সাহিত্যচর্চা ও পরিচর্যা, রাজধানী থেকে দূরে ॥ আমিনুল ইসলাম


পুনশ্চ আয়োজিত ৭ বইয়ের প্রকাশনা উৎসব

বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মসূত্রে কলকাতা শহরের মানুষ ছিলেন এবং রাজকীয় পরিবারে মানুষ ছিলেন।কিন্তু তাঁর সৃজনশীল জীবনের বড় অংশটাই কেটেছে কলকাতা শহর থেকে দূরে-অনেক অনেক দূরে-প্রকৃতির কোলে।শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসর এবং তাঁরই তৈরি শান্তিনিকেতনে।তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক লেখক-বলা যায় সর্বমাত্রিক লেখক।কি নেই তাঁর লেখায়? তারপরও শেষ জীবনে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, তিনি যাদের সাথে অন্তরঙ্গভাবে মিশতে চেয়েছিলেন, যাদের ‘লোক’ হতে চেয়েছিলেন , তাদের সঙ্গে তাঁর যাপিত জীবনে ও সৃজনশীলতায় একটা ফাঁক রয়ে গিয়েছিল।

সেটা অনেকটাই অপরিহার্য ছিল।তবু তিনি তা মেনে নিতে পারেননি মন থেকে।একটা অন্তরঙ্গ বেদনা তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল আমৃত্যু।তিনি তাঁর শেষজীবনে সেসব নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা বলেছিলেন।তাঁর তেমনি একটি কবিতার নাম ‘ ঐকতান’। তিনি এ-কবিতায় বলেছিলেন,
‘কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির-বাণী-লাগি কান পেতে আছি।
সাহিত্যের আনন্দের ভোজে
নিজে যা পারি না দিতে,
নিত্য আমি থাকি তারি খোঁজে।
সেটা সত্য হোক
শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ।
সত্য মূল্য না দিয়ে সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি
ভালো নয়, ভালো নয়, সে শৌখিন মজদুরি।
এসো কবি অখ্যাতজনের
নির্বাক মনের।
মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার-
প্রাণীহন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারি ধার,
অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি
রসে পূর্ণ করি দাও তুমি।
অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারই
তাই তুমি দাও উদবারি।’

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই তাঁর সেই প্রার্থনা মঞ্জুর হয়েছিল। ‘অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি রসে পূর্ণ’ করে দিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম-জসীমউদদীনের দল যারা ছিলেন মাটির কাছাকাছি থাকা, মাটির সাথে গা লাগিয়ে থাকা কবি-সংগীতকার-কথাশিল্পী।বাংলা সাহিত্যে-সংগীতে-সিনেমায়-চিত্রশিল্পে গ্রামবাংলার কোনো শ্রেণিরই মানুষ আর অনুপস্থিত থাকেনি। কিন্তু পুনরায় বেশ কিছুদিন ধরে বাংলা শিল্পসাহিত্য কেবলমাত্র শহরের উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির কতিপয় মানুষের চর্চার ও উপভোগের জিনিস হয়ে উঠতে চাইছে।আধুনিকতা-উত্তরাধুনিকতা আরও কত ইজম !

কিন্তু কোনোটাই গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের ছবি চিত্রিত করার অনুকূলে নয়।তদুপরি বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র বিধায় সবকিছুর রাজধানী, সবকিছুর মঞ্চ, সবকিছুরই নিয়ন্ত্রণ-কেন্দ্র হয়ে উঠেছে ঢাকা।বাকিসব ‘মফস্বল’।আর মফস্বলের কণ্ঠস্বর কেন্দ্রে বেজে ওঠার সুযোগ পায় না; কখনবো বেজে উঠলেও তা ‘পাত্তা’ পায় না। তো রাজধানীর বাইরের শিল্পসাহিত্যচর্চা ‘অবজ্ঞার তাপে’ শুকিয়ে মরে যেতে বসার উপক্রম হচ্ছে আবারও। তবে তৃণমূলব্যাপী বিদ্যুতায়ন, পাকাসড়কের সংযুক্তি, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি মফস্বলের শিল্পসাহিত্য চর্চার পক্ষে অনেকখানি আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আর সব ব্যবধান একসাথে ঘুচিয়ে দিতে চায় ফেসবুক। তো ফেসবুকের বিরুদ্ধে ফেসবকু-সাহিত্য বলে নাক সিটকানো উন্নাসিকতা কারও কারও কথায় ফুটে উঠলেও তাতে কিছু আসে না তৃণমূলের সাহিত্যচর্চার। রাজধানীর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে রাজধানীর বাইরের শিল্পসাহিত্যের চর্চা।

