নাটক ‘এর নাম জীবন’ ॥ নাসরিন সুলতানা


ছবি ও অলঙ্করণ: লংরিড

চরিত্র পরিচিতি:
১. রুবি: মূল চরিত্র, ২৮
২. সান: রুবির প্রেমিক ও স্বামী, ৩৭
৩. সাথী: সানের বোন, ৩৪
৪. সাজিদ: রুবির সাথে বিয়ে হবে, ৩৫
৫. রুবির মা
৬. রুবির বাবা
৭. সাজিদের মা
৮. সানের মা
৯. এমডি
১০. সাথীর স্বামী


[রুবি শুয়ে আছে। ঘুম ভাঙল। মোবাইল ফোন দেখল।]
রুবি (মনে মনে): এসএমএস কে দিল? নিশ্চয়ই আমার সান।
সানের কণ্ঠ: ভালোবাসায় সুখ-দঃখ, আনন্দ-বেদনা আছে। এই অম্ল-মধুর ভালোবাসায় নিমজ্জিত থেকো। শুভ ভালোবাসা দিবস।
[রুবি ফোন করল।সানের অসাধারণ হাসি।]

ফোনালাপ:-
সান: হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, ময়না পাখি।
রুবি: হুঁম।
সান: কেবল ঘুম থেকে উঠেছ?
রুবি: হুঁম।
সান: তোমার এই ঘুম ঘুম কণ্ঠটা যে কী ভালো লাগে! ইচ্ছে হয়…
রুবি: হুম।
সান: কেমন আছ?
রুবি: হুম।
সান: হুম হুম হুম…এরকম করলে তো আমি পাগল হয়ে যাব।
রুবি: হুম।
সান: হাহাহা…
রুবি: হুম।
সান: ওঠ। হাত-মুখ ধোও।বাইরে নাস্তা খাব।
রুবি: হুম।
সান: হা হা হা…আমি তোমার বাসার সামনেই আছি।তুমি মেইন রোডে এলেই আমাকে পাবে।
রুবি: হুম।
সান: একটা ফোন তুমি হুম দিয়েই শেষ করলে। ইউ আর অলওয়েজ স্পেশাল, ময়না পাখি!
রুবি: হুম।
সান: হাহাহা…আচ্ছা, রাখছি। তাড়াতাড়ি এসো।
রুবি: হুম।

২.১
[রাস্তায় হাঁটছে রুবি ও সান]
রুবি: তুমি আমার নম্বরে ফোন করলে না কেন ?
সান: কখন?
রুবি: একটু আগে।
সান: মানে?
রুবি: তুমি যে সোহানার নম্বরে ফোন করে আমাকে আসতে বললে?
সান: তাই, নয়? তুমি এত বড় একটা বোকাকে পছন্দ করলে…আফসোস হয় তোমার জন্য।কী আর করবে বল, ধরে নাও ঐ সোহানাই তুমি। কারণ সোহানার নম্বর আমি জানি না।
রুবি: তাই? তা হলে ও কি আমার ফোন রিসিভ করেছিল?
সান: ময়না পাখি, কোটি কণ্ঠের মধ্য থেকে আমি তোমার কণ্ঠটা আলাদা করতে পারি।
রুবি: হাহা হাহা হা…আমি তো কিচ্ছু বলিনি।
সান: তবুও।তোমার সব কিছু অন্য সবার থেকে আলাদা।
রুবি: তোমারও।

২.২
[রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছে রুবি ও সান।]
সান: সাথীর বিয়ে সেই ছেলেটার সঙ্গেই ঠিক হয়েছে।
রুবি: সোনালী ব্যাংকের অফিসার?
সান: হুম।
রুবি: বাড়ি কোথায়?
সান: বাড়ি তো তোমাদের ঐদিকেই। বাবাও ব্যাংকের অফিসার ছিল।
রুবি: চিনি না। গ্রামের কাউকেই তেমন চিনি না।কোনোদিন তো যাওয়া হয় না।চিনব কী করে?
সান: আমি তোমাকে তোমাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাব।
[হাসল রুবি]
সান: সত্যি।অত বড় একটা বাড়ি, খালি পড়ে আছে, দেখতে ইচ্ছে করছে।
রুবি: দেখাব তো।
সান: তুমি কী দেখাবে? আমিই তোমাকে দেখাব।
[হাসল রুবি]
সান: হাসছ কেন?
রুবি: আচ্ছা, দেখিও।


[সান আর তার মা সোফায় বসে আছেন।]
সান: বিয়ে মসজিদে হবে।ওখানে কাজি নিয়ে যাব।বাসায় এসে সাথীর স্বাক্ষর নিয়ে যাবে।
মা: কাজির দ্বারা বিয়ে পড়ানো আমার ভালো লাগে না।বিয়ে পড়াতে হয় একজন পরিচিত নেককার মানুষের দ্বারা।
সান: এটা একটা ভালো কথা।জীবনের শুরুটা একজন ভালো মানুষের দ্বারাই হোক।
মা: বিয়ের সাথে সাথে কাবিন করার দরকার নেই।দুদিন যাক।ওরা দুজন দুজনকে জানুক।
সান: মোহরানা ধরতে হবে এখনই।
মা: তা তো হবেই।মোহরানা বিয়ের একটা শর্ত।মোহরানা ধরতে হয় মেয়ের মর্যাদা এবং ছেলের সামর্থ্য অনুযায়ী।
সান: সেটাই।মোহরানা বাকি রাখলে ওটা আর নেওয়া যায় না।
মা: যে ছেলে মোহরানা দিতে পারবে না তার কাছে মেয়ে দেওয়ার দরকার কী?
সান: বেশিরভাগ মানুষই তো বাকি রাখে।
মা: কী দরকার? তুমি বিশ হাজার দিতে পারবে, সেটাই লিখে দাও।সেই রকম পরিবার থেকে মেয়ে আনো।তুমি লিখে দিলে পাঁচ লাখ, দিলে না পাঁচ টাকাও, এটা কী রকম বিয়ে?
সান: তাই তো।
মা: তোর বাবা কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই মোহরানার টাকা দিয়েছিল।
সান: সেটাই তো নিয়ম, মা।


