শৈশবের ঈদ ॥ সালমা তালুকদার


আশির দশকের ঈদের সাথে এখনকার ঈদের অনেক পার্থক্য।ঢাকা শহরে মানুষ কত কম ছিল।সবাই কত আপন ছিল। হারিয়ে যাওয়ার বা রাস্তাঘাটে অপমান অপদস্ত হওয়ার কিছু ছিল না।তখন সমাজে বয়সে ছোট মেয়েদের নিজের ঘরের ছোট বোন আর মেয়ের মতই মনে করতো সকলে।তাই ঢাকার মতো জায়গায় নিজের এলাকায় সারাদিন ছুটে বেড়ালেও বাসায় কেউ টেনশন করতো না।

ঈদ।ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে গেছে।আমার ছোট বেলার মতো।চারপাশে তাকিয়ে ছোটবেলাটা খুঁজি।পাই না।ছোট বেলার ঢাকায় এত জৌলুশ ছিল না।রাস্তাঘাট এত সুন্দর ছিল না।তবে অস্থিরতাও ছিল না।এবার খুঁজতে থাকি ফাঁকা ঢাকায় ছোটবেলার ঈদ আমেজ।

আত্মীয়-স্বজনের আনাগোনা।বড় হতে হতে সব হারিয়ে ফেলেছি।মা নেই তাই আত্মীয় স্বজনেরাও নেই।বড় হয়ে দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছে বলে নিজের ঈদ হারিয়ে গেছে ব্যস্ততার অন্তরালে।

ছোটবেলায় ঈদ ছিল একটি কেবল নতুন জামায়।সারা বছরে একটা দামি নতুন জামা পেতাম।এবং সেই জামাটা অবশ্যই একটু স্টাইলিশ হতো।আব্বা সারা জীবনই অনেক ব্যস্ত ছিলেন।বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন।পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিলেন।আমাদের তিন ভাই-বোনের সবকিছু আমার মা দেখতেন। ঈদের বোনাস পেয়ে আব্বা আম্মাকে নির্দিষ্ট একটা টাকার অংক ধরিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতেন।আর আম্মা সেই টাকা দিয়েই কিভাবে যেন শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ি, নিজের ঘরের সব কেনাকাটা সেরে ফেলতেন।

আমাদের জামা কাপড় আমাদের সাথে নিয়ে গিয়েই কিনতেন।মৌচাক মার্কেট আর ইস্টার্ন প্লাজা ছিল আমাদের ঈদের মার্কেটিং এর জন্য নির্দিষ্ট মার্কেট।মনে আছে যে জামাটা আর যে জুতাটা পছন্দ করতাম নিজের জন্য আম্মা সেটাই কিনে দিতেন।দোকানদার যদি কোনকিছুর দাম ২০০০ টাকা বলতো অদ্ভুত দক্ষতায় আমার মা সেটার দাম অর্ধেকের ও নিচে নামিয়ে আনতেন।তখন শুধু দেখেছি আর এখন অবাক হয়ে ভাবি এত কম আম্মা কি করে বলতেন!

একবার ঈদে বের হলো রাজা, রানী ড্রেস।আমি বায়না ধরলাম আমি রাজা ড্রেস কিনবো।রাজার ড্রেসের মাঝে ফাঁড়া থাকতো।অনেকটা এখনকার লম্বা কোটির মতো।আর রানীর ড্রেস থাকতো ফোলা ফ্রক স্টাইলের।আমি খুব সাজতে পছন্দ করতাম।আব্বা আম্মা কখনো সাজগোজে বাঁধা দেননি।ঈদের দিন খুব সেজেগুজে কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হতাম।যখনকার কথা বলছি তখন থাকতাম গোপীবাগ।মতিন সাহেবের বিল্ডিংবলে সবাই চিনতো।পুরো বিল্ডিং চক্কর কেটে ঈদ সালামি নিয়ে নিচে নেমে আসলাম।চার তলার একটা ফ্ল্যাটে কিছু বড় ভাইয়া থাকতেন।সম্ভবত ঐ আন্টির তিন চারটা ছেলে।

আমাকে খুব ভালোবাসতেন সবাই।আমি গেলেই ভাইয়াগুলো বলতে থাকতেন ‘আমাদের সালমা আগা এসেছে’। আমি জানতামই না কার নামে আমাকে ডাকা হচ্ছে।খুব মেজাজ খারাপ হতো। ঈদের দিন সেটা চিন্তা করে আর পা বাড়াইনি। সোজা নিচে নেমে এলাম।নেমেই পেয়ে গেলাম এক রানীকে।আর যায় কোথায়! ঈদের সারাদিন রাজা রানী একসাথে ছিলাম।অবশ্য এখন আর মনে নেই রানিটি কে ছিল।

তখন ফোন ছিল না।টেনশানও ছিল না।আম্মা রান্নাবান্না, মেহমানদারি নিয়ে ব্যাস্ত থাকতেন।আর আমি সারাদিন বাইরে বাইরে।তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমিই চঞ্চল ছিলাম।বাকি দুজন বাসাতেই থাকতো।কিন্তু আমি সারাদিন টই টই করে বিকেলে বাসায় ফিরতাম।

এই আমিই আবার যখন বড় হলাম, এইচএসসি পরীক্ষা দিব সামনে। এমনি সময়ের এক ঈদে আম্মা বললেন, ‘এবার তোর আব্বার হাত টান আছে। ঈদে কিছু দিতে পারবে না (আব্বা নতুন বাড়ি করেছেন তখন যাত্রাবাড়ীতে)’। শুধু ছোট বোনের জন্য একটা ড্রেস নিয়ে এসেছিলেন। আমি কিন্তু একটা শব্দও করলাম না।

ঈদের সারাদিন আম্মার সাথে ঘরে কাটালাম।এগুলো ভাবলে এখন খুব ভালো লাগে।এক চঞ্চলতা ছাড়া আম্মাকে তেমন ডিস্টার্ব করিনি। চাহিদা কখনোই খুব বেশি ছিল না। দামি কিছুর চাইতে নতুন কিছুর প্রতি আগ্রহ ছিল বরাবর।তাই যে বছর আব্বা নতুন জামা দিতে পারেনি সে বছর এক কালারের কালো সুতি কাপড় কিনে কামিজ বানিয়ে পরেছি।কালো কাপড় কেনার আগে দেখে নিয়েছি বাসায় সাদা সালোয়ার আর ওড়না আছে কিনা।ছোটবেলার ঈদ আনন্দ আর কখনো ফিরে পাব না।তবে এই যে স্মৃতির পাতা হাতড়ে কিছু লিখতে পারা এটাই বা কম কিসে।সবাইকে ঈদ শুভেচ্ছা।