রফিকুল ইসলাম স্যার ও কিছু স্মৃতিকথা ॥ জেবউননেছা


২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ছিল বাংলা একাডেমির ৪৪তম বার্ষিক সাধারণ সভা। বাংলা একাডেমি চত্বরে প্রবেশ করতেই প্রধান ফটকে বড় করে লেখা ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি এবং বাংলা একাডেমির সভাপতি,বরেণ্য শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামর প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।’

লেখাটির পাশে স্যারের ছবি।মনে হচ্ছে স্যার তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। প্রবেশ পথের প্রাঙ্গণে খানিকটা দূরেই স্যারের ছবি সম্বলিত শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে স্যারের সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখা।আমি সে নামফলকটিকে নিয়ে এসে সামনে রাখলাম।অনুষ্ঠান স্থলে মঞ্চে তাকিয়ে দেখি সভাপতির আসনে স্যারের ছবি সামনে ফুল রাখা। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি।

চা বিরতিতে মঞ্চে উঠে স্যারের ছবির পাশে একটি ছবি নিচ্ছিলাম। পাশ থেকে একজন বলছেন, উনি আমার স্যার।আমি বললাম, উনি আমারও শিক্ষক।তিনি জানতে চাইলেন।আমার শিক্ষক কি করে রফিক স্যার। আমি তো লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী।আমি তাকে বললাম, শ্রদ্ধেয় রফিক স্যার আমার আব্বুর একুশভিত্তিক নাটক ‘বাংলা আমার বাংলা’ গ্রন্থে মুখবন্ধ দিয়েছেন।আমার সম্পাদিত ‘মুক্তিযুদ্ধ:বুদ্ধিজীবীর দৃষ্টিকোণ ও অভিজ্ঞতা’ নামক গ্রন্থে ‘একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ’ শিরোনামে লেখা দিয়েছেন।১০০টি প্রবন্ধ সংকলন নিয়ে আমার গ্রন্থ ‘সোনালী বাংলাদেশের প্রত্যাশায়’ গ্রন্থে স্যার মুখবন্ধ দিয়েছেন। তাছাড়াও স্যারের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।

উনি শুনে বললেন, এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়। বাংলা একাডেমি চত্বরে সবার সাথে সাক্ষাৎ করি আর খুঁজে ফিরি স্যারের সাথে স্মৃতিমালা।কত স্মৃতি মনে আসে।এই চত্বরেই স্যারের সাথে সাধারণ সভায় দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে ইউনিভার্সিটি লিবারেল আর্টস অব বাংলাদেশে।যখনি যা লিখতাম স্যারকে ফোন করে বলতাম।তথ্যগত কোন ভুল থাকলে সংশোধন করে দিতেন।

আমার লেখার বিষয়ে মন্তব্য প্রদান করতে গিয়ে স্যার বলেন, ‘জেবউননেছা একজন মৌলিক এবং পরিণত লেখক’। আমি একরকম বিস্ময় নিয়েই স্যারকে বলেছিলাম, স্যার আমাকে পরিণত লেখক বললেন আপনি? স্যার বললেন, আমি তোমার মধ্যে সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছি। আমি স্যারের কথা শুনে ইতস্তত বোধ করি।স্যার সবসময়ই বলতেন, তাঁর নামের আগে ড. লেখার দরকার নেই।শুধু নাম লিখলেই হবে।

করোনাভাইরাসের অতিমারিতে স্যারকে ফোনে বলেছিলাম, স্যার আপনার আত্মজীবনী লিখুন।স্যার বলেছিলেন,শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তবে সময় পেলে লিখব।আমি বলেছিলাম, তাহলে স্যার আমি লিখে দেই। স্যার বলেছিলেন, করোনাভাইরাসের প্রকট কমলে বাসায় এসো।তখন আমি বলব, তুমি লিখবে।

স্যার চলে যাওয়ার কয়দিন পূর্বে স্যারকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম, স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই অ্যাসোসিয়েশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শতবর্ষ উপলক্ষে ‘যাত্রিক’ নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশ করতে যাচ্ছে। আমি সেই প্রকাশনা কমিটিতে আছি।আপনি একটা লেখা দিবেন স্যার। স্যার বলেছিলেন, তোমার বইয়ে আমি যে লেখাটি দিয়েছিলাম,সেটি দিয়ে দাও।শরীর ভালো যাচ্ছে না।এই ছিল স্যারের সাথে আমার শেষ কথা।

