অগ্নিতৃষ্ণা ॥ দীলতাজ রহমান


খুব সকালে প্রাচীরের ওপাশে মাটি কোপানোর শব্দ শুনে তারাবানু রাস্তা দিয়ে ঘুরে সেখানে চলে গেলেন। তারাবানু গিয়ে দেখেন তাদের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী একমাত্র সদস্য চল্লিশোর্ধ রীটা প্রায় হাঁটু সমান এক গর্ত করে ফেলেছে। পাশে সেই বিশাল স্তূপ মাটিসহ বাংলাদেশের শন-আকৃতির একবোঝা গুল্ম। যা খুব সাবধানে বেঁধে আনা।

তারাবানু রীটার খুঁড়ে তোলা মাটি প্রায় ডিঙিয়ে গুল্মগুচ্ছের কাছে চলে গেলেন। পরখ করে দেখলেন, ওটা আসলে শন নয়। এখানে আশেপাশের আরও বাড়িতে তিনি ওটা দেখেছেন। এটা অন্যরকম এক ফুলগাছ। এর প্রতিটি ডগায়ই গাঢ় গোলাপি রঙের সরু সরু ফুল ফোটে। দেখতে তখন বেশ লাগে।

অত সকালে রীটার অমন ভজখট সময়ে তারাবানুর উপস্থিতিতে রীটা খুশি হলো কিনা, তারাবানু সে ভাবনার ধারেকাছেও গেলেন না এবং তিনি আগবাড়িয়ে শাবলের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন রীটাকে সহযোগিতা করতে। আর রীটাও শাবলখানা আস্তে করে ছেড়ে দিল পঞ্চাশোর্ধ তারাবানুর হাতের ভেতর। তারাবানুর প্রতি রীটার তখন ভাবখানা, ‘দেখো, পারো কি না!’

তারাবানু চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। এসব কাজে অভ্যস্ত তিনি দেখলেন, এ মাটি বাংলাদেশের মাটির মতো নয়। খুবই শক্ত। রীটাকে আবার শাবলখানা ফিরিয়ে দিয়ে গায়েপড়া মানুষের মতো তিনি সেখানে দাঁড়িয়েই থাকলেন। রীটা জানে না, যে রীটা ধীরে ধীরে তারাবানুর সত্তারই আরেকটি অংশ হয়ে গেছে! রীটা যে তারাবানুর ভেতরে বেজেচলা বিষণ্ণ সেতারেরই আরেকটি তার তা কি তারাবানু নিজেও আগে অতটা বুঝেছেন? রীটা গর্তটা মসৃণ করতে করতে তারাবানুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, এই গাছ সে তার এক্স হাজবেন্ডের বাড়ি থেকে এনেছে।

রীটা ফ্যাশন ডিজাইনার। স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর হলো। রীটার দুটি ছেলে আছে। এখন তাদের একটির বয়স বিশ আরেকটির বারো। রীটার নিজের থাকার জায়গা ছিল না বলে ছেলেরা তার সাথে আসেনি। বাবার কাছে থেকে গেছে। সে শুধু স্কুল হলিডেগুলোতে ছেলেদেরকে কাছে পেত। তাও তাদেরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, রেস্টুরেন্টে খাইয়ে আবার তাদের বাবার কাছে রেখে আসতে হত।

রীটা ফ্ল্যাটটি যে কিনেছে, সে নিজেই জানে এর দাম অনেক বেশি পড়েছে। তবু এই ফ্ল্যাটটি তার কেনার কারণ, এই লাইনের কোনো এক বাড়িতে তার সুখের দাম্পত্য অতিবাহিত হয়েছে। সে সেই স্মৃতির কাছাকাছি থাকতে চায়। তারাবানু দেখেছেন, যতবারই রীটা তার পরিবারের কথা বলতে যায়, প্রতিবারই সে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। একটি বাক্য শেষ করতে কয়েকবার তাকে ঢোক গিলতে হয়। রীটার সাথে পরিচয় হয়ে আটপৌরে ধ্যান-ধারণার তারাবানুর সমস্ত জীবনের ধারণা পাল্টাতে থাকে। তিনি ভাবতে থাকেন, সারাজীবন শুনে এসেছেন, উন্নত দেশের নারীরা পুরুষের ছেড়ে যাওয়ার তোয়াক্কা করে না। স্বামী একজন নিয়ে গেলে স্ত্রীও আরেকজন খুঁজে নেয়। এসব নিয়ে খুব বেশিদিন তারা দুঃখবোধ পোষে না!

