‘বাংলার শব্দকথা’ বাঙালি ও বাংলাভাষার অনুভূতির ছবি ॥ ইসমত শিল্পী


ডা. নৃপেন ভৌমিক একজন বিখ্যাত স্নায়ুশল্যবিদ্যা বিশেষজ্ঞ। একাধারে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের লেখক, অভিধানকার, গবেষক এবং দধীচি ট্রাস্টের প্রাণপুরুষ। সবথেকে বড়কথা, তিনি অসাধারণ এক স্নিগ্ধ মানুষ; লেখায়, কথায় এবং তাঁর পেশায়।

‘বাংলার শব্দকথা’ বইয়ের শুরু থেকেই দেখতে পাই, শল্যবিদ নৃপেন ভৌমিকের দৃষ্টি মানব-শরীর কিংবা মানব-স্নায়ুর দিকে থেকেও বাংলা শব্দভাণ্ডারের গোলাঘরের দিকে গভীরভাবে নিবেদিত।সেই গোলাঘরের দরোজা খুলে তিনি প্রবেশ করেছেন বাংলা শব্দভাণ্ডারের বিপুল সংগ্রহশালায়: খুঁজে পেয়েছেন বাংলা শব্দের রত্মভাণ্ডার।

গ্রন্থের ভূমিকার শুরুতেই তাঁর সোচ্চার উচ্চারণ ‘প্রথমেই বলে রাখা ভালো, এটি অভিধান নয়’; ঠিক তাই ‘বাংলার শব্দকথা’ অভিধান নয়। তবে এর ভিত্তি ‘শব্দ’ বা ‘শব্দসন্ধান’, তাই অভিধানের ঘ্রাণসমৃদ্ধ। কেবল শব্দ কিংবা শব্দসন্ধানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি শল্যবিদ নৃপেন ভৌমিক; বরং তিনি তাঁর নিত্যসঙ্গী সূক্ষ্ম-শাণিত মন নিয়ে দৃষ্টির গভীর নিরিখে অবলোকন করেছেন শব্দসমূহের অতলরূপ।খুঁজে এনেছেন সেই শব্দনির্ভর বিষয়-আশয়ের তলদেশস্থিত ইতিহাস-সংস্কৃতির রূপ-রূপায়ণ। কেবল তুলে এনেই ক্ষান্ত নন তিনি, বরং পাঠক স্নায়ুর দ্বারগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন এর যথার্থ মর্মকথা।

আমরা গর্বিত আধুনিক কালের মানব-স্নায়ুশল্যবিদ ডা. নৃপেন ভৌমিক তাঁর অধীত বিদ্যা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে বাংলা শব্দভাণ্ডারকে মানব-স্নায়ুর দ্বারগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়।এর মাধ্যম তাঁর সরস ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও পরিবেশনার অনন্যতা চোখে পড়বার মতো। যা আপনসন্ধানী বাঙালিমানসে চির অম্লান হয়ে থাকবে বলেই বিশ্বাস করা যায়।

শব্দ এবং শব্দার্থধারার বাইরে যুক্ত হয়েছে বিষয়ভিত্তিক অভিধান। এসেছে বিশেষার্থক অভিধান।সংকলিত হয়েছে তারিখ-অভিধান, পরিভাষাকোষ ইত্যাদি।উদঘাটিত এবং সংকলিত হয়েছে শব্দের উৎসানুসঙ্গ।বলা যেতে পারে এটি বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ ভিন্নধারার এক অনুভূতিকোষ গ্রন্থ ‘বাংলার শব্দকথা’ বইটি। একে কোনো বিশেষ অভিধায় অবিহিত করা কষ্টসাধ্য এবং দুঃসাধ্য; ডা. নৃপেন ভৌমিক রচিত এই গ্রন্থের ভূমিকায় গ্রন্থকারের বক্তব্য উদ্ধৃত করে গ্রন্থের বিষয়-বৈচিত্র্য সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

