নিঃসঙ্গতার অস্তায়মান ॥ ইসরাত জাহান


অলঙ্করণ: কাজী জহিরুল ইসলাম

‌‘হারাডাদিন ভাতারের লগে হুইয়া থাকলে হইবে? ঘরের কাম করোন লাগবো না। আমার পোলাডাও বলদা, বৌডারে মাথা তুইলা নাচে। বাপের মতো হইলো না বলদাডা…’

সকালে গরুর খাবার দিতে দিতে আম্বিয়া এই কথাগুলো বলতে থাকে। এই কথাগুলো মরিয়মের শাশুড়ির প্রতিদিনকার সকালের সূচনা বাণী।সকালে ছেলের ঘরের টিনের দরজাটা বন্ধ দেখলে ওনার মুখমণ্ডল কালবৈশাখী ঝড়ের আগের রূপ ধারণ করে। মাঝে মাঝে বিজলির মতো ঝলকানি দেয়ার মতো করে কিছু অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে ছেলে ও ছেলের বউকে। মরিয়ম সবকথা শুনেও, না শোনার ভান করে চুপচাপ স্বামীর গায়ের সাথে লেপ্টে থাকে আর জয়নাল সাদাসুখ নিঃশেষ করে বেঘোর ঘুমায়। একটু আগে যে ছিলো স্ত্রীর কাছে দানব।মরিয়মও সারা শরীরে সুখ মেখে এখন কিছুটা ক্লান্ত। তাই তো উঠতে ইচ্ছে করে না। উঠলেই সারাদিনে হাড়ভাঙা খাটুনি।চাঁটাই বিছিয়ে মরিচ শুকানো, ধান শুকানো, গরুর গোসল ও খাবারের জন্য পুকুর থেকে পানি আনা।টিউবওয়েল থেকে দশ কলস পানি এনে ইট বাঁধানো খোলা হাউজটা ভরা- সবই নিজের হাতে করতে হয়। পাছে আবার শাশুড়ির নানা বাহানার গালাগাল তো আছেই। তাও হজম করতে হয়। আম্বিয়াকে বাড়ির ষাটোর্ধ্ব বুড়োও ভয় পায়। সেখানে মরিয়ম তো কচি শিশু। কিছু বলার চিন্তা করলেও ভয়ে গলার কাছের কথাগুলো দলা পাকিয়ে যায়। তখন তার অন্যায়গুলো ন্যায় ভেবে চুপসে যায় মুখখানি। ছেলে জয়নাল আবার মাকে পাত্তা দেয় না। তাইতো স্বামী যতক্ষণ বাড়ি থাকে ততক্ষণ মরিয়মের শান্তি। গঞ্জের হাটের দিনে ওর মন খারাপ থাকে। সকাল সকাল চলে যায় আর ফেরা হয় রাতে সব সবজি, ডিম, হাঁস-মুরগি বেঁচে। ফেরার পথে বউয়ের খুশির জন্য আলতা, সুবাস সাবান, চুড়ি নিয়ে ফেরে। তবে পুরোটাই লুকিয়ে কারণ বুড়ির (বয়স চল্লিশের বেশি) আবার ছেলের এসব আধিখ্যেতা সহ্য হয় না।

‘কি রে জয়নাল আইজকা উঠবি না, কি রে বাপ শরীরডা কি ভালো আছে?’
আবার কিছুসময় দম নিয়ে বলে,
‘ছিনাল মাগিডা তো জামাইয়ের গতরে হাইন্দা থাকতে পারেই বাঁচে’

মরিয়মের আর সহ্য হয় না। উঠে বসে। চৌকির আশপাশে ব্লাউজটা খোঁজে, পায় না। বোঝে ওর ব্লাউজ জয়নালের শরীরের নিচে শায়িত । পেটিকোটের গিঁটটা শক্ত করে বেঁধে শাড়িটা শরীরের সাথে জড়িয়ে বের হয় টিন কাঠ দিয়ে বাধানো ঘর থেকে। ওর বাপের ঘর আবার বেড়া ও শনের তৈরি। ঘর থেকে বের হয়ে বেশ দ্রুত কলপাড়ের দিকে পা বাড়ায় মরিয়ম।যেন বুড়ির সাথে চোখাচোখি না হয়। ওর যেদিন সকালে শাশুড়ির সাথে প্রথম দর্শন হয়, সেইদিন ওর দিনটা খারাপ যায়। হয় গরুর শিংয়ের ঘুতা খায় বা পুকুরপাড়ে স্যাঁতস্যাঁতে কাদায় আছাড় খায়। আজ চেষ্টা করেও শাশুড়ির চোখ এড়াতে পারে না।

