আমি যা দেখছি, যা চাচ্ছি তাদের মধ্যে সমন্বয় করতে সাহিত্যের পথ বেছে নিয়েছি: নাসরিন সুলতানা


নাসরিন সুলতানা।শিশুসাহিত্যিক, নাট্যকার। বর্তমানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫টি। সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন লেখালেখি, সংস্কৃতিচর্চা এবং সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক সাইফ বরকতুল্লাহ

সাইফ বরকতুল্লাহ: আপনি তো ছোটদের জন্য বেশি লিখছেন। বিশেষ করে শিশুদের বিকাশে সিরিজ রচনা করছেন।এ বিষয়ে জানতে চাই।
নাসরিন সুলতানা: খুব ভালো লাগছে যে শিশুদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে পারছি।শখ নামের একটা মেয়েকে নিয়ে আমি সাতটি বই করেছি। প্রত্যেকটি বইয়ে মেয়েটির বয়স একটু একটু করে বেড়েছে।তার মানে গল্পের বিষয়বস্তু ক্রমশগভীরে গিয়েছে।লেখার পরিমাণ বেড়েছে।ছবির পরিমাণ কমেছে।বইগুলোর পেছনে শিশুর বয়স আর শখের বাংলা বই ১, ২, ৩ এরকম লেখা আছে। যে শিশু ২ পড়তে পারবে তাকে ৩ দিতে হবে। যে শিশু ৫ পড়তে পারবে না তাকে ৬ দেওয়া যাবে না। বয়স অনুযায়ী শিশুর পড়ার দক্ষতা ঠিক আছে কি না সেটি পরিমাপ করা যাবে।তাতে শিশুর পড়ার দক্ষতা বাড়বে।

গল্পটা যে বিষয়ে লেখা হয়েছে সে দিকেও শিশুর মনোযোগ যাবে। আমরা তো বছরের শুরুতেই শিশুর পড়ার সক্ষমতার স্তর নির্ধারণ করি এবং তিনটি দলে ভাগ করে ফেলি।এই কাজটি বছরে তিন চারবার করতে হতে পারে। শিশু তো একটা স্তরেই থাকবে না। তার পরিবর্তন ধরার জন্য টুলস ব্যবহার করতে হবে।টুলস বানানোর যোগ্যতা সবার থাকে না।থাকলেও সময় হয় না।বারবার আগের শ্রেণির বই ব্যবহার করার চেয়ে আমার বইগুলো ব্যবহার করলে ভালো হবে।শিশু নতুন একটি গল্প জানবে।যে শিশু কথা বলতে পারে কিন্তু বর্ণ চেনে না, তার জন্য আমি একটি বই করেছি। সে বইয়ে কোনো লেখা নেই।ছবি দিয়েই গল্পটা সাজানো।ছবি সম্পর্কে বললে তার বলার দক্ষতা বাড়বে। অনেক কিছু মাথায় রেখে বইগুলো করেছি।

সাইফ: আপনার লেখালেখি কীভাবে শুরু হলো, সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন, ছোটোবেলা থেকেই লেখক হওয়ার স্বপ্ন ছিল কী?
নাসরিন সুলতানা: আমি যখন বর্ণ চিনতাম না, তখন থেকেই মুখে মুখে ছড়া বানাতাম। যখন লিখতে শিখেছি তখন থেকে লেখা শুরু করেছি।লেখার গুণটা নিয়েই আমি পৃথিবীতে এসেছি। আমার মা কাজ করতেন আর গল্প শোনাতেন।কথায় কথায় ছড়া কাটতেন। আমার খুব ভালো লাগত। আগ্রহটা ওখান থেকেই এসেছে। পাঠ্যবইয়ে তো সাহিত্য ছিলই। সেগুলো পড়তে গেলেই মনে হতো আমার নামটা যদি এখানে থাকত! আমি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তখন থেকেই আমি ঠিক করেছি লেখক হবো। স্নাতকে ভর্তি হয়েই আমি স্থানীয় দৈনিকগুলোতে লেখা পাঠাতে শুরু করি।এখন তো বড় হয়েছি। বৃদ্ধ হওয়ার আগে ভালো কিছু কাজ করতে চাই। আমি আমার দেশকে অনেক ভালোবাসি। আমি যা দেখছি আর যা চাচ্ছি তাদের মধ্যে একটা সমন্বয় করার জন্য আমি সাহিত্যের পথটা বেছে নিয়েছি।

সাইফ: আপনার কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে? বইগুলোর বিষয়বস্তু কী?
নাসরিন সুলতানা: ১৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাটকের পাণ্ডুলিপি, গল্প আর উপন্যাস।

সাইফ: বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা বেড়েছে।এতে লেখকও বাড়ছে। আপনার অভিমত জানতে চাই।
নাসরিন সুলতানা: আমি শেক্সপিয়রের নামটা বলতে চাই। আজ আমরা যত মানুষের লেখা পড়ছি তিনি তো এত পড়েননি। আমরা কেন তাকে ছাড়িয়ে যেতে পারছি না? লেখকের কাজ হচ্ছে বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। যার মনের মধ্যে লেখার বিষয়বস্তু তৈরি হয় না সে লেখক নয়। অন্যের লেখা পড়ার পরে উপস্থাপনার সৌন্দর্যটা বাড়তে পারে। লেখকের চারপাশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো দেখেই তার মনে লেখার বিষয়বস্তু তৈরি হবে। কেউ যদি দশটি লেখা পড়ে একটা বিষয়বস্তু বানায় সে প্রকৃত লেখক নয়।একটি লেখা পড়লেই বোঝা যায় তা ভেতর থেকে এসেছে না কি অন্যেরটা পড়ে লেখা হয়েছে।

সাইফ: একটা সার্থক লেখার গুণাবলী কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
নাসরিন সুলতানা: একজন পাঠক হিসেবে বলব, সেই লেখাই সার্থক যা মানুষের কাছে ভালো লাগে। লেখাটা হতে হবে শুদ্ধ বাংলায়।আমি আর কোনো শর্ত দিতে চাই না। ছাপার ভুল বা বানানে ভুল কেউ ইচ্ছে করে না। সেটা পাঠক ধরেন না। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম মাপের কথা বলা হয়। কেউ কেউ মাত্রার হিসেব ঠিক করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় শব্দ আর প্রত্যয় যোগ করেন। সাহিত্য আর গণিত এক কথা নয়। যে পাঠক কবিতার মাত্রা গুণতে জানেন না তিনিও শুদ্ধ বাংলা জানেন। তাদের কথা মাথায় রেখে লিখতে হবে।সাহিত্য হচ্ছে পাঠকের অবসর কাটানোর মাধ্যম।সেটা অবশ্যই সুন্দর হতে হবে। পাঠক কখনও দুর্বোধ্য লেখা চান না। একজন লেখক হিসেবে বলব, সাহিত্যের প্রত্যেকটা শাখার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কিছু নিয়ম আছে।

সেই নিয়মগুলো রক্ষা করে যদি লেখা হয় সেই লেখাটাই সার্থক। শিশুসাহিত্যের কথা একটু আলাদা করে বলব। কারণ ওরা যদি বড়দের লেখা পড়ে তা হলে ওদের মাথায় একটা চাপ পড়বে।একটা শিশুর পড়ার সক্ষমতার স্তর শূন্য থেকে ছয় পর্যন্ত হতে পারে।স্তরটা বইয়ে লিখে দিতে হবে।গদ্য হোক, পদ্য হোক সেটি কত বছরের শিশুর জন্য লেখা হলো তাও বইয়ে লেখা থাকবে। কোন স্তরের শিশুসাহিত্যে কতটুকু ছবি থাকবে, পৃষ্ঠা সংখ্যা কত হবে, এক পৃষ্ঠায় ক’টা বাক্য থাকবে, একটা বাক্যে ক’টা শব্দ থাকবে, একটা শব্দে ক’টা বর্ণ থাকবে, বর্ণের আকার কতটুকু হবে, এগুলোর ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট শর্ত আছে।এই শর্তগুলো রক্ষা করে যদি শিশুসাহিত্য লেখা হয় তা হবে সার্থক শিশুসাহিত্য।

সাইফ: আপনি শিক্ষকতা করছেন, পাশাপাশি লিখছেনও। কাজের সমন্বয় কীভাবে করেন?
নাসরিন সুলতানা: সরকারি দপ্তরগুলোতে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক দিন।বছরে বায়ান্ন সপ্তাহ।এই বায়ান্ন দিন বছরের বিভিন্ন সময়ে ভাগ করে দেওয়া হয়।চার বা পাঁচবার বড় ছুটি পাই।তখন আমি লিখি।একটা দেশের বিবেক হচ্ছে সে দেশের শিক্ষক সমাজ।শিক্ষকতাকে যারা পেশা হিসেবে নিয়েছেন তাদের অনেক দায়িত্ব।আমার মধ্যে লেখার প্রতিভা আছে।সময় আমাকে বের করতেই হবে।আমি কখনও স্কুলে বসে লিখি না।ছোটোখাটো লেখা রাতে বা ছুটির দিনে লিখি।

সাইফ: তরুণদের মধ্যে যারা লিখতে চান তাদের জন্য আপনার পরামর্শ..
নাসরিন সুলতানা: লেখক সমাজ হচ্ছে একটা দেশের আয়নার মতো।দেশ কেমন আছে-এটি শুধু লেখকরাই বলতে পারেন। আয়না যদি নষ্ট হয়ে যায় চেহারা ঠিকমতো দেখা যায় না। লেখক হতে হলে তাকে ভালো মানুষ হতে হবে।

আপনি যা লিখতে চান তার নিয়মগুলো জানুন। সুন্দর করে লেখার চেষ্টা করুন। ভালো লেখকদের লেখা পড়ুন। জাতীয় দৈনিকগুলোতে যে লেখাগুলো ছাপা হয় সেগুলো পড়ুন। যে বইগুলো পুরস্কার পায় সেগুলো পড়ুন। এক সময় আপনি নিজেই বুঝবেন আপনার লেখা কেমন।

সাইফ: সময় দেওয়ায় ধন্যবাদ।
নাসরিন সুলতানা: আপনাকেও শুভেচ্ছা।