আমিনুল ইসলাম: কবিতার ভূগোলে ইবনে বতুতা


আমিনুল ইসলাম বাংলাদেশের চলমান সময়ের শক্তিশালী কবি। কেউ তাঁকে স্বতন্ত্র কবি, কেউ ‘ইতিহাস ঐতিহ্যের কবি’ কেউ ‘শিকড় বৈভবের কবি, কেউ ‘নিভৃতচারি কবি’ কেউ ‘স্বত:স্ফূর্ততার কবি’ ‘স্বাধীন কবি’ ‘প্রতীকী প্রতিবাদের কবি’ এমনি নানা অ্যাখ্যা-উপাধিতে ভূষিত করেছেন।

আমিনুল ইসলাম লিখেছেন বহুবিধ বিষয়ে বহুমাত্রিকভাবে।কবিতার বিষয় হয়েছে বৈচিত্র্যে ভরপুর, উঠে এসেছে নদী, পাখি, হাট-ঘাট, মাঠ-প্রান্তর, ইতিহাস-ঐতিহ্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভূগোল, রোমান্টিকতা প্রভৃতি।সঙ্গতকারণেই তিনি বহুবিধ-উপাধিতে আখ্যায়িত হয়েছেন। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও শিল্পসমালোচক হাসনাত আবদুল হাই আমিনুল ইসলামের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন: ‌‍‍‍‍‌‍‌‍‌‘বলতে হয়, শুধুই নিজের আনন্দ এবং ভেতরের তাড়নায় তিনি লিখে চলেছেন নিরলসভাবে, খ্যাতি কিংবা জনপ্রিয়তার মুখাপেক্ষী না হয়ে। এমন একজন কাব্যপ্রেমিককে ‘জাতকবি’, ‘নিবেদিতপ্রাণ’, ‘নিভৃতচারী’, এসব অভিধায় বর্ণনা করা যায়। কিন্তু তাঁর কবিতা পাঠ করলে বোঝা যায় তিনি একজন মৌলিক কবি। তিনি কবিতা লেখার জন্য নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করেছেন যা একইসঙ্গে নাগরিক এবং বাস্তবতামণ্ডিত। দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা শুধু তাঁর অনেক কবিতার বিষয় হয়নি, সেখানে ব্যবহৃত অনেক নতুন শব্দ তিনি অনায়াসে এবং শিল্পিত ভঙ্গিতে ব্যবহার করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁকে ‘আধুনিক’ বলতে দ্বিধা হয় না। তিনিই ডিজিটাল যুগের প্রথম কবিতা রচয়িতা, একথা বলা হলে অত্যুক্তি হবে না ।” [আমিনুল ইসলামের কবিতা/ হাসনাত আবদুল হাই, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৮ ডিসেম্বর ২০২০]

কবিতার বিশেষ উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো ছন্দ, শব্দালঙ্কার, রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্প ইত্যাদি। এ সবের সমন্বিত, সুসঙ্গত, কুশলী ও নান্দনিক ব্যবহারে কবিতা যথার্থ কবিতা হয়ে উঠে। সাহিত্যচর্চা ও ভাষাচর্চার সমন্বিত ব্যবহারে শব্দের কুশলী প্রয়োগে উৎকৃষ্ট কবিতার জন্ম হয়। আলোকপাত করতে চাই আমিনুল ইসলামের কাব্যভাষার উপর। আমিনুল ইসলাম জানেন কিভাবে কাব্যভাষা তৈরি করতে হয়। আমিনুল ইসলামের একটি নিজস্ব স্টাইল রয়েছে। তিনি বিষয় বৈচিত্র্যের সাথে শব্দ তৈরীতেও পটু।তাঁর কিছু কবিতার বিষয়, বলার ধারণ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় যে, তিনি এক শক্তিশালী ও নান্দনিক কাব্যভাষা তৈরি করতে পেরেছেন। ‘উৎকৃষ্ট কবিতা বিষয়ে আত্মকথন’ প্রবন্ধে কবি আমিনুল ইসলাম বলেন যে, “শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যেতে পারে-কবিতা হচ্ছে সুন্দর করে কথা বলা; কোনোকিছুকে নান্দনিক সৌন্দর্যে উপস্থাপন করা।” আমিনুল ইসলামের ‘নেলসন ম্যান্ডেলা: ভালবাসার কবি’ কবিতায় শব্দালঙ্কার ও রূপক-রূপমার কুশলী প্রয়োগ লক্ষ করা যায়:

‘আফ্রিকার বাঘ সিংহ ও নেকড়ের চোখে
ঈর্ষা জাগিয়ে
অন্য এক হায়েনার দল ছিঁড়ে খাচ্ছিল
কালো ত্বকে মোড়ানো তরতাজা প্রাণ।’

