লেখা স্বতঃস্ফূর্তভাবে না এলে জোর করে কিছুই লিখি না ॥ নাহিদা আশরাফী


অলঙ্করণ: লংরিড

বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার-২০২১ পেয়েছেন নাহিদা আশরাফী। লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনায় তিনি এ পুরস্কার পেয়েছেন।তিনি একাধারে কবি, গল্পকার , প্রাবন্ধিক, সম্পাদক এবং প্রকাশক। ছোটকাগজ ‘জলধি’ সম্পাদনা করছেন তিনি। বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পাওয়ার পর নাহিদা আশরাফীর মুখোমুখি হয় যোগসূত্র। এ সময় তিনি লেখালেখি, সম্পাদনা ও পুরস্কারপ্রাপ্তিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদমান সাবের

যোগসূত্র: লিটলম্যাগ সম্পাদনায় বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার পেলেন। কেমন লাগছে পুরস্কার প্রাপ্তিতে?
নাহিদা আশরাফী: বগুড়া লেখক চক্র দীর্ঘদিনের একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাদের সুনাম রয়েছে। খ্যাতিমান অনেক লেখকের হাতেই যে পুরস্কার উঠেছে , তাতে এ বছর আমার নাম যুক্ত হচ্ছে জেনে অবশ্যই ভালো লাগছে।ধন্যবাদ বগুড়া লেখক চক্রকে। তবে ভালোবেসে কোনো পাঠক যখন জলধির কোনো একটি পুরনো সংখ্যাও হাতে তুলে নেন বা খুঁজে নেন ও পড়েন তখন সেই আনন্দক্ষণকেই আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার মনে হয়।

যোগসূত্র: আমাদের ছোটকাগজ আন্দোলন সাহিত্য নিয়ে আপনার মূল্যায়ন?
নাহিদা আশরাফী: ইতিহাস ঘাটলে লিটলম্যাগ এর যে লালনভূমি সেখান থেকে কিছুটা নয় আমি বলি বেশ খানিকটাই সরে এসেছে।বাজার ভর্তি বাণিজ্যিক কাগজের ভিড়ে লিটল ম্যাগ তার স্বরূপ ও স্বভাব হারাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানিক তাবেদার ও সাহিত্য ইজারাদার এর সংখ্যা বাড়ছে। ফলত তারুণ্যের যে সাহিত্যপ্রবণতা তা রুগ্ন আকার ধারণ করে প্রতিষ্ঠানের তোষামোদি ও প্রচার প্রপাগান্ডার স্থুলতায় চাঁপা পড়ে ভগ্ন ও মৃতপ্রায় শাখায় পরিণত হয়েছে।আদর্শিক চেতনা ও মননশীল চর্চার নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে।আশার কথা এটুকুই যে, এর মধ্যেও ছোটকাগছের চর্চা নিভু নিভু করে হলেও জ্বলছে।আঠেরো শতকের মাঝামাঝি প্রকাশিত আমেরিকার বোস্টন থেকে প্রকাশিত, যৌথভাবে রেলফ ওয়ালডো এমারসন ও সারা মার্গারেট সম্পাদিত ‘ডায়াল’ (১৮৪০-৪৪), বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার শিকাগো থেকে প্রকাশিত ও কবি হেনরিয়েট মনরো এবং কবি এজরা পাউন্ড (বিদেশি সম্পাদক) সম্পাদিত ক্ষুরধার লিটলম্যাগ ‘পোয়েট্রি : এ ম্যাগাজিন অব ভার্জ’ (১৯১২) জাপান থেকে প্রকাশিত ‘গারাকুতা বুনকো’ (১৮৮৫), ভারত উপমহাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গদর্শন’, অবিভক্ত বাংলায় কলকাতার ‘কল্লোল’ (১৯২৩), বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা (১৯৩০), পঞ্চাশের দশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ এর কৃত্তিবাস, হাংরি জেনারেশন এর ‘হাওয়া ৪৯’ ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’ ‘সমকাল’ ‘স্যাড জেনারেশন’ এরকম আরো অনেক নাম বলা যায় যারা লিটল ম্যাগ এর আদর্শিক চেতনাকে ধারণ ও লালন করেছেন। প্রশ্ন এসে যায় সেই চেতনা এখন কেন বিলুপ্তপ্রায়। এটা কী প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখায় লিটল ম্যাগকে ঢেলে সাজাবার অপচেষ্টায় নাকি তরুণদের সাহিত্যের প্রতি অনিহা। ভাববার বিষয় বোধকরি। এই অপচেষ্টা বা অনিহার কারণ কী? একটা সূক্ষ্ম যোগ কিন্তু রয়েছে।

