দুটি অণুগল্প ॥ সায়নী ব্যানার্জী


স্বীকারোক্তি

সুজাতার সাথে সৌম্যর যবে থেকে বিয়ে ঠিক হয়েছে , সৌম্যর বাড়ির সকলেই সুজাতাকে লক্ষ্মী বলে মনে করে। মাত্র কয়েক সপ্তাহে পরপর যেন সুসংবাদের ঢল নেমেছে বাড়িতে। দুজনের আশীর্বাদের দিন স্থির হলো। বাড়ি ভর্তি সেদিন লোকজন।লাল টুকটুকে শাড়িতে সুজাতা তখন আশীর্বাদের পিঁড়িতে।

হঠাৎ সুজাতার কানে এলো নিমন্ত্রিতদের একজন বলছে , ‌ ‘বেশ সতী লক্ষ্মী বৌ হয়েছে’। কথাটা কোথাও সূঁচের মতো বিধলো সুজাতার।

-না, আর দেরি করা উচিৎ হবে না। এখনই সৌম্যকে সবটা জানাতে হবে। কিছুতেই আমি ওকে ঠকাতে পারবো না।
দৌড়ে সুজাতা তখন তার হবু স্বামীর মুখোমুখী।

জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি তার নতুন জীবন শুরুর আগে জানাতেই হবে নইলে সে হয়তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না। সারাজীবন একজন ভালো মানুষকে ঠকানোর যন্ত্রণায় গুমরে যাবে। অনেক কথা চেপে রাখা, ছলছলে দুচোখ তখন সৌম্যকে বুঝিয়ে দিয়েছে অনেকটাই হয়তো এখনো জানা বাকি থেকে গেছে।
কাঁপা কাঁপা গলায় সুজাতা বলে,
– আমি তোমার সতী লক্ষ্মী বৌ নই। আমি তোমার চির অসতী সঙ্গী। ভুল মানুষকে ভালোবেসে প্রথম গর্ভের ভ্রূণকে মেরেছি আমি।আমি ঠকেছি কিন্তু ঠকাতে চাই না তোমায়। আমি সতী নই , নই
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো সুজাতা।
কাঁধে হাত রেখে সৌম্য বলে,
– নির্দ্বিধায় তোমার স্বীকারোক্তি আবার প্রমাণ করলো সুজাতা নারীরা শরীরে নয়, অন্তরের শুদ্ধতায় সতী হয়। তোমার প্রতি আমার সম্মান আজ থেকে আরও বেড়ে গেল। যে সম্পর্কের স্বচ্ছতা বোঝে সেই মেয়েই আমার আদর্শ জীবনসঙ্গী।

ঊলু ধ্বনি আর শঙ্খের সুরে সম্পূর্ণ হলো ওদের আশীর্বাদ।

প্রত্যাবর্তন
‘তোমার অসীমে, প্রাণ মন লয় ‘-চা এর কাপ হাতে দক্ষিণের বারান্দায় খোলা গলায় গান ধরলো প্রমিতা।বেশ কিছু বছর আগে ক্যাম্পাসের বিজয়া সম্মেলনীতে প্রমিতা গান গাইতে স্টেজে উঠলে সে দেখলো অনেক চেয়ার ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।আর চেয়ার এ বসে থাকা মানুষগুলো ছেড়ে যাচ্ছে কিছু ব্যঙ্গাত্মক হাসি আর অবজ্ঞার আচরণ।সেদিন সামনে বসে থাকা এক বয়স্ক মহিলা প্রমিতার ঘাবড়ে যাওয়া মুখ দেখে ভরসা দিয়ে বলেছিলেন,‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। ভরসায় বুক বেঁধে সেই থেকে প্রমিতার গানের অনুষ্ঠানের পথ চলা শুরু।আজ দেখতে দেখতে সাতটা বছর পেরিয়ে গেছে।ঝুলিতে এসেছে অনেক সম্মান ,অর্থ,যশ আর তার পাশাপাশি অনেক কটূক্তি,ব্যঙ্গ,অপমান।প্রথম যেদিন প্রমিতা ওর বাবা মা কে জানিয়েছিল যে ও পার্থ সরকার থেকে প্রমিতা সরকার হতে চায় ,সেদিন সমাজের কিছু কুরুচিপূর্ণ,অবমাননা আর অযাচিত প্রশ্নের ভয়ে ঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন প্রমিতার বাবা।আমাদের সমাজ যে বোরো অদ্ভুত।দূর থেকে দেখা মানুষগুলোর মুখে মুখোশের যে কত স্তর আছে তা বোঝা অসম্ভব।তাদের কৌতূহল ভরা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে ভয় পেয়ে সেদিন পার্থ ওরফে প্রমিতাকে অস্বীকার করেছিলেন তিনি।এরপর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো দিন।প্রমিতার বাবা মিথ্যে কিছু কথায় নিজেকে ভুলিয়ে, সমাজকেও ভুলিয়ে রেখে আজও এক অজানা ঘোরের ভিতর বাস করেন।

সেদিন ছিল রবিবার।বাড়িতে এক বসে টিভির চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একটি চ্যানেলে দেখলেন, -সাক্ষাৎকারপর্বে উপস্থিত-সফল গায়িকা রূপান্তরিত প্রমিতা সরকার।চেয়ার এর হাতল দুটো শক্ত করে ধরে জল ভরা ঝাপসা চোখে তখন পর্দার ওপারে বাবার আদরের পার্থ।কিন্তু প্রমিতার কথায় তাদের প্রতি নেই কোনো অভিমান,অভিযোগ।সাফল্যের আকাশ ছুঁয়ে সে প্রমাণ করেছে সাফল্য নারী বা পুরুষের কাছে আসে না,আসে মানুষের কাছে।কিছু মুখোশধারী মানুষের তিরস্কার জেদ হয়ে পুরস্কার রূপে এসেছে তার ঝুলিতে।

তিন দিন পর বাড়িতে বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন।ফুল দিয়ে সাজানো গোটা বাড়িতে আজ আবার ফিরছে বাড়ির ছেলে- না ছেলে না-গর্বিত বাবার সন্তান প্রমিতা সরকার।নিমন্ত্রিতদের আড়াল থেকে একজন বলে উঠলেন-‘একজন হিজড়ার জন্য এত বাড়াবাড়ি-ঘরের ভেতর থেকে ভেসে এলো প্রমিতার গলায় রেকর্ডিং,‘ছোড়ো বেকার কি বাতও মে কাহিন বিত না যায়  রায়না,কুছ তো লোগ কেহেঙ্গে/লোগোকা কাম হ্যা কেহেনা’।