আমিনুল ইসলামের কবিতার দৈর্ঘ্য কখনো ছোট, কখনও বড়, কখনো মধ্যম। তাঁর দীর্ঘ কবিতাও কম নয়।আমিনুল ইসলামের একটি দীর্ঘ কবিতা হল ‘যদি আমি মরে যাই’।দীর্ঘ কবিতা লেখার সাহসই বা হয় ক’জনের! দম থাকতে হবে তো! কবি আল মাহমুদ একবার এ ধরনের অভিমত দিয়েছিলেন যে, এখনকার কবিদের দীর্ঘ কবিতা লেখার সাহস নেই। সাত লাইন লেখার পরে আট লাইন লিখতে গেলে দম ফুরিয়ে যায়। কিন্তু আমিনুল ইসলামের দম ফুরোয় না।কারণ তিনি সত্যিকারের একজন শক্তিশালী কবি।

কবিতা একটি শব্দ প্রধান শিল্প এবং তাকে শিল্পের নানা শর্ত পূরণ করে ‘কবিতা’ হয়ে উঠতে হয়। পাঠকের কাছে পৌছানোর এবং পাঠককে বিনোদিত করার ক্ষেত্রে কবি যদি যথেষ্ট প্রতিভাবান না হন তাহলে তাকে ফাপরে পড়তে হতে পারে। এই শৈলী পীড়িত ও প্রকরণশাসিত সময়ে কবি আমিনুল ইসলাম ঝুঁকি নিয়েই লিখলেন এ দীর্ঘ কবিতা। তিনি জানেন শব্দ প্রয়োগের কৌশল, জানেন পাঠকের কাছে পৌঁছানোর রাস্তা। আর তাই সরল ও সরাসরি শৈল্পিক শব্দের গাঁথুনিতে তিনি বাজিমাত করেছেন। কবিতায় মানুষের মনের কথা, না বলা কথা ও সাহসের কথা উঠে এসেছে শৈল্পিকভাবে।ভারতীয় উপমহাদেশে সবুরের গাছে মেওয়া না ফললেও কবি সবুর করতে চান।তিনি জানেন মানুষ বিজয়ী হবেই। ‘যদি আমি মরে যাই’ কবিতায় তিনি বলেন,
‘মহাকালের আর্কাইভে চোখ মেলে দ্যাখো,
কোনা দুর্যোগই স্থায়ী হয়নি, এটাও হবেনা,
অবশ্যই জয় হবে মানুষের’

তিনি স্বপ্ন দেখেন, তারও চেয়েও বেশি দেখান-তিনি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। এ স্বপ্ন মানুষকে নিয়ে যাবে কবিতায় বর্ণিত ‘ অতীতের চেয়ে ভাল হবেরে ভবিষ্যৎ’ এর স্বর্গভূমিতে।

‘অভিবাসীর গান’- অভিবাসী ও অভিবাসনের উপর আমিনুল ইসলামের আর একটি দীর্ঘ কবিতা। কবিতায় অভিবাসনের মাধ্যমে সভ্যতা বিকাশের একটি মৌলিক ও যূথবদ্ধ ধারণা প্রদান করা হয়েছে, তুলে ধরা হয়েছে অভিবাসীর কষ্ট-বেদনা। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের অভিবাসী বিতাড়ন তথা আদি মানুষের জনপদকে নতুন করে আবিষ্কারের নেশার প্রেক্ষিতে ক্ষোভ ও ক্ষেদোক্তিও প্রকাশ পেয়েছে। কবিতায় কী চমৎকারভাবে বলা হয়েছে ‘অভিবাসন প্রকৃতিরই ধর্ম’, ‘মানুষও মূলে অভিবাসী’!

Huntington বলেছিলেন, “History in its broadest aspect is a record of man’s migrations from one environment to another.” মানুষের মৌলিকত্বই অভিবাসন।অথচ অভিবাসী ও অভিবাসনের ওপর সেভাবে সাহিত্যকর্ম তৈরি হয়নি। সে হিসেবে একটি মৌলিক সাহিত্যকর্ম পাওয়া গেল। কবিতাটি হৃদয়স্পর্শী, প্রত্যয়দীপ্ত ও আশাজাগানিয়া।

আমিনুল ইসলামের কবিতায় ইতিহাস-ঐতিহ্য-মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে বিষয় বৈচিত্র্যে বহুমাত্রিকভাবে।মুক্তিযুদ্ধ ও স্বদেশপ্রেমের কবিতায় তিনি শুধু শব্দের কারিগরই হননি, আধমরাকে ঘা মেরে বাঁচিয়েছেন, ভয়কাতুরেকে অসীম সাহসী বানিয়েছেন।আমিনুল ইসলামের স্বদেশ প্রেমের একটি অন্যতম কবিতা ‘তোমার ছেলেরা মাগো’। কবিতায় মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার বন্দনার পাশাপাশি মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া ভাষাসৈনিক এবং পূর্বসূরী কবিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধাবোধ ফুঠে উঠেছে।কবিতাটি ভাষা প্রেমের অপূর্ব অভিব্যক্তি!