[রুবি হাঁটছে। ]
ফোনালাপ:-
রুবি: রুবি রুবি করে ডাকো।
সান: রুবি!
রুবি: আবার।
সান: রুবি!
রুবি: আবার।
সান: হাহাহা… কেন?
রুবি: ভালো লাগে।ডাক।
সান: রুবি!
রুবি: থ্যাংকইউ।কারো ডাক এত সুন্দর লাগে না।
সান: তুমি আমাকে বেশি ভালোবাস তো তাই এরকম মনে হয়।
রুবি: না, তোমার সব কিছু সুন্দর।আগে আমার মনে হত তুমি আমাকে বেশি ভালোবাস তাই আমার সঙ্গে সুন্দর করে কথা বল।পরে খেয়াল করলাম যে আমি লাইনে থাকতে তুমি যখন অন্য কারো সঙ্গে কথা বল তখনও সুন্দর করে বল।
[রুবি রিকশায় উঠে বসল।রিকশা চলতে শুরু করল।]
সান: রিকশার শব্দ পাচ্ছি কেন? তুমি কোথায়?
রুবি: আমি একজনের সঙ্গে এক জায়গায় যাচ্ছি।
সান: কোন জনের সঙ্গে কোন জায়গায় যাচ্ছ?
রুবি: নদীর পাড়ে সুন্দর একটা ফুলের বাগান করা হয়েছে।বিভিন্ন চ্যানেল থেকে দেখাচ্ছিল যে ওটা বসন্তের প্রথম দিন খুলে দেওয়া হবে। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম তোমাকে নিয়ে ওখানে যাব।কিন্তু তুমি নিয়ে গেলে না।
সান: ইট ওয়াজ ইন ইওর মাইন্ড।তুমি আমাকে বললে আমি তোমাকে অবশ্যই নিয়ে যেতাম।
রুবি: তুমি তো হঠাৎ করেই চলে গেলে।
সান: এখন কোথায় যাচ্ছ তাই বল।
রুবি: এখন আমি একজনকে নিয়ে সেই ফুলের বাগানে ঘুরতে যাচ্ছি।
সান: সেই মানুষটা কে?
রুবি: সেটা তোমাকে বলা যাবে না। শুধু এটুকু বলতে পারি যে সে তোমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর।
সান: তার মানে তুমি একা।
রুবি: কেন?
সান: তোমার চোখে তো আমার চেয়ে সুন্দর কেউ নেই।
রুবি: শোন, চলার পথে যখন আমি শর্ষে ক্ষেত দেখি, কৃষ্ণচূড়া বা যে কোনো সুন্দর জিনিস, আমি যত ব্যস্তই থাকি বা আমার মন যত খারাপই থাকুক না কেন তোমার কথা মনে পড়ে যায় এবং সাথে সাথে মনটা ভালো হয়ে যায়।
সান: তাই?
রুবি: মনে হয় কী, জানো? ওদের চেয়ে তুমি কত সুন্দর!
সান: হাহাহা…তোমার মাথাটা আসলেই খারাপ হয়ে গিয়েছে।
রুবি: টিভিতে একটা সাবানের এড দেয়, নামটা বোধ হয় ডেটল। ছোট একটা ছেলে, গোসল করে আর নাচে।ওকে দেখলেও আমার তোমাকে মনে পড়ে।খুব সুন্দর বাচ্চাটা।আমার মনে হয় তুমি ছোট বেলা ওর মতো ছিলে। যদি পার দেখে নিও।
সান: আচ্ছা।
রুবি: কতদিন বললাম, এতগুলো টিভি চ্যানেল, তোমার পরিচিত এত মানুষ, তুমি একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা কর।
সান: আহহা, তাহলে তো আমি সবার হয়ে যাব।আমি তো সবার হতে চাই না; আমি শুধু তোমার থাকতে চাই।
রুবি: কী যে বল!
সান: সেলিব্রেটিদের কোনো ব্যক্তিগত জীবন আছে?
রুবি: আমি জীবনেও কোনো মানুষকে এত সুন্দর করে কথা বলতে দেখিনি।
সান: আমিও জীবনে কোনো মানুষকে এত সুন্দর করে কথা বলতে দেখিনি।
রুবি: সরো!
সান: সত্যি।
রুবি: তুমি যদি একটা প্রোগ্রাম নিয়মিত কর কিছু দিনের মধ্যেই তোমার নাম চার দিকে ছড়িয়ে পড়বে। রেডিও-টেলিভিশনের শিল্পীরা তোমার কাছ থেকে কথা বলার ধরন শিখবে।
সান: হাহাহা…
রুবি: হাসছ কেন? আমি সত্যি বলছি। আমি সুন্দর করে কথা বলা পছন্দ করি। আমি খেয়াল করি কে কীভাবে কথা বলে।কোনো নায়ক-নায়িকা তোমার মতো করে কথা বলতে পারে না।
সান: এখন থামো নইলে পথচারীদের ধমক খাবে।
রুবি: একটুও না। তুমি একটা ছোটো শব্দও, যেমন হ্যাঁ-না এগুলোও সাদা-মাটা করে বল না।
সান: থ্যাংকস।আসলে তুমি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাস তো তাই আমার সবকিছু তোমার কাছে এত ভালো লাগে।
রুবি: এটা একটা বোকার মতো কথা বললে। তোমার সবকিছু ভালো লাগে বলেই তোমাকে এত বেশি ভালোবাসি।তোমাকে যদি ভালোই না লাগল তাহলে ভালোবাসব কিসের জন্য?
সান: তাই তো।
রুবি: তুমি আর একটা কাজ করতে পার। কোনো কিছুর স্টিল মডেল হতে পার।
সান: সিগারেটের প্যাকেটে আমার ছবি থাকবে…
রুবি: সিগারেট কেন? তুমি তোমার পছন্দমতো যে কোনো জিনিসের মডেল হতে পার। তোমার যদি কোনো পণ্যের মডেল হতে ভালো না লাগে তা হলে তুমি কোনো প্রতিষ্ঠানের মডেল হতে পার।ওদের টিভি এড বা প্রসপেক্টাস বা লিফলেটে তোমার ছবি থাকতে পারে।তুমি যেখানে চাকরি কর বা অন্য যে কোনো উৎস থেকে তুমি মডেল হতে পার।
সান: লাগবে না। আমার ভালো লাগে না।
রুবি: ভালো না লাগলে তো আর জোর করা যাবে না।
সান: রাগ করো না, প্লিজ!


[ফুলশয্যা। সাজানো খাটে সাথী আর তার স্বামী শুয়ে আছে। কম আলো।]
স্বামী: তুমি চাকরিজীবী মানুষ, আমাকে একটা মোটর সাইকেল কিনে দিও।
সাথী: আমার কোনো টাকা নেই। বেতন পেয়ে মাকে দিয়ে দিই।
স্বামী: এখন তার কাছ থেকে আনো।


[সাথী আর তার মা খাটে বসে আছেন।পা ঝোলানো।সাথী থ্রি পিচ পরা।]
মা: থ্রি পিচ পরেছিস কেন? ও তো এখনই চলে যাবে। তার পরে পরতি।
সাথী: ওকে আর আসতে বলো না, মা।আমি ওর সাথে সম্পর্ক রাখব না।
মা: বলিস কী!
সাথী: হ্যাঁ, লোভী।বেতনটা পেয়ে হাত খরচটা রেখে সব টাকা তাকে পাঠিয়ে দিতে হবে।
মা: প্রথম দিনই এই কথা বলল?
সাথী: তোমার বুদ্ধিটাই ঠিক আছে, মা।কাবিনটা করার দরকার নেই।
মা: কিন্তু…
সাথী: কোনো কিন্তু নয়, মা।মানুষ চলতে গেলে হোচট খায়, আছাড় খায় তাতে পথ চলা বন্ধ হয় না।
[সাথী উঠে গেল। তার মা’র সামনে পৃথিবীর সব কিছু ঘুরতে লাগল।]


[বাসায় সান-সাথী আর তাদের মা]
সাথী: এই ছেলে রুবির পরিচিত।রুবির কথায় ভাইয়া এই ছেলে ঠিক করেছে।
সান (অবাক হয়ে): কী বলছিস তুই! কী করে বানালি এই আষাঢ়ে গল্প?
[সানের মা অবাক হয়ে সানের দিকে তাকিয়ে আছেন।]
সাথী: মোটেও আষাঢ়ে গল্প নয়।ছেলে নিজে আমাকে বলেছে সে রুবিকে চেনে।
সান: সে রুবিকে চেনে আর রুবি এই ছেলের সাাথে তোকে বিয়ে দিতে বলেছে এটা এক কথা হল?
সাথী: রুবিকে আমি এই ঘরের বউ হতে দেব না, কিছুতেই না। আমার জীবন নষ্ট করে সে তার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করবে, তা হতে পারে না।
সান: তুই ভুল ধারণা করছিস, সাথী। রুবি এ রকম মেয়ে নয়। সে যদি ভালো মেয়ে না হত আমি তাকে পছন্দ করতাম?
সাথী: তোমার চোখে ছানি পড়েছে, ভাইয়া।
সান: দেখ, সাথী, তুই আমার চেয়ে অনেক ছোট। আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলা তোর অন্যায়। আমি তো তোকে বার বার বলেছি, তুই কাউকে পছন্দ করলে আমাকে বল।
মা: আমি যদি বেঁচে থাকি তা হলে এ ঘরের বউ হবে আমার ভাইঝি।
সান: তোমরা কেন এসব বলছ? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। রুবি এ ছেলেকে চেনে না।বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে আমি ওর সাথে আলাপ করেছিলাম।
সাথী: রুবিকে তুমি বিয়ে করবে না, ব্যস। আর কোনো কথা নেই। আমি যদি তোমার বোন হয়ে থাকি তা হলে আমার কথাটা তুমি রাখবে।
সান: কিন্তু কেন? রুবির দোষটা কী?
মা: কোনো দোষ না।তুই কেয়াকে বিয়ে করবি।
সান: এতো অনেক পুরনো কথা।আর কেয়াকে যে আমি বিয়ে করব না সেটাও অনেক পুরনো কথা।
মা: কী পেয়েছিস তুই ঐ মেয়েটার মধ্যে?
সান: রুবি এই ছেলেকে চেনে না, মা, তুমি বিশ্বাস কর।তুমি চাইলে আমি প্রমাণ করিয়ে দিতে পারি।
মা: কোনো দরকার নেই।কেয়া ছাড়া আর কাউকে এলাউ করা হবে না।
সান: আমার পছন্দের কোনো মূল্য নেই?
মা: আমাদের কথা আমরা বলেছি।এখন তোর যা খুশি তুই করতে পারিস।
সাথী: শুধু কেয়া কেন? আমরা মেয়ে দেখব।
মা: আজ-কালকার মেয়ে দূর থেকে দেখে চেনা যায় না।
সান: এত বড় একটা সিদ্ধান্ত তোমরা আমার ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে পার না।
[সানকে রেখে তারা দুজন চলে গেল।]


