পোস্টমডার্ন সিরিজ: ৩
‘অন্তহীন পিপাসার্ত আকাশ আমার শাড়ি নিঙড়ে টেনে নিচ্ছে
নীল পরমায়ু। আকাশে ভ্রমণ আমার ঠিক হয়নি; ঠিক হয়নি
কাঠ কয়লার গুদাম ঘেঁটে হিরার অনুসন্ধান।’
ঘুম ভেঙে গেলো মাঝরাতে।
ও কি করছে একটা ফোন দিয়ে দেখি।
কিন্তু ও-তো ঘুমুচ্ছে এখন। ফোন কি ধরবে?
আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
কান্না পাচ্ছে খুব।
দেখতে ইচ্ছে করছে মানুষটাকে।
এত ভালোবাসি তবু মন ভরে না আমার।
আরও ভালোবাসতে সাধ জাগে।
প্রতিদিন প্রেম যেন বাড়ছেই আমার।দিনের বেলা ফোনে ভালো করে কথা বলতে পারি না কাজের ব্যস্ততার জন্য, কিন্তু আমি তো অফিসেও নেই। ওর কাছেও নেই। ও সেদিন এক কবির কবিতা পড়ে শোনাচ্ছিলো। স্বপ্নে লাইনগুলো ভেসে এলো- ‘অন্তহীন পিপাসার্ত আকাশ আমার শাড়ি নিঙড়ে টেনে নিচ্ছে’। কবিরা মানুষের মনের কথা জানে। বুঝতে পারে খিদে পেলে। নিজেকে হারিয়ে যেতে দেবো না ভেবে এমন কাউকে ভালোবাসলাম, সে সব দিলো, কিন্তু আর কিছু না নিয়েও আমাকেই গ্রহণ করে নিল। প্রচণ্ড রাগ হয় আমার তার উপরে।
কপট রাগে প্রতিটি দিন আমি এক হই আবার হারিয়ে যাই অতৃপ্তিতে। প্রচণ্ড তৃষায় মরি, ফিরে আসি।
একটা ফোন দেই ওকে। কথা না হোক। ফোনটা বাজুক। তেতেও ওকে পাবো আমি। এত কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। ইস! এত ভালোবাসি কেন? প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। খুব। পারি না আমি এভাবে একা থাকতে, দূরে। ওর পাশে প্রতি রাতে ঘুমুতে চাই।এই ছাইমাথার চাকরিটা ছেড়ে চলে যাবো আমার আত্মাটার কাছে।আর ভালো লাগছে না।
সেদিন সন্ধ্যায় গরুর মাংস ভুনা রেঁধে বসে থাকলাম, তবু সে এলো না। আমার খাওয়া হলো না। তারপর দুইদিন রাগে কথা বলিনি। ওর কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় না।একবারও বউকে এসে দেখে যেতে পারে না লোকটা? এতটা অলস কেন? দূর থেকেই কি সব প্রেম হয়? কাছে এলে বুঝি সব প্রেম ফুরিয়ে যাবে? কিসের এত ভয় তার? এক্ষুনি জিজ্ঞেস করবো আমি। ফোন না ধরলে সারারাত ভর কল করেই যাবো আমি, যতক্ষণ জবাব না পাই।
– হ্যালো! ঘুমাওনি? কাল অফিস নেই?
– আমাদের সুখের দিন শেষ হয়ে গেছে। আমি ঘণ্টা ধরে ফোন হাতে বসে থাকি। তুমি একবার আসবে, বেজে উঠবে ফোনটা। বাজে না। তুমি আসো না। আমি বসে থাকি। এখনো এই মাঝরাতে বসে আছি।
– অভিযোগ আর অভিযোগ শুধু। আর কিছুই জানো না তুমি।
– অভিযোগ নয় এসব। যাই হোক আজকাল আর কথা নাই। কেমন হয়ে গেছি আমি। তুমিও একটু অন্যরকম।
– সরি বউ।
– জানো, সারাদিনে পারি না, রাতে একটু ভালো করে কথা শোনার জন্য আমার খুব খিদে পায়।
– দূরে থাকা হয়।তাই অনেককিছুই হয় না।অফিসের পর তুমি বাড়ি ফিরলে একটু পাশে বসে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে। তোমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও খেতে যেতে ইচ্ছে করে।বউ জানো, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চিতইপিঠা খেতে খেতে শরিষা ভর্তার ঝাঁঝে তোমার চোখ লাল হয়ে পানি বের হয়- আর তখন তুমি হাত পা নেড়ে লাফাতে শুরু করো, তখন কি-যে মিস্টি লাগে তোমাকে দেখতে।এইগুলো আমি প্রতিদিন দেখতে চাই। প্রতিদিন।
– হয়েছে। আর ঢং করতে হবে না। সেরাতে এলে না তুমি। এত আদর করে ডাকলাম। মজা করে গরুর মাংস রেঁধে বসে থাকলাম, দুজন একসাথে এক প্লেটে খাবো,তুমি এলে না। আমারও খাওয়া হলো না।
– চলে আসবো সোনা। তুমি আমার লক্ষ্মী বউ। তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে না। যদি কথা দাও আমি এলে শাড়ি পরবে, তাহলে এক্ষুণি রওনা দেবো আমি। সত্যি বলছি।
– ইস! আমার সত্যবাদি রে! এক মিথ্যুক রাজা তুমি। কখনো সত্যি কথা বলো না। তোমাকে বিয়ে করে ফেসে গেছি আমি। কত ছেলে আমার মন পেতে পিছু পিছু ঘুরেছে, এখনো লেগে আছে, শেষেমেশে বিয়ে করলাম আমি এই মিথ্যুক লোকটাকে। যে আমাকে ভালোবাসে না। দেখতে আসে না একবারও। শুধু আমাকেই ছুটে যেতে হবে, বারবার।
– জানো বউ, এইবার তুমি যাওয়ার দিন থেকে মন খারাপের রাত শুরু। রাতের পর রাত জেগে তারা গুনি। খালি লাগে ভেতরটা। আকাশে তো তারা আছে। আমার ভেতরে কিছু নেই। তুমি নেই এখানে। কোথায় আছো বুঝতে পারি না।
– তোমার প্রিয় কবির কবিতা পড়ছিলাম সেদিন।
– কোন কবি? কার কথা বলছো?