‘তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চণ্ডীদাস
শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন
তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ
বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ
তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম।’
[হুমায়ুন আজাদ]

হুমায়ুন আজাদের শুরুর পরে নন্দিত কবি আমিনুল ইসলামের আর এক মায়াজাল ‘তোমার ছেলেরা মাগো’।
এ কবিতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মধুসূদন, জীবনানন্দ, জসীম উদ্দিন বাংলার এসব সৃষ্টিশীল কালজয়ী সন্তানদের অবদান তুলে ধরা হয়েছে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবি আমিনুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর বন্দনায় শ্রদ্ধাশীল ও আন্তরিক হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বাণীই যে বাঙালির প্রধান শক্তি ও প্রেরণা সে কথাই অনবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে আমিনুল ইসলামের কবিতায়। কবির ‘আমার মুক্তিযোদ্ধা হতে পারা না পারার গল্প’ কবিতায় অপূর্ব পংক্তিমালা পাওয়া যায়,
‘ মাটির দেয়ালে সাঁটা-আসমানী সেই পোস্টারে
মেঘের মিনারছোঁয়া আঙুলের ইশারা দেখেছিলাম
…. .এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম!’

বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা নিয়ে অনেকেই লিখেছেন।কিন্তু অমিনুল ইসলামের লেখায় রূপকল্প, শব্দ ও বাক্য বিন্যাসের এক স্বতন্ত্র নান্দনিক ব্যবহার ফুটে উঠেছে।

আমিনুল ইসলামের কবিতার একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ প্রেম।তাঁর অসংখ্য প্রেমের কবিতা রয়েছে।আবার প্রেমের কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবেনা এমন কবিতাতেও প্রেম তার সুবাস ছড়িয়েছে।আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রেম এক বিজয়ী সত্ত্বা।প্রেম যখন বিজয়ী হয় তখন ভালোবাসাহীন দিনও থাকে না, ভালোবাসাহীন রাতও থাকে না। ভালোবাসার অনবদ্য পংক্তিমালায় সাজানো আমিনুল ইসলামের ‘আমাদের ভালোবাসার দিন’ কবিতাটি।নদীর মত পাহাড়ের ওপর থেকে দুকূল ছাপিয়ে ভালোবাসা নেমে এসেছে সমতলে।এ কবিতায় কবি বলেন,

‘আমরা মানি না ভালোবাসাহীন দিন
আমরা মানিনা ভালোবাসাহীন রাত
বসন্ত অধরা সিডর ঘূর্ণিঝড়ে
প্রেমের বাঁধনে আমরা বেঁধেছি হাত।’

ভালোবাসার চেয়ে কোন পর্বতশৃঙ্গ কিংবা কোন টুইন টাওয়ার বেশি উচুঁ হতে পারেনা।একই কবিতায় কবি বলেন,
‘আমাদের নেই পেট্রিয়টের গোলা।
বি-ফিফটি-টু লাগবে না কোনোকাজে
অধরে অধরে আমরা রচিলে মিনার
টুইন টাওয়ারও নুয়ে আসে ঘনলাজে।’

আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রেমের অনুষঙ্গ এসেছে ভিন্নভাবে। ‘আমাদের ভালোবাসার দিন’ কবিতায় তিনি সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের প্রভাবক শক্তি ক্ষেপনাস্ত্র ‘পেট্রিয়ট’, বোমারু বিমান ‘বি-ফিফটি-টু’, বাণিজ্যিক ভবন ‘টুইন টাওয়ার’ শব্দসমূহ ব্যবহার করেছেন এবং প্রেমের শক্তির নিকট এসবের শক্তি পরাজিত সেটিও তুলে ধরেছেন। নর-নারীর কথিত শারীরিক সৌন্দর্য্যের বাহিরে ভিন্ন শব্দের প্রয়োগে প্রেমকে উপস্থাপনে কবি আমিনুল ইসলাম অভিনবত্ব এনেছেন।

আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা প্রসঙ্গে সরকার আবদুল মান্নান এর নিম্নবর্ণিত মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য, “প্রেমের কবিতার একটি প্রথাগত রূপৈশ্বর্য ও বিষয় বৈভবের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে। বিচিত্র অনুষঙ্গে মানব-মানবীর লীলালাস্যই সেখানে মুখ্য।আমিনুল ইসলাম মোহন প্রেমের এই প্রথাগত আখ্যান রচনা করেন না। সংঘাতময় জীবনের বিচিত্র ক্ষতকে তিনি তুলে ধরেন জীবন-প্রেমিকের বিস্ময়কর আন্তর্লোক থেকে। ফলে নারী নয়, পুরুষ নয়, আটপৌরে প্রতিদিন নয়-বরং এসব কিছু নিয়েই সৃষ্টি হয় তাঁর প্রেমের কবিতার প্রবল জীবন-তৃষ্ণা। প্রচণ্ড এক সংবেদনার মধ্যে কবি আমিনুল ইসলামের কবিতা প্রাণময় হয়ে ওঠে।এই সংবেদনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেমের সীমা অতিক্রম করে যায় অবলীলায় এবং ইতিহাস, এতিহ্য, লোকজ্ঞান ও লোকজীবন তাৎপর্যপূর্ণ সফলতায় ধরা দেয় কবির প্রেমভাবনার অবয়বে। ফলে পালটে যায় পরিচিত ডিকশন, প্রবল প্রতাপান্বিত ফর্ম। আর সেই বিচূর্ণ কবিভাষার সমাধিস্থলে গজিয়ে ওঠে আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতার নতুন এক ভাষিক জগৎ, স্বতন্ত্র এক গঠনসৌষ্ঠব। জীবনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আমিনুল ইসলামের কবিতার অন্তর্গত শক্তি।ফলে সমকালের বিচিত্র দুর্দৈবের মধ্যেও তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে অবিনাশী জীবনের গান। বোধের এই সততা ও দায়বদ্ধতায় আমিনুল ইসলামের প্রেমসমগ্র হয়ে ওঠে জীবনসমগ্র-আর্তনাদের মধ্যে আনন্দিত উত্থান।অধিকন্তু তাঁর প্রেমের কবিতার সঙ্গে এসব জাগতিক ভাবনা জড়িয়ে থাকে যে নিখাঁদ প্রেমবোধ অনেক সময়ই ব্যাহত হয়।প্রেমের কবিতার এই ভিন্নতাই আমিনুল ইসলামের কবিতার স্বাতন্ত্র্য।” ( হারুন পাশা সম্পাদিত ‘পাতাদের সংসার’, ১৮তম সংখ্যা, ডিসেম্বর, ২০১৮)

‘তুর্কি মেয়ের জন্য’ আমিনুল ইসলামের এক অসাধারণ কবিতা। গন্ধম থেকে ল্যাংড়া, রবীন্দ্রনাথ থেকে হাফিজ-রোমাঞ্চের বিশ্ব ভ্রমণ। রবীন্দ্রনাথ বিদেশীনিকে শিউলি ফুল দিতে চেয়েছিলেন আর কবি আমিনুল ইসলাম ল্যাংড়া আমের সঘন স্বাদ দিতে চান। তরুণী তুর্কি দর্শনে কবি বিমোহিত। পাঠক নতুন করে বুঝতে পারবেন কবি হাফিজ কেন তুর্কি মেয়ের কপোলের তিলের বিনিময়ে সমরখন্দ আর বোখারা বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন! ‘তুর্কি মেয়ের জন্য’ কবিতায় কবি বলেন,

‘তোমার দেশের বীরের বৈশিষ্ট্য মিশে আছে
আমার যৌবনের ফল্গুধারায়;
আরকাদেস হই বা না হই,
আমি তোমার কার্দেস তো বটে!’

প্রেমের আলোচনা প্রসঙ্গে আমিনুল ইসলামের নারী ভাবনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, তিনি নারীকে দেখেছেন নতুন দৃষ্টিতে।আমিনুল ইসলামের নারী সোনাভানের মত বলিষ্ঠ, দীর্ঘদেহী, আত্মশক্তিতে বলিয়ান, অমুখাপেক্ষী, আত্মনির্ভরশীল।তিনি শারীরিক সৌন্দর্যের বাইরে নারীর হৃদয়কে প্রাধান্য দিয়েছেন।প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, ‘মুকুটহীনা’ কবি আমিনুল ইসলামের প্রিয়তমাকে নিয়ে লেখা একটি অন্যতম নারী বিষয়ক কবিতা।মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘অংশুমালী’ এর মার্চ ২০২০ সংখ্যায় নাজিয়া ফেরসৌস নিবন্ধ লেখেন ‘কবি আমিনুল ইসলামের নারী ভাবনা।’ এ নিবন্ধে নাজিয়া ফেরসৌস কবি আমিনুল ইসলামের নারী বিষয়ক অনেক কবিতার মধ্যে ‘মুকুটহীনা’ কবিতারও বিশ্লেষণ করেন। নাজিয়া ফেরসৌসের মূল্যায়ন, “নারীকে তিনি সম্মানের আসনে আসীন দেখতে চান। কবি আমিনুল ইসলাম নারীকে দেখেছেন প্রেম ও সৌন্দর্যের উর্ধ্বে।”