[সান শুয়ে আছে। পাশে একটা তোয়ালে। তার দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। তোয়ালে দিয়ে মুছছে। আবার নামছে।]
সান (মনে মনে): সাথীর একটা বানানো কথা মা বিশ্বাস করে নিলেন। ইচ্ছে করছে রুবিকে বুকের মধ্যে চেপে ধরি।বিনা দোষে এই মেয়েটাকে এত কথা বলল।এত ভালো একটা মেয়ে!
[সান উঠে বসল।চোখের পানি মুছল। ]
সান (মনে মনে): রুবিকে বিয়ে করা যাবে না।ভাবটা এমন যেন তাতে শুধু রুবি একাই কষ্ট পাবে; আমার কিচ্ছু হবে না।আমি কেয়াকে বিয়ে করব।বিয়েটা যেন একটা অঙ্ক।যে কোনো উপায়ে উত্তর বের করতে পারলেই হল।ভেবেছিলাম মা যতদিনে রাজি না হবে ততদিনে বিয়ে করব না।এখন মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে রুবিকে বিয়ে করে ফেলি।সাথীর ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে সেটা একটা দুর্ঘটনা।এটাকে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে।এই কথা যদি কোনোভাবে রুবির কানে যায় ও আমাকে বিয়ে করতে চাইবে না। আজকেই ওকে ফোন করতে হবে।ঢাকায় গিয়ে বিয়ে করে ফেলব। তার পরে যা হয় হবে।


দুজনের ফোন টেক্সট বিনিময়-
[সান চলন্ত মাইক্রোবাসে।সাথে লোকজন আছে। ফোনে এসএমএস এলো। সান দেখল।]
রুবির কণ্ঠ: (সুরে সুরে) এই সান! সান! এই সান! সান! এই সান! সান!
[সান এসএমএস টাইপ করল।]

[রুবির ফোনে এসএমএস এলো।রুবি পড়ল।]
সানের কণ্ঠ: যখনই ডাকবে, আমি হাজির…তাই তো তুমি আমায় এত ভালোবাস…

রুবির কণ্ঠ: ইস! আমি তোমাকে ভালোবাসি না…
[হাসল সান।সে আবার মেসেজ লিখল।]

সানের কণ্ঠ: তোমার জীবনে আমি সাগরের ঢেউ, বেলাভূমি না চাইলেও বারে বারে ফিরে যাই, বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরি, চুমু খাই, সিক্ত করি, ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে চলে আসি আবার ফিরব বলে।

রুবির কণ্ঠ: এই, তুমি দেখছি কবি হয়ে গিয়েছ। লেখাটা পড়লে মনে হয় যেন বড় কোনো কবির লেখা। শুভকামনা রইল এই নতুন কবির জন্য।
[হাসল সান।]

১০
[বাসায় সাথী আর তার মা]
সাথী: মা, তোমার এত বড় একটা উপকার করে দিলাম এবার কিন্তু আমার পছন্দের ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিতে হবে।
মা: কোন উপকারের কথা বলছিস তুই?
সাথী: এই যে রুবির বাছাই করা ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে এটা তো আমার ধারণা।
মা: তা তো আমি বুঝতে পেরেছি।
সাথী: এখন তুমি তোমার ভাইয়ের মেয়েকে তোমার ঘরের বউ বানাতে পারবে।
মা: আমি তোকে আগেই বলেছিলাম, তোর পছন্দের কেউ থাকলে আমাকে বল।
সাথী: তখন ছিল না; এখন আছে।
মা: কে?
সাথী: বলব।আর কিছু দিন দেখি।
মা: দেখ।
সাথী: সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে রুবিকে ঠেকানো।ও খুলনায় আসার পর থেকেই শুনেছি, এই পাড়ার সব চেয়ে ভদ্র মেয়ে। আমার গাটা জ্বলে যেত।ও এসেছে একটা গ্রাম্য পরিবেশ থেকে।ওর সঙ্গে আমাদের তুলনা কেন হবে?
মা: আমি বেঁচে থাকতে ও আসতে পারবে না, চিন্তা করিস না।