লিটল ম্যাগ এ তারুণ্যের ছোঁয়া ও আলো না থাকলে তাকে কী লিটল ম্যাগ বলা যায় । তবে হ্যাঁ এই ‘ছোঁয়া’ আর ‘আলো’র ব্যাখ্যাটি জরুরি মনে করছি। জনাকয়েক ছেলেমেয়ের নিজের মত লিখবে বলে, আত্মদর্শনের ঐশ্বর্য প্রকাশ করার বাসনা নিয়ে যার যার মাটির ব্যাংক ভেঙে যা পেলো এনে জড়ো করে নিজেদের মতো একখানা কাগজ বের করলো। সে কাগজের ফর্মা গুনে হতাশ হলেও ফর্ম আর ফিউচার নিয়ে আপনার মনে আলো জাগবেই। এই আলোর নাম আশা। আর সেই আশার হাত ধরে ধরে আপনি তাকে পৌঁছে দিলেন আরো কিছু হতাশ-বিতৃষ্ণ-বিচ্ছিন্ন অন্তরে। এই ভগ্নপ্রায় হৃদয়গুলো আলো পেলো। এই সব উজ্জ্বল তরুণদের জিজ্ঞেস করে দেখুন আমি নিশ্চিত তাদের দশজনে দুজন অন্তত পাবেন যারা বড় পত্রিকার তাবেদারি বা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের চাহিদা মাফিক লেখা লেখেন না। তারা নিজের স্বস্তিতে লেখেন। কারণ তারা জানেন লেখা নিজ আত্নার প্রশান্তির জন্যে। তার মানে এই দুজন অন্তত পাওয়া গেল যারা সাহিত্যের মহাকাল ছোঁয়ার জন্যে নিরুত্তাপ ও নিরুদ্বিগ্নভাবে লিখে যান। আর লিটল ম্যাগের সার্থকতা এখানেই।

যোগসূত্র: ছোটকাগজ সম্পাদনার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলো কেন?
নাহিদা আশরাফী: ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার প্রথম প্রচ্ছদ করেন শিল্পী দ্বিজেন্দ্রনাথ গোস্বামী। চিত্রটি ছিলো এক নারীর, যার মাথায় মুকুট, হাতে শস্যগুচ্ছ, গলায় সাতনরী হার। বা দিকের একটু উপরে সূর্যাস্তের চিত্র। ফেনিল জলরাশি থেকে সিক্ত বসনে যেন উঠে আসছেন ভারতমাতা। ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ/ সেদিন বিশ্বে সে কি কলরব, সে কি মা ভক্তি, সে কি মা হর্ষ।’ – দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রচিত এই বিখ্যাত কবিতাটি পত্রিকার তৃতীয় ও চতুর্থ পৃষ্ঠায় শোভিত হয়ে পত্রিকাটির জৌলুশ ও নামকরণের সার্থকতা যেন সর্বাংশে সবার সামনে উদ্ভাসিত করে তুলেছিলো। এই প্রচ্ছদটি দেখার পর থেকে চোখ ফেরাতে পারিনি অনেকটা সময়। আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। সেদিন থেকেই নিজের ভিতরে এক অন্যরকম স্বপ্ন বুনেছি। একটা নিটোল ছোট কাগজ করার। স্বপ্নকে লালন করলে একদিন তা বাস্তবায়ন হয়- দরকার শুধু সাহস আর গন্তব্যের প্রতি স্থির দৃষ্টি।সম্পাদক জলধর সেন সেদিন কিন্তু জানতেন না শতবর্ষ পরে তার পত্রিকাটির প্রচ্ছদ ও লেখা কারো ভেতরে এমন উদ্দীপনা তৈরি করবে। আমিও স্বপ্ন দেখি শত বছর পরে কেউ একজন ঠিক এমন করেই জলধির কথা লিখবেন। জলধি দিয়েই শুরু করবেন তার লেখাটি অথবা জলধিকে তার সৃষ্টির প্রেরণা ভাববেন। স্বপ্ন দেখি কেউ একজন লিখছে…
জলধি
জলে জোছনায় জীবনের আবাহন
প্রথম বর্ষ- প্রথম সংখ্যা
জুলাই-২০১৭
সম্পাদক- নাহিদা আশরাফী
প্রকাশক – ..