আমি জন্মসূত্রে গাঁয়ের ছেলে। কর্মসূত্রেও ঢাকার বাইরে কেটেছে ১৫/১৬ বছর।তারপর প্রায় ১৭/১৮ বছর ঢাকায় আছি। বাধ্য হয়ে।এই রাজধানীতে যারা সাহিত্য চর্চা করেছেন, এখন করছেন, তাদের সকলের সাথে মেলামেশার কিংবা অন্তরঙ্গ হওয়ার সুযোগ না হলেও তাদের সাহিত্যকর্ম, তাদের শিল্পকর্ম পড়ে দেখার, চেয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি।তেমনি রাজধানীতে বসবাস করে পড়ছি রাজধানীর বাইরে রচিত-সৃষ্ট শিল্পসাহিত্য।আমি রাশিদা সুলতানার নগরজৈবনিক ছো্টগল্প-কবিতা পড়ছি, একইসঙ্গে পড়ছি রাজধানী থেকে দূরে থাকা এলিজা খাতুনের গল্প-কবিতা।পড়ছি ঢাকাকেন্দ্রিক অন্যান্য কবি-কথাসাহিত্যিকদের কবিতা-গল্প-উপন্যাস, একইসঙ্গে পড়ছি ‘মফস্বলবাসী’ মাসুদার রহমান-অনিফ রুবেদ-তামিম মাহমুদ সিদ্দিকদেরও নানামুখী রচনাও।আমি তাদের কারও কারও কথাসাহিত্য-কবিতা নিয়ে কিছু লেখাও লিখেছি; সেগুলোর কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে। আশা করি বাকিগুলোও হবে।এত কথা বললাম একটি আয়োজনের কথা বলবো বলে।

শুক্রবার (১ এপ্রিল ২০২২) নওগাঁ গিয়েছিলাম।বিখ্যাত লিটল ম্যাগাজিন ‘পুনশ্চ’ এর সম্পাদক এবং ‘পুনশ্চ , শিল্পের আড়ং’ নামের প্রকাশনা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা কবি রবু শেঠ আয়োজিত একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। অতীশ দীপঙ্কর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ুন কবির, অন্নদাশঙ্কর রায়, আখতার হামিদ খান প্রভৃতি মনিষীর স্মৃতিধন্য নওগাঁয় এক বছরের জন্য ছিলাম আমিও। নওগাঁয় মাত্র এক বছর। কিন্তু নওগাঁ আমার এতটাই আপন যতটা প্রকাশ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটি লাইন: ‘ক্ষণিক মিলনে তবু হে অন্তরতম/তোমারে চিনিনু চিরপরিচিত মম।’ এই অনন্য সম্পর্কের অন্য প্রান্ত হচ্ছে বয়সে আমার অনেক ছোট কবি রবু শেঠ এবং এই সম্পর্কের গাছের শেকড়ে জল-মধু-সার দিয়ে এসেছে সে-ই। আর আমি তাকে দিয়ে শুধু ভালোবাসা ভরা সমর্থন। সে আমার পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ অনুজ সদস্যসের সমান।আর নওগাঁর বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে আজতক অনেক কবিতা-ছড়া-কিশোর কবিতা লিখেছি, হয়তোবা যা নওগাঁর নিজস্ব কবি-সাহিত্যিকগণও লেখেননি। সেসব বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। আজ সে প্রসঙ্গ এ পর্যন্তই থাক।