– ওই সে সেদিন পড়তে দিলে, তামান্না তুলির কবিতা।
– হ্যাঁ।দারুণ ভালো লেখে সে। তুলির কোন কবিতাটা পড়েছো তুমি?
– ‘অন্তহীন পিপাসার্ত আকাশ আমার শাড়ি নিঙড়ে টেনে নিচ্ছে’
– হুম।দারুণ ছোঁয়াচে কবিতা। মনে আছে তোমার?
– হুম।শুনবে?
– শোনাও।
অন্তহীন পিপাসার্ত আকাশ আমার শাড়ি নিঙড়ে টেনে নিচ্ছে
নীল পরমায়ু। আকাশে ভ্রমণ আমার ঠিক হয়নি; ঠিক হয়নি
কাঠ কয়লার গুদাম ঘেঁটে হিরার অনুসন্ধান।
সময়টা আমার ভীষণ দুঃসময়ের আবর্তে! পাখি ও নর্তকীর আত্মহত্যার মতো বিষণ্ণ।ছেনাল জল ঘেঁটে একাকী একটা
হ্রদ, হরিণের ভয়ার্ত মুখচ্ছবি আর বেনাল বাতাসে শুধু মাংস
পোড়া ঘ্রাণ।
আকাশ থেকে ফিরে করাতকলে প্রবেশ করলাম
ঝরঝরে সবুজ থেকে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত
মানুষের ভেতর প্রবেশ করলাম
মানুষের ভেতর টুকরো টুকরো অনেক মানুষ
করাতকলে কেটেকুটে ফিরে যাচ্ছে উন্মুল বাতাস !
– আচ্ছা বউ! তোমার ভেতরে কি চাঁদ জাগে? ফাগুন আসে? ফুল ফোটে?
– হ্যা। তুমি চাঁদ জেগে থাকো প্রিয়।ফুল হয়ে ফোটো তুমিই। এত প্রেম আসে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাকে কোথাও।আমি ঠায় বসে থেকেও ভেসে যাই।এত প্রচণ্ড তার তাণ্ডব। তুমি এইসবের কিছুই জানো না। জানার সময় হয় না তোমার।অভিমানে ডুবে থাকো তুমি।ডুবি আমিও।
– ওরে! ওরে! আমার সুন্দরী অভিমানিনী, তোমার কথা শুনতে শুনতে ইচ্ছে করে ভুলে যাই নিজেকে।তবে পরে তুমি যখন আর থাকো না, কথা বলো না, শুধু রাগ দেখাও। চেষ্টা করি ফিরতে, দেখি, আমি বলে আর কিছু নেই। সব তুমি আর তুমি মিলে একটা রংধনু জাদু আমার ভেতরটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে।জানি, তোমার এমন হয় না।
– মনে পড়ে শুরুর শুরুর রাতগুলোতে আমরা তসলিমা নাসরিনের লেখা –‘এমন ভেঙেচুরে ভালো কেউ বাসেনি আগে ’ কবিতাটা শুনতাম দুইজনে ফোনের দুইপাশে, দূরে থেকেও। তুমি ছিলে সেই পুরুষ, যার প্রেম আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কোথাও। এরপর বিয়ে করলাম। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলো। আমরা একটি সমুদ্রের দুই তীরে দুই দ্বীপ হয়েছি। নিজেদের মাঝে আনাগোনা কমেছে।
– হ্যাঁ।এখন একে অন্যকে মিছিমিছি আর আদর দিয়ে ডাকি না। রাগ দেখাই সারাদিন।সীমান্তে অনুষ্ঠান করি, দেখা হয় আমাদের। ফিরে যাই।
– কখনো তুমি আসো।দামামা বাজে আমার রক্তে।এত রাতে ফোন দেই। আজকের মতন রক্তের ভেতরে প্রলয় এলে; এরপর মিথ্যুকরাজ তুমি, মায়াকথায় ভুলিয়ে প্রবল প্রেমে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাও নিজের কাছে।