বিদায় দিলারা আপা ॥ আদনান সৈয়দ


দিলারা হাশেম

কথাসাহিত্যিক দিলারা হাশেমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল নিউইয়র্ক মুক্তধারা বইমেলাতে। সম্ভবত ২০০৪ সালে তিনি নিউইয়র্ক বইমেলায় যোগ দিতে এসেছিলেন এবং তখন তাঁর সঙ্গে মুক্তধারার দপ্তরে শিল্প সাহিত্য নিয়ে লম্বা এক আড্ডাও হয়েছিল।

তারপর সম্ভবত আবার ২০১০ সালের দিকে। হয়তো অনেকেই জানেন না দিলারা আপা মুক্তধারা নিউইয়র্ক বইমেলার একজন অন্যতম উপদেষ্টা। আগে থেকেই জানা ছিল তিনি ভীষণ অসুস্থ। কাউকে নাকি চিনতে পারতেন না। কিন্তু আমাদের খুব ইচ্ছে ছিল তিনি যেন আবার নিউইয়র্ক বইমেলায় একটিবারের জন্য আসতে পারেন। কিন্তু তা আর হল না। তিনি চলে গেলেন (দিলারা হাশেম শনিবার ১৯ মার্চ ২০২২ যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে মারা যান)। রয়ে গেল তাঁর অনেক স্মৃতি।

স্মৃতির পাতায় তিনি জমা হয়ে থাকলেন।আর জমা হয়ে থাকলো তাঁর অটোগ্রাফ দেওয়া গ্রন্থ ‘হামেলা’ নামের অসাধারণ এই উপন্যাসটিও।

এই সুযোগে উপন্যাসটি নিয়ে দুটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না।আমি মনে করি ‘হামেলা’ অসাধারণ একটি উপন্যাস।দিলারা হাশেম তাঁর এই উপন্যাসে ‘যৌনতা’কে অকপট সাধারণ মামুলি ভাষায় যেভাবে তুলে এনেছেন তা দেখে তখন খুব অবাক হই।কারণ আমাদের বাঙালি সমাজে ও সাহিতেও খুব কমই ‘যৌনতা’কে তুলে আনা হয়।যদিও ক্ষুদা, তৃষ্ণা, আনন্দ, ভোগ বিলাসের মত যৌনতাও আমাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় কিন্তু তারপরও দেখা যায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের লেখককুল বা সমাজ খুব একটা আলো ফেলেন না বা নানা কারণে এই নিয়ে কথা বলতে চান না।দিলারা হাশেম তাঁর ‘হামেলা’ উপন্যাসে সেই কাজটিই করেছেন এবং এই নিয়ে যথেষ্ঠ আলোও তিনি ফেলেছেন।

‘হামেলা’ উপন্যাসের মূল বিষয়টিই হল নরনারীর জীবনে প্রেম এবং যৌনতাকে নিয়ে। প্রেম এর পরিনতি যৌনতায় আবার যৌনতার পরিনতি প্রেমে। প্রেম আর যৌনতাও যে পরস্পর হাত ধরাধরি করে হাটে তা তিনি এই উপন্যাসে অসাধারণ দক্ষতায় তুলে এনেছেন।তিনি দেখিয়েছেন যৌনতা ও প্রেম শব্দদুটি অনেক সময় সমার্থে ব্যবহৃত বা উচ্চারিত হয়। অথচ আমাদের সমাজের পবিত্র পণ্ডিতগণ মনে করেন যৌনতা মানেই বিষয়টি নিয়ে খোলা প্রান্তরে আলোচনার কোন বিষয় নয়।এই নিয়ে সাহিত্য আলাপ করা যায় না, পারিবারিক পরিবেশে যৌনতা নিয়ে কথা বলা মানেই মহাপাপ। লজ্জা শরমের মাথা খুইয়ে এই নিয়ে কেউ কথা বলেন না, সমাজ এবং রাষ্ট্র্ও বিষয়টিকে বোরকার কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়ার পক্ষপাতি। সে কারণে সাহিত্যে অশ্লিলতার দায়ে অনেক লেখককেই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। দিলারা আপার কপাল ভালো তাঁর ‘হামেলা’ উপন্যাসটির জন্য অন্তত তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।

মোট কথা হল নারী ও পুরুষের যৌনতার আশ্চার্য দুনিয়াকে লেখক দিলারা হাশেম তাঁর দক্ষ কলমের আঁচড়ে তুলে আনতে পেরেছেন।হামেলা প্রকাশ করেছে মাওলা ব্রাদার্স।

পড়ুন: কথাসাহিত্যিক দিলারা হাশেম আর নেই

দিলারা আপার আত্মার শান্তি কামনা করছি। তার সৃষ্টি আমাদের বাংলাসাহিত্যকে অনেক অনেক সমৃদ্ধ করেছে।বিশেষ করে তাঁর ‘ঘর মন জানালা’ বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য অলংকার। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি রুশ এবং চীনা ভাষাতেও অনূদিত হয়ে আন্তর্জাতিক পাড়াতেও বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। তাঁর অন্যান্য বিখ্যাত গ্রন্থগুলো হলো আমলকীর মৌ, মিউর‌্যাল, একদা এবং অনন্ত, কাকতালীয়, স্তব্ধতার কানে কানে’।

বিদায় আপা।এই নশ্বর দুনিয়ায় আপনি নেই কিন্তু আপনি আছেন এবং থাকবেন আমাদের হৃদ মন্দিরে।