লিরা ॥ সীমা শামীমা


আলোকচিত্র: লংরিড

টিয়া আর দিয়াকে জড়িয়ে ধরে নীরবে কাঁদছে লিরা। এই কান্না কেবল শোকের কান্না নয়, বহুদিনের জমানো ব্যথাদের জেগে উঠার কান্না। মনে হচ্ছে টিয়া দিয়ার মতো সেও বুঝি কিছু হারিয়েছে, প্রিয়জন হারানোর কান্না। কিন্তু রাইমা কি লিরার প্রিয়জন ছিলো। রাইমার মৃত্যুতে কি লিরা এতটাই শোকাহত যে তার ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে? না, তা তো নয় !

আত্মীয়তার কারণে রাইমার সাথে যেটুকু কথা বা আলাপচারিতা ছিলো তা নিতান্তই সামান্য। সেজন্য কি লিরার এভাবে কাঁদার কথা? তবে কি টিয়া দিয়ার মাতৃহীন হওয়ার শোকে লিরার এই কান্না? অনেকক্ষণ কান্নার পর এইসব ভাবতে ভাবতে লিরা ধাতস্থ হলো, অনেকটা আষাঢের বৃষ্টি থামার মতো ক্রমশ ! এইসব প্রশ্ন তাকে কিছুটা সন্দিহান করে তুলল ! টিয়া দিয়ার প্রতি কেনো জানিনা লিরার অন্যরকম একটা টান ছিলো ! ওদের দেখলেই বুকের ভিতর কোথায় যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস মোচড় দিয়ে উঠতো। হায় ! আজ সেই টিয়া দিয়া মাহারা। এইটুকু বয়সেই ওরা মায়ের আঁচলের ছায়া থেকে বঞ্চিত হলো। আর টিয়া দিয়ার মতো আরো একজন তার সবচাইতে প্রিয়, প্রাণের দোসর, সুখ-দুখের অংশীদারকে চিরদিনের মত হারালো সে হলো লিরার নিয়াজ ভাই।

টিয়া আর দিয়াও কাঁদছে। কান্না আসলে ছোঁয়াছে। কান্নারত মানুষের চোখে চোখ পড়লেই বা তাকে ছুঁলেই বিদ্যুতের মতো অপরের চোখে সংক্রামিত হয়, লিরা, টিয়া দিয়ার বাবা নিয়াজের খালাতো বোন। নিয়াজের বিয়ের তেরো বছরের মধ্যেই দুই মেয়ে টিয়া আর দিয়াকে রেখে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলো রাইমা, নিয়াজের স্ত্রী, অবস্থার অবনতি হলে হসপিটালাইজড করে। তেরো দিন পর মারা যায় রাইমা । আনলাকি থার্টিন রাইমা আর নিয়াজের সংসারে তার নামের সত্যতা প্রমাণ করে দিলো। সাজানো গুছানো একটা সংসার শোকের বন্যায় ভেসে গেলো। খবর পেয়ে একছুটে চলে এসেছে লিরা। যেহেতু করোনায় মৃত্যু, তাই খুব বেশি লোক সমাগম ছিলো না, টিয়া দিয়া আর নিয়াজ কোয়ারেন্টাইনেই ছিলো চৌদ্দদিন। নিয়াজ যদিও ঢাকাতে থাকে কিন্তু লাশ নিয়ে এসেছে গ্রামের বাড়িতেই। কাছাকাছি বাড়ি হওয়াতে লিরার আসতে সময় লাগেনি। এসে অব্দি টিয়া দিয়াকে জড়িয়েই ধরে রেখেছে।

বুকে জমানো পুরানো কষ্টগুলো যেনো বেরিয়ে গেছে, এখন কেবল স্থির চোখে তাকিয়ে আছে কোন কিছুর উপর দৃষ্টি না দিয়েই। দুই হাতে দুইপাশে টিয়া আর দিয়াকে জড়িয়ে রেখেছে ঠিক যেনো মা পাখিটা ডানা দিয়ে আগলে রেখেছে তার উড়তে না জানা বাচ্চাদের।

পনেরো ষোল বছর আগে। নিয়াজ তখন ব্যাংকে জয়েন করেছে, নতুন চাকরি। পাত্রী খোঁজা হচ্ছে বিয়ের জন্য। লিরা তখন অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। গা থেকে তখনো স্কুল কলেজের গন্ধটা পুরোপুরি যায়নি, জড়তা ভেঙে সবে মনের গোপন ভালোলাগাগুলো ডাল-পালা ছড়াতে শুরু করেছে। নিয়াজকে দেখলেই লিরার শিরদাঁড়া ঝিমধরে যেতো, সারা শরীর উত্তপ্ত হয়ে যেতো এক অজানা অনুভূতিতে। কেমন যেনো ভয় ভয় একটা অনুভূতি অথচ সারা মনে রঙের দোল খেলা শুরু হয়ে যেতো। নিয়াজের জন্য শরবত বানাতে গেলে চিনির চামচ পরে যেতো নয়তো গ্লাস উলটে যেতো। চা করতে গেলে চিনি দিতে ভুলে যেতো। হাঁটতে গেলে ঠিকমত পা ফেলতে পারতো না, যেনো ওর আগেই ওর ভিতরের কেউ একজন পা ফেলে হাঁটছে আর ও তাল মেলাতে না পেরে হোচট খাচ্ছে। সামনে গেলে লজ্জায় নিয়াজের মুখের দিকে তাকাতে পারতো না। অথচো নিয়াজ কী সহজভাবেই না কথা বলতো।

