, বাচ্চা ফোটে। রাহেলা বেগম বাইরে এলেই কাকগুলো কা কা করে। খাবারের পর এঁটোকাঁটার সাথে কিছু ভাত মিসিয়ে গাছতলায় রেখে দিলে ওরা খুঁটে খুঁটে খেয়ে নেয়।

ঝুঁটি ওয়ালা লাল মোরগ, প্যাঁক প্যাঁক করা হাঁস, কালোজামের মত গোটা গোটা লাদা নির্গমণ করা ছাগল। ভোর হবার আগে কোয়েলের কোলাহল, কিচিরমিচির, কাকের চিৎকার মোরগের আজান এসবই রাহেলা বেগমের জীবনের অংশ।

গোসল সেরে, জোহরের নামাজ পড়ে রাহেলা বেগম ছোট্ট একটা কানাতোলা গোল স্টিলের থালায় ভাত, মুরগির মাংস, সামান্য আলুভর্তা আর একটু জলপাইয়ের আচার নেয়। মাংস আর আচার হলে সে আগ্রহ করে ভাতটুকু খেয়ে নিবে। বড়বাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে নিজের খুশি প্রকাশ করে নিজস্ব ধরনে। দ্রুতই খাওয়া শেষ করে ফেলে। শেষে কিছুটা ডাল খাইয়ে দিয়ে পরম যত্মে ওর মুখটা মুছিয়ে সে খাবার টেবিলে আসে।

এক এক করে সবাই টেবিলে আসে। শাকিল, সুমনা, তুহিন, রিমি, ওদের বাবাও, আজ ছুটিরদিন বলে সে বাসায় আছে। এই ঘরেরই একদিকে দেয়ালের সাথে লাগানো বড়বাবুর খাট। এটি রান্নাঘরের কাছাকাছি বলে ওকে এখানে রাখে রাহেলা বেগম। তাহলে চোখের সামনে থাকে।

হালকা কথাবার্তার সাথে চলে খাওয়া দাওয়া।রাহেলা বেগম শোলমাছের মাথাটা রিমির বাবার পাতে তুলে দেয়।দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে যে যার মত ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেয়। রাহেলা বেগম বড়বাবুর পাশে শুয়ে পড়ে একটা পান মুখে দিয়ে। পান জর্দার ঘ্রাণের মধ্যে ধীরে ধীরে বাচ্চাটি ঘুমিয়ে পড়ে, রাহেলা বেগমের চোখ বন্ধ হয়ে আসে। দশভুজা রাহেলা বেগম রানুর দিনে ঘুমানোর অভ্যাস আছে। দুপুরে একটু ভাতঘুম না দিলে শরীরটা চলে না।

২.
রাহেলা বেগমের চার ছেলে মেয়ে। বড় ছেলে ওয়াকিলুর রহমান। এরপর শাকিলুর রহমান। এরপর তুহিন এবং সবশেষে রিমি। রিমির বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সংসারে নির্দিষ্ট আয় বলতে রিমির বাবার পেনশনের কটা টাকা।অবসরের পর তিনি ধর্মকর্মে অধিক মনো্যোগী হয়েছেন। মসজিদ তার প্রিয় জায়গা হয়ে উঠেছে।এদিকে খরচের তো লেখাজোঁখা নাই। তুহিন, রিমি দুজনেই কলেজে পড়ে। মেজ বৌমা সুমনাও বিয়ের পরই অনার্স কমপ্লিট করল।

মেজো ছেলে শাকিলকে নিয়ে রাহেলা বেগমের অন্তহীন সমস্যা। একে তাকে ধরে ওকে একটা চাকরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর করার পরই সে সেখানে ঝামেলা করে ফেলে। চাকরি থেকে ডিসমিস তো হয়ই, বাড়তি জেল জরিমানা ক্ষতিপূরণ দিতে ঘরের সঞ্চিত টাকা, রাহেলা বেগমের হাতের চুরি সব চলে যায়। আবার সে যে বেকার সেই বেকারই হয়ে যায়। এদিকে তো প্রেম করে বিয়ে করেছে এক ছাত্রীকে। যাকে আবার লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হয়। তিন তিনজনের লেখাপড়ার খরচ, কাপড়চোপড়, হাতখরচ, বাড়ির মাসিক খরচ চালানো দিনদিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। রিমির বাবা অনেক ঘুরে ঘুরে অবশেষে একটা ছোট খাট চাকরি যোগাড় করে নিয়েছেন। কিন্তু শাকিল যা তাই। খায়দায়, ঘুরে বেড়ায়।

