আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর ছোটগল্প (পর্ব-২) ॥ রকিবুল হাসান


‘অন্য কোনখানে’ আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর এক নাগরিক জীবনের জটিলতার গল্প। নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ অভাব-অনটনে পড়ে কিভাবে চরিত্রের স্খলন ঘটান এবং সমাজের উচ্চশ্রেণিতে পরিণত হন তার এক বাস্তব চিত্র এ গল্পে ফুটে উঠেছে।

এ গল্পের নায়িকা মিস নীলিমা নাসরিন।সে গ্রাম্য সহজ-সরল বিএ ফেল যুবকের স্ত্রী।চাটগাঁর লাভ লেনের ভাঙাবাড়িতে তারা বসবাস করত। স্বামীর টাকা নেই মূলধন নেই।স্বামীর কারণেই এই ভাঙাবাড়ির সামনে মাঝে মাঝেই মোটর এসে দাঁড়াত।ধনাঢ্য মানুষের আগমন ঘটতো। কিন্তু নীলিমা এসবে প্রবল আপত্তি করতো, বাধা দিত এবং নিরুপায় হয়ে কান্নাকাটি করতো।অথচ তাঁর স্বামী অনড়।কারণ নীলিমা তার বিয়ে করা বউ।বউয়ের ওপর তার যথেচ্ছার অধিকার রয়েছে।এই অধিকারকে পুঁজি করে নিজের বউকে বাধ্য করে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সঙ্গ দিতে, তাদের মনোরঞ্জন করতে।অবশেষে স্বামীর অনৈতিকতা ও অপইচ্ছার কাছে হেরে নীলিমা গ্রাম্যবধূর পোশাক খুলে আধুনিকা হয়ে ওঠে।আর এর পিছনে ইন্ধন জোগায় জোয়ারদার।ঠিক দশ বছরে নীলিমা মোহনীয় ও ধনবতী মহিলাতে পরিণত হয়।বর্তমানে সে কসমোপলিটান ট্রেডার্স-এর সেক্রেটারি।

তারই স্বামী আশরাফ আলম তার হেড ক্লার্ক।স্বামীর সামনেই সে ইভনিং রিক্রিয়েশন করার জন্য ওভারসিজ এজেন্সির ডিরেক্টর মি. ডানকান, নজফ খোরাসানি, গ্রীন হিলের জোয়ারদারকে ডাকেন।এ সমস্ত ঘটনায় আশরাফ আলম মলিন বিমর্ষতায় কামরা থেকে বেরিয়ে আসেন। লেখকের ভাষায় যা চিত্রিত হযেছে এভাবে- একটা মৃতদেহ যেন হেঁটে বেরিয়ে আসে খাস কামরা থেকে।সকলে অবাক হয়ে দেখে।

অফিসের জুনিয়র টাইপিস্ট মেঞ্জিসের স্বভাব বউ পাল্টানো।তার দ্বিতীয় বউ তাকে ডিভোর্স দিয়েছে এ কথা অফিসে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি করে। নীলিমা নাসরিন আশরাফ আলমকে ডাকার আগেই সে হাজির হয়ে পদত্যাগ পত্র দিয়েছে।আশরাফ আলম নির্ভয়ে স্ত্রীর মতো সম্মোধন করে কথা বলেছে।তারপর সে বিবর্ণ ও বিমর্ষ বেশে নয় স্বহাস্য ও জীবন্ত বেশে কামরা থেকে বের হয়ে এসেছে।

লেখক তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-
মেম সাহেবের চেম্বার থেকে আজ আর একটা মৃতদেহ নয়, রক্ত-মাংসের সজীব আরেক আশরাফ আলম যেন বেরিয়ে আসেন।তারপর থেকেই নীলিমা স্বাভাবিক থাকতে পারেননি।দশ বছর আগের স্মৃতি তার ভেসে ওঠে।সমাজের এ দুর্বৃত্তদের প্রতি তার ঘৃণা নিক্ষিপ্ত হয়।স্বামীর ছবিটিতে আগুন ধরিয়ে অ্যাসট্রেতে গুঁজে দেন।ছটফট করে ওঠে তার মনপ্রাণ। ঘামতে থাকেন অবিরত।হঠাৎ সকালে হাউমাউ করে দরজায় আঁছড়ে পড়ে মেঞ্জিস।কারণ, তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে আশরাফ আলম পালিয়েছে।

সর্বোপরি, গল্পটিতে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ ও নাগরিক সভ্যতার জীবন-জটিলতার বাস্তব আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে।গল্পকার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নগরজীবনে ঘটে যাওয়া অসঙ্গতিগুলোকে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।