প্রথম পরিচয়েই রীটা কোনো রাখঢাকের ধার না ধেরে বলেছিল, ওর স্বামী আরেক নারীর প্রেমে পড়ে ওকে ডিভোর্স দিয়েছে।
তারাবানু সেদিন জানতে চেয়েছিলেন, তোমার প্রাক্তন স্বামী পরে তাকে বিয়ে করেছে?
রীটা বলেছিলো, না। তবে তারা নিয়মিত ডেটিং করে।
তারাবানু বুঝেছিলেন, ও লোক আর ও মেয়েকেও বিয়ে করছে না! শুধু মুক্ত বিহঙ্গের মতো ওড়ার সাধ মিটাচ্ছে। খোলা মাঠে ঘাস খাওয়া পশুকে পোষ মানাতে মানুষের বেগই পেতে হয়েছিল। তারপরই তো তারা বংশানুক্রমে পোষ মানতে শুরু করেছে! মানুষের বেলায় নিশ্চয় এরকম হেরেফের থেকে থাকবে।

তারাবানুর ছেলে আর রীটা, দুজনের একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি মাঝামাঝি ভাগ হয়ে সামনে পিছনে দু’পাশে মোট চারখানা উঠোন। দু’দিকের উঠোনেই মাঝখানে কাঠের প্রাচীর। সে প্রাচীর ফুঁড়ে এপাশ থেকে ওপাশে, আর ওপাশ থেকে এপাশে দেখা যায় না কিছুই। কিন্তু হাঁটাচলা এমন কি নিঃশ্বাস দীর্ঘ হলে তারও শব্দ শোনা যায়। আর এভাবেই পঞ্চাশ অতিক্রান্ত তারাবানু রীটার অনেকটাই জেনে যায়।

রীটা বাসায় থাকলে কে আসছে, কে যাচ্ছে, কখনো একজন দুজন, বা অনেকের মিলিত হৈচৈও কখনো ভেসে আসে। এতে তারাবানু খুশিই হন। এতবড় বাড়িটাতে মেয়েটিকে বিষণ্ণ একটি প্রদীপের মতো মনে হয় তারাবানুর। অবশ্য মাঝারি গড়নের শক্ত-পোক্ত শরীরের রীটার বয়সও পয়তাল্লিাশের কম হবে না। তবু সে তারাবানুকে মম বলে ডাকে। কারণ এপাশে তারাবানুর ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনি নিয়ে এক ভরা সংসার। তাই তাকে মায়ের স্থান না দিয়ে সেও পারেনি। তারাবানু ইংরেজি জানে না তবু ভাঙাচোরা যা বলে তা রীটা বুঝে নেয়। আবার রীটার কথার পুরোটা না বুঝলেও তারাবানু নিজের মতো করে যা বোঝার বুঝে নেন।

পাশের ফ্ল্যাটটি বিক্রির আগে খুব যখন ঘষা-মাজা রঙ-পলিস করার কাজ চলছিল, তাতেই তারাবানুর পরিবার বুঝতে পেরেছিল, যে ওপাশটা বিক্রির আয়োজন হচ্ছে। তারপর একদিন রীটা কতগুলো কামরাঙা নিয়ে এলো, এপাশের মানুষের সাথে পরিচিত হতে। বিদেশি রীটার হাতে অনেকগুলো কামরাঙা দেখে চমকে ওঠে তারাবানুসহ ঘরের সবাই। তারাবানুই আশ্চর‌্য হয়ে বললেন, কুইন্সল্যাণ্ডে কামরাঙা হয়? আমি তো ভেবেছিলাম, পুরো অস্ট্রেলিয়ার কোথাও এ ফল নেই।

রীটা বললো, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীনে যা হয়, তার স-বই কুইন্সল্যাণ্ডে হয়। পেঁপে, পেয়ারা, এমন কি গ্যাণ্ডারিও। কুইন্সল্যাণ্ডের আবহাওয়া অনেকটা ভারত উপমহাদেশের মতোই!

তারাবানু বললেন, কি জানি মেলবোর্নে থাকতে তো অনেক রকম চারা কিনে লাগিয়ে দেখেছি। যেকোনো চারা একটু বাড়ে, তারপর সব পাতা শীতে এমনভাবে পুড়ে যায়, মনে হয়, আগুনে পুড়ে গেছে। তবে ওখানকার নিজস্ব কিছু ফল-ফসল আছে, যা শীত এলে বাড়ে। যেমন পালংশাক, ধুনেপাতা, জুকিনি। তাছাড়া অনেক গাছই মরে যায়। মেলবোর্নে আমার ছেলের নিজের বাড়ি আছে। সেখানে তো আমি গাছ-গাছালি নিয়ে এত এক্সপেরিমেন্ট করেছি, কিন্তু নিজের দেশে যা কখনো করা হয়নি।

উঠোনের খালি জায়গা দেখিয়ে রীটা সেই প্রথম দিন এসেই বলেছিল, এখানে কি কি গাছ লাগালে ভালো হবে। রীটার কথার উত্তর তারাবানুর বউমা দিয়েছিল। বউমা বলেছিল, আমরা দুজনই কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির টিচার। দুই বছরের জন্য এখানে এসেছি। আবার মেলবোর্ন নিজের বাড়ি ফিরে যাবো। তাই এসব নিয়ে খুব বেশি পরিকল্পনা নেই। এখানে এই অল্প বিস্তর যা করেছেন, আমার শাশুড়িই করেছেন। উনি কারো নিষেধ শোনেন না! দেখা যাবে এটুকু খোঁড়াখুঁড়ির জন্য বাড়িভাড়া বাবদ যা টাকা অ্যাডভান্স করেছি, বাড়িওয়ালা পুরোটাই কেটে রেখেছে।

