প্রায়দিন তামান্না তুলির কবিতা কীভাবে ও কেন পাঠ করি ॥ নাসরিন জে রানি


[ সম্পাদকীয় নোট: বিশ্ব কবিতা দিবস ২১ মার্চ। বিশ্বব্যাপী কবিতা পাঠ, রচনা ও প্রকাশনাকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো এই দিনটিকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।এবারের কবিতা দিবসে যোগসূত্রের পাঠকদের জন্য বিশেষ আয়োজন গল্পকার নাসরিন জে রানির চোখে কবি তামান্না সুলতানা তুলির কবিতা ]

সব মানুষের হৃদয়ে একটি কবি সত্ত্বা বাস করে। মানুষ তার মনের ভেতরের যেকোন ভাব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিগুলো যখন কাব্যিক ঢঙে প্রকাশ করে, তখন থেকেই সেটা কবিতা হয়ে ফুটে ওঠে। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ বলেছেন- ‘গদ্য মানে শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো, আর পদ্য মানে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দকে সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।’

কবিতার গুরুত্ব উপলব্ধি করে সারা বিশ্বব্যাপী কবিতা পাঠ, রচনা, প্রকাশনা ও শিক্ষাকে উৎসাহ দিতে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে ইউনেস্কো ২১ মার্চকে ‘বিশ্ব কবিতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্ব কবিতা দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো- কবিদের সম্মান জানানো, কবিতা আবৃত্তির ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করা, কবিতা পড়া এবং কবিতা পড়ানো, কবিতা লেখা ও শিক্ষার প্রচার, নাট্য, নৃত্য, সংগীত ও চিত্রকলার মতো অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে কবিতার সমন্বয়তাকে উৎসাহ দেওয়া এবং কবিতাকে বিভিন্ন মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলা।

২০২২ সালের আজ ২১ মার্চ, বিশ্ব কবিতা দিবস। এই দিনে আমি সম্মান জানাতে চাই সমসাময়িক বাংলাদেশের তরুণ কবিদের মাঝে অন্যতম প্রত্যুৎপন্নমতি কবি তামান্না সুলতানা তুলিকে।তুলির কবিতার ভেতরে তার রকমফের বহুবিধ ভাবনার, রচনাশৈলীর ভেতর-পথ ধরে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ফুটে উঠেছে।

আজকের আলোচ্যতে নেওয়া তামান্না তুলির লেখা পাঁচটি কবিতা-
১.
সাঁতারের নিশ্চয়তা পেলে ধার দেব
আশবটি
মাছেদের সংসারে লাগাবো কোন্দল

২.
মানুষের অবিশ্রাম প্ররোচনার পাশে ফুটে
আছে আমার
স্বেচ্ছামৃত্যুর পুষ্প

৩.
নরম মাংসের ভেতরে
খেলা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী কবুতর

৪.
এমন শূন্যতায় ভাসতে ভাসতে ফাপা
হাড়ের ভেতর
ঘন হয়ে আসে ঈশ্বর ও ঈশ্বরহীনতা

৫.
স্থবির গ্রহের দিকে চলে যাচ্ছি
এখানে নড়েচড়ে উঠলেই ধ্বসে যাচ্ছে
শব্দের সংযম

কবিতা হলো রক্তকে কালিতে রুপান্তর করা পীড়া, ক্লেশ।একজন কবি সীমাহীন ও অবাধে বিচরণরত থেকে সবার দৃষ্টিসীমার বাইরে অবতীর্ণ হয়ে কবিতা রচনা করতে পারেন।

তামান্না তুলির কবিতার সংবৃতি বিদ্যমানতা-১
সাঁতারের নিশ্চয়তা পেলে ধার দেব
আশবটি
মাছেদের সংসারে লাগাবো কোন্দল

আঁশবটি- যে বঁটিতে মাছ কোটা হয়।যে ইস্পাতে তরবারি হয়। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘আঁশবটি কর তারে।’

কোন্দল- ঝগড়া, কলহ।
সাঁতার- জলোপরি ভাসন, সন্তরণ, পানিতে ভাসমান অবস্থায় বিচরণ/ সাঁতার দেওয়া।
নিশ্চয়তা-সংশয়শূণ্যতা, নিঃসন্দেহ।
ধার-দেনা, কর্জ, সম্বন্ধ-সম্পর্ক ধারধরা।
সংসার-জগৎ, পৃথিবী।

সমস্ত স্তরের ভালোবাসা, দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি, যিনি কবি এবং তার কবিতাগুলো হয়ে ওঠে পারফর্মেন্স ইন ওয়ার্ড।