৩.
রাহেলা বেগমের বড় ছেলে ওয়াকিলুর রহমান ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিল। সে সব ক্লাসেই ভালো রেজাল্ট করত। ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাশ করে, এমবিএ করার পর সে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে। ওর বউও একজন ব্যাংকার। ছেলে বাবা মায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন করে। মাসে মাসে মায়ের নামে টাকা পাঠায়। ছোট ভাই শাকিল একবার ঠিক করল সে দোকান দিবে, টাকার দরকার। কি করা যায়! কোথায় পাওয়া যায় টাকা! ভয়ে ভয়ে রাহেলা বেগম বড় ছেলেকে বলে। সেই বা আর কত করবে! কিছুদিন পরে বড় ছেলে ঠিকই টাকা পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সে দোকান পাট শাকিল করতে পারলে তো! কিছুদিন চলার পরই সেসব লাটে উঠে যায়।

এই বড় ছেলের সন্তান বড়বাবু। ওর একটি সুন্দর নাম আছে কিন্তু বাসার সবাই আর রাহেলা বেগম বড়বাবু বলেই ডাকে। তারই ধারাবাহিকতায় মেজো ছেলের পুত্র ছোটবাবু। বড় বাবুর বয়স এখন ১২ বছর। সে কোন স্বাভাবিক শিশু নয়। সে শোয়া থেকে উঠতে পারে না।জন্মের পর থেকেই তার স্পাইনাল কর্ড শক্ত হয়নি। কথা বলতে পারে না। তার বাবা মা দেশে তো বটেই বিদেশে বহু চিকিৎসা করিয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতেই কিছু হয়নি। সে বাবামায়ের সাথে ঢাকার বাসাতেই থাকত, কিন্তু কাজের লোকের কাছে রাখাটা কতটা নিরাপদ!তাছাড়া কাজের লোক থাকতেও চায় না। আলাপ আলোচনার পরে ঠিক হয় সে দাদীর কাছে থাকবে। গত চার বছর যাবত বাবু দাদীর কাছে থাকে। বাসার সবাই দেখাশোনা, আদর যত্ম করে। সারাক্ষণ ওর কাছে কাউকে না কাউকে বসে থাকতে হয়।যখন যে সময় পায় ওর কাছে থাকে। আর ওর দাদী সবকিছু তীক্ষ্ণ চোখে তদারকি করে।

যতদিন মেজোবউ সুমনার বাচ্চাকাচ্চা হয়নি সেও বড়বাবুর যত্নআত্তিকরত।এখন আর সময়ও পায় না, মনে হয় মনও চায় না।

সন্ধ্যা হয়েছে। কেরামতিয়া মসজিদের আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রাহেলা বেগম অজু করে এসে বড়বাবুর চেয়ারের পাশেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। এটি একটি বিশেষ চেয়ার যা সিঙ্গাপুর থেকে আনানো। এখানে বাবুকে বসিয়ে একাধিক বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। মোনাজাতে গিয়ে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। এই বাচ্চাটির জন্য তার মনে বড় কষ্ট। ওর বয়সী বাচ্চারা খেলছে, দৌড়াচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে… ওর কপালটাই এমন হওয়া লাগে! বিধাতার এ কেমন বিচার! কেমন খেলা! খেলা নাকি বৈরিতা!
জানে তার বড় ছেলে বড় বৌমার মনেও গভীর দুঃখ। এক অনির্বান জলন্ত হাহাকার।এ এক ক্লান্তিকর জার্নি, কিন্তু কিছু করার নেই।

এরকম একটি বাচ্চার দেখাশোনা করাও বিলক্ষণ একটি জটিল ব্যাপার। ওর বয়স বাড়ছে, দিনদিন লম্বা হচ্ছে, সবাইকে ধুমধাম মার বসিয়ে দেয়, পায়ের কাছে কিছু থাকলে বা কেউ গেলে বেকায়দা পা চালিয়ে দেয়। দিনদিন জিদও খুব বেড়ে যাচ্ছে।নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ গ্রো করছে। কথা না বলেও নিজের মতামত জানাতে পারে। সবচেয়ে কঠিন কাজ ওকে গোসল করানো। একজন শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয় আরেকজন গোসল করাতে হয়। সমস্যা আরো আছে সে নিজের হাত নিজে কামড় দিয়ে রক্তাত্ত করে ফেলে, হাত মুঠি করে নিজের মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে। তারপরও রাহেলা বেগম আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় ওর নিরাপত্তা, সেবাযত্নের যেন ঘাটতি না হয়।