আমিনুল ইসলামের সম্প্রতি রচিত একটি দীর্ঘ কবিতা ‘হিজলের সার্কিট হাউসে বসে শোনা’। টাঙ্গুয়ার হাওরকে নিয়ে লেখা এ কবিতা। রূপক-উপমা-প্রতীক-রূপকল্প অনেক সময় এতটাই শিল্পের উৎস্য হয়ে উঠে যে, তখন এগুলোকে অনায়াসে কবিতার শিল্প বলা যায়।কবি এখানে শব্দের কারুকাজে কবিতার পুষ্পিত ভূবন তেরি করেছেন।প্রকৃতি যে হাওরকে রুপ রসে এত পরিপূর্ণ করেছে তা এ কবিতা থেকে জানা যায়।আর কবিতাও যে রুপ রসে এত পরিপূর্ণ হতে পারে তাও পাঠক কবিতা পাঠ করেই জানতে পারে।বলা হয় আমিনুল ইসলামের কবিতা পাঠে আনন্দ ভ্রমণ সম্ভব।‘হিজলের সার্কিট হাউসে বসে শোনা’কবিতা পাঠে হাওরে বজরায় পালতুলে আনন্দ ভ্রমণই হবে। এ কবিতায় বলা হয়েছে,

‘আমার ডায়াবেটিস হয় না
কারণ আমি দিতে জানি’

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্ব করার সুবিধা হলো বিনিময়ে প্রকৃতি কিছুই চায়না। এই সত্যাটি কবিতার যাদুমন্ত্র হয়ে উঠেছে। কবিতায় আমিনুল ইসলাম অপূর্ব কাব্যিক ব্যঞ্জনায় বলেন,

‘নিজের হৃদয়ে বানিয়ে রাখো
উন্মুক্ত হাওড়’-

কবিতার এ বাণী চিরকালের পাঠকের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবে। কথা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্পে কবিতাটি হাওরের মতই অবারিত বৈচিত্র্য ও মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।

মিল্টন বিশ্বাস একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, ‘আমিনুল ইসলামের কাব্য ভাবনায় নদী।’ নদী নিয়ে লিখিত হলেও আমিনুল ইসলামের কাব্যের সামগ্রিক মূল্যায়নও করা হয়েছে প্রবন্ধে।প্রবন্ধের প্রথমে আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রেমের একটি মূল্যায়ন করা হয়েছে। আমিনুল ইসলাম মোটাদাগে প্রেমেরও কবি। নদী ও প্রেম দুটিকে অপূর্ব দক্ষতায় আমিনুল ইসলাম এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছেন। তাঁর কাব্যে প্রেম বহতা নদীর মত। উপচে পড়া জলের স্পর্শে ভালবাসার ভূগোল হয়ে ওঠে এক ফসলী মাঠ। তিনি কি চমৎকারভাবে বলেন, “শুধু তোমার চুল জড়িয়ে শ্রাবণের এক যমুনা”। আমিনুল ইসলামকে নিয়ে প্রাবন্ধিক যথার্থই বলেছেন, “প্রেমসমগ্র হয়ে ওঠে জীবনসমগ্র”।

আমিনুল ইসলামের কবিতার এক অনিবার্য অনুষঙ্গ নদী। নদীর প্রতি আমিনুল ইসলামের ভালোবাসা প্রেমিকার প্রতি ভালোবাসার মতোই। আমিনুল ইসলামের অনেক কবিতায় হৃদয় যন্ত্রণার হাহাকার শোনা যায়। কিন্তু নদী তাকে ফেলে যায়নি।

২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ এ ভোরের কাগজ এ প্রকাশিত সমীর আহমেদ এর ‘আমিনুল ইসলামের কবিতায় নদী’ শীর্ষক নিবন্ধে লেখকের মূল্যায়ন “চৈতন্য প্রভায় টেরাকোটার কারুকাজের মতো শব্দ শিল্পে আলোকরশ্মি ছড়িয়েছে নদী”। তেমনি টেরাকোটার কারুকাজের মতো একটি কবিতা ‘কীর্তনখোলার ঢেউ’।মার্চের হাওয়ার উত্তালতা, রবীন্দ্রনাথের মতো কান পেতে শোনা উপমাসমূহ অসাধারণ।মধূসুদনের কপোতাক্ষ, লর্ড টেনিসনের ‘The brook’ এর মতো ‘কীর্তনখোলা’ও আমিনুল ইসলামকে স্মৃতিকাতর করেছে।পাঠক একটি ভিন্ন মুগ্ধতার স্বাদও পেল।কবির এলপিআর দিন আর এলপিআর রাতে কীর্তনখোলার এলপিআর নেই। সে বয়েই চলে। টেনিসনও তাই বলেছিলেন, “Men may go and men may come but I go on forever.” ‘কীর্তনখোলার ঢেউ’ মুগ্ধতার ঢেউ তুলেছে, অনেকদিন বয়ে চলবে সাহিত্য নদীর স্রোতে।