রীটার গর্ত করা শেষ হলে বিশাল একতাল মাটিসহ তুলে আনা সে গাছ রীটা একাই গর্তের ভেতর লম্বা খুব সাবধানে একাই নামিয়ে দিল। তারপর তার গোড়ায় আর আগের মাটি না দিয়ে আলাদা করে করে রাখা কিছু শুখনো পাতাযুক্ত মাটি, কিছু বালি আরো কি কি সব প্রতি পরতে পরতে সাজিয়ে দিতে দিতে সে নিজে থেকেই বললো, তার এক্স হাজবেণ্ডের বাগানে আরও কতরকম গাছ আছে। ধীরে ধীরে সে দু-একটি করে আনবে। তার গাছ-গাছালির খুব শখ।

রীটার এই কথায় তারাবানুর চোখের সামনে কেমন এক গল্পের চোখ খুলে যায়। তারাবানুর অনেকদিন কাঠের প্রাচীরের এপাশ থেকে মনে হয়েছে, এই রীটার বাসায় এত মানুষ আসা-যাওয়া করে। এদের ভেতর ওর স্বামীও কি আসে না কখনো! অথবা কখনো সে একা? যা আমাদের ধর্মে গর্হিত অপরাধ। একদিন তারাবানু দুপুরের খাওয়া সেরে একটি বাংলা পত্রিকা নিয়ে তাদের সামনের উঠোনে গিয়ে বসছেন। পত্রিকার পাতা ওল্টানোর আগেই ওপাশে কজনের কলহাস্য করতে করতে বেরিয়া যাওয়া অনুমান করলেন। কিন্তু সবাইকে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢোকার আগেই রীটার বমির শব্দ কানে এল। তারাবানু বুঝলেন, মদ বেশি খাওয়া হয়ে গেছে! তবু তারাবানু রীটাকে এতটুকু ঘৃণা করতে পারলেন না। কারণ রীটার যে প্রবল মাতৃত্ব তিনি টের পেয়েছেন, তা এরকম কিছু তুচ্ছ ঘটনা কোনোভাবেই ম্লান করে দিতে পারবে না!

কিন্তু তিনি তখন গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন, রীটা যদি স্বামীর বাড়ির মাটি খুঁড়ে গাছ আনতে পারে আর এমন অকপটে তা স্বীকারও করতে পারে এবং যদি তার প্রাক্তন স্বামী তার এখানে কখনো আসে, একা বা দলের সাথে তাহলে রীটা হারালোটা কি?
বাড়ির সামনে দিয়ে এতটুকু রাস্তা পেরিয়ে যে পথে তারাবানু গিয়েছিলেন, ঠিক সেই পথে ফিরে আসতে আসতে তার মনে হলো, রীটা যা হারিয়েছে, তা শুধু স্বামীত্বের অধিকার! কারণ স্বামীর সাথে সংসার করাকালীনও তো এসব দেশে কেউ শুধু সংসার নিয়ে থাকে না। সব নারীই পুরুষের মতো একইভাবে রোজগার করে। তাহলে রীটাও নিশ্চয় তখনো রোজগার করতো! স্বামী স্বেচ্চাচারী হলে স্ত্রী তাকে বাঁধা দিতে পারে। কিন্তু স্ত্রীকে ডিভোর্স দিলে তো তার আর অধিকার থাকে না তার ভ্যাবিচার ঠেকাতে। বা তা নিয়ে তাকে কিছু বলার! তাই রীটার সব বোবা অভিমান ওই অধিকারটুকু হারানোতেই।

কিন্তু রীটার নিজের অর্জিত যে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা তা তাকে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে বটে। কিন্তু আদতে ও তো এক আহত পাখির মতো বেঁচে আছে। স্বামী-সন্তান-সংসার নিয়ে এই একই মনোভাব নিশ্চয় পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের প্রতিটি নারীর। যদিও তারাবানু খুব বেশি কিছু দেখেননি জীবনে। খুব বেশি রকম মানুষকে তিনি জানেনও না। তবু এরকম বিন্দু-বিসর্গ ঘটনা চোখে পড়ে তার ইদানীং এরকমই মনে হয়।

