আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর ছোটগল্প (পর্ব-৫) ॥ রকিবুল হাসান


‘ত্রিযামা’ গল্পে সমাজজীবনে বসবাসরত নানান প্রকৃতির লোকের দোষ-ত্রুটি-হিংসাদ্বেষ, অপকৌশল কার্যসিদ্ধি করার চেষ্টা বর্ণিত হলেও এর মূল বিষয় প্রেম।মিজান ভুঁইয়ার মেয়ে রোশনার প্রতি জহির চৌকিদারের দুর্বলতা এবং তাকে পাবার জন্য সে বিভিন্ন অপকর্মে যুক্ত হয়ে পড়ে। রোশনাকে পাবার জন্য সৈন্যদলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও, বাস্তবে তা হয়নি, হয়েছে চৌকিদার-যার কাজ হলো চোর-ছ্যাঁচোড়কে ধরা, পিটুনি দেওয়া। মানসিকভাবে এ চাকরি সে পছন্দ না করলেও মায়ের কান্নাকাটির কারণে চৌকিদারি গ্রহণ করে। কিন্তু এসবের পরেও গল্পে যা প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে তা হলো রোশনাকে পাবার জন্য তার একটির পর একটি অন্যায়, অপকর্ম ও ষড়যন্ত্র।আর এসবের শুরু হয় যখন রোশনার বাবা মিজান ভূঁইয়া তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

মনের গহীনে সে রোশনাকে না পাবার বেদনা সংগোপনে লালন করে চলে। হঠাৎ একরাতে ‘দীঘির ভৌতিক অস্পষ্ট অন্ধকারের ছায়াশূতিটাকে দু’বাহুতে ঘিরে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে’ থাকতে দেখে সে ভাবে হয়তো এ গভীর রাতে রোশনাও তার স্বামী মন্তাজের বলিষ্ঠ রোমশ বুকের ভেতর সমর্পিতা হয়ে আছে।জহিরের মনে তখন ঈর্ষার আগুন জ্বলে ওঠে।মন্তাজকে জব্দ করে রোশনাকে পাবার একটা আকুতি তার মধ্যে জন্ম নেয়।মন্তাজকে জব্দ করার জন্য সে তার বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত তৈরি করে।প্রেসিডেন্টের প্রিয় রাতের কারবারী করিমের সহায়তায় সে মন্তাজের ঘরে চুরির মাল রেখে দেয়।পুলিশ মন্তাজকে ধরে নিয়ে যায়।রোশনা বুঝতে পারে এটি চক্রান্ত।তার চোখে মুখে আগুন জ্বলে ওঠে।সে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে বলে ‘আমার স্বামী নির্দোষ’।

মন্তাজ অসুস্থ থাকার কারণে সে যে বিছানা ছেড়ে পর্যন্ত ওঠেনি তাও রোশনা স্পষ্টভাবে জানায়।জহিরের চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যায়।করিমই চোরাইমালগুলো মন্তাজের ঘরে রেখে এসেছিলো।এছাড়া মন্তাজের স্ত্রীর গয়নাপত্র এই করিমই চুরি করেছে।মন্তাজ প্রেসিডেন্টের প্রিয়পাত্র করিমকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। আর সে হেরে যায় রোশনার কাছে।ব্যর্থ প্রেমিক হিসেবেই জহির চরিত্র চিত্রিত হয়েছে।সর্বোপরি সমাজজীবনের নানা অসঙ্গতি গল্পটির বিষয়বস্তু হিসেবে স্থান পেলেও একটি ব্যর্থ প্রেমের গল্প হিসেবেই এটির গুরুত্ব অধিক।

‘জইতুন’ গল্পে সমাজের নিকৃষ্ট একশ্রেণির চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। সাদাসিধে স্বভাবের সুরুয সাধারণ এক জিলিপি বিক্রেতা।সততা ও আদর্শ মেনে তার জীবন।কোনো অন্যায়, অসততা, মিথ্যাচারিতা তার মধ্যে নেই।স্বল্পভাষী সুরুয নিয়মকানুন মেনে সামাজিকভাবে জইতুনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। চেরাগ মিজির মাধ্যমে।মিজি আশঙ্কা করে জইতুনের সঙ্গে সুরুযের বিয়ে তেমন কঠিন না হলেও জলিল সমস্যা তৈরি করতে পারে।কারণ জলিল জইতুনকে চতুর্থ স্ত্রী হিসেবে পেতে বদ্ধপরিকর।জলিলকে যখন সুরুযের বিষয়টি জানানো হলো তখন সে বাধা দেয় না। বরং ‘খুশি মনে আরো পঁচিশ’ টাকা ঋণ দেয় সুরুযকে।

কিন্তু এর বিনিময়ে একটা চিরকুটে সুরুযের টিপসই নিয়ে রাখে।মনে মনে ভাবে সুরুযকে একসময় সর্বশান্ত করে জইতুনকে তালাক দিতে বাধ্য করবে এবং এরপর সে নিজে জইতুনকে বিয়ে করবে।জলিলের চক্রান্ত অনুযায়ী সুরুযের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। সুরুয এতে অবাক হয়।জলিল সুরুযের কাছে জইতুনকে তালাক দেওয়ার প্রস্তাব দিলে রাগে ক্ষোভে ঘৃণায় সে জলিলের গালে কষে এক চড় মারে। তারপর ঘরে ফিরে যখন জইতুনকে বলতে শোনে ‘দোহাই তোমার, ক্যান আমার লাইগ্যা মান-সম্মান, বাড়ি-ঘর, জোত-জমি হারাইবা’ তখন দুঃখ-কষ্টে জইতুনের গালেও কষে চড় মারে।এরপর সুরুযের দুচোখ পানিতে ভরে ওঠে। আর সে চোখে তখন ‘দুঃসহ ক্রোধ, তিক্ত ঘৃণা, নিদারুণ বেদনার ম্লান ছায়া’।সমাজে জলিলের মত নষ্ট মানুষেরা ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য বিভিন্ন চক্রান্তের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে যে কত রকম বিপদ সমস্যা ও অসম্মানের মধ্যে ঠেলে দেয় এবং মানসম্মান, বাড়িঘর, জোত-জমি এসবের থেকেও সুরুযের মত মানুষের কাছে স্ত্রীই বড়-এ দুটি দিক গল্পের প্রধান আকর্ষণ হয়ে ওঠে।গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে সমাজের একশ্রেণির মানুষের নোংরা কর্মকাণ্ডের ফলে সাধারণ মানুষেরা কিভাবে ভোগান্তির শিকার হয় তা উপস্থাপিত হয়েছে।