১১
[বাইরে কোথাও বসে আছে রুবি আর সান।]
রুবি: বল তো, তোমার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছে কত দিন আগে?
সান: তিন বছর।
রুবি: হয়নি।
সান: কম না বেশি?
রুবি: বেশি।
সান: দাঁড়াও, আমি বলছি।(একটু চিন্তা করে) তিন বছর তিন মাস।
রুবি: হয়নি।
সান: এখনও হয়নি?
রুবি: না।
সান: আমার তো মনে হয় হয়েছে।আমি জুলাই মাসে বাড়িতে গিয়েছিলাম।লেবাররা পুকুর ভরাট করছিল।আমি দেখছিলাম।হঠাৎ তোমার ফোন।
রুবি: তোমার এত কিছু মনে আছে?
সান: (হেসে) আমার স্মৃতিশক্তি তো একেবারে খারাপ না।
রুবি: আমি বলি না যে তোমার স্মৃতিশক্তি খারাপ।আমার অভিযোগ হচ্ছে তুমি আমাকে মনে রাখ না।
সান: তোমার অভিযোগ মিথ্যে, ভিত্তিহীন, বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
[রুবি হেসে কুটিকুটি]
সান: আমি এর জন্য তীব্র নিন্দা প্রকাশ করছি।এর জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা দরকার।
রুবি: কর।
সান: তোমার ফোন পেয়ে আমার যে ঐ মুহূর্তে কী পরিমাণ ভালো লাগছিল আমি বোঝাতে পারব না।আমার চারপাশে লোকজন না থাকলে আমি আনন্দে নাচতাম।
রুবি: এখন নাচো।
সান: তা তো কতই নাচলাম।
রুবি: আমার ভালো লাগছিল এজন্য যে তুমি খুলনা থেকে চলে যাওয়ার উনিশ বছর পরে আমি যেদিন তোমাকে ফোন করলাম সেদিন তুমি খুলনায়।
সান: হ্যাঁ, এ জিনিসটা আমারও খুব ভালো লেগেছিল।পুরো ব্যাপারটাই ছিল অনেক অনেক ভালো লাগার।তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করলে, আপনি কবে খুলনায় আসবেন? আমি বললাম, আমি তো খুলনায়।আজকে ঢাকায় যাব।
রুবি: আমার কী সৌভাগ্য, নয়?
সান: না।আমার বেশি সৌভাগ্য।কারণ আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।আমার মা আমাকে বিয়ে করানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছে। আর আমি তো তোমাকে খুঁজছি।
রুবি: মনে মনে।
সান: তা ছাড়া উপায় কী, বল? নাসির ভাইর কাছে আমি দুদিন গিয়েছি। তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি। সে এড়িয়ে গিয়েছে। তার পরে কি আমি বলতে পারি? আমি যদি বিয়ে করে ফেলতাম তা হলে তুমি অভিযোগ করতে পারতে।আমি যদি অপেক্ষা করি এবং ভাগ্য বলতে যদি কিছু থেকে থাকে তা হলে আমি তোমাকে পাব।এটা ছিল আমার ধারণা।ছোট যদি কারো কাছে হতেই হয় তোমার কাছে হব; তোমার ভগ্নিপতির কাছে নয়।
রুবি: বা-বা-হ!
সান: হিম।উনিশ বছর।ক্যান ইউ ইমাজিন দ্যাট? তোমার বয়স তখন নয় বছর, ফাইভে পড়।
রুবি: তুমি?
সান: আমি তো তখন বড় মানুষ, বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে। হাহাহা…
রুবি: ইস…
সান: ইস কী? আমি তোমার চেয়ে নয় বছরের বড় নই?
রুবি: একুশ বছর না হলে বিয়ে করা যায় না।
সান: ওটা তো সরকারের কথা।আমার তো আঠার বছর বয়সেই বিয়ে করতে ইচ্ছে করছিল।
রুবি: পাজি।
সান: সত্যি। যখন খুলনা ছেড়ে যাচ্ছি কী যে খারাপ লাগছিল! তুমি এত ছোট ছিলে যে কিছু বলতেও পারছিলাম না।
রুবি: দশ বছর আগেই তো আমার বয়স আঠারো হয়েছে।তখন কেন বললে না?
সান: আমি তো তোমাকে খুঁজেছি।পাইনি।
রুবি: বাসায় যেতে।
সান: আমি লাজুক মানুষ।
রুবি: হ্যাঁ, বসে বসে বয়স বানিয়েছ সাঁইত্রিশ।
সান: সাঁইত্রিশ বানালাম কোথায়? তিন বছর আগেই তো তোমাকে খুঁজে পেলাম।
রুবি: অবজেকশন! আপনি আমাকে খুঁজে পাননি; আমি আপনাকে খুঁজে পেয়েছি।
সান: তুমি আমাকে খুঁজেছ!
রুবি: ইয়েস।
সান: কবে থেকে?
রুবি: বড় হয়ে।যখন শুনেছি আপনি বিয়ে করেননি।
সান: তাই বল।
রুবি: আমার এখন লজ্জা লাগছে।চল, যাই।
সান: যাব কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কথা বলার বয়স কত তা তো বললে না।
রুবি: তোমার ফোন নম্বর আমি নিয়েছি জুলাই মাসের তিন তারিখ, তোমাকে ফোন করেছি পাঁচ তারিখ।আজকে অক্টোবরের আট তারিখ।
সান: তাতে কী দাঁড়াল?
রুবি: তিন বছর তিন মাস তিন দিন।
সান: চমৎকার! ইউ আ ভেরি স্পেশাল।
রুবি: আজকের দিনটা তোমার সঙ্গে কাটাতে পেরে খুব ভালো লাগছে।
সান: ভেরি গুড।আজকের রাতটা আরো ভালো কাটবে।হাহাহা…
রুবি: ইনশা আল্লাহ বল।
সান: ইনশাআল্লাহ।আচ্ছা, চল।বিকেল চারটার মধ্যে রেডি হয়ে থেকো। আমি কল দেওয়ার সাথে সাথেই যেন বেরিয়ে আসতে পার।
রুবি: জি, স্যার।
[ওরা দুজন উঠল। রাস্তার দুপাশে সৌখিন গাছপালা।হাঁটতে হাঁটতেও কথা হতে লাগল।অনেক সুখ, অনেক আনন্দ…]

১২.১
[ফুটপাতে একটা ট্র্যাভেলিং ব্যাগ।পাশে রুবি দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার অপর দিকে তাকানো সে।]

১২.২
[ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাস্তা পার হচ্ছে সান।হাসি আর আনন্দ নিয়ে রাস্তার অপর দিকে তাকাচ্ছে।দুর্ঘটনার শিকার হলো।]

১২.৩
[চলন্ত ট্যাক্সি ক্যাবে রুবি বসে আছে।তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে সান।তার শরীর রক্তাক্ত।সে ছটফট করছে।]

১৩.১
[রুবি বিছানায় শুয়ে আছে।]

১৩.২
[সাদা-কালো।চলন্ত ট্যাক্সিক্যাবে বসে আছে রুবি।তার কোলে শুয়ে আছে সান।কপাল থেকে রক্ত ঝরছে।সে অজ্ঞান।]

১৩.৩
[রঙিন। কাঁদছে রুবি]

১৩.৪
[ সাদা-কালো।]
ফোনালাপ:-
[কয়েকজন দিনমজুর পুকুর ভরাটের কাজ করছে।সান দাঁড়িয়ে দেখছে। রুবি তার কক্ষে বসে আছে।সানের ফোন বেজে উঠল।দুজনই হাসি-খুশি, প্রাণবন্ত।]
সান: হ্যালো।
রুবি: আচ্ছালামু আলাইকুম।
সান: ওয়া আলাইকুমুচ্ছালাম।
রুবি: সান ভাই?
সান: জি, ভাই!
রুবি: আমি রুবি। (একটু পরে) খুলনা থেকে।
সান: ওওওও…
রুবি: কেমন আছেন?
সান: ভালো।আপনি কেমন আছেন?
রুবি: ভালো।
সান: আমার ফোন নাম্বার পেলেন কোথায়?
রুবি: আল্লাহ মিলিয়ে দিলেন।
সান: তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
রুবি: খুলনায় আসবেন কবে?
সান: সেটাই তো কথা।
রুবি: কী কথা?
সান: আমি এখন খুলনায়।আজকে ঢাকায় যাব।
রুবি: কখন?
সান: তিনটের বাসে।
রুবি: আমার সাথে দেখা হবে না?
সান: অবশ্যই।
রুবি: কোথায়?
সান: আপনি যেখানে বলবেন।
রুবি: আচ্ছা, আমি বাসস্ট্যান্ডে যাব।
সান: থ্যাংকইউ।

১৩.৫
[রঙিন।কাঁদছে রুবি]
রুবি (মনে মনে): এই কষ্ট আমি কীভাবে সহ্য করব?
[রুবির মা এলেন।]
মা: কী ব্যাপার? এই অসময়ে শুয়ে আছিস? শরীরটা খারাপ নাকি?
[রুবি ঘুমের মতো পড়ে রইল।তার মা তার পাশে বসে গায়ে হাত দিলেন।]
মা: রুবি, রুবি, এই রুবি…
[রুবি চোখ মুছে তাকাল।]
মা: সাজিদ এসেছে।ওঠ।
রুবি: না।
মা: না মানে? দেখা করবি না?
রুবি: না।
মা: কেন?
রুবি: ইচ্ছে করছে না।
মা: তোর বাবা শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে।
[রুবি নির্লিপ্ত]
মা: ওঠ। একটু দেখা করে আয়।বাসার পরিবেশ খারাপ করিস না।
রুবি: আমি পারব না।
মা: পারতে তোকে হবেই।তুই তোর বাবাকে চিনিস না? মুখ থেকে যা একবার বের করে তা না ফলিয়ে ছাড়ে?
রুবি: মা, আমি এখন বিয়ে করব না।
মা: আগেরবার যখন এই ছেলে এসেছিল তখন তুই বলেছিলি পড়াশোনার মধ্যে বিয়ে করবি না।এখন তোর পড়াশোনা শেষ।এখন কী বলবি?
রুবি: আমি বিয়ে করব না, মা।
মা: বাদ দে এসব ঢঙের কথা।বিয়ের পরে কাগজপত্র রেডি করতেও তো একটা সময় লাগবে।
রুবি: আমার অনেক কাজ, মা।বিদেশ আমার ভালো লাগে না।
মা: কোথায় পেয়েছিস এইসব আজব কথা?
রুবি: আমি ওকে বিয়ে করব না, মা।দেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
মা: সেটা তুই ওকে গিয়ে বল।ও দেশে চলে আসুক।আর কতদিন বাইরে থাকবে? ওর তো প্রচুর আছে।আর কষ্ট করার দরকার নেই।আমার একটা মেয়ে।দেশেই থাকুক।নাকি আমি বলব?
রুবি: না, মা, আমিই বলব।
মা: আচ্ছা, ঠিক আছে।তুই রেডি হয়ে আয়।
[রুবির চোখে রাজ্যের অসহায়ত্ব]