বরেন্দ্রসভ্যতার প্রাণকেন্দ্র নওগাঁর সাহিত্য চর্চা নিয়ে একদিন আলাদা করে বলবো।একদিন হার-না-মানা জীবনসংগ্রামী রবু শেঠকে নিয়েও বলবো আলাদা করে। আজ শুধু দুদিন আগের আয়োজনের কথা বলি। সেটি ছিল ‘পুনশ্চ’ আয়োজিত ৭টি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব। ‘৭ বইয়ের আদ্যোপান্ত’ শিরোনামে পুনশ্চ প্রকাশনার আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০২২ সালের ১ এপ্রিল, শুক্রবার বিকেলে আঞ্চলিক সমবায় ইনস্টিটিউট, নওগাঁয় বর্ষীয়ান কবি-গবেষক আতাউল হক সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন নওগাঁর জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান ।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কবি আমিনুল ইসলাম।অনুষ্ঠানে কবি সালিমুল শাহিনের ‘নৈকট্য একটি দূরত্বের নাম’ বই নিয়ে কবি ড. মাসুদুল হক, অনল আকাশের ‘প্রতিদিন একটি কবিতা’ নিয়ে কবি রাজা সহিদুল আসলাম, মোহাম্মদ শহিদুল ইসলামের ‘শিয়রে সন্ন্যাসী’ নিয়ে কবি রিঙকু অনিমিখ, রহমান হাবিবের কাব্যগ্রন্থ ‘ফুল কুড়ানোর দিন’ নিয়ে কবি মামুন রশীদ, গুরুদাস দত্ত বাবলুর ‘যত মত তত পথ’ নিয়ে প্রাবন্ধিক জাহান আলী, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘চোরাবালি’ নিয়ে কবি সহস্র সুমন অনিমা দেবনাথের গল্পের বই ‘বই ও বাতায়ন’ নিয়ে আলোচনা করেন গল্পকার আসাদ সরকার।এর আগে ‘পুনশ্চ’ সম্পাদক ও প্রকাশক রবু শেঠের স্বাগত বক্তব্যের পর নির্বাচিত সাতটি বইয়ের পাঠ উন্মোচন করা হয়। পাঠ-উন্মোচন করেন মেহেদী হাসান, নিমো সাজু, সামস-ই-সাত্তার তামান্না চমন, রফিকুদ্দৌলা রাব্বি, তামিম মাহমুদ সিদ্দিক, তানিয়া খন্দকার, আবদুল্লাহ আল রাফি সরোজ।

অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রফেসর ড. শাবিন শাহরিয়ার , প্রফেসর শরিফুল ইসলাম খান, অধ্যক্ষ (অব.) নওগাঁ সরকারি কলেজ, প্রফেসর মো. হামিদুল হক অধ্যক্ষ, সরকারি বিএমসি মহিলা কলেজ, নওগাঁ, প্রফেসর মো. নাজমুল হাসান অধ্যক্ষ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ এবং নওগাঁর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গল্পকার সাজিদ রহমান প্রমুখ।

সংস্কৃতিজনদের কথাপর্বে বক্তব্য রাখেন- কবি সরদার মোজাফফর হোসেন, অ্যাডভোকেট ডি এম আব্দুল বারী, কবি নীল সোহন।

আলোচনা শেষে সংগীত পরিবেশন করেন স্থানীয় শিল্পীরা। নওগাঁকে নিয়ে লেখা আমিনুল ইসলামের ‘ভোরের হাওয়ায় ভাসে বাংলাদেশ ‘কবিতাটি আবৃত্তি করেন নওগাঁর নন্দিত বাচিকশিল্পী রফিকুদ্দৌলা রাব্বি। সমগ্র অনুষ্ঠানটি উপভোগ্য রূপে উপস্থাপন করেন কবি-কথাশিল্পী অধ্যাপক তামিম মাহমুদ সিদ্দিক এবং বাচিকশিল্পী তানিয়া খন্দকার।

এক কথায় এটি ছিল পরিপূর্ণ প্রকাশনা অনুষ্ঠান। আমি রাজধানীতেও এমনটি দেখি না। ঢাকার বাইরে অবস্থানকারী ৭ জন কবি-কথাসাহিত্যিকের ১টি করে মোট ৭টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, লেখকদের পরিচিতিপর্ব এবং তাদের নিজস্ব বক্তব্য, প্রতিটি বইয়ের ওপর একজন করে যোগ্য লেখকের আলোচনা এবং উদ্বোধক-সভাপতিসহ অতিথিদের বক্তব্য। স্বল্পকথায় বলেতে গলে, অনন্যমাত্রায় সমৃদ্ধ এক আয়োজন।কোনো পিঠ চুলকাচুলকি নয়, কোনো তৈলবাজি কিংবা বিরুদ্ধাচরণও নয়, আলোচকগণের আলোচনা ছিল আন্তরকিতাময় ও সুবিবেচনাপ্রসূত।তারা প্রতিটি বইয়ের সবল ও দুর্বল উভয়দিক নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেছেন যা থেকে বইয়ের লেখকগণ উপকৃত হবেন, সন্দেহ নেই।বইয়ের লেখকগণও আলোচনা-সমালোচনাগুলো ইতিবাচক মন নিয়ে হাসিমুখে গ্রহণ করেছেন।