লিরার মনে হতো কথা নয় যেনো বশীকরণ মন্ত্র পড়ছে। লিরার চোখে নিয়াজই ছিলো হিরো, গানে গল্পে চিন্তা ভাবনায় সে অনন্য। স্বভাবে কিছুটা গম্ভীর হলেও নিয়াজ লিরাদের সাথে কথা বলত প্রাণ খুলে। প্রতি উইকেন্ডে নিয়াজ গ্রামের বাড়ি আসতো। এলেই লিরাদের বাড়ি আসতো, আর লিরা সারা সপ্তাহ উন্মুখ হয়ে থাকতো সেই দিনটির জন্য, কত কথা ভেবে রাখতো বলার জন্য, কিন্তু নিয়াজ এলেই সব গুলিয়ে যেতো। সেই হাতে পায়ে কাঁপা-কাঁপি, বুকের ভিতর হাপড় পিটানোর ধুপধুপ ধুপধুপ শব্দের হুলুস্থুল !

লিরা কিছুই বলতে পারতো না। নিয়াজ এলেই যেনো সমগ্র পৃথিবীটা হেসে উঠত খিলখিল করে, চলে যাবার সময় লিরার খুব মন খারাপ হতো, মনে হতো গাছের সব পাতাগুলি বুঝি মলিন হয়ে গেছে, কোথাও কোন প্রাণ নেই, আলো নেই। লিরা চাইতো সব সময় নিয়াজ ভাই তার কাছাকাছি থাকুক, লিরাকে ভালো করে দেখুক, তার চোখের ভাষা বুঝুক, অন্যরকম চোখে তাকাক,গাঢ়ো স্বরে কিছু বলুক। আবার নিজের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে, “যদি নিয়াজ ভাই মনের কথা পড়ে ফেলে, যদি চোখ দেখে টের পেয়ে যায় দুর্বলতা ! তবে তো আমি লজ্জায়ই মরে যাবো” !

লিরা তার বন্ধুদের মুখে শুনেছে কীভাবে ওদের জীবনে প্রেম এসেছে ! গল্প উপন্যাসের মত সব প্লট, সিচুয়েন তৈরি হয়েছে, একে অন্যের কাছে এসেছে, কিন্তু লিরা অতোটা সাহসী না, সে মরে গেলেও নিয়াজ ভাইকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবে না, পারেওনি। মনে মনে কেবল নিয়াজকে ছুঁয়ে গেছে গোপন ভালোলাগায়। লিরা কাউকে তার এই অনুভূতির কথা বলতে পারবেনা কোনদিন !

সবাই প্রস্তুত। তাড়া দেয়া হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই জানাজার জন্য লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। কী অদ্ভুত। এতদিনের সুখ দুঃখের সাথী। আজ সে পর। আজ তাকে কেউ নাম ধরেও ডাকছে না, এখন সে সবার কাছেই লাশ। লিরা একবারের জন্যও রাইমাকে দেখেনি। লিরা মনেমনে নিজেকে দোষারোপ করছে। তবে কি তার দীর্ঘশ্বাসের তাপে নিঃশেষ হয়ে গেলো রাইমা? লিরা তো কোনদিন কোন অভিযোগ করেনি, যে তার নয়, যে তাকে চায়নি সে যার ইচ্ছে হোক। লিরা তো কেবল গোপন করেছে নিজের ব্যথা, নিজের মুখ। নিজের ভালোবাসার কথা বলতে না পারার ব্যথা, নিজের ভালোবাসা বুঝাতে না পারার ব্যর্থতা, জীবনের দীর্ঘপথ একা পাড়ি দেবার সংগ্রামের ক্ষত, গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে সব আয়োজন থেকে। তবু কেনো তার শকুনি দৃষ্টি পড়ল রাইমার উপর। রাইমা সরল, সাদা মনের মানুষ ছিলো। লিরাও পছন্দ করতো তাকে। বরং এটা ভেবেই সুখী হতো যে নিয়াজ ভাই তার যোগ্য সঙ্গিনী পেয়েছে। যাকে পেয়ে নিয়াজ ভাইও সুখী।