পুজিঁবাদ আজ সমাজ পরিচালনার একচ্ছত্র শক্তিশালী নিয়ামক। রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-সমরনীতি সবকিছুর মূল পরিচালক পুঁজিবাদ। কবি আমিনুল ইসলামের ‘পুঁজিবাদ’ কবিতা সময়ের অত্যাবশ্যক অনুষঙ্গ। পুঁজিবাদের উপর অনেকেই লিখেছেন। অধিকাংশ লেখাতেই পুঁজিবাদের আগ্রাসী দাঁতাল রূপ এবং তার ক্ষতিকর দিক ফুটে উঠেছে। এখানে এ কবিতায় পুঁজিবাদের দাঁতাল রুপের স্বরুপ উন্মোচনের পাশাপশি পুঁজিবাদের সুবিধা গ্রহণে তৎপর গোষ্ঠীরও একটি চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কবিতার শেষ চার লাইনে অপূর্ব কাব্যিক ব্যঞ্জনায় সুবিধাবাদী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।বলা যায় কবিতার মূল সুর এর শেষ চার চরণে বেজে উঠেছে।পুঁজিবাদের বিকেন্দ্রীকরণ ধারণাটি এভাবে খুব বেশি পাওয়া যায়নি ।এটি লূম্পেন ব্যুর্জোয়া, মুৎসুদ্দি ব্যুর্জোয়া তথা ব্যুর্জোয়া চরিত্রেরও একটি সুবিধাবাদি বৈশিষ্ট্যকে সামনে এনেছে। আমিনুল ইসলাম পুঁজিবাদের স্বরূপ এবং মানুষের স্ববিরোধী দ্বৈতসত্ত্বার পরিচয় তুলে ধরে বলেন,

‘দৈত্যটির বদনাম গায়
প্রায় সবাই
অথচ সুযোগপেলে
তাদেরই অনেকেই হয়ে
ওঠে তারই স্থানীয় সংস্করণ মিনি অথবা মাঝারি।’

এই পরস্পর বিরোধী আহারই সুবিধাবাদি চরিত্রের আর একটি বৈশিষ্ট্য। আমিনুল ইসলামের কবিতায় পুঁজিবাদের ভোগ লিপ্সার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী চেতনা সব সময়ই ফুটে উঠেছে।একসময়ের বামপন্থী বিপ্লবীদের একটা ড় অংশ সময়ের পরিবর্তনে পুঁজিবাদ প্রযোজিত ভোগবাদী জীবনের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। মুখে সমাজতন্ত্রে কথা বললেও মনেপ্রাণে পুঁজিবাদী লোভের অনুসারী।কবি তার প্রথম কবিতাতেই কি অপূর্বভাবে বলেন,

‘প্রলোভের গোপন শকটে
বিপ্লবীরা চলে যায় পুঁজিবাড়ি ভোগের বাগানে
প্রবাদের কণ্ঠসম সাম্যধ্বনি প্রেসক্লাব গেটে
হেসে ফেলে রিক্সাওয়ালা টাঙাওয়ালার বেফাঁস জবানে।’

এই প্রতিবাদী ও মানবিক চেতনার কারণে আমিনুল ইসলাম হয়ে উঠেছেন খোলসহীন মানবিক কবি।

আমিনুল ইসলামের আর একটি অনবদ্য কবিতা ‘প্রেমিকার জন্য সার-সংক্ষেপ।’ এ কবিতায় কবি প্রেম বা তাঁর প্রেমিকাকে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন। সাধারণত নীতিগত সিদ্ধান্তও বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সার-সংক্ষেপ প্রশাসনিকভাবে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণ করা হয়। আর কবি আমিনুল ইসলাম সার-সংক্ষেপ পাঠিয়েছেন প্রেমিকার কাছে। প্রেমিকাকে তিনি রাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় অতিগুরুত্বপূর্ণ পদধারীর সমমর্যাদায় দেখতে চেয়েছেন। প্রেয়সী এবং রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান বাঁধা পড়েছেন একই উচ্চতায়। প্রশাসনিক ভুবনের বাইরের মানুষের কাছে অজানা একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক টার্মিনলজিকে তিনি অভূতপূর্ব দক্ষতায় ও অনবদ্য কাব্যিক ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করেছেন কবিতায়।কবিতার শুরুতেই তিনি চমৎকারভাবে বলেন,

‘কোনো কোনো দিন দেখা হয়নি
সংবাদপত্রের শিরোনাম
ভুলে থেকেছি
স্বভুমে সর্বহারামানুষের জন্য
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলার কথা,
সেই আমাকে দেখে ব্যথিত হয়েছে
বঙ্গোপসাগরের জলে লেখা
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’

সার-সংক্ষেপ অনুমোদিত হলে নিশ্চয় কবি শহীদ কাদরির মতো তাঁর প্রিয়তমাকে অভিবাদন জানাবেন।‘প্রেমিকার জন্য সার-সংক্ষেপ’ কাব্যগ্রন্থের দীর্ঘতম কবিতাটির নাম ‘ আকাশের ঠিকানায় সাগরের চিঠি’। প্রায় ১৩ পৃষ্ঠার দীর্ঘ কবিতাটিতে কবি একটি চিঠির আদলে অন্তরঙ্গ ভবনের এবং বাইরের জগতের বহুবিধ বিষয়কে তুলে ধরেছেন পরিহাস, শ্লেষ, উপমা, চিত্রকল্প, কল্পচিত্র, সংকেত প্রভৃতি কাব্যালংকার সহকারে। ভাবনার অভিনবত্ব এবং কবিতার উপস্থাপনা কৌশল ও ভাষা এতটাই আকর্ষণীয় যে কবিতাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় পাঠককে। কোথাও পুনরাবৃত্তি নেই। কোনো ক্লান্তি আসে না। ‘আকাশের ঠিকানায় সাগরের চিঠি’ কবিতার এক অংশে কবি বলেন,