প্রধান অতিথি ছিলাম বলে প্রতিটি বইয়ের ১টি করে কপি আমাকেও দেওয়া হয়েছিল। আমি সাথে করে ঢাকায় নিয়ে এসেছি। ইতোমধ্যে দুতিনটি বই পড়া হয়ে গেছে আমার ।কবি সালিমুল শাহিনের ‘নৈকট্য একটি দূরত্বের নাম’ বইটি আমি বইমেলা চলাকালেই পড়েছিলাম এবং ফেসবুকের পাতায় একটা ছোট রিভিউ লিখেছিলাম। আজ পড়লাম কবি-কথাশিল্পী অনিমা দেবনাথের ছোটগল্পের বই ‘ বই ও বাতায়ন’। বইটির নামকরণও চমৎকার। অনিমা দেবনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে ব্যস্ত আছেন।তার ছোটগল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এরই নাম মাটির কাছাকাছি থাকা লেখক; এরই নাম সত্যমূল্য দিয়ে কবি বা কথাশিল্পী নাম গ্রহণ। তার ‘মাসুমার স্বপ্ন’, ‘সময় ও অসহায়ত্ব’, ‘স্বাধীনের মা’ এবং অন্যান্য গল্পে ধারণ করেছে জনজীবনের নিবিড় ও গহণ ছবি। যারা মুক্তিযুদ্ধের বানানো গল্প লেখেন, তারা পড়ে দেখতে পারেন অনিমা দেবনাথের ‘স্বাধীনের মা’ গল্পটি।

আমি এর আগে এলিজা খাতুনের ছোটগল্প নিয়ে লিখেছিলাম; তামিম মাহমুদ সিদ্দিকের ‘আতর’ গল্পটি নিয়ে কয়েকটি বাক্য লিখেছিলাম।এসব লেখায় আমি আসল বাংলাদেশকে দেখতে পাই।এই কথিত ‘মফস্বলে’ নগদ লাভ, পুরস্কারের লোভ, সেলিব্রেটি হওয়ার মোহ-ইত্যাদি কাজ করে না বলে এসব লেখকের সাহিত্যকর্মে উপরচালাকি, চামচাগিরি, ইতিহাস বিকৃতি, মিথ্যায়ন এবং সাহিত্যের ইজম-তাড়িত কল্পনার কৌষ্ঠকাঠিন্যময়তা কিংবা শিল্পের নামে সরস্বতীর নাপিতগিরি থাকে না।আজকের সর্বজন স্বীকৃত কথাসাহিত্যিক-গবেষক-কবি হোসেনউদ্দীন হোসেন সারাজীবন মফস্বলে বসেই লিখেছেন সবকিছু।এমন উদাহরণ আরও দেওয়া যায়।কী দরকার তার ? অবশ্যই ব্যতিক্রমও আছে এবং সেসব তো ব্যতিক্রমই। আসলে উৎকৃষ্ট সাহিত্য নগদলোভের লোভ হতে মুক্ত মন থেকেই রচিত হয়। মফস্বলে থেকে আবু ইসহাক যখন ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ রচনা করেন, তখন তিনি নিজেও জানতেন না তাঁর সেই সৃষ্টি কীভাবে গৃহীত হবে অথবা তা আদৌতেই গৃহীত হবে কি না। আর তখন তো আজকের বিতর্কে ভাবমূর্তি হারিয়ে ফেলতে বসা বাংলা একাডেমি পুরস্কার কিংবা অন্য কোনো সাহিত্য পুরস্কার ছিল না এদেশে।

নওগাঁর সাহিত্য অনুষ্ঠান নিয়ে লিখতে বসে আমার নিজের লেখা একটি আত্মজৈবনিক কবিতার কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আমার সেই কবিতাটির নাম ‘একটি নদীর আত্মকথা’।

‘আমি শ্রাবণের গঙ্গা নই,
আমি ভাদরের মেঘনা নই,
আষাঢ়ের যমুনাও নই আমি;
হতে পারি আমি ইছামতি,
হয়তো হতে পারি পুনর্ভবা
অথবা বাঙালীও হতে পারি;
সত্য যে আমি একটি নদী।