তারাবানুর নিজের চোখে দেখা, তাও সেই শিশুবেলায়। তবু তিনি তা আজো ভুলতে পারেন না। তারাবানুর এক ফুপুর ভাসুরের ছেলে স্ত্রী এবং দুটি ছেলে রেখে আবার বিয়ে করেছে। দ্বিতীয় বউটি ততদিনে বছর পাঁচেকের এক কন্যাসন্তানের জননীও হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বউটির বয়স কম এবং সুন্দরী হলেও নিচু ঘরের তা তার আচরণে বোঝা যায়। শিক্ষা-দীক্ষা আছে বলেও সেই তখনি শিশু তারাবানুর তা মনে হয়নি। ফুপুর ভাসুরের সে ছেলে খুলনা একটি জুটমিলে চাকরি করতো। সেখানে সে একাই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিল। সে বউ-কন্যা নিয়ে মাঝে মাঝে বাড়িতে এলেও সে ওই দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়েই পড়ে থাকতো। একদিন ওরকম দ্বিতীয় স্ত্রীসহ ফুপুর ভাসুরের ছেলে আবার বাড়িতে এসে আবার সেই ছোট বউকে নিয়েই শোয়ার আয়োজন করতে করতে তারাবানুর ফুপু তার ভাসুরের সেই ছেলের কাছে গিয়ে খুব অনুনয় বললেন, ‘বাবা, আমজাদ, তুমি আজ পাশের ঘরে গিয়ে তোমার ছেলে দুটোর কাছে ঘুমাও। ছোট বৌমা আর নাতনিকে আজ আমি আমার ঘরে আমার কাছে নিয়ে রাখি।’

ছোট বউ আমার ফুফুর থেকে অতখানি মান্যতা পাওয়ার মতো নয়। সে মান্যতা তাকে ও বাড়ির কেউ কোনোদিন দেয়নি। কিন্তু দীর্ঘদিন স্বামীর সাহচার্য ছাড়া বড় বউটির প্রতি সমব্যথি হয়ে ফুপুর যারপর নেই ওই চেষ্টা ছিল। কিন্তু ফুপুর ভাসুরের ছেলে কিছুতেই রাজি হলো না, বরাবর তাদের অত্যন্ত সম্মান পাওয়া, থানার বড় দারোগা তাদের ছোট চাচার স্ত্রী, আমার ফুপুর সে প্রস্তাবে। এক ঘরের ভেতর পার্টিশন দিয়ে করা দুটি রুম। তারই একটাতে বড় বউ থাকে। আর তার স্বামী এলে শ্বশুর-শাশুড়ি আরেকটি রুম ছেড়ে দিয়ে বারান্দার ছোট রুমটিতে যায়। দূরত্ব শুধু এটুকু। কিন্তু সেই দূরত্ব কোনোদিন আর বড় বউয়ের জীবন থেকে ঘোচেনি।

তারাবানুর আজো মনে আছে, ফুপুর ভাসুরের ছেলেকে ফুপুর অনুনয়-বিনয়ের সময়ে ঘরের ভেতর লম্বা ঘোমটা আড়ালে বড় বউটি লজ্জায় মরিয়া হয়েছিল। কারণ তার বাড়ন্ত ছেলে দুটি সেখান দিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। বারান্দায় তারাবানুর ফুপুর সাথে ছিল সে বড় বউটির নিজের শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়াও বাড়ির ওই শ্রেণির আরো মুরুব্বিরা। ছিল সেই কচি মাংসের তাল জাতগোত্রহীন তার স্বামীর দ্বিতীয়বার বিয়ে করে আনা সেই অকর্ষিত নারীও, যার কাছে মাটি হয়ে গেল কর্ষিত মৃত্তিকার মতো বউটির স-ব সম্ভাবনা ও অহংকারের গৌরব।

তারাবানুর বয়স তখন সাত-আটের বেশি হবে না! তবু তার মনে হচ্ছিল, কি লজ্জা। কি অপমান, স্বামীকে তার কাছে শোয়ানোর জন্য মুরুব্বিরা অনুরোধ করছে। তবু স্বামী তার কাছে যাবে না! যায়নি গত দীর্ঘ আট বছর। তবু সে বউয়ের মুখে হাসি ফুটে থাকতো। সংসারের প্রতিটি কাজ সে-ই করতো। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ির খেদমতও কম করতো না। গালভরে তাদের আব্বা-আম্মাও ডাকত! কেন বউটি অত ভাল ছিল, তারাবানুর বয়স বউটির কাছাকাছি হলে তখন ঠিকই তার কাছে জানতে চাইত, ‘তুমি এত ভালো কেন?’ ফুপুর ভাসুরের ছেলেকে তার প্রথম স্ত্রীর কাছে মাত্র একটি রাত কাটানোর সেই নিষ্ফল আকুতির বছর পাঁচেক পর যখন বউটি এমনি এমনি কদিনের জ্বরে মরে গেল, তখন তারাবানু পরিপূর্ণ কিশোরী। খবরটা শোনার পর সেই পাঁচ বছর আগে, তার কাছে তার স্বামীকে মাত্র একটি রাত যাপনের জন্য ফুপুর যে অপারগতা তিনি নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছিলেন, তার সব সুদে আসলে বেড়ে বহুগুণ হয়েছিল। ততদিনে তারাবানুর নিজেরও তো বয়স বেড়েছে। তাই তিনি সেই বড় বউটিকে এবার কল্পনায় মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলতে লাগলেন, ‘কেন এমনিই মরতে গেলি! কেন বিষ খেয়ে মরলি না? গলায় দড়ি জোটেনি তোর? জগতের বুকে কেন ক্রুশের মতো একটি কঠিন চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেলি না? কেন তোর নিজের মরণটা এমন অভিযোগহীন রেখে গেলি? কেন?’