লিরা কেবল দূর থেকে নিয়াজকে একনজর দেখেছে। তাকাতে পারেনি ভালো করে। একি হাল হয়েছে নিয়াজ ভাইয়ের। চোখ দেবে গেছে কোটরে, চোখের নিচে কালি। শুকিয়ে জীর্ণ। যেনো কতকাল জেগে আছে নির্ঘুম ! আহা নিয়াজ ভাই। তার প্রাণের নিয়াজ ভাই। আজো পনের বছর আগের মতো বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল, যেনো ফাঁকা হয়ে গেলো সব। মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা ! লিরা ছাদের কার্নিশ ধরে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলো উদাস চোখে, মেঘের ছুটাছুটি দেখছিলো, কানের কাছে আঙ্গুলের তুড়ি বাজিয়েই নিয়াজ প্রশ্ন করল, ‘ কিরে? প্রেমে পড়েছিস নাকি, এমন কবি কবি চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছিস যে? লিরা চমকে গিয়েছিলো ! ‘ওহঃ নিয়াজ ভাই ! কী যে বলো না, আমার মতো পেত্নীকে কে ভালবাসতে যাবে ?’ শ্যামলা পাতলা ছিপছিপে গড়নের লিরা, সাদামাটা চোখ মুখ, এই রূপ নিয়ে লিরার খুব একটা আক্ষেপ না থাকলেও মাঝেমাঝেই ভাবতো, আরেকটু সুন্দর তো হতেই পারতো সে। কেনো বিধাতা তাকে ইকটু খেয়াল করে বানায়নি।
‘কেনো ? একটা বিকট আকারের ভূত ! জানিস তো ভূতেরা খুব রোমান্টিক হয়। একদিন দেখবি বিরাট এক জলহস্তির কাঁধে চড়ে এসে তোকে বিয়ে করে সাত সাগরের তলদেশে পেত্নীরাজ্যে নিয়ে যাবে ! অবশ্য দৈত্য হলে ভালো হতো, একটা চেরাগের ভিতর দুজনে গুটিসুটি মেরে থাকতে পারতি ‘ বলেই হা হা করে হেসে উঠল নিয়াজ ! এই সামান্য ঠাট্টাটাও নিতে পারল না লিরা, চোখ ছলছল করে উঠল। নিয়াজ ভাই এমন কেনো ? সে কি ইকটু বলতে পারতো না যে তুই হলি প্রিন্সেস ডায়নার মত সুন্দরী।

খুব বুড়ি হয়ে গেছিস না ? দাঁড়া খালা খালুকে বলবো তোকে যেনো তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়।
মাকে একদম কিচ্ছু বলবে না নিয়াজ ভাই। আমি পড়াশোনা করব, নিজের পায়ে দাঁড়াবো, চাকরি করব তোমার মতো। ওসব বিয়ে টিয়ের কথা বলবে না। এক দমে কথাগুলো বলে লিরা যেনো নিজেই অবাক হলো। এসব তো লিরার স্বপ্ন নয়। কী হবে এত পড়াশোনা করে, একজীবন সে কেবল নিয়াজ ভাইকেই চায়, খুব সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়াজ ভাইর সাথে সংসার করতে চায়। ক্লান্তিতে শ্রান্তিতে সে কেবল নিয়াজ ভাইয়ের আশ্রয় হতে চায়। নিয়াজ ভাইয়ের হাত ছুঁয়ে একজনম পার করে দিতে চায়। এর বেশি লিরার আর কিছু চাওয়ার নেই।
ঠিক বলেছিস ! তোকে পড়াশোনা করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এদেশের প্রতিটি মেয়েকে পড়াশোনা করে নিজেকে অগ্রগামী বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে হবে, নিজের অধিকার বুঝে নিতে হবে।

লিরা সেদিন নিয়াজ ভাইর চোখে দেখেছিল উজ্জ্বল আলোর ঝলক, একটা স্বপ্ন, একটা উন্নত দেশের স্বপ্ন, যেখানে সব মেয়েরা স্বনির্ভর। লিরা সেদিন সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিয়াজ ভাইয়ের স্বপ্নপূরণ করবে।

তার মাস খানেক পরই একদিন তার নিয়াজ ভাই একটি মেয়ের ছবি নিয়ে এসে তাদের সবাইকে দেখালো। মেয়েটি যেমনি সুন্দরী তেমনি মিষ্টি। শিক্ষিতা, একেবারে পার্ফেক্ট। নিয়াজ ভাইয়ের সাথে মানাবে ভালো । লিরার মাবাবাকে বলল মেয়ের বাড়িতে যেয়ে মেয়ে দেখে বিয়ের দিন তারিখ পাকা করে আসতে। নিয়াজের বাবা নেই সৎ মা, তাই খালাখালুকে সে মাবাবার মতোই সম্মান করে। মেয়েটি নিয়াজের ব্যাংকের ম্যানেজার স্যারের বোন। ম্যানেজার স্যার নিয়াজকে দেখে তার কাজের প্রতি মনোযোগ, অ্যাক্টিভিটি দেখে খুব পছন্দ করেছেন। জহুরি খাঁটি সোনা চিনতে ভুল করেননি এদিকে নিয়াজও এমন চমৎকার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি । নিয়াজের এই সিদ্ধান্তে লিরার মাও কিছুটা আহত হয়েছিলেন। কারণ তারও ইচ্ছে ছিলো মাতৃহীন ভাগ্নের হাতে লিরাকে তুলে দিয়ে নিজেদের কাছাকাছি রাখবেন, ইনফেক্ট আরেঠারে নিয়াজকে বহুবার সেটা বুঝিয়েছিলেনও। উড়া উড়া ভাবে ভাতিজা আজমলকে দিয়ে নিয়াজের কানেও কথাটা পেরেছিলেন।

আজমল আর নিয়াজ কেবল মামাত ফুফাতো ভাই-ই নয়, খুব ভালো বন্ধুও। কিন্তু নিয়াজ বুঝেও না বুঝার ভান করে সেদিন এড়িয়ে গিয়েছিলো। তাই নিয়াজের এই অকস্মাৎ সিদ্ধান্তে তারাও কিছুটা অবাক হলেন।