নাইবা হলো যাওয়া সমুদ্রের বাড়ি
জলের দৌড়ে নাইবা হলো লেখা
প্রান্তবাসী এই আমার নাম
আমাকে মনে রাখবে
গরীবের বউয়ের মতো এক ভূগোল।’

সেদিনে আয়োজনে আমি আমার বক্তব্যে বলেছিলাম, তাদের কোনোভাবেই নিরুৎসাহিত না হতে। কোনো বিরূপ সমালোচনা কিংবা সাহিত্যের ফতোয়া দ্বারা বিভ্রান্ত না হতে। তবে যতদূর সম্ভব, পূর্বের ও সমকালীন বিখ্যাত অথবা বহুল আলোচিত সাহিত্যগুলো পড়া দরকার। তারপর নিজের সৃজনশীল মেধাকে সম্বল করে লেখা চালিয়ে যেতে হবে। দেশের ইতিহাস মানে তো কেবল রাজা-বাদশার ইতিহাস নয়; দেশের সাধারণ মানুষের ইতিহাসই প্রকৃত ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধ মানে শুধু কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা আর সেক্টর কমান্ডারের যুদ্ধ নয়। এটা ছিল সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত যুদ্ধ, যার নাম গণযুদ্ধ।

তেমনি নদীমাতৃক দেশ মানে কেবল পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-কর্ণফুলীর দেশ নয়। নাম জানা না-জানা তেরো শত নদ-নদী আর অজস্র খাল-বিল-দিঘি-পুকুরের সম্মিলিত অবদানে সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা আমাদের নদীমাতৃক বাংলাদেশ। সাহিত্যে ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বাংলা সাহিত্য মানে কেবল মধুসূদন-রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ—বিভূতিভূষণ-ওয়ালীউল্লাহ-শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ নয়; বাংলা সাহিত্যকে গড়ে তুলেছেন শত কিংবা সহস্র অথবা তারও বেশি সংখ্যক কবি-কথাসাহিত্যিক-পুঁথিকার-নাট্যকার-সংগীত রচয়িতা-বাউলশিল্পী-রূপকথার লেখক-কবিগানে রচয়িতা-গম্ভীরা গানের স্রষ্টা।

তাদের অধিকাংশই আমাদের প্রত্যক্ষতার আড়ালে, আমাদের পঠনপাঠনের বাইরে রয়ে গেলেও তাদের অবদান মিথ্যা হয়ে যায়নি; মিথা হয়ে যাবে না। নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ এই সত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তাঁর প্রার্থনা ছিল, পরামর্শ ছিল, শহরের ও প্রচারের লাইমলাইটের বাইরে থাকা শিল্পী-সাহিত্যিকদের মূল্যায়ন করার পক্ষে, তাদের সম্মানিত করণের পক্ষে। তিনি তাঁর সেই ‘ঐকতান’ কবিতার উপসংহারে বলেছিলেন,
‘সাহিত্যের ঐকতান সংগীতসভায়
একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়-
মূক যারা দুঃখে সুখে,
নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে,
ওগো গুণী,
কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি।
তুমি থাকো তাহাদের জ্ঞাতি
তোমার খ্যাতিতে তারা পায় যেন আপনরাই খ্যাতি-
আমি বারংবার
তোমারে করিব নমস্কার।’

নওগাঁ আঞ্চলিক সমবায় ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে স্থানীয় কবি-লেখকদের সহায়তায় রবু শেঠ আয়োজিত ‘৭ বইয়ের আদ্যোপান্ত’ শিরোনামের আয়োজনটি ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশা ও পরামর্শের ষোল আনা অনুকূলে। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য পতিসরের বাতাস ছুঁয়ে সন্ধ্যাটি প্রাণবন্ততায় উচ্ছলিত ছিল প্রত্যাশার চেয়েও বেশি।আয়োজনে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়ে নিজেকে পুরস্কৃত মনে হয়েছে আমার।সেজন্য রবু শেঠ- সালিমুল শাহিনকে ধন্যবাদ না দিলেও তারা আমাকে কৃপণ ভাববেন না, পর তো নয়ই।

সেই ৭ জন লেখকের সবাইকে আবার অভিনন্দন। রবু শেঠকে রাবীন্দ্রিক নমস্কার।