তারাবানুর গা গুলাতে থাকে। নিজেকে ধমকান তিনি, পৃথিবীতে কতকিছু আছে ভাববার। এই যে নিজের দেশ ছেড়ে এমন একটি উন্নত দেশে তার আসার সুযোগ হয়েছে। তার উচিৎ এখানকার ভালো ভালো ঘটনায় স্মৃতির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে নিয়ে যাওয়া। ভালই তো তার দিন কাটছিল এখানে এসে। আগে ওই ফ্ল্যাটে কজন ছাত্র-ছাত্রী মেস বানিয়ে থাকতো। ছেলে-মেয়েগুলোর কলহাস্যে বাড়িটি মুখর হয়ে থাকতো। আগে তো তিনি ভাবতেই পারেননি, উন্নত দেশ হলেও ছাত্র-ছাত্রীরা একসাথে এভাবে থাকতে পারে। তাদেরকে তুলে বাড়িটা বিক্রি হয়ে রীটা এসে তারাবানুর মনে এই সংকট এই টানাপোড়েন তৈরি করেছে।

আর রীটার সূত্র ধরে একের পর এক ফেলে আসা বিস্মৃত অনেকগুলো অসহ্য মুখ তারাবানুর মনে পড়ে যেতে থাকে। তারাবানু যে স্কুলে পড়েছে, সেই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, সেক্রেটারির এক মেয়ে আদিলা আর তারাবানু একসাথে পড়তো। বড়লোক আদিলাদের বাড়ির কাছেই ছিল, খানদানি কিন্তু নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মানো তারাবানুদের বাসা। দুজনের খুব ভাবও ছিল। তাই দিনে দু-একবার দুই বাড়ির মাঝখানের মাঠের ভেতর দিয়ে আড়াআড়ি ওরা যাওয়া আসা করতো। একদিন তারাবানু ওরকম পিছনের পথ দিয়ে আদিলাদের বাড়িতে ঢুকছিল, আর তখনি ওর কানে চলে এল, ‘বুবু, আইজকার রাইতটা আমি হ্যার ঘরে শুই?”

শোয়ার এই কথাাটা বলছেন, আদিলার নিজের মা তার মায়ের বড় সতীনকে। মানে আদিলার সৎমাকে। কুয়োর প্রায় পনের ফুট কিংবা তারচেয়ে বেশি নিচে থেকে পানি তুলতে হত। আদিলার মা দড়িতে ছোট বালতি বেঁধে, সেই দড়ি টেনে টেনে পানি তুলে বিশাল দুই বালতি ভরে প্রতিদিন পানি তুলে দিয়ে সাংসারিক অন্য কাজে চলে যায়। আর আদিলার বড় মা ডলে ঘষে স্বামীকে গোসল করিয়ে, গা মুছিয়ে সাথে করে নিজের ঘরে নিয়ে যান। এর ভেতর স্বামীর সাথে টু-শব্দ করার অবকাশ থাকে না আদিলার নিজের মায়ের।

তারাবানুর বয়স কম হলেও তার মন প্রমাদ গুণতে শুরু করে দেয়। তিনি তখনি ভেবেছিলেন, মেঘ কতটা ভারী হলে আকাশে ফিরে না গিয়ে সে পৃথিবীতে এসে ঢেলে পড়ে। তেমনি আদিলার মার শরীর তাকে কতটা আলোড়িত করলে তিনি প্রভুর মতো সতীনের কাছে স্বামীর ঘরে একটি রাত কাটানোর প্রার্থনা জানাতে পারেন। তারাবানু তার নিজের চোখে আরো দেখেছেন, বড় বড় সংসারে শুধু কাজ করানোর জন্য দরিদ্র ঘর থেকে পরিশ্রমী মেয়ে দেখে দ্বিতীয়, তৃতীয় বিয়ে করিয়ে আনা হতো! আদিলার মাও যে ওই ঐতিহ্যবাহী পরিবারটিতে তেমন ছিল, তা কিশোরী তারাবানু আগেই আঁচ করতে পেরেছিল একদিন স্কুল থেকে তারা কজন এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে, পথে শনের ছোট ছোট দু-খানা ঘরের একটি বাড়ি দেখিয়ে বলেছিল, এটা আদিলার মামাবাড়ি।

শহরের বড় বাজারে শাড়ি-কাপড়ের বিশাল দোকান ছিল আদিলাদের। তার বাবা সকালে গিয়ে সেই দোকানে বসতেন। দুপুরে নেয়ে-খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে আবার হেঁটে হেঁটে দোকানে চলে যেতেন। আসতেন গভীর রাতে।