সেদিন কেউ জানেনি লিরার ভিতর কতোটা ভাঙন হয়েছিল। বুকের ভিতরটা যেনো চৈত্রের ফসল তোলা জমির মত ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। সেই চৌচির মাঠে নদী ভাঙনের উথাল-পাতাল ঢেউ। কী আশ্চর্য। এত উথাল-পাতাল ঢেউয়েও সেই চৌচির মাঠ এতটুকুও ভিজছে না। সারাটা রাত লিরা কেঁদেছিল। তার এই অস্ফুট বেদনার কথা সে কোনদিন কাউকে বলতে পারেনি। লিরার মনের খুব গহীনে খুব সন্তর্পণে একটা মিহি ভাবনা শাওয়ালের চাঁদের মতো মাঝেমাঝেই উঁকি দিত লিরাকে না জানিয়েই। ‘হয়তো নিয়াজ ভাইও আমাকে…… ‘ লিরা আর বেশিদূর ভাবতে পারত না, লজ্জা ভয় এসে তাকে আড়ষ্ট করে ফেলত, সেদিনের সেই সরুচাঁদ আজ যেনো পূর্ণিমার বড়চাঁদ হয়ে লিরার মাথায় ভেঙে পড়ে খানখান হয়ে গেলো।

লাশ নিয়ে যাচ্ছে, রাইমাকে শেষ বিদায় জানাতে লিরা বাইরে এসেছে , টিয়া আর দিয়াকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। টিয়া দিয়া খুব কাঁদছে, লিরার বুকটা হাহাকার করছে, বড্ড অসহায় লাগছে তার । নিয়াজ ভাই খাটিয়ার সামনের দিকের একটা পায়া কাঁদে নিয়ে যাচ্ছে। রাইমা যেনো নতুন বউ, এই লাশের খাটিয়া যেন পালকি। সবাই তাকে বয়ে নিয়ে চলেছে। কিন্তু কারো মুখেই হাসি নেই, সমস্তই বিষাদে ছাওয়া। হায় এমনি করেই তো একদিন পালকি চড়ে এই উঠানে এসে দাঁড়িয়েছিল !, সেদিন সবাই কত হাসিখুশি ছিলো ! সারা বাড়ি সেদিন আলোর বন্যায় ভেসেছিলো। আর আজ যেনো বাড়ির সমস্ত প্রদীপ নিভিয়ে, সব আলো ঐ সাদা কাফনে মুড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একেই বুঝি বলে মৃত্যুর মতো অন্ধকার ! এতঅশ্রু,এত কান্না,কলরোল কোনদিকেই কোন খেয়াল নেই, এসব তাকে স্পর্শ করছে না, এতটুকুও বিচলিত হচ্ছে না। কী নির্বিকার জগদ্দল পাথরের মতো গভীর ঘুমে নিমগ্ন। তবু সবাই কত সন্তপর্ণে চলছে, নিশ্বাস ফেলতেও যেনো দুলে উঠছে না কারো হাত পাছে তার ঘুম ভেঙে যায়, সামান্য ঝাঁকুনিতে যদি ব্যথা পায়। হায় মৃত্যু ! হায় পাথর ! মনে হচ্ছে কেউ যেন নিয়াজ ভাইকে চাবুক মেরে মেরে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে ! অশ্রুতে ভেসে যাচ্ছে নিয়াজ ভাইয়ের বুক। লিরা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখল। সহ্য করতে পারছে না নিয়াজ ভাইয়ের এই কষ্ট, টিয়া দিয়ার মা হারার আর্তনাদ। খাটিয়ার সাথে সাথে ক্ষীণ হতে থাকলো কান্নার রোল ।

সময় কারো জন্য থেমে থাকে না, এই সত্য জেনে যাবার পর আস্তে আস্তে ফিকে হতে থাকে শোকের রঙ। নিয়াজ অফিসে জয়েন করেছে। টিয়া দিয়াকে সামলে অফিস করাটা তার জন্য ইকটু কঠিন হয়ে পড়েছে। তবু হাসিমুখে চালিয়ে যেতে থাকলো। টিয়াদিয়া যেনো মায়ের অভাব না বুঝতে পারে তাই তাদের সব বায়না আবদার মেটাতে থাকলো। প্রতিদিন ঘুরতে যাওয়া, বাইরে খাওয়া যেনো একটা অভ্যাসে পরিণত হতে থাকলো। টিয়া দিয়াকে নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলো যে নিজের দিকে তাকানোর সময়ও পায়নি। ছমাস কেটে গেছে। এই ছয় মাসে নিয়াজের বয়স বেড়েছে ছয় দুগুণে বার বছর। নিজের ভিতরের শূন্যতাকে কখনো মাথাচাড়া দিতে দেয়নি। তবু মাঝেমাঝেই মাঝরাতে ঘুম আসতো না, বারান্দায় বসে থাকতো। রাইমার সাথে কাটানো সুখের স্মৃতিগুলো তার পায়ের কাছেই বিড়ালছানাদের মতো হুটোপুটি খেলতো । সেই খেলা দেখতে দেখতে কখন যে ভোর হয়ে যেতো টের পেতো না। এরই মাঝে একদিন আজমল এলো, নিয়াজকে দেখেই আজমল জড়িয়ে ধরল বুকে – এ কী হাল করেছিস নিজের? আয়নায় দেখেছিস নিজেকে? এইভাবে চলতে থাকলে তোরও রাইমার কাছে যেতে সময় লাগবে না।
তাই যদি যেতে পারতাম ! আমি আর পারছি না রে আজমল, কেনো এমন হলো বলতো? বিধাতার কী ক্ষতি হচ্ছিলো আমাদের সুখে? বলেই ডুকরে কেঁদে উঠল নিয়াজ।