১৩.৬
[ রুবি ও সাজিদ সোফায় বসা। রুবির মুখটা নিচু ও ম্লান]
সাজিদ: তোমার মনটা বোধ হয় খারাপ।ছাদে যাবে?
রুবি: চল।

১৩.৭
[ ছাদে রুবি ও সাজিদ]
সাজিদ: বিয়ে করতে এসেছি।আর অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে না।
[রুবি মাথা নিচু করে আছে।মুখটা মলিন।]
সাজিদ: তোমার কোনো সমস্যা থাকলে বলতে পার।বিয়ের পরে অশান্তি হোক তা আমি চাই না।
[রুবি কাঁদছে।]
সাজিদ: আমাকে তুমি বিয়ে করতে চাও না।বলতেও সাহস পাচ্ছ না। কারণ এই বিয়েটা অনেক আগেই আমার বাবা আর তোমার বাবা ঠিক করে রেখেছে। এখন বলতে গেলে তোমার বাবা তোমাকে রাগ করবে। এই তো? নাকি আরো কিছু?
রুবি: আর কিছু না, সাজিদ ভাই।আমি আমার বাবাকে ভীষণ ভয় পাই।
সাজিদ: আমি যখন আগেরবার এলাম তখনও তুমি বলতে পারতে। তোমার ব্যবহারেও কিন্তু বোঝা যায়নি।এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
রুবি: তখন কোনো সমস্যা ছিল না।
সাজিদ: এখন কী হয়েছে?
রুবি: স্যরি, সাজিদ ভাই।আমাকে কোনো প্রশ্ন করো না।
সাজিদ: ঠিক আছে।তুমি যা ভালো মনে কর।
রুবি: প্লিজ, আমাকে বিপদে ফেলো না।
সাজিদ: আচ্ছা।
রুবি: থ্যাংকইউ, সাজিদ ভাই।
সাজিদ: এত সৌজন্য দরকার নেই।চলি।ভালো থেকো।
[সাজিদ ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছে।]
রুবি: দাঁড়াও, সাজিদ ভাই, প্লিজ।
[দাঁড়াল না।রুবি ওর যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইল।তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।দুহাতে মুখমণ্ডল চেপে ধরে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।]

১৩.৮
সাজিদ: রুবিকে আমার পছন্দ হল না, মা।
মা: মনে হয় যেন আগে কোনো দিন দেখিসনি ?
সাজিদ: একজন মানুষকে তুমি যত বেশি দেখবে তত বেশি চিনবে। আমার ভাগ্য ভালো যে বিয়েটা আগেরবার করে যাইনি।
মা: রুবি এমন লক্ষ্মী একটা মেয়ে যে একবার দেখে সে পাগল হয়ে যায়। কেউ নিজের জন্য, কেউ ছেলের জন্য, কেউ ভাইয়ের জন্য।পৃথিবীতে তুইই বোধ হয় একমাত্র মানুষ যে রুবিকে পছন্দ করে না।
সাজিদ: রুবি খারাপ মেয়ে তাতো বলিনি।অবশ্যই ভদ্র কিন্তু আমেরিকার মতো একটা আধুনিক দেশে যাওয়া মাত্রই সে হার্টফেল করবে।ওখানে চলার মতো মেয়ে সে নয়।
মা: আমি শুধু একটা কথাই জানি যে ভালো কাজের ফল কোনোদিন খারাপ হয় না।মেয়েটা যদি উচ্ছৃঙ্খল হত তা হলে একটা আপত্তি করা যেত।একটা ভদ্র মেয়ে, তুই তাকে নিয়ে ভাবছিস?
সাজিদ: আমি ভেবে দেখব, মা, মন খারাপ করো না।

১৪.১
[রুবির মা-বাবা]
বাবা: আমি এ কথা বিশ্বাস করি না।যে ছেলের এত পরিকল্পনা, রুবি কবে ঢাকা থেকে আসবে সে অপেক্ষায় যে ছেলে অস্থির হয়ে পড়েছে সে ছেলে রুবিকে বিয়ে করবে না এ হতে পারে না।
মা: সাজিদের মা আমাকে বলল, আমি তোমাকে বললাম।
বাবা: দেখ, এই ছেলেটা কত বছর ধরে আমেরিকা থাকে।ও যদি ভদ্র ছেলে না হত তাহলে কি রুবির অপেক্ষায় থাকত? ওর জন্য কি মেয়ের অভাব? কী নেই ওর? কোন দিক থেকে খাটো, বলতে পার?
মা: আমি কী বলব?
বাবা: সাজিদ তো রুবিকে এই প্রথমবারের মতো দেখেনি।যখনই দেশে আসে দেখা হয়।পছন্দ না হলে আগেই বলত।সাজিদ যদি উচ্ছৃঙ্খল হত তাহলে এতদিনে একটা উচ্ছৃঙ্খল মেয়ে যোগাড় করে ফেলত। রুবি ঢাকা থেকে আসার আগ পর্যন্ত তার কত অপেক্ষা, সে এ রকম বলবে কেন?
মা: জানি না।
বাবা: (রেগে) তোমাকে জানতেই হবে।কারণ তুমি মেয়ের মা।তুমি মেয়েকে জিজ্ঞেস কর সে সাজিদকে কী বলেছে।যাও, জিজ্ঞেস কর নইলে আমি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেব।দশ বছর ধরে যে ছেলে অপেক্ষা করছে সেই ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস সে কোথায় পেয়েছে? বসে আছ কেন? মেয়ের কাছে যাও।

১৪.২
[রুবি তার কক্ষে বসে মা-বাবার কথা শুনে ভয় পাচ্ছে।]
রুবি (মনে মনে): এখন কী করি!

১৪.৩
মা: আমি পারব না।সারাজীবন তো শুনেছি তোমার মেয়ে।এখন আমাকে পাঠাচ্ছ কেন? শুধু হুংকার দিতে পারলেই পুরুষ হওয়া যায় না। মেয়ে যদি সাজিদকে বিয়ে করতে না চায় তাকে জোর করার কোনো দরকার নেই।বিয়ে-শাদি জোর করে হয় না।
বাবা: ভালোই তো ওকালতি শুরু করেছ।তার মানে তুমি সবকিছু জানো।
মা: আমি তো বলিনি আমি জানি।তুমিই তো সন্দেহ করছ রুবি সাজিদকে কিছু বলেছে।
বাবা: হ্যাঁ, বলেছে এবং সেটা তুমি জানো।
মা: হ্যাঁ, জানি।এখন তুমি কী করবে?
বাবা: আমি সাজিদের সঙ্গে রুবির বিয়ে দেব।
মা: দাও।
বাবা: হ্যাঁ, দেব যদি আমি ওর জন্মদাতা বাবা হয়ে থাকি। যে মেয়ে আমার মান-সম্মানের দিকে তাকাবে না সে আমার মেয়ে নয়।

১৪.৪
[রুবি কেঁদে ফেলল।]
রুবি: (মনে মনে) হে আল্লাহ! আমাকে রক্ষা করুন।

১৪.৫
[ রুবি কাঁদছে। তার মা এলেন।]
রুবির মা: রুবি, তুই রাজি হ, মা।আমাকে বাঁচা।
রুবি: আমি পারব না, মা, কিছুতেই না।
রুবির মা: কেন?
রুবি: সব কথার জবাব দেওয়া যায় না, মা।আমি তোমাকে পরে বলব।
রুবির মা: আমি তোর মা।আমার কাছে সব বলা যায়।আমি কাউকে বলব না।
[রুবি জোরে জোরে কাঁদছে।তার মাও কাঁদছেন।]
রুবির মা: বল, মা, কী হয়েছে? সাজিদ তো ভালো ছেলে।

