আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর ছোটগল্প (পর্ব-৬) ॥ রকিবুল হাসান


‘সুন্দর হে সুন্দর’ গ্রন্থের ‘সুন্দর হে সুন্দর’ গল্পটি বাঙালি জীবনের প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অম্লমধুর বাস্তবের আলেখ্য। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনা করা যায় না।বাঙালি জীবনে বিষয়টি একই সুতোয় বাঁধা।তাই সুখ ভোগ করতে গেলে দুঃখ-কষ্ট তার জীবনে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে।জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে গেলে অসুন্দরও তেমনি দানা বেঁধে ওঠে।অমসৃণ পথে পা বাড়ানোর চিত্র উন্মোচন করে সমাজ-বাস্তবতার এক জীবন্ত চিত্র তুলে ধরেছেন।

মানুষ জীবন ও জীবিকাকে সুন্দর ও মসৃণ করে তুলতে চায়।তাই সামাজিক প্রতিকূলতায় প্রতিনিয়ত তাদের সংগ্রাম করতে হয়।নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য বেছে নিতে হয় অসুন্দরের পথ।এ গল্পে দেখা যায় মমতা ভালো বেতনের চাকরিজীবী রায়হানকে বিয়ে করে এবং মনের মধ্যে অনেক সুন্দর স্বপ্ন বুনে।কিন্তু তার স্বামী চাকরি হারালে তাকে জীবন ও জীবিকার জন্য বেছে নিতে হয় গানের মাস্টারের চাকরি।অন্যদিকে মঈন নীলুফাকে বিয়ে করেন।কিন্তু তাকেও জীবিকার পথ হিসেবে বেছে নিতে হয় শিল্পীর।ছবি এঁকেই তার মজুরি মেলে।

সর্বোপরি বলতে হয়, গল্পটিতে নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের জীবন প্রণালীর বিচিত্রতা এবং জীবন-জীবিকার টানাপড়েনের জটিল আবহ চিত্রিত।

ছা-পোষা সমাজের প্রতিনিধি আমাদের দরিদ্র শিক্ষকসমাজ।এই শিক্ষক সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত অসম দুঃখ কষ্টের করুণ চিত্রের ফসল ‘উত্তরণ’ গল্পটি।

গল্পের নায়ক হত দরিদ্র শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি নেয়ামত মাস্টার। স্ত্রী কন্যা নিয়ে তার মাস চলে ত্রিশ টাকায়।তবুও সেটি প্রতি মাসে পাওয়া যায় না। তাই ছাত্র পড়িয়ে অনেক কষ্টে তার সংসার চলে।তার স্ত্রী রাগে ক্ষোভে তাকে মুটোগিরি করতে বলে।

অন্যদিকে এই শিক্ষকের কাছ থেকে হাতেখড়ি দিয়ে যারা আজ বড় চাকরি করছে তারা পিয়নকে পঁচাত্তর টাকা বেতন দিচ্ছে অথচ শিক্ষকের ভাগ্য বদলের জন্য কোন চেষ্টা করছেন না।এমনকি শিক্ষকের প্রতি তারা ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধটুকুও করতে পারে না।সমাজের এ শ্রেণির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে শওকত মিজি ও তার স্ত্রী লুৎফার মধ্যে।আবার আত্মগর্বে ফেটে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে পিয়ন রহিমকে দিয়ে নেয়ামত মাস্টারের কন্যার বিয়ে ঠিক হওয়াতে।কারণ মাস্টারের বিশ্বাস রহিম তার শ্বশুরের পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।

তাই একদিকে পিয়ন রহিম যেমন খুশি হয়েছে ঠিক তার চেয়েও বেশি খুশি হয়েছে স্কুল মাস্টার।আসলে সুখ-স্বচ্ছলতা একটু আপেক্ষিক ব্যাপার।গ্রামের সাধারণ মানুষভাবে সব সুখ যেন শহরে আটকা পড়ে আছে।সঙ্গত কারণেই প্রাইমারি স্কুলশিক্ষক নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন শহরের এক পিয়নের সঙ্গে।তিনি ভাবেন রহিম পিয়ন হলেও হয়তো দারিদ্র্য-নিপীড়িত প্রাথমিক শিক্ষককে সত্যিকারের শ্বশুরের মর্যাদায় শ্রদ্ধা করবে।

সর্বোপরি বলতে হয়, গল্পটিতে সমসাময়িক কালের নিপীড়িত, নির্যাতিত, অবহেলিত ও অত্যাচারিত একজন হত দরিদ্র প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকের জীবন জটিলতার বাস্তব চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।
চলবে..