‘আদিম’ মূলত সামাজিক প্রেমের গল্প।জেলে কন্যা লক্ষ্মীকে ঘিরেই এর কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।এই গল্পে ইলশার বুকে জেলেদের জীবনযুদ্ধ, সোনাকান্দি গ্রামের মানুষদের জীবন-জীবিকা-সংগ্রাম, আর্থ-সামাজিক, সে সঙ্গে সুন্দর তরুণী-বধূ লক্ষ্মীকে ঘিরে বংশীর প্রেম-ঈষা-হিংসা-প্রতিশোধপরায়ণতা এবং সোনাকান্দির বিত্তশালী মনসুর তালুকদারের প্রেমার্তি পাঠকের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।লক্ষ্মী চলা চোখের আলোতে মনসুর তালুকদারকে সম্মোহিত করে ইলশা নদীতে বাঁধ দেবার অনুমতি লাভ করিয়ে নেয়।

মনসুর তালুকদার নিজেও জানতেন নদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে সোনাকান্দি গ্রামের মাঠের পর মাঠ ধান পচে যাবে।অভাব-অনটনে জর্জরিত হবে সাধারণ মানুষ।কিন্তু লক্ষ্মীর চোখের আলোর নাচন আর রহস্যময় শরীরী সৌন্দর্যে তার কাছে সে সব তুচ্ছ হয়ে ওঠে।নদীর বুকে এই বাঁধ নির্মাণকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীর স্বামী যুগল এবং সেকান্দারের মধ্য বাক-বিতণ্ডা শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সেকান্দারের মাথা ফেটে রক্তাক্ত হয়।তখন যুগলভাবে সেকান্দারকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখলে সারা গ্রামের লোক তাদের দিকে ছুটে আসবে এবং আক্রমণ করবে।ফলে যুগলের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক ও অস্থিরতা তৈরি হয়।লক্ষ্মী তা বুঝতে পেরে ছুটে আসবে এবং আক্রমণ করবে।

ফলে যুগলের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক ও অস্থিরতা তৈরি হয়।লক্ষ্মী তা বুঝতে পেরে স্বামীকে নির্ভাবনা করে জ্ঞানহীন সেকান্দারকে মায়াবী স্পর্শ বুনে দিতে থাকলে একসময় সে জ্ঞান ফিরে পায়।লক্ষ্মীর স্পর্শে মুহূর্তসময় সে মোহাবিষ্ট হলেও হঠাৎ স্ত্রী সখিনার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় তার মোহচ্যুতি ঘটে এবং সে দ্রুত সখিনার কাছে ছুটে যায়।এই দৃশ্য লক্ষ্মীর প্রেমপ্রার্থী বংশী দেখে ফেলে। যুগলের কাছে বারবার অপমানিত হওয়া এবং লক্ষ্মীকে নিজের করে না পাবার কারণে প্রতিশোধপরায়ণ বংশী হয়তো এরকম একটি সুযোগের অপেক্ষাই করছিলো।বংশী বুঝতে পারে রক্তাক্ত সেকান্দারকে দেখে গ্রামের লোক প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে এবং বাঁধ ভেঙে ফেলবে।

আর এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সে যুগলকে খুন করার পরিকল্পনা করে।কারণ সে নিশ্চিত-এ খুনের দায় পড়বে গ্রামবাসীর ওপর।সবাই জানবে যুগল গ্রাম্য-বিবাদে খুন হয়েছে।তারপর লক্ষ্মীকে নিয়ে সে চলে যাবে।অর্থাৎ সাগরের নিরুদ্দেশ বুকে।বংশী খুন ঠিকই করে কিন্তু যুগলকে নয়, মনসুর তালুকদারকে।অন্ধকারে বংশী ঠিক চিনে উঠতে পারেনা তাকে। আর যে লক্ষ্মীর জন্য এতসব করলো বংশী- সেই লক্ষ্মীর সজোর ধাক্কাতেই নদীগর্ভে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যায় সে।বাঁধ ভেঙে যায়। গহীন স্রোতে ভেসে যায় মনসুর তালুকদার, আর সে সঙ্গে বংশীও।নারী নিজের শরীরি সৌন্দর্য ও চোখের যাদু পুরুষের চোখে-মনে ছড়িয়ে আদিম প্রবৃত্তির নেশা জাগিয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হবার যে চেষ্টা এটিই এই গল্পের প্রধান দিক।

এই গল্পটিতে জীবন সংগ্রামের এক অনবদ্য চিত্র পাওয়া যায়।দরিদ্র রূপসী নারীর অসহায়ত্বকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা ধণীশ্রেণির স্বভাবজাত, আর এই অন্যায় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করার কারণে অসংখ্য মানুষের জীবনে কতটা ভয়াবহ ক্ষতি নেমে আসে, আবার জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য জেলে কন্যা রূপবতী লক্ষ্মীর বিভিন্ন ধরনের ছলাকলার আশ্রয় গ্রহণ, প্রেমে ব্যর্থ বংশীর ঈর্ষা, প্রতিশোধপরায়ণতা গল্পটির বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।