১৫
[সাজিদের মা আর রুবি।]
রুবি: আপনারা নিজেদেরকে কী ভাবেন? আপনার ছেলে আমাকে পছন্দ করে না।তার পরেও আপনারা তার সঙ্গে আমার বিয়ে দিচ্ছেন কেন?
সাজিদের মা: (আহত হয়ে) আমি তো দিচ্ছি না; দিচ্ছে তোমার বাবা। আমার তো এখন মনে হচ্ছে তার সন্দেহটাই ঠিক।
রুবি: মানে?
সাজিদের মা: মানে তুমি তো কোনো দিন বড়দের সঙ্গে এভাবে কথা বল না।এখন কেন বলছ?
রুবি: বলছি এজন্য যে আপনারা আমাকে জবাই করছেন।
সাজিদের মা: তুমি রাগ করো না, মা। আমি তোমার বাবাকে বলব। যেভাবে পারি এ বিয়ে বন্ধ করব।
রুবি: (কেঁদে) তা-ই করুন।
সাজিদের মা: আসলে তোমাদের সমস্যাটা কী বল তো!
[রুবি মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগল।]
সাজিদের মা: কেঁদো না, মা। মাথা ঠান্ডা করে সিদ্ধান্ত নাও। প্রয়োজনে তোমার মা-বাবা অথবা সাজিদ এমন কী আমার সঙ্গেও আলাপ করতে পার। তোমার ক্ষতি আমরা কেউ চাই না। জীবন তো শুধু তোমার একার নয়; তোমার সঙ্গে আমরাও জড়িত।

১৬.১
[রুবির বাবা আরা সাজিদের মা]
রুবির বাবা: অসম্ভব!এ বিয়ে বন্ধ করা যাবে না।যে ছেলেকে আমি ছোটোবেলা থেকে চিনি তার কাছে মেয়ে দেব না দেব কার কাছে? অপরিচিত একটা ছেলের কাছে মেয়ে দেব কোন ভরসায়?
সাজিদের মা: সাজিদ নিজেই যেখানে রাজি না সেখানে দিতে চান কোন ভরসায়? রুবি তো আপনার একার মেয়ে নয়; সে আমারও মেয়ে।তার কোনো অমর্যাদা হোক তা আমি চাই না।
রুবির বাবা: সাজিদও আপনার একার ছেলে নয়; সে আমারও ছেলে। আমি তাকে চিনি।রুবিকে অপছন্দ করার মতো ছেলে সে নয়।প্রয়োজন হলে দুই পক্ষের অভিভাবক আমি একাই হব তবুও আগামী শুক্রবার সাজিদের সঙ্গে রুবির বিয়ে হবে।

১৬.২
[রুবি তার কক্ষ থেকে সব কথা শুনেছে।]
রুবি (মনে মনে): আমি এখন কী করব? আমার কী করা উচিত? আমাকে যদি ধরে বেঁধেও বিয়ে দেয় তবুও তো আমাকে বলতে হবে যে এই বিয়েটা জায়েজ হবে না।কিন্তু এই কথাটা আমি বলি কী করে? সান যেটা নিষেধ করেছে সেটা আমি বলতে পারি না। বললে যেমন কষ্ট পাবেন সানের মা তেমন কষ্ট পাবেন আমার মা-বাবা।আমি কি এদেরকে সানের চেয়ে বেশি ভালোবাসি? না।কিছুতেই নয়। যে চলে গিয়েছে সে সব কিছুর ঊর্ধ্বে।আমি তার কোনো কথা ফেলব না। যেভাবেই হোক, বাসা থেকে পালাতে হবে।এছাড়া কোনো উপায় নেই।

১৬.৩
[রুবির মা-বাবা]
রুবির বাবা: মেয়ের দিকে খেয়াল রেখো।ও কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।
রুবির মা: পালিয়ে যাবে কার সাথে? কেউ ঠিক করা আছে নাকি?
রুবির বাবা: অবশ্যই আছে।আর সাফাই গাওয়ার দরকার নেই।আমার সব কিছু বোঝা হয়ে গিয়েছে।মেয়ে যেন ঘর থেকে বের হতে না পারে এই আমার শেষ কথা।
রুবির মা: মেয়ে তো ঢাকা যাবে।
রুবির বাবা: কেন?
রুবির মা: চাকরি হয়েছে।
রুবির বাবা: চাকরির চিঠিটা আমাকে দেখাতে পার?
রুবির মা: এই জন্যই মেয়ে তোমাকে বলেনি।সব কিছুতে সন্দেহ আর অবিশ্বাস। দেখ গিয়ে। মেয়ের টেবিলের উপরেই আছে। সে কালকে যাবে।
রুবির বাবা: গিয়ে আবার ছুটি নিয়ে আসতে বলবে।চাকরির নামে বিয়ে থেকে মুক্তি নেই।
রুবির মা: তুমি এ রকম করছ কেন? মেয়ে কি তোমাকে একবারও বলেছে সে বিয়ে থেকে মুক্তি চায়? বলেছে সাজিদ। রুবিকে তার পছন্দ হয়নি।রুবি আমেরিকায় চলার মতো মেয়ে নয়।এ কথা শুনে কোন মেয়ের মন ভাঙে না? মেয়েটা সারাদিন শুয়ে থাকে।ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করে না।শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গিয়েছে।মুখের দিকে তাকালে শত্রুর চোখেও পানি আসে।
রুবির বাবা: আমি শত্রু নই।আমি ওর বাবা।ওর কিসে ভালো হবে সেটা আমি বুঝি।সাজিদ এত টাকা কামাই করে ওর আবার চাকরির দরকার কী?
রুবির মা: একবারও এ কথা বলবে না।চাকরি পাওয়া কঠিন; ছাড়া সহজ।জয়েন করুক।তার পরে দেখা যাবে।ভালো চাকরি।এই চাকরি আমেরিকা গিয়েও করতে পারবে।
রুবির বাবা: আচ্ছা, ঠিক আছে।জয়েন করুক।আমিও যাব ওর সঙ্গে।
রুবির মা: যাও।
রুবির বাবা: এটা আমার কর্তব্য।মেয়ে চাকরিতে জয়েন করতে যাবে। পরিবেশটা দেখার দরকার আছে।

১৭
[অফিস।একটা কাচের চেম্বারের মধ্যে এমডি।তার সামনে রুবি আর তার বাবা। সবাই বসা।]
রুবির বাবা: (এমডিকে বিনয়ের সাথে) প্রথম জয়েন করতে এসেছে, কথাটা আমার বলা উচিত নয় কিন্তু বলতে হচ্ছে।ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। একটু ছুটি দেবেন।
রুবি: বাবা, তোমাকে বলা হয়নি, এখান থেকে ফোনে আমাকে বলেছিল, চার মাস দশ দিন একটানা প্রশিক্ষণ নিতে হবে।এই সময়ে কোনো ছুটি নেওয়া যাবে না। দুই বছর শিক্ষানবিসকাল।এই সময়ে এক দিনের বেশি ছুটি নেওয়া যাবে না।অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার ব্যবস্থা কোম্পানি নেবে এবং সুস্থ হওয়ার পরে চার মাস দশ দিন পূরণ করতে হবে।এই শর্ত মেনে নিয়েই আমি জয়েন করতে এসেছি।
রুবির বাবা: (এমডিকে বিনয়ের সাথে) আমি খুবই দুঃখিত।আমি যদি এটা জানতাম তা হলে জয়েন করতে দিতাম না।ছেলেটা আমেরিকা থেকে এসেছে।
এমডি: (বাবাকে) আপনি একটুও মন খারাপ করবেন না, ওর ট্রেনিং পিরিয়ডটা যাক।ওর বিয়েতে আমরা সবাই যাব।ডায়মন্ডের গহনা পরিয়ে ওকে শ্বশুর বাড়ি পাঠাব।নতুন একটা চাকরি নিয়েছে।ওকে একটু গুছিয়ে উঠতে দিন।
রুবির বাবা: আমি ছেলের সঙ্গে কথা বলে দেখি।
এমডি: দেখুন।এই চাকরি ও আমেরিকা গেলেও করতে পারবে। (রুবিকে) আপনি ইচ্ছে করলে কোম্পানির হোস্টেলে থাকতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই।এখানে থাকা-খাওয়া বেশ ভালো।
রুবি: জি, আমি হোস্টেলেই থাকব।
এমডি: এখানে থাকলে যাতায়াতের ঝামেলাটা থাকে না আর নিরাপত্তার ব্যাপারেও কোনো চিন্তা থাকে না।