‘কি রে কুইড়া নবাবজাদি ঘুম হইছে? বুড়া শাশুড়িডারে না খাটাইলে চলে না তোর’

মরিয়ম আর কথা বাড়ায় না। সোজা চলে যায় চুলার পাড়ে কয়লা খুঁজতে। সকালবেলা কাঠকয়লা দিয়ে দাঁত ঘষার অভ্যাস ওর জন্ম থেকে। এখন হালের ব্রাশ দিয়ে দাঁত ঘষামাজা করতে ভালো লাগে না । ক্রিমের মতো মিষ্টি মিষ্টি জিনিসটা জিভে জ্বালা ধরায়।তাই তো এড়িয়ে চলে। তবে জয়নাল সবসময় বলে কয়লা দিয়া দাঁত না মাজতে।

আম্বিয়া বউকে দেখে নিজের ঘরে যায়। জানে এখন মরিয়ম ধীরে ধীরে ওর রোজকার কাজগুলো গুছিয়ে গুছিয়ে করবে।বউটার একটাই সমস্যা সকাল সকাল উঠতে চায় না। তাছাড়া সবদিক থেকে সেরা বউ হলো ওর ছেলের বউ।মনে মনে স্বীকার করলেও মুখ ফুটে কখনো বলে না। যদি মেয়ের দেমাগ বাড়ে। ভাসুরের ছোট মেয়েটাকে ছেলের বউ করেনি ঐ মেয়ের দেমাগের কারণে।

আম্বিয়া এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে পনেরো বছর বয়সে। দুই বছর স্বামীর সোহাগ পায়, তারপরে আচমকা সবশেষ হয়ে যায় একদিনেই। কয়দিনের বৃষ্টিতে পাটক্ষেতে পানি জমে ছিলো, তাই তো জয়নালের বাপ পাটক্ষেতে গিয়েছিলো নালা কাটতে। নালা কেটে ঘরে এসে কচু তরকারির সালুন দিয়ে ভাত খায় অনেকগুলো। তবে খেয়ে উঠে আর দাঁড়াতে পারে না, মুখে ফেনা তুলতে তুলতে শুয়ে পড়ে চাটাইতে। আম্বিয়ার শ্বশুর ছুটে আসে কবিরাজ নিয়ে , তার আগেই সবশেষ। কবিরাজ পরে জানায় জয়নালের বাপ আজগরকে সাপে কেটে ছিলো নালা কাটার সময়ই, টের না পাওয়া দেরি হয়ে যায়।

বিষ ছড়ায় সারা শরীরে।আম্বিয়া তখন তিন মাসের পোয়াতি ছিলো। জয়নালের জন্মের পরে মুখে হাসি ফোটে ওর ।কারণ ছেলে জন্ম দিয়ে বংশরক্ষা করতে পেরেছিলো একমাত্র আম্বিয়া। অন্য বউরা বছর বছর মেয়ে জন্ম দেয়ার কারণে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে ওর একটা আলাদা কদর হয় তখন। আর সেই কদরের কারণেই সতেরো বছর বয়স থেকে একা নিঃসঙ্গ আছে এই বাড়িতে। সকাল সকাল জা, ননদের ভেজার শাড়ি, ব্লাউজ দেখে বুকের ভেতরে হুরহুর করে উঠতো একটা সময়।শরীরে কামনা জাগতো, কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কামনা শারীরিক পরিশ্রমে মাধ্যমে পানি করে ফেলতো।তাই তো এখন এই বাড়ির সবাই ওর এক ডাকে ভয়ে জড়ো হয়, মান্য করে।

‘ও জয়নাল, ও বাপ, আর কত ঘুমাবি? তাড়াতাড়ি উঠ। গঞ্জে গিয়া আমার বাতেঁর ব্যাদনার তেলডা অ্যাইনা দেয়। সারারাইত ঘুৃমাইতে পারি না।’

মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে ২৩ বছরের তাগড়া যুবক জয়নালের।ছয় মাস আগে পাশের গ্রামের মরিয়মকে বিয়ে করছে মায়ের পছন্দে। চাচাতো বোনের সাথে একটু পিরিত ছিলো, সাথে মদ ও জুয়ার প্রতি টান।সেটা আম্বিয়া টের পেয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে করিয়ে আনে গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়ে মরিয়মকে।ঘরের বউ এসে যেন ছেলেকে বেঁধে রাখতে পারে সব আসক্তি থেকে।কারণ মায়ের কথা শুনতো না জয়নাল। আদরে বাঁদর হয়েছিলো ছেলে।

জয়নাল ঘুম থেকে উঠে বউকে খোঁজে, পেটে দানাপানি দেয়ার জন্য। তাছাড়া কচি লাউয়ের ডগার মতো চঞ্চল বউটাকে ওর বেশ ভালো লাগে।সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে মন চায়।

মইরাম
ও মইরাম,
স্বামীর ডাকে কান খাড়া হয় মরিয়মের, রান্নাঘর থেকে বের হবার আগেই শাশুড়ি গিয়ে হাজির হয়।মনে মনে শাশুড়িকে ভৎর্সনা করে আবারও চুলার সামনে গিয়ে বসে।ছেলের হাতে টাকা দেয় ওষুধ, মালিশ তেল আনার জন্য, সাথে কিছু ডিম আর লাউ দেয় গঞ্জে বিক্রি করার জন্য, যদি কিছু টাকা আসে হাতে। নতুন একটা গাভী গরু কেনার ইচ্ছা অনেকদিনের, সেজন্য টাকা জমাচ্ছে আম্বিয়া। বউটা যদি পোয়াতি হয় তাহলে প্রতিবেলা দুধ খাওয়াবে। নাতিটা যেন বউটার মতো সুন্দর হয়। অনেক স্বপ্ন আম্বিয়ার চোখে। আজগরের সাথে বিয়ের পরে ওর দাদী শাশুড়ির নারকেল, তিল আর হলুদ মাখানো তেল ঘষতো ওর গায়ে যেন চাপা গায়ের রংটা একটু উজ্জ্বল হয়। গায়ের রং উজ্জ্বল হয়েছিলো কিন্তু সেই গায়ে সোহাগ মাখাতে পারেনি বেশীদিন।

বেলা গড়ায়, ধান মরিচ ঘরে তুলে মরিয়ম যায় পুকুরে গোসলের জন্য। গতকাল নতুন একটা গন্ধ সাবান আনছে জয়নাল। আজ বলেছে এই সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করতে। আজ গঞ্জ থেকে আসার সময় মোবাইলে নতুন সিনেমা লোড করে আনবে।রাতে দুজনে একসাথে দেখবে। বাড়িতে কিছুদিন হলো পল্লীবিদুৎ এসেছে, কিন্তু টিভি এখনো আসেনি ঘরে।তাই তো বিনোদন বলতে ওই মোবাইলে লোড করা সিনেমা, গান আর নাটকই ভরসা।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে কাপড় তুলে মরিয়ম চুলে তেল দিতে বসে শাশুড়ির কাছে।আম্বিয়া বেশ যত্ন করে বউয়ের মাথায় তেল দিয়ে চুলগুলো বেঁধে দিতে দিতে নিজের পুরনো দিনের সুখ দুঃখের আলাপ সারে। তেল দেয়া শেষ হলে মরিয়ম যায় চাচা শ্বশুরের ঘরে ননদগুলোর সাথে গল্প করতে।যা আম্বিয়ার আবার একদম পছন্দ না।তবে মুখ ফুটে কিছু না বললেও হাবভাবে বুঝিয়ে দেয়। মরিয়ম গায়ে মাখে না।

হঠাৎ পাশের বাড়ির আক্কাস ছুটে আসে আম্বিয়ার কাছে।
‘চাচী, জয়নাল তো মটোরসাইকেল এক্সিডেন্ট করছে। ওরে সদর হাসপাতালে লইয়া গেছে, তুমি তাড়াতাড়ি লও’