নানান দুর্ভাবনা, পরিশ্রমে আজকাল ক্লান্তি চলে আসেকিন্তু সংসার কি ক্লান্তি ক্ষমা করে? নিজের বয়সটাও তো বাড়ছে।এভাবেই শীত গিয়ে বসন্ত আসে। বসন্ত গিয়ে আবার শীত আসে।

দুপুরের আগে আগে রাহেলা বেগম বাজার থেকে ফেরে। নিজের ওষুধ, বাসার প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি, ছোট নাতীর জন্য প্যামপার্স, দুধের টিন, সুজি, মোমবাতি, ডিম ইত্যাদি নিয়ে। বড় নাতির জন্য কিছু আনতে হয়না। বড় বৌমা গাড়ি বোঝাই করে ওর প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে যায়। এত দেয় যে তা দিয়ে বাড়ির অন্যদেরও প্রয়োজন মিটে যায়। সে ফোন করে জেনে নেয় কি আছে কি নেই। ওরা প্রতি মাসেই আসে। মাঝে মাঝে বৌমা ছুটি নিয়ে কয়েকদিন থেকে যায় ছেলের কাছে।
এভাবেই অনেক খাড়াই ভেঙে, অনেক পাথরের দেয়াল উতরে, বরফনদী পেরিয়ে রাহেলা বেগমের সংসার এগুতে থাকে। নাতিরা বড় হতে থাকে। দাদু-দাদীরা ভাটি থেকে আরো ভাটির দিকে হাঁটতে থাকে। ঢাকা-রংপুরের দীর্ঘপথে এক জনম দুঃখী বাবা মায়ের পারাপার অন্তহীন চলতে থাকে।

কিছুদিন আগে সুমনা যখন সন্তান সম্ভবা তখন রাহেলা বেগমও খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন কথা উঠেছিল যে বড় বাবুকে ওর বাবামা নিজেদের কাছে নিয়ে যাবে। সে ওই প্রস্তাবে কিছুতেই রাজি হয়নি। রিমির বাবা বলেছিল-
-এটাই তো ভালো হবে রানু, তুমি আর কত করবা? ছোট বৌমার শরীর ভালো না, রিমির লেখাপড়া আছে, তুমি নিজেও দিনদিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ। হাতের ব্যথা, কোমরের ব্যাথায় রাতভর কোঁ কোঁ কর। ওর বাবা মা তো নিজে থেকেই নিয়ে যেতে চাচ্ছে, নিয়ে যাক।এত জিদ করছ কেন! গোঁ ধরছ কেন!
কিন্তু রাহেলা বেগমের এক কথা বাবু কোথাও যাবে না। সে আমার কাছেই থাকবে।

সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে। মনোরম এক বিকেল গুটিগুটি পায়ে আঁধারের দিকে এগুচ্ছে। হুশহাশ বাতাস বইছে।সন্ধ্যার নামাজ শেষ হয়েছে, রাহেলা বেগম বসে বসে দোয়া দরূদ পাঠ করছে। এমন সময় ছোটবাবু পেল্লাই এক চিৎকার দিয়ে ওঠে। রাহেলা বেগম চমকে কান খাড়া করে। এদিকে ওর চিৎকার শুনে বড়বাবুও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সেও উচ্চকিত উ! আ! শব্দ করতে থাকে আর হাত পা ছুঁড়তে থাকে। প্রবলবেগে দুদিকে মাথা নাড়ে, মুখ দিয়ে লালা চলে আসে। রাহেলা বেগম একহাত দিয়ে ওর মাথাটা চেপে ধরে থাকে। ওদিকে ছোটবাবু চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। সুমনা গেল কই! বাথরুমে নাকি?। রাহেলা উঠতে গিয়েও পারে না। আজ কোমরটায় বড্ড ব্যথা। বাবু পড়ে গেল নাকি কে জানে! পিঁপড়েও কামড় দিতে পারে। আবার যখন উঠতে যাবে ঠিক তখুনি সুমনা শাকিলের কণ্ঠ শোনা যায়।