নিয়াজ, শান্ত হ। টিয়া দিয়ার কথা ভাব ! তুই ভেঙে পড়লে ওদেরকে দেখবে?
সেজন্যই হয়তো বেঁচে আছি।
নিয়াজ, একটা কথা বলবো?
কী কথা?
তুই আবার বিয়ে কর। দেখ তোর কী হাল হয়েছে, টিয়া দিয়াকে কে দেখবে? ওদেরও তো মাতৃস্নেহ দরকার?
আমিওতো বলি ওদের মাতৃস্নেহ দরকার। একজন বাবা খুব চেষ্টা করলে বড়জোর একজন ভালো ও প্রিয়বাবা হতে পারে, কিন্তু একজন মা সে হতে পারে না। বিধাতা কেনো ওদের মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করল? বিয়ের কথা আমায় বলিস না আর। এক মুহূর্তের জন্যও রাইমাকে ভুলতে পারছি না। আমি রাইমার স্থানে কাউকে বসাতে পারবো না।

দেখ নিয়াজ, বাস্তবকে তো মেনে নিতেই হবে। আর বাস্তব এটাই যে রাইমা আর নেই, নেই মানে নেই,ফিরবেও না কোনদিন। ও এখন কেবল স্মৃতিতে আছে, আর স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটানো যায় না। জীবনের পথটা নেহাৎ ছোট না। টিয়া দিয়ার কথা ভাব, কে ওদের আগলে রাখবে মায়ের মমতা দিয়ে। টিয়া দিয়ারও একজন মা একজন ভালো বন্ধু প্রয়োজন।

হাহা, হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়াজের। নিজের মনেই হাসলো। ভাবছে মানুষ কত সহজেই অতীত ভুলে যায়। কত সহজে ওকে বিয়ে করতে বলছে।

হাসলি যে?
আচ্ছা আজমল, আজ যদি আমি মারা যেতাম, রাইমা থাকতো তবে তুই রাইমাকে কি এই একই কথা বলতি? বলতি ওকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে?
আজমল থতমত খেয়ে যায়। আক্রমণটা এভাবে আসবে সেটা ও একবারও ভাবেনি। কিন্তু আজমলও এত সহজে দমে যাবার পাত্র নয়।

সেক্ষেত্রে রাইমার ইচ্ছে বা প্রয়োজনটাই প্রাধান্য পেতো। রাইমা যদি মনে করতো ওর নিজের জন্য একজন সঙ্গী, একটা ভরসার জায়গা দরকার তবে সেটা রাইমা ঠিক করতো। রইল বাকী টিয়া দিয়া। টিয়া দিয়ার জন্য রাইমাই যথেষ্ট ছিলো যেটা তুই না। একজন মা খুব সহজেই বাচ্চাদের আগলে রাখতে পারে যেটা একজন বাবার জন্য সহজ নয়।
কেনো সহজ নয়? উন্নত বিশ্বে দেখ, ওদের বাচ্চারা ত নিজে নিজেই বড় হচ্ছে।
হা হা, এবার তুই হাসালি মোরে। আমাদের দেশটা উন্নত বিশ্ব নয়রে। আমাদের জীবন আমাদের দুঃখ দুর্দশা আমাদেরই রাষ্ট্র বা সমাজের নয়। এর দায় রাষ্ট্র নেবে না, কিন্তু ওদের সব দায় রাষ্ট্রের। আমরা এখনো আমাদের দেশকে সে স্তরে নিতে পারিনি, আর যতদিন না এটা পারছি ততদিন আমাদেরকে আমাদের মতো করেই ভাবতে হবে, বাঁচতে হবে।
আজমল যেনো ক্লাসে লেকচার দিচ্ছে, যেনো ওর সামনে ক্লাসভর্তি ছাত্র-ছাত্রী বসে আছে হা হয়ে।
এমন একটি দেশের স্বপ্নই তো আমরা দেখতাম!
থাক এসব কথা অন্য কথা বল। খালা খালু কেমন আছেন?
ভালো আছেন তবে তারা লিরাকে নিয়ে বেশ চিন্তায় থাকেন। খালাখালু চান লিরা বিয়ে করে সংসারী হোক, কিন্তু লিরার সেই একই কথা – ও বিয়ে করবে না।