আম্বিয়া দোচালা ঘরের মাঝে দাঁড়ানো থেকে মাটিতে বসে পড়ে।দুই পাশের ঘর থেকে ছুটে আসে ভাসুর দেবর দুজনেই। ঘরের ভেতর থেকে চিৎকার ভেসে আসে মরিয়মের সাথে আরো কিছু নারী কণ্ঠ ।মূর্ছা যায় সুন্দরী বউটা স্বামীর শোকে।এই শোক দীর্ঘ হয়, যখন সারাগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে মধ্যরাতে জয়নালের মৃত্যুর সংবাদটি।ফজরের নামাজের সময় ইমান সাহেব সকলের কাছে জায়নালের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।বাদ জোহর লাশ সদর থেকে আনা হয়, আর বাদ আসর জানাজার।কিছু সময়ের ভেতরে মরিয়মের রঙিন কাপড় সাদা হয়ে যায়।

নতুন সূর্য ওঠে।অস্ত যায়।দিন গিয়ে সপ্তাহ যায়।সপ্তাহ মাসকে স্বাগতম জানায়।কিন্তু আম্বিয়া আর মরিয়মের কোন পরিবর্ত হয় না। শোক কাটিয়ে উঠতে পারে না দুজন।

দেড়মাস মোটামুটি কোনরকম হুঁশ থাকে না। নতুন তাজা কবরের মাটি, খেজুর পাতা শুকিয়ে আসে।নতুন বেড়া দেয়া হয়। সব আম্বিয়ার ভাসুর, দেবর নিজ নিজ তাগিদে করে মৃত ভাইয়ের একমাত্র ছেলের জন্য। প্রতিদিন গ্রামের বয়স্ক পুরুষরা নামাজ শেষে মোনাজাত করে আসে কবরে পাশে দাঁড়িয়ে জয়নালের জন্য।এসে আবার জানায় কেমন আছে আম্বিয়ার সোনার টুকরার কবরখানি।

মাস গড়িয়ে তিনে যায়, মরিয়ম এখন শাশুড়ির সাথে এক বিছানায় ঘুমায়।রাতে আম্বিয়া বউমার মাথায় হাত বুলায়, গায়ে কাথাঁ দেয়। মাঝেমাঝে নিজের হাতে খাইয়ে দেয়।যেদিন মরিয়ম বেশি কান্নাকাটি করে।ছয় মাস পরে ধীরে ধীরে জয়নালের শোক কাটিয়ে দুজন মানুষ একটু স্বাভাবিক হয়ে আসে।আম্বিয়া ঘরের লাগোয়া গোসলখানা বানায়, সাথে পায়খানা।যেন রাতবিরাতে ছেলের বউয়ের কষ্ট না হয়। হঠাৎ একদিন মরিয়মের বাবা আসে বেয়াইনের সাথে আলাপ পরামর্শ করে মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে।সেহেতু জয়নালের কোন স্মৃতি মরিয়ম বহন করতে পারেনি।তাই শুধু শুধু এই বাড়িতে মায়া বাড়িয়ে কি লাভ। মেয়েকে নতুন করে বিয়ে দিতে চান তিনি।অল্প বয়সী মেয়ে, ছয়মাস সংসার করেছে মাত্র।বাকি জীবনটা সাদা ভুষনে রাখতে চায় না মেয়েকে।

বেয়াইকে দেখে প্রথমে খুশি হলেও পরে কথাবার্তা শুনে আর ভালো লাগে না।কিন্তু বুদ্ধিমতি আম্বিয়া মুখ ফুটে কিছু বলে না। চুপচাপ সবকথা শোনে।
‘হো, অল্প বয়স। আমিও বুঝি। ভালো পোলা পাইলে আমিও চাই মরিয়মের বিয়া দিতে।যতদিন বিয়া না হয় আমার কাছেই থাউক। ঘরডা খালি খালি লাগে। তয় একটা কতা, আমার বাড়ি থাইক্যাই বিয়ার কন্যা যাইবো বেয়াই’

মরিয়মের বাবা বেয়াইনের উদারতায় মুগ্ধ হয়ে খুশি মনে বাড়ি ফেরে। মেয়ের জন্য নতুন বিয়ের সমন্ধ দেখতে শুরু করে।মরিময় সুন্দরী তাই পাত্রের অভাব হয় না।