এবারে, আস্তে ধীরে দোয়া কালাম শেষ করার পর সে উঠে পড়ে। পানের খিলি মুখে পোড়ে। বের হয়ে এসে বারান্দা থেকেই হাঁক দেয়,
-সুমনা বাবুর কি হইছে? পড়ি গেছিল? ব্যথা পাইছে নাকি? অসুমনা! অই শাকিল! কারো কোন সাড়া না পেয়ে সে এসে বড়বাবুর পাশে চুপচাপ শুয়ে পড়ে। আজকাল সুমনার কপালে দিবারাত্র বিষণ্নতার ভাঁজ। সংসারে সুখ অসুখ থাকেই। ঝড়ঝাপটা বিপদ আপদও আসে। আবার এরই মাঝে দখিনা বাতাসও বয়। বড় একটা শ্বাস ফেলে সে।

৪.
চাঁদের হিসেব ছাড়াই রাহেলা বেগমের সংসারে ঈদ লেগেছে। ঢাকা থেকে বড় বৌমারা এসেছে। বরাবরের মতো প্রচুর খাবার দাবার এনেছে। সবার জন্য কিছু না কিছু গিফট এনেছে। বড়বাবু ছোট বাবুর একই রঙের ড্রেস। আর এনেছে জন্মদিনের বেলুন, রঙিন পোস্টার, মোমবাতি, সোনালি, রূপালী রঙিন রাংতা আরও অনেক কিছু। আগামীকাল বড়বাবুর জন্মদিন। নিজেরা নিজেরাই পালন করে, বড়জোর দুচার জন বন্ধু কিংবা পাশের বাসার বাচ্চাদের বলা হয়। বাবুটা ঠিকই বোঝে ওকে নিয়েই কিছু হচ্ছে, এইদিন সে মহাখুশি থাকে।

পরদিন রাহেলা বেগম পোলাও, মাংস, রোস্ট, পায়েশ রান্না করে। সবাই মিলে খাবার ঘরটিই বাবুর জন্য সাজানো হয়। রাহেলা বেগম আগেই চিলিজ এ কেকের অর্ডার দিয়ে রেখেছে।

দুই বাবুকেই বড়বৌ নুতন ড্রেস পরিয়ে দেয়। দুজনেই দাঁত বের করে হাসতে থাকে। ছোট বাবুর উপস্থিতি বড় বাবু বুঝতে পারে এবং ওকে খুব পছন্দও করে।ছোটবাবু আজকাল দাদিকে, দাদুর অনুকরনে “আ-নু, আ-নু” বলে ডাকে। সেটাই ওকে দিয়ে ডাকানো হচ্ছে আর সবাই তুমুল হাসাহাসি করছে।
একসময়, বেলুন ফুলাতে ফুলাতে তুহিন বলে ওঠে
-আজকে দু-ভাইয়েরই জন্মদিন একসাথে হয়ে যাক। সুমনা ঝট করে মুখ তুলে দেবরের দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে চোখে রোষানল ফুটে উঠতে থাকে। হঠাৎ কথার তালে রাহেলা বেগম বলে ফেলে
-হ্যাঁ আর দু মাস পরেই তো ওর জন্মদিন। একদিনেই দু-ভাইয়ের করে ফেললেই তো হয়।
-হ্যাঁ, এক কেকে, এক খরচেই সব হয়ে যায়। ঝঞ্ঝাট ঝামেলাও মিটে যায়। সঞ্চিত রোষ রাসায়নিক কোন এক বিক্রিয়ায় বিষে পরিণত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয় সকলের উদ্দেশ্যে।তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কথাগুলো বলে সুমনা ছেলেকে বড় জায়ের কোল থেকে টেনে নেয়, হাত থেকে বেলুন কেড়ে ফেলে দেয়। ছেলে এখানেই থাকতে চাচ্ছে,আবার হাতের বেলুন কেড়ে নেয়াতে সে ভ্যা করে কেঁদে ওঠে। চলে যেতে যেতে সে ছেলের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলে ঘরের সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা দমকা বাতাস এসে ঘরের পর্দা, জরির ঝালর, বেলুন সব উড়িয়ে নিতে চায়। কিন্তু রাহেলা বেগম ক্ষিপ্র দুহাত মেলে সব রক্ষা করে।
পরে অনেক ডাকাডাকি করেও সুমনাকে আর আসরে আনা যায় না। তবে ছেলেকে ঘর থেকে বের করে দেয়।