লিরা কেনো এমন সিদ্ধান্ত নিলো? ও তো এমন ঘরণার মেয়ে ছিলো না,

নিয়াজ, আমি যদি ভুল না হই তবে লিরা তোকে আজও ভালোবাসে।
আজও ভালোবাসে মানে, কী বলছিস এসব? এই ভয়টাই নিয়াজ এতদিন মনের কোণে লুকিয়ে রেখেছিলো। এই ভাবনাটা যে নিয়াজের মাথায় কখনো আসেনি তা নয় তবে নিয়াজ খুব সাবধানে এড়িয়ে গেছে। নিজেকে হালকা, নির্ভার রাখার চেষ্টা করেছে সতত।
আজও ভালোবাসে মানে সেদিনও ভালোবাসতো আজও ভালোবাসে। তুই অন্ধ ছিলি তাই কিছু বুঝিসনি বা বুঝেও এড়িয়ে গেছিস।
প্লিজ আজমল। আমাকে এতবড় অভিযোগ দিস না।
তাছাড়া সেদিন যাকে বুঝিনি আজ তার কথা কেনো বলছিস ? আমি এতটা ছোট হতে পারব না, আর লিরাকেও অসম্মান করতে পারব না।

নিয়াজ, জীবনটা তিন ঘণ্টার সিনেমা নয় যে স্মৃতিচারণ করে ভালোবাসা আগলে রাখার অভিনয় করে কাটিয়ে দিবি। জীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই আছে আর সেটা আমার চাইতে তুই ভালো জানিস। আর সেই চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে একটা শক্ত হাত লাগে যাকে ধরে সমস্ত প্রতিকূলতা পার হওয়া যায়। তাছাড়া তোর কথা নাহয় বাদই দিলাম কিন্তু টিয়া দিয়ার দিকটা বিবেচনা কর। একজন মা’ই পারে সন্তানকে সঠিক গাইড দিতে। আজ হয়তো তুই এটা বুঝতে বা মানতে চাইছিস না, কিছুদিন যাক তারপর ঠিকই টের পাবি।

নিয়াজ মনেমনে হাসছে। কী অদ্ভুত পৃথিবী ! কত সহজেই মানুষ রিপ্লেসমেন্ট ঠিক করে নেয় ! আজমলের যুক্তিগুলো নৈমিত্তিক ! এর সাথে আবেগের কোনো সম্পর্ক নেই। এই যুক্তি, এই প্রয়োজনের বাইরেও যে একটা জগত আছে, যার নাম আবেগ, অনুভব, ভালোবাসা — সেই জগতে চাইলেই যখন-তখন হুটহাট কাউকে ঢুকিয়ে ফেলা যায় না আবার সেখান থেকে যখন-তখন টেনে-হিঁচড়ে কাউকে বের করে দেওয়াও যায় না। এখানে কারো শাসন, বারণ চলে না, এই সত্যটা অধিকাংশ মানুষই নিজের বেলায় বুঝে কিন্তু অন্যের বেলায় তা বুঝতে চায় না। তার আবেগ-অনুভব-ভালোবাসা সবটা জুড়ে রয়েছে রাইমা এটা আজমলও এখন বুঝতে চাইছে না।

সময় চলে গেছে আরো একবছর। এতদিনে নিয়াজও কিছুটা সামলে নিয়েছে নিজেকে। সময় এক বড় মহৌষধ। সব ক্ষত ভুলিয়ে দেয়। নিয়াজের শোকের নিঃসঙ্গতা কিছুটা কেটে গেছে আর সেই স্থান দখল করে নিয়েছে একাকিত্বের বিষণ্নতা।

প্রকৃতির এই এক শূন্যস্থান পূরণ খেলা, যেখানেই শূন্যতা পাবে সেখানেই বিকল্প কিছু দিয়ে তা পূর্ণ করে দিবে। রাইমা এখন সারাক্ষণ আর নিয়াজের চোখে বসে থাকে না। স্মৃতি থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছে যেনো। তবে ফিরে এসেছে নিয়াজের অবচেতনে, অভ্যাসে। আজকাল নিয়াজ রাইমার শূন্যতা অনুভব করে অন্যভাবে। অফিস থেকে ফিরে কারো একটু আদর, যত্ন আর ভালোবাসার টান অনুভব করে। বড্ড ক্লান্ত লাগে তখন।
মাঝেমধ্যে ঘুমের ঘোরেই বিছানায় হাতড়ে রাইমাকে খুঁজে। শূন্য বিছানা ! ধরফর করে উঠে বসে। দেয়ালে টাঙানো রাইমার ছবিটা তখন মুখটিপে হাসে, যেনো এটা লুকোচুরি খেলা আর নিয়াজকে বোকা বানিয়ে সে খুব মজা পেয়েছে।