তিনি লিখেছেন, ‘নিছক কৌতূহলের বশে বাঙালির অত্যন্ত পরিচিত কিছু বাংলা শব্দের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে তাদের ব্যুৎপত্তি অনুসরণ করে এবং অর্থ পরিবর্তন অনুধাবন করে প্রাচীন বাংলার অজ্ঞাত জীবনচর্চার কিছু কিছু ইতিহাস জানতে পেরেছি।এর ফলে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়েছে বাঙালির পরিচয়, তার ভাষা, চারিত্রিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, ধর্মবিশ্বাস, জাতিভেদ সমস্যা এবং সংস্কার-কুসংস্কারের বিভিন্ন দিক। তারপর একে একে উদ্ঘাটিত হয়েছে বাঙালির ঘরবাড়ি, ঘরসংসার, আসবাবপত্র, বাসনকোশন, রান্নাবান্না, খাবারদাবার, মসলাপাতি, পিঠাপুলি, মণ্ডামিঠাই, কাপড়চোপড়, সাজগোজ, প্রসাধন, গয়নাগাটি, উৎসব-অনুষ্ঠান, বাদ্যযন্ত্র, লোকগীতি, খেলাধুলা, ব্যবসাবাণিজ্য, অসুখবিসুখ, গালিগালাজ ও পদবি ইত্যাদির ইতিবৃত্ত। এছাড়াও বাংলার খেতখামার, জলাশয়, গাছগাছালি, ফলফলাদি, শস্যফসল, শাকসবজি, পশুপাখি, পথঘাট, যানবাহন ও মুদ্রাব্যবস্থার কথাও উঠে এসেছে।’

গ্রন্থসূচিতে রয়েছে আরও বৈচিত্র্য। ৪৩ মূল বিষয়ের ২২৫ বিষয়ধারার সূচিপত্রই তার প্রমাণ।গ্রন্থটি সাজানো হয়েছে বিষয়ভিত্তিক ক্রমানুসারে।

লেখক গবেষক বদিউর রহমান গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেছেন, “গ্রন্থের শিরোনাম ‘বাংলার শব্দকথা’ হলেও এর পরিসীমা কেবল ‘শব্দকথা’র সীমায় সীমাবদ্ধ থাকেনি; হয়ে উঠেছে আরও কিছু, অন্যকিছু। ‘শব্দকথা’ চাপা পড়ে গেছে বাঙালি জীবনের অজস্র বিষয়াদির উৎস সন্ধানের গভীরতায়; যা সহজেই পাঠকচিত্তকে নিয়ে যায় বিষয়ের অতল গভীরে। পাঠকহৃদয় আপন মনে বলে ওঠে ‘হেথা নয়, হোথা নয়─ অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে’। এই ‘অন্যকিছু’ সন্ধানী বাঙালি পাঠক সহজেই খুঁজে পেতে পারেন তাঁর ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ইত্যাদির পরিচয়-নির্যাস।”

ডা. নৃপেন ভৌমিক বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অক্লান্ত সাধনা করে চলেছেন।শিক্ষায় মাতৃভাষাই যে মাতৃদুগ্ধ একথা রবীন্দ্রনাথ বলে গিয়েছেন।যত ভাষাই শিখি না কেনো দিনের শেষে স্বপ্ন দেখি সেই মায়ের ভাষা বাংলাতেই।চিকিৎসার উঠোনে এবং উঠোনের বাইরেও রেখেছেন আমাদের জন্যে কিছু শিক্ষণীয় বিবিধ লেখা। রচনা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যভাবনা নামের অসাধারণ গ্রন্থ। মাতৃভাষা যে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ধুঁকছে।বিদেশি ভাষাকে অবশ্যই স্বাগত কিন্তু মাতৃভাষার বিনিময়ে কখনোই নয়।একটি বিশেষ দিনে শুধু আবেগে ভাসা নয়, কর্মযজ্ঞে এ আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক।

এই মূল্যবান প্রকাশনার জন্য ডা. ভৌমিককে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।এই গ্রন্থ পাঠক সমাজকে অবশ্যই ঋদ্ধ করবে, আমার স্থির এবং দৃঢ় বিশ্বাস।বইটি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি জগতে অসাধারণ একটি প্রকাশনা।‘বাংলার শব্দকথা’ হয়ে উঠুক বাঙালি পাঠকের নিত্যসাথি, ভবিষ্যবাঙালির গৌরবের আধার।

এমন অপূর্বসৃষ্টি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় প্রকাশককে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।দুই মলাটের মাঝে বহুবিধ মূল্যবান বাঙালি-সাংস্কৃতিক ছবি এবং বিষয়বস্তু।বইয়ের প্রচ্ছদও মার্জিত এবং অনন্য।

বই : বাংলার শব্দকথা
লেখক : ডা. নৃপেন ভৌমিক
প্রকাশক: অবসর
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ১২০০ টাকা
পৃষ্ঠা: ৮৩২