১৮
[হোস্টেলে রুবি তার কক্ষে।দুটো রুবি।রঙিনটা বিছানায় বসা।পা ছড়ানো, দেয়ালের সাথে হেলান দেওয়া।সে কাঁদছে।সাদা-কালোটা চেয়ারে বসা।চেয়ারের পাশেএকটা টেবিল।]
রঙিন রুবি: আমি মিথ্যে কথা বলেছি।আমার খুব খারাপ লাগছে।
সাদা-কালো রুবি: না বলে পারা যেত না?
রঙিন রুবি: ঐ মুহূর্তে এমন কি এখন পর্যন্ত আমি বুঝতে পারছি না আমার কী বলা উচিত ছিল।
সাদা-কালো রুবি: মিথ্যে বলা…
রঙিন রুবি: এটা ওয়াইট লাই।অন্য কারো কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু আমার অনেক উপকার হয়েছে।সানের মৃত্যুর বয়স চার মাস দশ দিন না হলে আমার বিয়ে করা উচিত নয়।
সাদা-কালো রুবি: হুঁম…একটা মিথ্যে বলে একটা বড় পাপ থেকে মুক্ত থাকা গেল।এখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
রঙিন: শুধু আল্লাহর কাছে নয়; স্যারের কাছেও অনেক ছোট হয়ে গেলাম।
সাদা-কালো রুবি: তার সঙ্গেও আলাপ করা উচিত।
রঙিন রুবি: চার মাস দশ দিনের মধ্যে সাজিদ ভাই আমেরিকা চলে যাবে।তার মন আমার দিক থেকে ফিরে যাবে।সানের স্মৃতি নিয়ে আমি এই জীবন কাটিয়ে দেব।

১৯
[অফিস।একটা কাচের চেম্বারের মধ্যে এমডি।তার সামনে রুবি।বসা।]
এমডি: কাজ কেমন লাগছে?
রুবি: জি, স্যার, ভালো।
এমডি: প্রথম দিকে একটু খারাপ লাগলেও পরে ঠিক হয়ে যাবে।যারা কাজ বোঝে না তাদের ক্ষেত্রে হয় উল্টোটা।কিছু না বুঝলে মারুফের সাহায্য নেবেন।সে বিরক্ত হলে আমাকে জানাবেন।
রুবি: জি, স্যার।
এমডি: আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনার এই চাকরিটা কীভাবে হয়েছে?
রুবি: সানের মাধ্যমে।
এমডি: জি।আপনার চাকরির বয়স এক বছর হলে কিছু কাগজপত্র আপনাকে ফিল আপ করতে হবে।ওখানে আপনি আপনার চাহিদাগুলো লিখতে পারবেন।প্রতি বছর আপনি চাহিদা পরিবর্তন করতে পারবেন। শুধু চাহিদা নয়; আপনার যে কোনো সমস্যা, যেকোনো মতামত আপনি লিখতে পারবেন।কর্তৃপক্ষ আপনাকে কথা দিচ্ছে না যে আপনার সব কথা রাখতে তারা বাধ্য।তবুও আপনি লিখবেন।
রুবি: জি, স্যার।
এমডি: সান সাহেব তার সর্বশেষ চাহিদাপত্রে লিখেছিল, তার মৃত্যুর পরে তার স্ত্রীকে যেন একটা সম্মানজনক চাকরি দেওয়া হয়।আপনার ডাক ঠিকানা, ই-মেইল এড্রেস, ফোন নম্বর এবং এসএসসি থেকে এমএসসি পাসের সব কাগজপত্র সে জমা দিয়ে রেখেছে।সে এটাও শর্ত দিয়ে রেখেছে যে এই চাকরি গ্রহণ করার অর্থ এই নয় যে আপনি অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবেন না।বুঝতে পেরেছেন?
রুবি: জি, স্যার।
এমডি: আপনি এই চাকরিতে থেকেও বিয়ে করতে পারবেন।আপনাদের বিয়ের ব্যাপারটা বোধ হয় দুই পরিবারের কেউ জানে না।ঠিক?
রুবি: জি।
এমডি: হ্যাঁ।তা হলে আপনার আর কোনো সমস্যা রইল না।আপনাকে আমি এত কথা বলছি এজন্য যে সান সাহেব আপনার সম্পর্কে লিখেছে, আপনি অসামান্য মেধাবী।কোম্পানি আপনাকে যতটুকু দেবে আপনি কোম্পানিকে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দেবেন।এরকম মানুষই তো আমরা চাই।কোনোদিন কারো চাহিদাপত্রে এরকম কোনো লেখা পাইনি আমি।
রুবি: আমি চেষ্টা করব, স্যার।
এমডি: কোনো সমস্যায় পড়লে নির্দ্বিধায় আমাকে বলবেন।আমরা চাই কাজ।সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আপনাকে দেওয়া হবে।আপনাকে আমরা ধুমধামের সাথে বিয়ে দিয়ে দেব।
রুবি: আমি আর বিয়ে করতে চাই না, স্যার।অফিসের পরিবেশ যদি ভালো থাকে তা হলে এই চাকরিটাই আমার জন্য যথেষ্ট।
এমডি: আমি যত দিন বেঁচে থাকব অফিসের পরিবেশ তত দিন ভালো থাকবে।আজকেই আমি আমার চাহিদাপত্রে লিখব, আমি যদি মরে যাই তা হলে আপনাকে যেন এমন একটা পদে দেওয়া হয় যাতে কেউ আপনাকে বিরক্ত করতে সাহস না পায়।
[রুবি মনোযোগ বাড়িয়ে দিল।]

এমডি: কোম্পানির এমডি মানেই চরিত্রহীন-লম্পট নয়। আপনার যোগ্যতার বলে আপনি উপরে উঠবেন।কেউ ঠেকাতে পারবে না। উইশ ইওর গুড লাক।
রুবি: থ্যাংকইউ, স্যার, আমি সানের কাছে আপনার অনেক সুনাম শুনেছি। সেই সাহসেই আমি এসেছি।কারণ সান কখনও চাইত না আমি কোম্পানির চাকরি করি।ও নিজেই যখন আমাকে এখানে দিয়ে গিয়েছে আমার আর কোনো ভয় নেই।আল্লাহ তো আছেন।
এমডি: এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।মানুষ আল্লাহর ওপর ভরসা করে না বলেই হতাশায় ভোগে।
রুবি: স্যার, আমি সাধারণত মিথ্যে বলি না। সেদিন বিপদে পড়ে আপনার সামনে বসে বাবার সঙ্গে একটা মিথ্যে কথা বলেছি।
এমডি: সেটা কি আমি বুঝিনি?
রুবি: সেই থেকে আমার খুব খারাপ লাগছে, স্যার। (কাঁদল।)
এমডি: খারাপ লাগার কিছু নেই।সেদিন আমিই তো আপনার কথা সম্পূর্ণ করে দিলাম।
রুবি: (চোখের পানি মুছে) আমি সেটা লক্ষ করেছি, স্যার, থ্যাংকইউ।

২০
[ হোস্টেলের খাটে শুয়ে আছে রুবি।অসহায় তার চোখদুটো।পানির ধারা নামল।চোখের পানি মুছল রুবি।]
রুবি (একাকী): পৃথিবীতে এ রকম অভাগী আর আছে যার স্বামী মারা গিয়েছে অথচ সে কারো কাছে বলতে পারছে না?