স্বপ্নটা কী খুব বেশি হয়ে গেলো? হোক না। স্বপ্ন দেখার অন্তর্দৃষ্টি যদি হয় পাখির মত তবে তার উড়বার আকাশটাও হোক সীমাহীন। লিটল ম্যাগ মানেই তো প্রাচীর ভাঙ্গার গল্প, শিকল ভাঙার কবিতা।

যোগসূত্র: আপনি তো লিটলম্যাগ সম্পাদনা ছাড়াও কবিতা, কথাসাহিত্যও চর্চা করছেন। কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

নাহিদা আশরাফী: আপনার পাঁচটি সন্তান থাকলে কার পরিচয়ে নিজেকে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন ? ঘাসফুল থেকে গোলাপ সব মিলিয়েই যেমন বাগানের সৌন্দর্য , সন্ধ্যাতারা থেকে শুকতারা মিলিয়েই যেমন অপরূপ আকাশ তেমনি কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও সম্পাদনা- সব মিলিয়েই আমার সাহিত্যের চর্চা।আমার আত্মার প্রতিধ্বনি, আমার চিন্তার প্রতিফলন। আলাদা করতে পারছি না তাই কোনটাকেই।তবে লেখা স্বতঃস্ফূর্তভাবে না এলে জোর করে কিছুই লিখি না। কারণ জোর করে আর যাই হোক নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না। লেখা আমার কাছে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর মতই নিরবচ্ছিন্ন ও সতত প্রবাহমান ধারা মনে হয়।

যোগসূত্র: পুরস্কার নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। আপনি পুরস্কারকে কোন চোখে দেখেন?

নাহিদা আশরাফী: আমার কাছে যেকোনো পুরস্কারই কর্মস্পৃহা বাড়ায়, সেই সাথে কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করে।কাজের প্রতি এই যে ভালোলাগা তৈরি করা, দায়িত্ব বাড়িয়ে দেওয়া এভাবে ভাবলে পুরস্কারের ইতিবাচক দিকটা অবশ্যই আনন্দের।আর পুরস্কার পেয়ে পা যদি মাটি ছেড়ে উপরে উঠে যায় তাহলে ক্ষতিটা লেখকেরই।

সাহিত্য পুরস্কার লেখককে মূল্যায়ন করে আর সেই মূল্যায়ন ধরে রাখার দায়িত্ব তো লেখকের।একজন লেখককে এটা মাথায় রাখা জরুরি যে একটি পুরস্কারের চেয়েও একজন পাঠকের কাছে মূল্যায়িত হওয়া অনেক বড় প্রাপ্তি।

যোগসূত্র: বাংলা একাডেমি পুরস্কার, করপোরেট পুরস্কারের পাশাপাশি দেশের সাহিত্যসংগঠনগুলো থেকে দেওয়ার পুরস্কারের মধ্যে আপনি স্পষ্ট কোনো পার্থক্য দেখেন? কোন পুরস্কারকে আপনার নিরপেক্ষ ও বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়?

নাহিদা আশরাফী: নিরপেক্ষ হলে সবই গ্রহণযোগ্য মনে হয় ও হবে। সেখানে স্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোনো পার্থক্য করারই কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না। ভালোবেসে গাছতলায় ডেকে নিয়ে কোনো সংগঠন যদি এক ঝুড়ি শিউলি ফুল দেয় তার মূল্য আর কর্পোরেট বা বাংলা একাডেমি পুরস্কারের মূল্য আমি আলাদা করতে পারি না। হয়তো এ আমার অক্ষমতা ।