সেদিন আদিলার মার প্রশ্নের জবাবে আদিলার বড় মা যে ঝামটা মেরে ‘নায়!’ বলেছিলেন, নাটকের খণ্ডাশের মতো সে বিষয়টি তারাবানুর চোখের সামনে পড়ে গিয়ে, তখন তারাবানুর ফুপুর সেই ভাসুরের ছেলের বড় বউটির পর সরাসরি তারাবানু দেখলেন আরেক চরম নিগৃহীতাকে। সেই থেকে তারাবানু দীর্ঘদিন ভেবেছে, এই যে আদিলার মায়ের পেটে যে ওরা ছয় ভাইবোন জন্ম নিয়েছে, তাদের সবার শুক্রাণু কি তার বড় মা ভায়া হয়ে তারই অনুগ্রহ নিয়ে তার বাবার কাছ থেকে তার মাকে গ্রহণ করতে হয়েছে।

আদিলা খুব সুন্দরী ছিল। কারণ তার মাও খুব সুন্দরী ছিলেন। সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে, আদিলাকে দেখলেই তারাবানুর মনে হতো, একজন সন্তানের কাছেও ছাইচাপা থেকে যায়, কত মায়ের কত বঞ্চনার আগুন। তারাবানু আদিলার উদ্দেশ্যে মনে মনে বলতেন, আদিলা তোর জীবনের গরলে আমি প্রতি মুহূর্তে কতটা ফেনায়িত হচ্ছি, তুই তা কোনোদিনও জানবি না।

রীটার উঠোন থেকে এসে তারাবানুর মনের বয়স পিছিয়ে সেই তার স্কুলের শেষের দিনগুলোতে নিয়ে যায়। সে যেন পথ পায় না আর বেরোতে। আর সেখানে এসে ভেড়ে আরো অসংখ্য অসংখ্য নারীমুখ।

আরেকবার, সেও ওই আদিলাদের বাড়ির কাছের বাড়িতে থাকাকালীন কোনো এক গ্রাম থেকে তাদের প্রতিবেশীর একবোন এসেছিল ঢাকাতে চিকিৎসা করাতে। বছর পয়ত্রিশের মতো হবে তার বয়স। কদিনে একটু পরিচয় জমে উঠতেই সে এক গভীর রাতে এসে তারাবানুর মাকে বলছে, ‘আপা, আমার নিজের মা নেই। আর যাকে বলি, সে-ই আমাকে বুঝ দেয়। সবাই বলে, ‘বাদ দাও। তোমার ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেছে তুমি তাই নিয়ে থাকো।’ ছেলে-মেয়ে নিয়েই তো আছি আপা। কিন্তু সারারাত ঘুম আসে না। আপনার জানাশোনা কেউ থাকলে তার কাছ থেকে আমাকে একটা তাবিজ নিয়ে দেন। আমার স্বামী যেন আমার কাছে আসে।’

শীতের ঋতু ছিল তখন। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে ছিলেন কিশোরী তারাবানু। তখন বয়সটা তারাবানুরও এমন এক সন্ধিক্ষণে, যখন তাদের সমবয়সী দু-একজন করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। হোক না তা অকাল বিয়ে। আকলিমা নামের একজন তো বাচ্চা পেটে নিয়ে স্কুলেই আসে। নবম শ্রেণির পরীক্ষাটা শেষ পর্যন্ত তার দেওয়া হবে না বলে সে মনে করছে। তারাবানু যখন আরও দুই ক্লাস নিচে পড়তেন, তখন একদিন বিকেলে কানামাছি খেলতে গিয়ে দীপু নামের পাশের বাড়ির ধেড়ে ছেলেটি তাকে ছুঁয়ে দেওয়ার নামে পিঠ বা অন্য কোথাও না ছুঁয়ে সে তার বুকে এমনভাবে ছুঁয়েছে, যে তাতে তিনি যেমন ব্যথা পেয়েছিলেন, তেমনি খুব অপমানিতও বোধ করেছেন। দীপুর মা-বাবা অন্য কোথাও থাকতো। আর সে থাকতো তার দাদা-দাদির কাছে।

অপমান বোধে সেদিন নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে, তারাবানু দীপুর দাদা-দাদির কাছে গেলেন বিচার দিতে। চোখ ফেটে বেরিয়ে আসা জল নিয়ে মনে মনে পণ করলেন তারাবানু, যে গিয়ে বলবেন, দীপু তাকে পিঠে খুব জোরে কিল দিয়েছে। ব্যথায় তার দম আটকে আসছে।