২১.১
[রুবি তার অফিসে কাজ করছে।সাথী এসে তার সামনে দাঁড়াল।]
সাথী: ম্যাডাম…
[রুবি তাকাল।দুজনই সমান অবাক।সাথী রাগ করে চলে গেল। রুবি দাঁড়াল, ডাক দিল।]
রুবি: সাথী আপা, সাথী আপা, সাথী আপা, প্লিজ, শুনুন।
[রুবি তার চেয়ারে বসে এমডিকে ফোন করল।]
ফোনালাপ:-
রুবি: এমডি স্যারকে দিন। (একটু পরে) স্যার, আচ্ছালামু আলাইকুম। সানের বোন এসেছে। নাম সাথী। আমাকে দেখে রাগ করে চলে গেল। সানের সব পাওনা তাকে দিয়ে দেবেন, প্লিজ।
এমডি: কিন্তু সান তো সব আপনাকে দিয়ে গিয়েছে।তাকে আমি কীভাবে দিই?
রুবি: আপনি ইচ্ছে করলেই পারেন, স্যার।আমি লিখিত দেব।
এমডি: কিন্তু কেন? এত বড় ত্যাগের দরকার কী?
রুবি: স্যার, কেউ যদি জানতে পারে সান সবকিছু আমাকে দিয়েছে তা হলে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা সবাই জেনে যাবে। সানের ওপর অসন্তুষ্ট হবে। কেউ ওর জন্য দোয়া করবে না। (কেঁদে ফেলল)
এমডি: সেটা তো জানবেই। আপনি আপনার সব কাগজপত্রে স্বামীর নাম লিখবেন, বৈবাহিক অবস্থা লিখবেন, এটা কি গোপন রাখার বিষয়? একটা সমাধান আছে।আপনি যদি আবার বিয়ে করেন তা হলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
রুবি: প্রয়োজন হলে আমি তাই করব তবু সানকে কারো কাছে ছোট করব না।
এমডি: ঠিক আছে।আপনি সানের সব পাওনার একটা লিস্ট এবং অন্য একটা কাগজে তার বোনকে দান করার কথা লিখে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।
রুবি: জি, স্যার, দিচ্ছি। থ্যাংকইউ।
[ফোন রেখে রুবি কাঁদল।]

২১.২
[সাদা-কালো।বিলাসবহুল ডিঙি নৌকায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে সান ও রুবি।আকাশের দিকে তাকানো।ছই নেই, মাঝি নেই, বৈঠাটা পাশে পড়ে আছে।]
সান: আমার মা-বোনের জন্য আমি আমার সাধ্যমতো করব।আমি যদি তোমাকে বিয়ে না করে একটা অপরিচিত মেয়েকে বিয়ে করতাম তা হলে এখানে সে একটা আপত্তি করত।আমার ভালো লাগত না।স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব এভাবেই সৃষ্টি হয়।
রুবি: জানি।একটা পরিবারের সমস্ত সুখ-শান্তি নষ্ট করে দেওয়ার জন্য খারাপ একটা বউই যথেষ্ট।সাপের মতো সে সবাইকে ছোবল মারতে থাকে।সবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে।কেউ কারো খোঁজ নেওয়ার সুযোগ পায় না।
সান: মা তো মনে করছে, ভাইঝিকে আনব, কোনো সমস্যা থাকবে না। তার ভাইঝির যে মেজাজ সবাইকে না খাইয়ে মারবে।আমি অনেক জায়গায় দেখেছি, ফুফাত ভাইকে বিয়ে করে শ্বাশুড়িকে চেনে না।

২১.৩
[রঙিন।রুবি চোখ মুছল।]
রুবি (মনে মনে): কত মেয়ে স্বামীকে ভালোবেসে দ্বিতীয় বিয়ে করে না। সারাজীবন একা কাটিয়ে দেয়।সেই ভাগ্যটুকুও আমার হল না।আমি এমন এক হতভাগী যে স্বামীকে বেশি ভালোবাসি বলেই আবার বিয়ে করব।ভালোবাসব একজনকে, সংসার করব আরেক জনের সাথে।কী কঠিন পরীক্ষায় পড়লাম!

২১.৪
[এমডি সাহেব তার চেম্বারে।কাগজপত্র দেখছেন।সামনের চেয়ারে সাথী।]
এমডি: আপনি সানের আপন বোন?
সাথী: জি।
এমডি: আপনার আর কোনো বোন আছে?
সাথী: না।
এমডি: আপনি জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে এসেছেন, ভালো কথা কিন্তু সানের টাকা-পয়সা নিতে পারবে তার সাথী নামের এক বোন।
সাথী: আমিই সাথী।
এমডি: আপনার পরিচয়পত্রে লেখা আছে আফিয়া সুলতানা। এখন আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে সাথী আর আফিয়া সুলতানা একজন। আমাদের অফিসে আপনার পরিচিত কেউ থাকলে আপনি তার দ্বারা লিখিয়ে আনতে পারেন।
সাথী: ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দ্বারা লিখিয়ে আনলে হবে না?
এমডি: হবে।তাতে আপনারও কষ্ট হবে, আমারও সময় নষ্ট হবে। একজন মানুষের জন্য কতবাব ফাইল ঘাটা যায়?
সাথী: স্যরি, স্যার, আপনার অফিসের কাউকে আমি চিনি না।
এমডি: (মনে মনে বললেন, চেনো না, ন? বেয়াদব! দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি মজা।) ঠিক আছে, আপনি পরে আসুন।

২২
[পার্কের বেঞ্চে বসে আছে রুবি ও সাজিদ। রুবির মন খুব খারাপ। সাজিদও গম্ভীর।]
সাজিদ: রুবি, তোমাকে বিরক্ত করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না, তুমি বিশ্বাস কর।বলতে খুব খারাপ লাগছে তবুও বাধ্য হয়ে বলছি।কাকা আমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলছেন।চার মাস দশ দিন না গেলে তুমি নাকি বিয়ে করতে পারবে না।সত্যি?
রুবি: জি।
সাজিদ: কথাটা তুমি আমাকে খুলে বলতে পারতে।আমি তোমাকে সারাজীবন ভালোবেসেছি।মাঝখান থেকে কেউ যদি ঢুকেও পড়ে সেটা আমার ভাগ্যের দোষ।আমি তোমাকে কিছু বলব না।তোমাকে সব ধরনের সাহায্য আমি করব।
[কাঁদছে রুবি।]
সাজিদ: কেঁদো না, রুবি, প্লিজ।আমার কষ্ট হয়।সেদিনও তুমি কেঁদেছ। সব ঠিক হয়ে যাবে।তোমার কষ্টের কথা তুমি কাউকে বলতে পারছ না বলেই তোমার এত খারাপ লাগছে।তুমি সব কথা আমাকে বলতে পার। অনেক হালকা লাগবে।আমি কিন্তু চার মাস দশ দিন সময়টা শুনেই বুঝেছি।এতদিন বুঝতে পারিনি। আমি অপেক্ষা করব, রুবি, আমি তোমার বন্ধু। আমি ঢাকায় থাকলে যদি তোমার ভালো লাগে তা হলে বলো।আমি থাকব।
রুবি: পরে বলব।তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করবে।আমি যেন ভেঙে না পড়ি।
সাজিদ: আমি তো আছি, সোনা, ভেঙে পড়বে কেন? পড়লেও আমি তুলে দাঁড় করিয়ে দেব।
[রুবি আরও বেশি কাঁদতে লাগল।]
সাজিদ: তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পার। আমি কাউকে বলব না।
রুবি: (চোখের পানি মুছে) আমার শুধু একটা কথাই বলার আছে, সাজিদ ভাই, মানুষ এত ভালো হতে পারে, কোনোদিন চিন্তাও করিনি।বিশ্বাস করতে ভয় হচ্ছে।যে মানুষটা সারাজীবন আমাকে ভালোবেসেছে তাকে না জানিয়ে আমি অন্য একজনকে বিয়ে করেছি।এত কিছু হয়ে গেল তবুও সে আমাকে ভালোবাসে, এত সুখ আমার ভাগ্যে আছে, আমি ভাবতে পারি না।
সাজিদ: ওহ! কী যে শান্তি পেলাম!
[সাজিদ উঠে দাঁড়াল। দুহাত মেলে দিয়ে হাহা করে হাসতে আর ঘুরতে লাগল।]
সাজিদ: হা হা হা…প্লিজ, একটু হাস, আমার এই বিশ্বজয়ের আনন্দে তুমি অংশ নাও।
[রুবি চোখে পানি নিয়ে হাসল। সাজিদ রুবির দু-হাত ধরে ওকেসহ ঘুরতে লাগল। চারপাশের ফুলগুলো আনন্দে হাসতে লাগল।]