আজকাল নিয়াজ যেখানেই যাক, আত্মীয় বন্ধু কলিগ, সবার মুখে একই কথা, ‘এবার নতুন করে কিছু ভাবো, আবার নতুন করে শুরু করো, টিয়া দিয়ার কথা ভাবো, জীবনে এমন কত দুর্ঘটনা ঘটে, তাই বলে কি জীবন থেমে থাকে? ব্লা ব্লা ব্লা…. ‘। আগে নিয়াজ বিরক্ত হতো, এখন এইসব কথাও গা সহা হয়ে গেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো মোস্ট অব দেম লিরাকেই ইন্ডিকেট করে। কোন একটা কথা যদি বারবার কাউকে বলা হয় তবে তা মিথ্যে হলেও সত্যি বলে মনে হয়, আর মনও যেনো সেই কথায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। এখন রাইমার কথা আর উঠতে বসতে মনে হয় না,যখনই মনে হয়, মনে হয় যে রাইমা আর আসবে না, সে যেনো দূরের কেউ ! যে কেবল নিয়াজের একাকিত্বকে দেখবে আর মজা নিবে, উপহাস করবে। যেনো নিয়াজকে একা ফেলে গিয়ে সে খুব জিতে গেছে। দূরে যেতে যেতে ঝাপসা হয়ে যায় রাইমার মুখ, তার পাশেই অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে একটা মুখ প্রত্যাশার মতো ফুটে ওঠে। আর সেটা লিরার মুখ। নিয়াজ নিজেকে সরিয়ে নেয় ভাবনা থেকে। তবে টিয়া দিয়াও ইদানিং ওদের মায়ের অভাবটা ফিল করছে। নিয়াজ তেমন সময় দিতে পারছে না কাজের চাপে। সেদিন ব্রেকফাস্টের সময় দিয়া তো বলেই ফেলল, আব্বু, তুমি একটা আম্মু নিয়ে এসো আমাদের জন্য। আম্মু আর আসে না কেনো? আমার আম্মুর কাছে যেতে ইচ্ছে করে। আমার সব ফ্রেণ্ডসদের তো আম্মু আছে, রোজ ওদের আম্মু ওদের স্কুলে নিয়ে আসে। আমার আম্মু আসে না কেনো? ‘নিয়াজ ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস গুম করে ফেলে ! হায় আল্লাহ্! এদের আমি কী করে বুঝাবো আর কী করেই বা বড় করবো? কিন্তু মুখে বলে অন্য কথা, ‘ মামনি! খাবার সময় এতো কথা বলে না, হ্যারি আপ, স্কুলে দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।

আব্বু, চলো আমরা এই উইকেন্ডে গ্রামে যাই লিরা ফুপিদের বাসায়? লিরা ফুপিকে নিয়ে আসি আমাদের এখানে। লিরাফুপির কাছে থাকতে আমাদের খুব ভালো লাগে। লিরা ফুপি আমাদের ইকটুও কষ্ট পেতে দেয় না,
তাই কি হয় মা? লিরাফুপির কাজ আছে না, জব আছে তো।

হাজারো প্রশ্ন আর বায়নায় নিয়াজ ক্লান্ত হয়ে যায়। এরই মধ্যে দিয়া ভিষণ অসুস্থ হয়ে যায়, জ্বর ঠাণ্ডায় একেবারেই যায় যায় অবস্থা। তিনদিন দিয়ার তেমন হুঁশই ছিলো না, হসপিটালাইজড হতে হয়েছিলো। সেই সময় নিয়াজের অফিস ছিলো না, নাওয়া খাওয়া কিছুই ছিলো না। যদিও নিয়াজের সৎমা ছিলো দিয়ার কাছে হসপিটালে তবুও তখন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে একজন বাচ্চার জন্য মা কতটা দরকারি। আর তখনই বারবার মনে হয়েছে লিরার কথা। নতুন করে আজমলের কথাগুলো কানে বাজে, ‘জীবনটা তিন ঘণ্টার সিনেমা না /জীবনে অনেক চড়াই-উতরাই আছে /প্রয়োজন একটা শক্ত হাত”। মানুষের মন, মনোজাগতিক ভাবনা বদলাতে কেবল একটা ঘটনা আর কয়েকটি সেকেণ্ডই যথেষ্ট ! মুহূর্তে নিয়াজ পাড়ি দেয় ভাবনার এক আলোকবর্ষ ! রাইমার স্মৃতি. আর লিরা, টানাপোড়েনে জয়ী হয় লিরা
সময় থেমে থাকে না, চলে নিজের মতো। টিয়া দিয়ার বায়নায় হোক বা ইচ্ছে করে হোক আজমলকে নিয়ে ওরা গ্রামে আসে একদিন। আজ আজমল নিয়াজকে বুঝিয়েছে। নিয়াজ যেনো লিরাকে কিছু বলে, নয়তো আজমলই বলবে।
বাচ্চারা লিরাকে পেয়ে খুব খুশি। নিয়াজ আর আজমল লিরার বাবামায়ের সাথে গল্প করছে।

লিরা চা করছে ওদের জন্য। একটা জড়তা, আড়ষ্টতা ঘিরে রেখেছে লিরাকে । লিরা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না আজ কেনো তার নিয়াজ ভাইকে দেখে এমন লাগছে ! কেনো সহজ হতে পারছে না তাদের সামনে? সেই পনেরো ষোল বছর আগের মতো সারা শরীর দিয়ে গরম ভাপ বেরুচ্ছে, শরীরের মাংস যেনো স্ফিত হচ্ছে, আর চামড়া তা আটকে রাখতে পারছে না, ওজন যেনো হঠাৎ করেই বাড়তে শুরু করেছে ! নিজেই অবাক হচ্ছে। কী অদ্ভুত ! কী হচ্ছে এসব ! কত রহস্য লুকিয়ে রেখেছে শরীর ! চায়ের ট্রে টি-টেবিলে রাখার সময় কি ইকটু বেশি জোরে শব্দ হলো? লিরা নিজেই সন্দিহান হচ্ছে বারবার।