‘কিন্তু যেই পন্থী হও, তুমি পদোন্নতি চাইতে;
কাজের ফাঁকে ফাঁকে কীসব বিদঘুটে ধরনের
বই পড়তে! হায় পদোন্নতি!
এদেশের সরকারি চাকরিতে কখন কীভাবে
কেন পদোন্নতি হয়, আর কেন যে হয় না,
এত বোঝো, অথচ আজ পর্যন্তএই ছোট্ট বিষয়টা
বোঝাতে পারলেনা আমাকে!
তোমার নাকি এসিআর ভালো; সবকিছু ক্লিয়ার;
তাহলে বাধা কোথায়!
আচ্ছা আকাশ, এসএসবি জিনিসটা কী?
সেটা কি বোদলেয়ারের বিড়াল
কিংবা টেড হিউজের কাক
অথবা জীবনানন্দ দাশের
মহিনের ঘোড়াগুলোর লাহান কিছু?’

এসএসবি হল সরকারি চাকরিতে উচ্চপদে পদোন্নতি প্রদানের সুপারিশ প্রদানের কমিটি। এসএসবি’র সুপারিশ প্রদানের ক্ষেত্রে বোদলেয়ারের বিড়াল, টেড হিউজের কাক, জীবনানন্দের মহীনের ঘোড়া রূপক হিসেবে উঠে এসেছে। বোদলেয়ার পরাবাস্তব কবি। বিড়াল তার পরাবাস্তব কবিতা। আর টেড হিউজ এর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রো’-যেখানে হিউজ ছিলেন প্রবল, অনমনীয় আর জগতের চূড়ান্ত ধ্বংসের বার্তাবাহক। আর ঘোড়া কবিতায় দেখা যায় জীবনানন্দের বিকল্পধারার বাক্য বিন্যাস: কী ভীষণ অন্যরকম ভাবনা! জীবনানন্দের বিক্ষত হৃদয়ের চিত্রকল্পই যেন মহীনের ঘোড়া। এই তিনজন বিশ্ববিখ্যাত কবির কবিতায় ব্যবহৃত ‘বিড়াল’, ‘কাক’ এবং ‘ঘোড়া’ কোনো প্রাণী নয় : সেসব হচ্ছে মানুষের অবদমিত ও সঙ্গোপন সত্তা-যৌনতা-কামনা-রিরংসা-লোভ এর প্রতীক। কিন্তু সাধারণ ও অনভিজ্ঞ পাঠকের পক্ষে তা বু্ঝে ওঠা সম্ভব নয়। ফলে কবিতাগুলো অধিকাংশ পাঠকের কাছে ‘দুর্বোধ্য’ বা ‘রহস্যাবৃত’ রয়ে যায়। আমিনুল ইসলাম ‘এসএসবি’ (সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড) এর ভূমিকাকে তেমনি রহস্যাবৃত হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন।কারণ পদোন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ তা কীভাবে, কোন কোন শর্তে, কোন কোন বিবেচনায় করা হয়, তা দেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকের বা অধিকাংশের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। একটি প্রশাসনিক বিষয়কে এভাবে উপমিত করা অথবা উপস্থাপনকরা শুধু অভিনবত্বই নয়, অন্যান্য ঘটনাও বটে।কারো কারো জন্য এসএসবি’র সুপারিশ হয়তো-বা পরাবাস্তব।

কবিতা একজন কবির নিজস্ব হাসিকান্নার; নিজস্ব আবেগ-অনুভূতির স্বাড়ম্বর প্রকাশ।কবি সমকালের হাতে বন্দি থাকতে চান না।তিনি লেখেন ভবিষ্যতের মানুষের জন্য।আমিনুল ইসলাম সমকালের ঘটনার ব্যবচ্ছেদ করেছেন যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাঠকের চিন্তার খোরাক জোটাবে। আমিনুল ইসলাম নিজে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। প্রশাসনিক বিষয়াদি হয়ে উঠেছে কবিতার বিষয়, প্রশাসনিক শব্দ হয়ে উঠেছে কবিতার শব্দশিল্প। তিনি শিল্পের রসে প্রশাসনিক শব্দকে সিক্ত করেছেন। নিরস শব্দসমূহ শিল্পরসে সরস হয়ে উঠেছে। চিত্রকল্পের মাধ্যমে কবি আমিনুল ইসলাম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রশাসনিক বিষয়াদি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন।একইসাথে কবিতায় প্রশাসনিক শব্দের ব্যবহারে আমিনুল ইসলাম সিদ্ধহস্তে অভিনবত্ব এনেছেন।