তামান্না তুলির কবিতার সংবৃতি বিদ্যমানতা-২
মানুষের অবিশ্রাম প্ররোচনার পাশে ফুটে
আছে আমার
স্বেচ্ছামৃত্যুর পুষ্প

একজন কবি সব ধরনের বিষবাষ্পকে নিঃশেষ করতে পারেন, সেই সাথে পারেন এগুলো থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে।

অবিশ্রাম-অক্লান্ত/অবিরাম।
প্ররোচনা-মন্দার্থে নিয়োজন/উত্তেজনা/উৎসাহ দান।
ফুটে আছে- পূর্ণ বিকশিত, সম্পূর্ণ প্রকাশিত/ব্যক্ত।
স্বেচ্ছামৃত্যু-আত্মহত্যার সমার্থক স্বেচ্ছামৃত্যু।
কোন ব্যক্তি যখন নিষিদ্ধ বিষ নিজের ওপর মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করে আত্মহননের পথ বেছে নেন, তখন তা আত্মহত্যা বলে আমরা জানি। একজন কবির কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুতে শুধু রুপান্তর ঘটে তার এক জীবন থেকে আরেকজীবনে, হয়ত মানব শরীর থেকে কবি বৃক্ষের প্রসূনরূপ পুষ্পের আকৃতিতে আবার ফিরে আসেন আমাদের মাঝে।

তামান্না তুলির কবিতার সংবৃতি বিদ্যমানতা-৩
নরম মাংসের ভেতরে
খেলা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী কবুতর

কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুনরূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম।

বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সায়ত্ত্বশাসন চায় না।বিচ্ছিন্নতাবাদ এক ধরনের ক্ষুদ্র ও উপেক্ষিত কিছুর সমর্থিত আওয়াজ।তুলির ‘নরম মাংসের ভেতরে খেলা করে বিচ্ছিন্নতাবাদী কবুতর’- একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী নিরন্তর কর্ম যা অন্য এক অস্থিতিশীলতার জন্ম দেয়, অশান্তি হয়।একজন কবি অতিমানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে সব মানুষের মাঝে উৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন, যখন একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনার রূপকধর্মী ও নান্দনিকতার সহযোগে তার কবিতাগুলো রচিত হয়।এই কবিতায় উল্লেখিত বিচ্ছিন্নতার জন্য এক বা একাধিক প্রেরণা থাকতে পারে, যা প্রভাববিস্তারকারী অংশের সাথে একত্রীকরণের প্রচেষ্টা তাদের পরিচয় ও বৃহত্তর আত্ম-সংকল্প অনুসরণ করার ক্ষমতার সাথে বিরোধপূর্ণ।

তামান্না তুলির কবিতার সংবৃতি বিদ্যমানতা-৪
স্থবির গ্রহের দিকে চলে যাচ্ছি
এখানে নড়েচড়ে উঠলেই ধ্বসে যাচ্ছে
শব্দের সংযম

একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিসেবে নিজেকে অন্যের চোখে ফুটিয়ে তোলেন, যেখানে তার রচিত কবিতাগুলো মুগ্ধ করে পাঠকদের।কবিতা বিহবল, মূঢ় করে তার সূক্ষ্ম অপরিমেয়তায়, একটি মাত্র গুঞ্জরনিতে নয়, একক ঝংকারে নয়।তুলির এই কবিতাটি পাঠের পর আমার উপলব্ধি হয়েছে- এ যেন আমার নিজস্ব বোধ, চিন্তা, যা ক্রমশ ভেসে উঠেছে তার সংহিতায়, ‘এ যেন নড়ে উঠলেই ধ্বসে যাচ্ছে শব্দের সংযম।’

তামান্না তুলির কবিতার সংবৃতি বিদ্যমানতা-৫
এমন শূন্যতায় ভাসতে ভাসতে ফাপা
হাড়ের ভেতর
ঘন হয়ে আসে ঈশ্বর ও ঈশ্বরহীনতা

এই আলোচনের অবশিষ্টাংশে পৌঁছে বলব- আসলে কবিতা হলো মানুষের পরিতৃপ্তির বিষয়।মানুষের মনের ভাব প্রকাশের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তের ইশতেহার বা প্রচারপত্র হলো কবিতা।একজন কবি অকথ্য দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে অকুণ্ঠ বিশ্বাসবোধ রচনা করে যখন, যেমন, যেখানে খুশী অভিগমন করতে পারেন- এমন শূন্যতায় ঘন হয়ে আসে ঈশ্বর ও ঈশ্বরহীনতা আমার ফাপা হাড়ের অন্তঃপুরে।