নির্বাচিত ছয় কবিতা ॥ সামসুল আলম খন্দকার


পোড়া পিঠ, পাঁজরের হাড়
কদাচিৎ ভেজে সেই জানে ভেজার আনন্দ
জলের পুলক।রোদে পোড়ে নিত‍্যদিন, তার কাছে তামাশা ভিন্ন
আর কি সূর্যস্নান ?

উদয়-অস্তের পূজারি-সেই করে ফসলের ভাগ
বৃষ্টিরা তাকেই চেনে; মানে মেঘমালা; সূর্য দেবতা
তার করে পরিত্রাণ

যে ভেজে সে ভেজে
মেঘ বজ্র তুচ্ছ করে ভেজে।যে পোড়ে
তার পোড়া পিঠ, বুক, পাঁজরের হাড়

পোড়া চোখে কী সৌন্দর্য ধরে পূর্ণ চন্দ্রখান!

ফ্রাইপ্যানে আরিচা ঘাটের সূর্য
সূর্য ডুবে যাচ্ছে আরিচা ঘাটে; যেন মস্ত একটা
ডিমের কুসুম, দিগন্ত-জোড়া একটা ফ্রাইপ্যানে ঢালা হচ্ছে
ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিলাম বলেই হয়তো ব‍্যাপারটা
খুব আস্তে ঘটছে মনে হলো

আচমকা ঝড়!
পানিকে মনে হলো খুব অচেনা আর বদরাগী
যাত্রীরা ঈশ্বরের নাম বেছে বেছে ডাকলো
কেউ-বা পছন্দের পীর-মুর্শীদ
কেননা, লঞ্চটা কূলের প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছিল

ততক্ষণে কুসুমসুদ্ধ ফ্রাইপ্যান মুছে গেছে
শুধু তেষ্টাই সত্যি
আমি একটা পানির বোতলের দর কমানোর কথা বলতেই
বিয়াদ্দপ ছেমরা বলে কি!
তারচে ফিটকিরি ধোয়া পানি ঢের ভালো

বৃত্ত ও খুঁটি বৃত্তান্ত
কতিপয় ষাঁড়-বৃত্ত রচনা করছে
খুঁটিকে কেন্দ্র ধরে; খুবই এবড়ো-থেবড়ো যার তল
সে কারণেই মাঝে মধ্যে হেঁচকা টান; মুক্তি খুঁজতে চাইছে!
কিন্তু কি সাধ‍্য!
দড়ি যা মোটা, তা-ও সে আবার বাঁধা!

তাই লিখছে (মাড়াচ্ছে আর কি) সুবোধ কেতাব
বৃত্ত অনুগত
যার প্রধান ছবক পড়ো…
এ এমনি এক লাউকুমড়ো, যার থেকে বিচিগুলো
আরও বড় বড়

বন্ধ‍্যা জমিনেও তড়তড় বাড়ে
এবং
ফলন প্রচুর

একাত্তরের সাহসী দিনগুলো
‘কুমোরখালীত বুঝি শেল প’লো রে বাপু’
প্রড়শি দাদিমা’র এমন আতঙ্ক আমার বাবা উড়িয়ে দিতেন
‘ধুর! ও কিছু না, কত কানামেঘ ও রকম গোঙরায়’

পচে ফুলে ওঠা লাশ…
বৈঠা কী নরম করে পাশ কাটিয়ে নিতেন বাছের শেখ!
যেন ডুবসাঁতার কাটছে কেউ; কিছুক্ষণ বাদেই উল্টান দিয়ে
উজান বাইতে শুরু করবে আবার

কোনো রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া
যেনতেনভাবে গোর দেওয়া মূর্দারা মনে হতো, বেড়ে যাবে বহুগুণ
আর জয়বাংলা বলে বিস্ফার করবে দিগ্বিদিক…

ছড়ি
অদৃশ্য
কিন্তু দস্তানাটি আমি টের পাই
যখন আমার সাথে তারা মুসাফা করে
এবং
খুব সাবধানে কোলাকুলি!
কোটের পিনটা আমাতে বেঁধে, তাই

বস্তুত
ঐ দূরত্বটুকুই তাদের গোটা কওমের জন্যে
এক বড়ো রকমের সান্ত্বনা
মাঝে মাঝেই নিজেকে আমার মনে হয় একজন উলঙ্গ লোক
টুপি পরে আছে

কী হাস‍্যকর!
এবং তারা হাসছেও
অবশ‍্য এজন্যে নয় আপাদমস্তক উলঙ্গ তাই লজ্জা আড়াল করছে

তাদের হাতে ছড়ি…

জানুর নিচে নেমে আসা হাত
(অধ‍্যাপক আহমেদ রেজা শ্রদ্ধাভাজনেষু)

দৈত‍্যটার হাত জানুর নিচে নেমে এসেছে!
এতখানিই যে, সে কনুই পর্যন্ত পুরো ভাঁজ করে পাছার চোঙ
আর গম্বুজ চুলকোতে পারে-
মজার নয় কি!

ব‍্যাপারটা আরও কৌতুককর
এবং উপভোগ‍্য হতে পারতো যদি
অতিকায় ঐসব হাতের আঙুলে ধারালো নখগুলো
খোদ চোঙাটা খুবলে রক্তাক্ত করে কি-না!

সেই সংশয়
সীমানা অতিক্রম করে না-যেত