২০১৮ সালে স্যারের অফিসে ৫ মিনিট ৩১ সেকেন্ডর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলাম।স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম,
স্যার এ প্রজন্মের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী ?
রফিকুল ইসলাম: একটি প্রকৃত শিক্ষিত জাতি দেখতে চাই।
প্রকৃত শিক্ষিত জাতি বলতে স্যার যদি বলতেন-
রফিকুল ইসলাম: শুধু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা নয়, শুধু ডিগ্রি নয়। প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ চাই।আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত একটি প্রজন্ম দেখতে চাই।এই প্রজন্মের কাছ থেকে দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যা কিছু মহান এই প্রজন্মের মধ্যে তার প্রতিফলন যেন পাই।
শিক্ষা সংস্কার কী প্রয়োজন আছে ?
রফিকুল ইসলাম: একসময় আামদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্স, মাষ্টার্স এগুলো ছিল ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি।পরবর্তীকালে আমরা সেমিস্টার সিস্টেমে পরিবর্তিত হই।এটি মার্কিন শিক্ষা পদ্ধতি অনুসারে।আমাদের নিজস্ব প্রয়োজন অনুসারে শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের অবশ্যই খুঁজে পেতে হবে।এখন শিক্ষার অনেক সম্প্রসারণ হয়েছে, কিন্তু মান আশানুরূপ হয়নি।কাজেই শুধু শিক্ষার সম্প্রসারণ নয় , শিক্ষার যেমন তার গুণগত পরিবর্তন এবং সে মানেরও উন্নতি প্রয়োজন।তাহলে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশরূপে বাংলাদেশ আরও অনেক অগ্রসর হতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেমন দেখতে চান ?
রফিকুল ইসলাম: বিশ্ববিদ্যালয় তো দেশের প্রয়োজনে।আামাদের দেশের প্রয়োজনে যে ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন সে ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে চাই।যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা উচ্চ শিক্ষা নিয়ে বের হবে। তারা যাতে দেশের সেবায় সহায়ক হতে পারে।দেশের উন্নতির জন্যে তারা যেন কাজ করতে পারে।আমরা যেন শিক্ষিত বেকার সৃষ্টি না করি।আমরা যেন শিক্ষিত যারা সত্যি সত্যি দেশের কাজে লাগবেন, দেশের উন্নতির কাজে সে ধরনের প্রজন্ম যেন সৃষ্টি করতে পারি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষকদরে জন্য কিছু বলবেন স্যার ?
রফিকুল ইসলাম: শিক্ষা অর্থ শুধু ক্লাস নয়, পরীক্ষা নয়, খাতা দেখা নয়।শিক্ষা অর্থ পাঠ, শিক্ষা অর্থ গবেষণা, শিক্ষা অর্থ প্রকাশনা।শিক্ষা অর্থ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ।
স্যার আপনাকে ধন্যবাদ
রফিকুল ইসলাম: তোমাকেও ধন্যবাদ।

এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণের পর স্যারকে বলেছিলাম, স্যার আপনার এই সাক্ষাৎকারটি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার দিতে চাই।স্যার বলেছিলেন, আমি যখন থাকব না তখন দিও।আমি স্যারের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম।

বাংলা একাডেমি চত্বরে সারাদিন বহু গুণীজনের সাথে দেখা হয়।কিন্তু আমি আনমনে খুজেঁ বেড়ালাম শ্রদ্ধেয় রফিক স্যারকে।কিন্তু যে যায় সে তো ফিরে আসে না।থেকে যায় সৃষ্টিকর্ম। প্রতি বছর বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হবে।গুণীজনের পদচারণায় মুখরিত হবে চত্বর। কিন্তু ফিরবেন না শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম স্যার।

‘সোনালী বাংলাদেশের প্রত্যাশায়’- ১০০টি প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থটি রফিকুল ইসলাম স্যারের হাতে তুলে না দিতে পারা আমার জন্য ভীষণ বেদনার।কারণ এই বইয়ের মুখবন্ধ স্যার দিয়েছিলেন। তবু যেন গুণীজন হারানোর বেদনা সইতে হয়।সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম মানতে হয়। রফিকুল ইসলাম স্যার বিদ্রোহী কবি নজরুল গবেষক ছিলেন, নজরুলের কবিতার চরণ দিয়ে শেষ করব রফিকুল ইসলাম স্যারের স্মৃতিকথা।
‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
অস্তপারের সন্দ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সে দিন বুঝবে।’

ড. জেবউননেছা : অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক