বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রসঙ্গে কিছু কথা ॥ আমিনুল ইসলাম


কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা (ডানে), আমিনুল ইসলাম (বামে)। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

আজ (২৪.০১.২০২২) বাংলা একাডেমি গিয়েছিলাম পড়ন্ত বেলায়। কাটিয়ে এসেছি দেড়/দুই ঘণ্টা সময়। বাংলা একাডেমি পুরস্কার সাফল্যের সাথে ঘোষণা করায় প্রথমেই একাডেমির মহাপরিচালক শ্রদ্ধেয় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ভাই এবং তাঁর টিমকে অভিনন্দন জানাই। অতঃপর বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময়।

বাংলাদেশে সাহিত্যে সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কারটির নাম বাংলা একাডেমি পুরস্কার। এটি পাকিস্তান আমলে চালু হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সত্তর দশকের শেষের দিকে চালু হওয়া একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার সবচেয়ে বড় দুটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কার; তবে তা সাহিত্য পুরস্কার নয় যদিও নানা বিষয়ের সাথে সাহিত্যক্ষেত্রে অবদানের জন্যও সেসব পুরস্কার দেওয়া হয়।

২। মহাপরিচালক মহোদয়ের সাথে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং নানা বিষয় নিয়ে আলাপ হয়েছে-যার সবটুকু বলার যৌক্তিকতা নেই। তাই গুরুত্বপূর্ণ দু-একটি কথা তুলে ধরা যায়।আলোচনার সময় আমার বক্তব্য ছিল: বাংলা একাডেমি পুরস্কারের সংখ্যা অন্তত কবিতার ক্ষেত্রে বৃদ্ধি করে যাদের নামে প্রস্তাব পাওয়া যাবে এবং তাদের মধ্যে যারা যারা যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন, তাদের সবাইকে পুরস্কৃত করা। পুরস্কারের টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে অন্তত ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করা। আজ অগ্রজ কবি বিমল গুহকে অভিনন্দন জানানোর সময় তিনি আমাকে বলেন, আমিনুল, আমি আজ ৭০ বছর বয়সে পুরস্কার পেলাম। গ্রহণ করেছি।

কিন্তু সেই আনন্দ পাইনি যেটা পেতাম অন্তত ৫০ বছর বয়সসীমার মধ্যে পেলে। তিনি জোরালোভাবে বলেছেন যে-কবিতায় বছরে ৫/৬ জনকে পুরস্কৃত করে বর্তমানে সৃষ্ট জট কমিয়ে আনা প্রয়োজন যাতে ভবিষ্যতে উদীয়মান তরুণ কবিরা ৪০ বছর বয়সসীমার মধ্যে পুরস্কার পান। পুরস্কারপ্রাপ্ত অগ্রজ কবি আসাদ মান্নানের প্রতিক্রিয়াও অমনটি পেয়েছি। আর অশীতিপর হোসেনউদ্দীন হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে গতরাতে কথা বলে দেখেছি, তিনি বলেছেন, তাঁকে পুরস্কারটি আগে দিলে কী ক্ষতি হতো বাংলা একাডেমির! এবারও না দিলেও তিনি কাউকে কিছু বলতেন না। আর আরও আগেই বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার তো নিয়মিত পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন এসব বিষয়ে। তাঁর সাথেও কথা হয়েছিল আমার।

কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সৈয়দ শামসুল হক কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন ৩১ বছর বয়সে; আল মাহমুদ কবিতায় ৩২ বছর বয়সে এবং শামসুর রাহমান কবিতায় ৪০ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন।আর এখন কবিদের পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে বুড়ো বয়সে যখন তাদের বাংলা সাহিত্যকে দেওয়ার মতো উদ্দীপনা, সাহস এবং বাঁক পরিবর্তনকারী মন-মেধা অবসন্নপ্রায়। মহাপরিচালক মহোদয় অভিন্ন মত পোষণ করেছেন।

তিনি আরও বলেছেন যে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫ লাখ নয়, অন্তত ১০ লাখ টাকায় উন্নীত করা প্রয়োজন এবং তিনি সেই চেষ্টা করবেন।

৩। পাকিস্তান আমলে যখন বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন এদেশে লোক ছিল ৪/৫ কোটি ; শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আর কবি-কথাসাহিত্যিক ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। বর্তমানে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা ১৭/১৮ কোটি; শিক্ষিত লোক প্রচুর। কবির সংখ্যা অগুনিত। বছরে এখন যদি কবিতায় ১/২ জন করে পুরস্কার দেওয়া হয়, তবে অধিকাংশ যোগ্য কবি পুরস্কার না পেয়েই ইহলোক ত্যাগ করবেন। কারণ তাদের সিরয়িাল আসবে না।একজন হোসেনউদ্দীন হোসেনকে ৮১ বছর বয়সে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া যতখানি আনন্দের, ততখানিই হতাশার।শিশুসাহিত্যে, কথাসাহিত্যে, লোকগবেষণায় নব্বই দশকের অন্তত দু-একজন ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে আজও সত্তর দশকে পড়ে আছে বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার জন্য কবিদের যদি ৭০/৮০ বছর বয়স অবধি অপেক্ষা করতে হয়, তো কবিতা লেখার প্রেরণা শুকিয়ে যেতে বাধ্য। তাছাড়া অত বছর বাঁচবেই-বা কয়জন কবি? আবিদ আজাদের মতো নিষ্ঠুর উপেক্ষা নিয়ে অকালে মরে যাবেন অনেকেই। বাংলাদেশের কবিতায় উন্নয়ন ঘটাতে হলে বাংলা একাডেমিকে এদিকটাও বিবেচনায় নিয়ে পুরস্কারের নীতিমালা এবং মনমানসিকতা পাল্টাতে হবে।একদিন শ্রদ্ধেয় কবি কামাল চৌধুরীর সাথেও বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছিল; তিনিও মনে করেন যে কবিতাক্ষেত্রে বিরাজিত পুরস্কার-জটের অবসান হওয়া প্রয়োজন। কোনো দশকেরই কিংবা কোনো বয়সেরই সবাই পুরস্কার পাবেন না; পাওয়ার যুক্তিও নেই। যারা যোগ্য তারা সময়মতো পাবেন। তারপর পরবর্তী দশকের বা তরুণতর কবিরা পাবেন যোগ্যতার নিরিখে। সুপ্রতিষ্ঠিত কথাসাহিত্যক সেলিনা হোসেন আপার সাথে এসব নিয়ে বেশ আগে মতবিনিময় হয়েছিল আমার।

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক-শিল্পসমালোচক-অনুবাদক অশীতিপর হাসনাত আবদুল হাই এ বিষয়ে অভিন্ন মত পোষণ করেন এবং তিনি এই নিয়ে নিজেও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন বলে আমি দেখেছি। তাঁর সাথে এই নিয়ে আমার একাধিকবার মুখোমুখি কথাও হয়েছে।

৪। পাকিস্তান আমলের ৪/৫ কোটি মানুষের দেশে এখন মানুষের সংখ্যা তার ১৭/১৮ কোটি । জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে মন্ত্রী, এমপি, সচিব, জেনারেল, ভাইস চ্যান্সেলর, মহাপরিচালক, অধ্যক্ষ-প্রভৃতি পদ পদবী পদোন্নতির সুযোগ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা বাড়লে কবির সংখ্যা বাড়বে না কেন এবং কেন বেশি সংখ্যক কবি ন্যায্য পুরস্কার পাবেন না? সবাই তো কবিদের লেখা পড়েই শিক্ষিত হন, অন্তত এসএসসি ও এইচএসএসি এর সনদপত্র লাভ করেন, উচ্চশিক্ষলাভের যোগ্যতা অর্জন করেন, পদ-পদবী পান! কবিদের অবদান কোনোভাবেই কারো চেয়ে কম নয়।

৫। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের অর্থমূল্য অবশ্যই বাড়ানো প্রয়োজন যেমনটি মহাপরিচালক মহোদয় বলেছেন। আমাদের বার্ষিক বাজেট ৪ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাচ্ছি। কত খাতে শতশত কোটি টাকা অনেকটা শিথিলভাবে বা উদার হাতে খরচ করছে রাষ্ট্র। বাংলা একাডেমি পুরস্কারের টাকাটা তো একেবারেই নগণ্য যা জাতীয় বাজেটের নিরিখে হিসেবের মধ্যেই পড়ে না। বিষয়গুলো নিয়ে আমি একদিন অগ্রজ শ্রদ্ধেয় কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গেও মত বিনিময় করেছিলাম। তিনি প্রায় সহমত পোষণ করেছিলেন। আমরা আশা করি, বর্তমান মহাপরিচালক একজন প্রখ্যাত কবি হওয়ায় এবং তাঁর অন্যতম হেল্পিং হ্যান্ড বাংলা একাডেমির সচিব হাসানাত লোকমানও একজন কবি বিধায় উত্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা কাজ করবেন এবং প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন করবেন।

৬। মহাপরিচালক মহোদয়ের সঙ্গে মতবিনিময়ের পূর্বে লোক গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিগবেষক আমাদের আপনজন আমিনুর রহমান সুলতানকে সশরীরে অভিনন্দন জানাই। তিনি আমাদের মিস্টি খাওয়ায়ে আপ্যায়ন করেন এবং তার প্রিয় লীনাভাবীকে তাঁর “ লোকগল্পের কবিতা’’ শীর্ষক একটি বই উপহার দেন। তারপর একাডেমির সচিব আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন কবি হাসানাত লোকমানের রুমে কিছুক্ষণ। আলাপ এবং চা পর্ব। মহাপরিচালক শ্রদ্ধেয় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ভাইয়ের সাথে আলাপ শেষে বাংলা একাডেমি থেকে আসার প্রাক্কালে তিনি তাঁর ‘‘ছোটবোন’’ লীনাকে বাংলা একাডেমি থেকে সদ্য প্রকাশিত তাঁর “ Flaming Powers : Poet’s Response to the Emergence of Bangladesh ” শীর্ষক বইটি উপহার দেন।

তো আজ আমরা বাংলা একাডেমি থেকে খালি হাতে ফিরিনি। নতুন বছরে নতুন মহাপরিচালকের দূরদর্শী ও সৃজনশীল নেতৃত্বে বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে নতুন আলোর সঞ্চার ঘটাবেন, এমন প্রত্যাশা নিয়েই লীনার এবং আমার।

যারা এবছর এই শীতের মৌসুমে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন, তাঁদের সবাইকে আবারও উষ্ণ অভিনন্দন !

[লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া। বানান রীতি লেখকের]