বিকেলে কেক চলে আসে। বাচ্চারা চলে আসে। বড়বাবুকে কোলে নিয়ে ওর বাবা টেবিলের মাঝখানে দাঁড়ায়। বড়বাবুকে কোলে রাখা মুশকিল দেখে ওর চেয়ার এনে ওকে বসিয়ে দেওয়া হয়। সেটা আবার নিচু হয়ে যায়। এবারে চাচ্চু তুহিন ওকে কোলে নেয় আর ওর বাবা মাথাটা ধরে রাখে। সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে যায়। ছোটবাবুকে কোলে নিয়ে বড়বৌ স্বামীর পাশে দাঁড়ায়। কেক কাটা হয়ে যায়। সবাই হাততালি দেয়। রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে যায়। না, সুমনা আর বের হয় না।

রাহেলা বেগম বোঝে দিনে দিনে সুমনার মনে একটা কালো বাতাসের ঘুর্ণি জমাট বাঁধছে। জমাট মেঘের আড়াল থেকে এক অদৃশ্য তীরন্দাজ বিষের তীর হেনে চলেছে অবিরাম। ভয়ঙ্কর ঝড় ওঠার আগেই ওই ঘূর্ণিটাকে নির্মূল করতে হবে। এসব ছোট বড় আপস, উৎপাটনের নামই যে সংসার।

কদিন পরের কথা। ওরা ঢাকায় চলে গেছে। দুপুরের খাওয়া শেষে বাচ্চারা ঘুমিয়েছে। রাহেলা বেগম ভাতঘুমের আরামটুকু জলাঞ্জলি দিয়ে সুমনাকে ডাকে,
-মা, কাপড় পরে নাও তো একটু বাইরে যাব।
-এ সময়ে! বাইরে! বাবু ঘুমাচ্ছে, উঠে পড়লে?
-সবকিছু রিমি দেখবে। তুমি দেরি করনা।
সুমনাকে নিয়ে সে রিকশায় ওঠে পড়ে।

বাইরে গড়াগড়ি খাচ্ছে রোদ্দুর। মেঘহীন আকাশ অনেক উঁচুতে উঠে আছে।রিকশা শ্যামাসুন্দরি খাল পেরিয়ে চলতে থাকে। শাশুড়ি বৌমাকে বলে এই খালের ইতিহাস জানো মা? বলে নিজেই বলতে থাকে- “ডিমলার দানশীল রাজা জানকী বল্লভ সেন তার মা ‘শ্যামাসুন্দরি’র স্মরণে এই খাল খনন করেছিলেন। আমাদের দেশে এমন খাল আর একটাও নেই। এটি ১৬ মাইল দীর্ঘ আর ৪০ থেকে ১২০ ফুট চওড়া। এটি ঘাঘট নদীতে গিয়ে মিশেছে”। ছোটবেলায় পড়ছিলাম মা।

শহরের, পার্কের, অবাক হওয়ার মত বিশাল মহীরুহগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। এ যেন আগুনের লকলকে ক্ষুধিত জিভ। জারুল, কৃষ্ণচূড়া ফুলে ছেয়ে আছে চারপাশ।একঝাক শালিক ঘোরাঘুরি করছে। একাকী দুপুর কাঁদছে পাতার আড়ালের ঘুঘুর গলায়। নির্দেশমত রিকশা চলে আসে শিরিন পার্কে।

রাহেলা বেগম দূরের একটি বেঞ্চের দিকে এগুতে থাকে।দুপুরবেলা পার্কে তেমন মানুষজন নেই। তাই বলে নিবিড় নির্জনতাও নেই। দুজনে বসে পড়ে। রাহেলা বেগম বাদাম ওয়ালাকে ডাক দেয়। কিছু বাদাম নিয়ে দুজনের মাঝখানে রেখে বলে
-বাদাম খাও। অবাক হবার কিছু নাই। তোমাকে একান্তে কিছু কথা বলার জন্য এখানকার এই নিরিবিলিতে আসছি। আমি যা বলব তুমি মন দিয়া শুনবা। কিছু বলার থাকলে পরে বইলো। শোন সুমনা, সংসার বড় কঠিন জায়গা। কেবল কঠিন না জটিলও। আমার মেজো ছেলে মানে তোমার স্বামী একজন বেকার মানুষ, আয় রোজগার কিছু নাই। এটা তোমার মাথায় থাকা দরকার। একথা সত্যি আমি বড়বাবুর পেছনে সময় দেই, মনোযোগ দেই তাইবলে তোমার মনে করার কোন কারণ নাই আমি আমার ছোট নাতিকে কম ভালোবাসি। দুজনেই আমার বংশধর, আমারই রক্ত। তুমি তোমার বড় আপার সাথে একদিন বলাবলি করছিলা যে অমন লুলা গুঙ্গা বাচ্চার দেখাশোনা করা ঠিক নয়। নিজে বাচ্চা নেওয়া দরকার। তোমরা বাচ্চা নিলে। যেখানে তোমার স্বামীর একপয়সা কামাই নাই, সে গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে চলে, তোমরা বাচ্চা নেও কোন আক্কেলে!

আমার গুণধর মেজোছেলে তোমার মতো এক ছাত্রীকে বিয়ে করে আনলো যখন তোমার পুরা অনার্স পড়ার খরচ কে যোগাইছে?
বাড়িতে কাজের মহিলা মইরোর মাকে কে রাখছে?
প্রতিমাসে এত এত খাবার দাবার দিয়ে যায় কে?
বাবা মায়ের প্রতি যে দায়িত্ব,তা পালন করে আমার বড় ছেলে। এটা ছেলের দায়িত্ব। বৌমার তো কোন দায় এখানে নাই। তারপরও সে করে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত করে। কেন করে? বোঝ?
নির্মম হলেও, বাস্তবতা হচ্ছে যার বাবার আয় রোজগার নাই, তার পাছার নিচে ত্যানাও জোটে না। কিন্তু আমি আমার ছোট নাতির জন্য প্যাম্পার্স কিনি আনি, যেহেতু বড়বাবু প্যাম্পার্স ব্যবহার করে। কিন্তু তুমি তো জান আমি কোন আয় করিনা।তাহলে? হিসেবটা বোঝার চেষ্টা কর।
আমার ছোট ছেলের এখনও লেখাপড়া শেষ হয় নাই, আমার মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, আমার মেজো ছেলে বেকার কাজেই মা আমাকে তো ভেবেচিন্তে, কৌশলে পা ফেলতে হয়।

বড়নাতির জন্য আমার মনে গভীর দুঃখ আছে, মায়া আছে, দাদী হিসেবে কিছুটা দায়িত্বও আছেএকথা সত্য কিন্তু তারচেয়েও বড় সত্য ও আমার সংসারে আশির্বাদ।আর সে আশির্বাদে আমরা সবাই, হ্যাঁ সব্বাই সে আশির্বাদে পুষ্ট।
তোমার আর তোমার বোনের যে ভাবনা, যে ভাষা, তারউলঙ্গ প্রকাশ করে আমাকে বলতেই হয়,
“হ্যাঁ ওই লুলা গুঙ্গাই আমার সংসারে সোনার ডিমপাড়া হাঁস”।শাশুড়ি বৌয়ের মাঝখানে বাক্যটি যেন পাক খেতে থাকে।একনাগাড়ে কথা বলে রাহেলা বেগম থামে, তার দুচোখে জলের ধারা। সুমনার থুঁতনি আরো বুকের সাথে লেগে যায়। রাহেলা বেগম এতক্ষণও গলা উঁচু করে নাই, এবারেও ততধিক নরম, নির্মোহ স্বরে জিজ্ঞেস করে
-তুমি কিছু বলবে মা?
সুমনা মাথা নাড়ে। ওর কিছু বলার নেই।

ফিরতি রিকশায় কেউ কোন কথা বলে না। পার্কের গেট থেকে নাতিদের জন্য রঙ বেরঙয়ের গ্যাস বেলুন কিনে নিয়েছে। রিকশা যখন বাড়ির সামনে আসে একটা অ্যাম্বুলেন্সে সাইরেন বাজাতে বাজাতে দ্রুত পাশ কেটে বের হয়ে যায়। রাহেলা বেগমের কপাল কুঁচকে যায়। কয়েকটা বাড়ির বহিরাঙ্গন এই জায়গাটুকু। তাড়াতাড়ি ভাড়া মিটিয়ে পা বাড়াতে যাবে শাক বিক্রি করা বুড়িটা চিৎকার দিয়ে ওঠে-
-অ বুজান! খাট থাকি পড়ি, তোমার নাতির মাতা দুই ফাঁক হয়া অক্তের নদী হয়া গেইচে…আল্লাক ডাকাও বুবু, আল্লাক ডাকাও…
কোথায় যেন উচ্চারিত হয় হে সান্ধ্যগ্রন্থি, হে আজানকাল, হে সংসার আমাকে আর মেরো না, মরা বাঁচার গাঢ় বেদনার অবিরাম ভার বইতে আমি অক্ষম।
সংসারী রাহেলা বেগমের মাথায় মুগুরের ঘা মারতে থাকে কোনজন? বড়বাবু? নাকি ছোটবাবু? কে?