‘উৎকৃষ্ট কবিতা বিষয়ে আত্মকথন’ প্রবন্ধে আমিনুল ইসলাম বলেন, “কবিতা কখনো কখনো বোঝা না বোঝার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে এক রহস্যের মায়াজাল তৈরি করে।কল্পনা দিয়ে কল্পনাকে ছুয়েঁ দেখার মতো।” প্রতীক-উপমা-রূপক-রূপকল্প কবিতার ভাষাকে শাণিত করে, ভাব ও বিষয়কে সুস্পষ্ট করে ও অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠকের মনে প্রগাঢ় অনুরণন সৃষ্টি করে।তাই আধুনিক কবিতায় এসবের ব্যবহার বিশেষ তাৎপর্যে¨ উদ্ভাসিত।যে কবি এসবের ব্যবহারে যত বেশি অভিনবত্ব ও পারদর্শিতা প্রদর্শন করেন, সে কবি তত বেশি উজ্জ্বলভাবে পাঠকের দৃষ্টিতে ধরা দেন।

আমিনুল ইসলামের কবিতার সংখ্যা প্রচুর এবং বিষয়গত বৈচিত্র্য ব্যাপক।তিনি কবিতার মধ্যে সারা পৃথিবীকে দেখেছেন এবং উপস্থাপন করেছেন।দেশে বিদেশের ভ্রমণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন দেশের কবিতার পঠন পাঠন থেকে অর্জিত জ্ঞান তার কবিতার মধ্যে বৈশ্বিকতার ঘ্রাণ জুগিয়েছে।তুর্কি মেয়ে সাবিহা ও সুরির অধরের হাসি, ইটালির মেয়ে সোফিয়ার চাহনী,, আটলান্টিকের ঢেউ, ব্লু মাউন্টেনের অ্যাবরিজিনাল সাইমনের বাঁশি, ওমর খৈয়ামের সাকির পেয়ালা, হাফিজের সিরাজীকন্যার গালের তিল, পেন্টাগনের প্রযোজনায় পরিচালিত ডেভিলের ওয়ার্কশপ থেকে আসা আণবিক মসলার ঘ্রাণ, স্টিফেন হকিন্সের ভাবনা প্রভৃতি চিত্রকল্প হয়েছে তার কবিতায়।তিনি অতীতদিনের মহসড়ক ধরেও হেটেছেন কাঁধে নিয়ে কবিতার ঝোলা। চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা মধুকর, বিশ্বখ্যাত মসলিন আব-ই রাওয়ান, আসহাব-ই-কাহাফ, আরব্যরজনীর দৈত্যের গুহা, অটোমানদের দিনরাত, তুতনেখামনের রাজত্ব, নেফারতিতির দিনরাত, রূপবান-মধুমালার ভালোবাসার ভুবন, রানি বিলকিসের শাসনামল প্রভৃতি ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। বিশ্বদর্শন এবং মহাকাল পরিভ্রমণের ছাপ পড়েছে তার কবিতায় এবং তার কাব্যভাষাতেও আন্তর্জাতিক সুঘ্রাণ পাওয়া যায়।

‘হে লেডি অব দি টু ল্যান্ড, তোমার নাকি মৃত্যু নেই; তাই তো
তোমাকে খুঁজে ফেরা। তোমার সৌন্দর্যের যতখানি দেখেছিলেন
বিদ্রোহীসম্রাট, তারচেয়েও বেশি ভাস্কর-সম্রাট থুতমোস; লুক্সোর
থেকে প্রত্নচোরেরা চুরি করে নিয়ে গেছে তোমাকে, চোরের বউয়ের
গয়নার মতো তুমি এখন ভিনদেশি যাদুঘরে দ্যুতি ছড়াচ্ছো,
ডিএসএলআর এর ক্লিক হয়ে তোমার ওপর পড়ছে রোজ লক্ষ
চোখের বিস্ময় নজরপাত: ‘ওয়াউ!’’ কিন্তু সেটা আজকের ফটোশপকে
হার মানানো কেবল তোমার আবক্ষ মূর্তি- সৌন্দর্যে অনুপম
আর তোমাকে জীবিত সবটুকু দেখার নেশায় আমার মিসর সফর।’
(নেফারতিরি সঙ্গে)

আমিনুল ইসলাম তাঁর কবিতায় যুগের মনকে প্রতিফলিত করতে পেরেছেন।পরিবর্তিত সময় ও বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তিনি শব্দ ও ভাষার কারুকার্যের এক নান্দনিক কাব্যভাষা তৈরি করেছেন। কাব্যভাষা বিচারে আমিনুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে একটি স্থায়ী জায়গা করে নিবে তা বলা যায়।