জলে নীলের ছায়া ॥ ইশরাত কবিতা


অলঙ্করণ: কাজী জহিরুল ইসলাম

তেমন যত্ন ছাড়া বেড়ে ওঠা লালচে, ঝাঁকড়া চুল ছিল আপনার। একটু কোঁকড়ানো অথচ গহীন আঁধারের মতন। ঝরঝরে বর্ষা অথবা কনকনে শীতেও আপনাকে নীলসাদা স্ট্রাইপ শার্ট একটু ঢিলা জিন্সেই দেখা যেত।পায়ে কখনও এ্যাশ বা ব্লাক কেডস্ বা স্নিকারস।

বেশ খানিকটা দূরের ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে যখন ডান কাত করে মাথাটা ঝাঁকিয়ে হেঁটে আসতেন সে দৃশ্যটা নিশ্চয়ই আমার দেখা একজীবনের সবচেয়ে অসাধারণ দৃশ্য। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আনমনে ব্যাগে কি যেন খুঁজতেন। এতটাই আনমনা থাকতেন, সে তন্ময়তা কখনও কাটবে বলে ভ্রম হতো আমার।

আজ সকালটা একটু তাঁতানো রোদে ঝলমলে ছিল। চামড়ার ঘনত্ব ভেদ করে সে রোদটা উষ্ণতায় ভেতরটা ছুঁয়ে যাচ্ছিল। এ দেশের অন্য সবকিছুতে মুগ্ধতা থাকলেও এ মরণ ঠান্ডাটা অসহনীয়।

গত এক সপ্তাহে ঠান্ডার তোড়ে একদিনও বাজার বা অন্য কোন কাজে বের হতে পারিনি। ওয়েদার এতটাই খারাপ ছিল। বলা কওয়া ছাড়া আচমকা তুষার ঝড়! হয়তো আমার কানে ওয়েদার রিপোর্ট যায়নি।

সংসার দৌড়ের সকাল, দুটো দুরন্ত ছেলে, তাদের সামলানো,সব গোছানো।

রুশোর শখের কুকুরকে দেখভাল করা, তারপর রেডি হওয়া।কোনরকম কফি রুটি গিলে বেরিয়ে পড়লাম। কোলে ঝুলিয়ে স্বপ্নকে (যদিও তার বাবা তাকে ড্রিম ডাকে)। আমি ডাকি স্বপ্ন ; বাংলার ছাত্রী আমি, এ ভাষার প্রতিটা অক্ষর আমার প্রাণ।যদিও রুশো পছন্দ করেনা। তাতে কি আমি ডেকেই যাই-বড়টার নাম শ্রেষ্ঠ। তাদের সামলে নিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং যখন ধরলাম বেলা তখন অনেকটা।

মলের পার্কিং লটে গাড়ি ঢুকিয়ে, দু’টোকে জাপটে ধরে বাজার করতে ঢুকলাম। লিস্টটাকে সামলে নিয়ে ট্রলিতে জিনিসপত্র তুলছি..
পিছনের স্পেসটা পার হয়ে শ্রেষ্ঠ দৌড়ে যাচ্ছে তাকে ডাকলাম চিৎকার করে,আচমকা তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে সেই চেনা মুখ!
স্যার আপনি!
ভূত দেখার মতন চমকে, বিদ্যুৎস্পর্শ খেলে গেল আমার শরীরে।কবে আসলেন স্যার? তেমনই আছেন এখনো!
কী আশ্চর্য..
তেমনই পিছনে মাথা হেলিয়ে চুলে হাত বোলানো এ দৃশ্যটা আমার কত রাতের ঘুমকাড়া ছিল। হুড়মুড় করে একগাদা কথা বলতে থাকলাম.. তাকে তেমন কিছু বলার সুযোগও দিলামনা।
তোমার বাচ্চারা?
হাসলাম, জ্বী স্যার।

কিছুক্ষণ কথা, কন্টাক্ট নম্বর দেওয়া অথচ তা যেন জীবনের অকস্মাৎ ঘটে যাওয়া দুর্লভ কোন পাওয়া। ঘোর কাটতে অনেকটা সময় লাগলো..রুশো রাতে তাড়া দিচ্ছিলো। আজ উইকেন্ডে বাইরে খাবার জন্য তোড়জোড় করছিলো সে। দুই ছেলেকে রেডি করে চিৎকার জুড়ে দিল।
নিম্মি!! তাড়াতাড়ি আসো..
কিন্তু অন্যপ্রান্তের ফোন কলটা চরম কাঙ্ক্ষিত ছিল।
কতদিন থাকবেন স্যার?
এই তো শিগগিরই ফিরে যাবো..
ফোনের ওপাশে সে দরাজ গলা!তেমনি গম্ভীর সব টুকরো কথারা। জাহাঙ্গীর নগরের ঝিলে, সেই যে প্রজাপতি মেলা,সাইবেরিয়ান পাখিদের কাকলী।

একটু একটু করে সবাইকে চেনাচ্ছেন আপনি।
আর আমি..
মন ঐ পাখিদের সাথে কোথায় উড়ে ছিল?
প্রায় ভুলেইতো গিয়েছিলাম।
রবীন্দ্র সরোবর! আবৃত্তিতে আমি কাঁচা.
কোথায় থামি,কোথায় পজ নেই.
বলেছিলেন, পারবে তুমি শেখো-
অনেককাল কবিতা পড়া হয় না,
কতদিন ভোর সূর্য দেখিনি!
আবারো ওপারে নিরবতা।
রুশোর হাকডাক শুরু হলো
বিদায়! বলার আগে আবারো সেই হৃৎস্পন্দনটা টের পেলাম।
ঠিক তেমনই অবিচল।

মৃদু নীল মায়াবী আলোর জলে আমার দু ছেলের হুটোপুটি।রুশো গ্লাসে কমলার রসে বরফ কুচি ঢালছে। সামনে পড়ে আছে প্রিয় ম্যক্সিকান গার্লিক সালাদ।
মৃদু স্বরে বিটলসের গান বেজে চলেছে-
আই ফিল ফাইন..
কেউ জানবেনা কখনও
এই যে ভরপুর পৃথিবী ; উচ্ছ্বল সংসার.
এখানে আমাদের প্রত্যেকের মন উঠোনটা কতটা ফাঁকা
কত গল্পের বুননের নীল জলের ছায়ায় ঘেরা
একা।