তারাবানু দীপুদের খিল আঁটা গেটের কাছে গিয়ে প্রথমেই দরজার কপাটের কাঠ থেকে গিরা ছোটা ছিদ্র দিয়ে এক চোখ বন্ধ করে আরেক চোখে নিরিখ করে দেখে নিতে চাইলেন, বুড়ো দাদা-দাদি এদিকটায় আছেন কি না! তখনো পূর্ণ কিশোরী না হয়ে ওঠা তারাবানু দেখলেন, দীপুর বৃদ্ধা দাদি নিচে জলচৌকি পেতে বসা, আর তার ষাটোর্ধ দাদা তার দাদির সামনের জলচৌকি ছেড়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে লুঙ্গির গেরো খুলে স্ত্রীর মুখের কাছে নিজের লিঙ্গটি নিয়ে বলছেন, ‘ধর, ধর, ধরি ছা, লোহার নাহাল শক্ত!’ তারাবানু ঊর্ধশ্বাসে ছুটে পালাতে পালাতে নিজের ব্যথা-কষ্ট ওই মুহূর্তে সব ভুলে গেল। তার শরীর কাঁপতে কাঁপতে চিন্তা-ভাবনা পাল্টাতে থাকে। সে ভেবেছিল, দাদা-দাদিদের জীবন থেকে এই অধ্যায় বহু আগে চলে যায়। কিন্তু আজ তার ভুল ভেঙে গেল। সে কার কাছে কি বলতে এসেছিল!

নতুন আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসলো। কারণ পরিপূর্ণ বয়সের কোনো পুরুষের লিঙ্গ সে এই প্রথম দেখলো। তাহলে যে অনেককেই তিনি বলতে শুনেছেন, তাদের একেকজনের সাত, আট, নয়, দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। তাহলে তাদের কি উপায় হতো। কিভাবে তারা ওটা ধারণ করতো! তারপর থেকে বড় হতে হতে ওই চিন্তা আর তারাবানুর মাথা থেকে যায় না। একেকটা অকাল বিয়ের খবর শোনে আর দীপুর দাদার সেই দৃশ্য তার সামনে ভেসে ওঠে। কানে বাজে, ‘ধর, ধর, ধরি ছা’!

মায়ের কাছে তাবিজের জন্য আসা প্রায় তার মায়ের সমবয়সী নারীটিকে মা খুব মমতা নিয়ে বলেছিলেন, তোমার নাম কি?
নারীটি বলেছিল, আয়েশা!
মা বললেন, শোনো আয়েশা, এসব তাবিজ-কবজে আসলে কিছু হয় না। আমি তোমাকে বুদ্ধি দিই, তুমি নিজে তার গায়ের ওপর পড়ো না কেন? তুমি কেন তাকে টেনে ধরো না?
আয়শা বললো, কেমনে ধরি আপা। কাছে তো আসতে হবে। চার বাচ্চার বাপ সে, কোনো এক কারণে মামলা খাইছিল, কোনখানে কোন বন্ধুর বাড়ি পালাতে গিয়ে বন্ধুর অবিবাহিত কুমারী বোনকে বিয়ে করে বাড়ি তুলেছে। সেই থেকে সে আর আমার মুখোমুখি হয়নি। এখনো দিনরাত সারাক্ষণ তার কাছে পড়ে থাকে। দিনেরবেলাও আরেক ঘরের থেকে তার খাটের মচর মচর শব্দে আমি টিকতে পারি না। দিনভর হাসিঠাট্টা আর খিল এঁটে যা করে সব আমি টের পাই। আমার শেষে মনে হয়, পাগল হয়ে একদিকে হেঁটে চলে যাই। কিন্তু ছেলে-মেয়ের জন্য পারি না।

তারাবানুর মা বললেন, তোমার স্বামীর পেশা কি? সংসার চলে কি করে?
আয়েশা বললো, শ্বশুরের বংশের নামডাক আছে। অবস্থা ভাল। জমিজমা মানুষের কাছে বর্গা দেওয়া। তারা যা দেয়, তাতে সংসার ভালভাবে চলে যায়।’

তারাবানুর মা বললেন, তোমার শরীরের কি হাল করেছ তুমি! মন শক্ত করো। শরীরের যত্ম নাও। লোকটা মহাঘোরে আছে। তুমি একটু সেজেগুজে থাকার অভ্যাস করো। আয়েশা বললো, আপা, দাবানলে বনের কি থাকে? এই দুই বছরে আমি ছাই হয়ে গেছি। এত লজ্জার কথা কাউকে তো বলাও যায় না! নাহলে দেখতে তো আমিও সুন্দরী ছিলাম। শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে খুব পছন্দ করে এনেছিলেন। আর সেও তো কম ভাল বাসতো না!
এইসব কথপোকথন শোনার পর তারাবানুর মা’য়ের ওপর তারাবানুর খুব রাগ হল। মনে পড়লে এখনো হয়। মার ভাবা উচিৎ ছিল, তার চৌদ্দ/ পনেরো বছরের মেয়ে তারাবানু ঘুমিয়েছে না সজাগ! সজাগ থাকলেও তো তাদের দুজনের এ ধরনের কথা ওঁৎ পেতে তার শোনারই বয়স। নিজের শরীরের ভেতর সেই তখন থেকে অস্বস্তিভাব এসে যায় তারাবানুর। নারী-পুরুষ সম্পর্কের এই বিষয়টি মানুষের জীবনের এত ঘনিষ্ঠ, সেদিন ওই আয়েশা নামক নারী আর মা’র কথপোকথনে তারাবানু আরো স্পষ্ট করেই বুঝেছিলেন। আর সেই থেকে বিধাতাকে তার পুরুষই মনে হয়। নারীর এই অসহায়, বোবা বেদনা তিনি নিজে নিশ্চয় পরখ করে দেখেননি। নাকি এ তার নিষ্ঠুর এক খেলা।