একেএকে চার পাঁচটা বিয়ের সমন্ধ নিয়ে গেলেও কারো সাথে মরিয়মের বিয়ে দিতে পারেনা ওর বাবা।সবাই ফেরত যায়।তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সবারই মেয়ে দেখে পছন্দ করে, হাতে টাকা দেয়। পাকা কথা দিয়ে যাবার দুইদিন পরেই পাত্রপক্ষই জানায়, তারা বিয়েতে রাজি না। এইভাবে বছর গড়িয়ে যায়।

স্বামীর মৃত্যর পরে মরিয়মের আর বাবার বাড়ি যাওয়া হয় না।ওর মা এসে মাঝেমাঝে মেয়েকে সঙ্গ দিয়ে যেতো। হঠাৎ মায়ের পুকুর ঘাটে আছাড় খেয়ে পায়ে ব্যাথা পাওয়ার সংবাদ শুনে মায়ের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে পোষন করে মরিয়ম।তারপরও শাশুড়ির শরীর খারাপসহ নানান ঝামেলায় সময় করতে পারে না।একদিন অনেকটা রাগ করে বাপের বাড়ি যাবার জন্য কাপড় গোছানো শুরু করে। বাপকে আসতে বলে, মাকে দেখতে মন চায় এই খবর জানিয়ে।ওদিকে কষ্টে বুক ফেটে আম্বিয়ার।এতো আদর যত্নের পরও কেন মরিয়ম তাকে ছেড়ে যেতে চায়। তাছাড়া এতদিন ধরে সুকৌশলে সব বিয়ে যে আম্বিয়াই ভাঙিয়েছে, তা যদি মরিয়ম বা ওর বাবা জেনে যায় কোনভাবে। মা বাবার মায়ার কারণে আর যদি ফিরতে না চায় মেয়েটা। তাহলে কি নিয়ে থাকবে।এতো বছর পরে নিঃসঙ্গ রাতের একজন সঙী হয়েছিলো ওর।তাই তো কোনভাবে হাতছাড়া করতে চায় না, ছেলেহারা বিধবার মায়ের একমাত্র যক্ষেধন পুত্রবধূ মরিয়মকে।

‘আম্মা আইয়া পড়মু, দুইদিন থাকমু, মায়েরে দেখতে মন চায়’
‘এক গ্লাস দুধ খাইয়া যাও বৌমা ,একটু খাড়াও আনতাছি’

মরিয়মের বাবা অপেক্ষা করে, সাথে মরিয়মও।কিছুসময় পরে চুলার পার থেকে আম্বিয়ার চিৎকারে ছুটে যায় মরিয়ম, দেখে গরম দুধের হাড়ি থেকে দুধ পড়ে ডান হাতের অনেকটা অংশ ঝলসে গেছে করিৎকর্মা বৃদ্ধার।শাশুড়ির হাত নিয়ে ছোটাছুটি করে একটা সময় বাপকে একাই ফেরত পাঠায় মরিময়।মাকে নিয়ে আসতে বলে সুস্থ হলে।

রাতে ঝলসানে হাত থেকে পানি বের হয়। গায়ে জ্বর আসে আম্বিয়ার। শাশুড়ির জন্য সাগু রান্না করে।পাশের ঘরের চাচী শাশুড়িরা আসে মরিয়মের কাছে।সুখ-দুঃখের আলাপ করে।মরিয়ম তাদের কথার ইঙ্গিত বুঝেও না বোঝার ভান করে।

রাতে নিজে হাতে ভাত খাইয়ে দিতে দিতে মরিয়ম শাশুড়িকে বকা দেয় একটু আদুরে স্বরে।
‘হাত না পুড়াইলেই হইতো আম্মা।আমারে কইলেই আমি যাইতাম না। আমি আপনেরে ছাইড়া কোনদিনও যামু না আম্মা।আম্নেহ আর ইমন পাগলামী কইরে না কইলাম’

কিছু সময় চুপ করে চোখের পানি ফেলে শাশুড়ির মুখের দিকে তাকায়।
‘জয়নালের কব্বরডার বড়ই মায়াগো আম্মা, বড়ই মায়া, আমি জয়নালে ছাইড়া যাইতাম না’

আম্বিয়া ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে তার যক্ষেরধনের দিকে।মেয়েটা কখন বউ থেকে যে মেয়ে হয়ে গেলো।বুঝতেই পারলো না। শেষ হলো আম্বিয়ার নিঃসঙ্গতার কালরাত্রি।