সমাজের ঘেরাটোপ সরে গিয়ে দিনে দিনে তারাবানুর দেখা এসব নারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর তারা তার অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে যায়। এসব নারীরা তার সত্তারও একেকটা অংশ হয়ে যায়। তিনি কোনোদিনই এদেরকে আর মন-মগজ থেকে নামাতে পারেননি। সেই সাত সমুদ্র পার হয়ে এত দূর অস্ট্রেলিয়া এসেও, এত বছর পরও তারা একেকজন তেমনি তার মনে জ্বলে আছে। আদতে তারা অনেকে হয়ত এখন পৃথিবীতেই নেই। তবু তার আঁকা আকাশে ধূসর সেই তারাদের ভেতর এখন শুরু হলো প্রবল দাহ নিয়ে রীটার গনগন করে জ্বলে থাকা।

তারাবানু ভাবেন, মেয়েটি যা খুশি তা করুক। অনেক বন্ধু-বান্ধব আসুক তার ঘরে। তার যাকে পছন্দ হয়, তার সাথে সে দৈহিক সম্পর্কে মিলিত হোক! এছাড়া নারীমুক্তি ধুয়ে কি নারীরা পানি খাবে?
তারাবানু আবার ভাবেন, কিন্তু রীটা বিয়ে করছে না কেন? ওর শরীরের বাঁধন ভাল। কাজ জানে। নিজে বাড়ি কিনলো। দামি গাড়ি আছে। তাহলে কেন যোগ্য কেউ তাকে বিয়ে করে সুখী করছে না!

বাড়ির সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করার সময়ে তারাবানুর চোখের দৃষ্টি নিজের অগোচরে সুচালো হয়ে রীটার ঘরের জানালার ঘোলা কাচ ভেদ করে ঢুকে চলে যায়। তার চেতন-অবচেতন মন ওই ঘোলা কাচ ফুঁড়ে জানতে চায়, গাড়ি যখন বাড়ির সামনে এবং আর কোনো একটি গাড়িও যখন ধারে কাছে নেই, তাহলে এমন ভারী সন্ধ্যায় একা ওই নারীটি কি করছে? তারাবানু প্রবল চেষ্টায় অনুমান করেন, ছায়ার থেকেও আবছা কায়াটির বইয়ের পাতা উল্টনোর আভাস ভাসছে পর্দাহীন জানালার ধূসর কাচে।
এমনাবস্থায় তারাবানুর পানির পিপাসা পায়। ঘরে ঢুকে প্রতিদিনই ঢকঢক করে পুরো গ্লাস পানি তিনি খেয়ে ফেলেন। এখানকার পানি তার কাছে অত্যধিক ঠান্ডা মনে হয়। তবু যেন এমন সব সময়ে পিপাসা মেটে না। নাকি পানি তার সে পিপাসা ছুঁতেই পারে না! তিনি ভাবতে থাকেন রীটার স্বামী সেই মেয়েটিকেও তো বিয়ে করেনি। আবার রীটার কাছেও আসে। একটা, ডিভোর্সি বা বিপত্নীক পুরুষ যদি একটি কুমারী মেয়ে বিয়ে করতে চায়। সেটা তার দ্বারা অসম্ভব হয় না। আর তাই ছেলে-মেয়ের মা হয়ে যাওয়া নারীকে সে কেন গ্রহণ করবে? তার যত যোগ্যতাই থাকুক, অর্থবিত্ত থাকুক সেটার সাথে শরীরের টানটান মাংস পেলে শিথিল মাংসের নারীকে তারা কেন বিয়ে করে জীবনসঙ্গী করবে? রীটা কি তবে তার পাশে মাছের মতো ভনভন করা পুরুষদের সেইরকম মনোভাবের শিকার?

কিন্তু একজন নারী দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে গেলে সে দেখে, অগেরজনের চেয়ে দ্বিতীয়জন যেন কোনো অংশে যোগ্যতায় খাটো না হয়! তাহলে এই পরাজয়টা তার নিজের কাছেই অপমৃত্যুর সমান।
ভিন্ন ভাষাভাষী, ভিন্ন ভূখণ্ডের, ভিন্ন ধর্ম-সংস্কৃতির প্রায় পৌঢ়া এই নারীও অবশেষে তারাবানুর অতীতে দেখা সব অতৃপ্ত ও স্বামী দ্বারা নিগ্রহের শিকার নারীদের সাথে একত্র হয়ে তারাবানুকে ঘিরে কোনো কুয়াশাছন্ন নির্জন জায়গায় শীতের প্রবল হীমে প্রতিদিন বারবার জমিয়ে তোলে। আর বারবারই তার একার সে আড়ষ্টতা ভাঙতে সময় লাগে।