কেমন আছেন নিয়াজ ভাই? ‘এই নিন চা’ বলে নিয়াজের হাতে চা তুলে দেবার সময় খেয়াল করেছে তার হাত কেঁপেছে।
কী রে লিরা? এখনো পার্শিয়ালিটি করবি? শুধু নিয়াজকেই জিজ্ঞেস করলি, আমি কেমন আছি জানতে চাইলি না তো।
ওহঃ আজমল ভাই ! তোমার সেই হিংসুটে স্বভাবটা যায়নি এখনো? বলেই হাসলো লিরা।
স্বভাব কি আর যায় রে ! স্বভাব হলো পুরোনো ভালবাসার মতো, শেষ হয়ে যায় না কখনো, কেবল ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে বুকের ভিতর !
লিরার ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল যেনো গরম তেলে পানি পড়লো ! আজমলের নিশানা অব্যর্থ। লিরার ঠিক জায়গায় লেগেছে। আরে আমি তো মজা করলাম।
তোমরা চা খাও, আমি ওদিকটা দেখছি বলেই লিরা যেনো পালিয়ে বাঁচলো।

নিয়াজ নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে অনেক, নিজেকে শতবার ভেঙেছে শতবার গড়েছে, রাইমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে হাজারবার। টিয়া দিয়ার সুস্থতার জন্য, সুন্দর, পরিপূর্ণ একটা পরিবেশ দেবার জন্য লিরাকে নিয়াজের দরকার। লিরার মত করে আর কেউ টিয়া দিয়াকে ভালোবাসবে না, আগলে রাখবে না। নিয়াজের নিজের জীবনে সৎ মায়ের স্মৃতি খুব যে ভালো তা নয়। তাই নিয়াজ আজমলের কথায় সায় দিয়েছে। কখনো কখনো ভালবাসার চেয়ে প্রয়োজনটাই বড় হয়ে যায়। লিরা নিয়াজের প্রয়োজন। তাছাড়া ইদানীং লিরার প্রতি একটা অদ্ভুত ফিলিং হচ্ছে নিয়াজের। মাঝেমাঝেই লিরার কথা, সেই আগের দিনগুলির কথা মনেপড়ে, আর তখন কোথা থেকে যেন একটা ভালোলাগার আবেশ এসে নিয়াজকে ঘিরে ফেলে। নিয়াজ জানে এটা ঠিক হচ্ছে না । সবাই নিয়াজকে লিরার কথা এতবার বলেছে যে বিষিয়টা তারও মস্তিষ্কে ঢুকে গিয়েছে।
লিরা ওর রুমে টিয়া দিয়াকে নিয়ে গল্প করছে, আসলে টিয়া দিয়াই কথা বলছে, লিরা কোনকিছুতেই মন দিতে পারছে না। নিয়াজ এসে টিয়া দিয়াকে আজমলের কাছে পাঠিয়ে দিলো ! লিরার আবার সেই পুরানো ফিলিংস, হাত পায়ের তালুতে যেনো আগুন ঝরছে। মনে হচ্ছে লিরার ভিতরে যেনো আরো দুটো লিরা ঢুকে গেছে। নিয়াজও প্রস্তুত, আজ কোনো ভণিতা নয়, কোনো ভয় নয়, লিরা যদি অপমান করে, সইবে, কটূ কথা বলে, মেনে নিবে। তার জন্য না হোক অন্তত টিয়া দিয়ার জন্য তাকে এটুকু স্বার্থপর, আত্মসম্মানহীন হতে হবে। আজ সে হেরে গেছে অতীতের নিয়াজের কাছে, রাইমার নিয়াজের কাছে।

লিরা তাকিয়ে আছে মেঝেতে যেনো মেঝে খুঁড়ে ভিতরে ঢুকে যাবে।
জানিস লিরা, বহুদিন টিয়া দিয়াকে এমন উচ্ছ্বাসিত হতে দেখিনি।
লিরা নিরুত্তর।
ওরা তোকে পেলে রাইমার অভাবটা ভুলে যায়,তোর মাঝে ওরা ওদের মায়ের মমতা, ভালোবাসা খুঁজে পায়।
আচ্ছা, তুই এখনো বিয়ে করছিস না কেনো?
কাউকে ভালোবাসিস?

জীবনে এই প্রথম নিয়াজ লিরার সামনে থতমত খাচ্ছে,কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না, কী বলছে তা সে বুঝতেও পারছে না, তাই উত্তর বা দাড়ি-কমার তোয়াক্কা না করে হড়হড় করে কেবল বলে যাচ্ছে।
লিরা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে, নিজেকে প্রস্তুত করে ভিতরে ভিতরে। সেদিনের লিরা আর আজকের লিরার মাঝে অনেক পার্থক্য। আজকের লিরা পুরুষের সমানতালে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে , কলিগদের সাথে বসে চা খায়,গল্প করে, চোখের দিকে তাকিয়ে বোর্ড মিটিং করে। হল ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে লেকচার দেয়। একটা সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা সে। কীভাবে গুছিয়ে কথা বলতে হয় তা সে জানে। তবু তার পা কাঁপছে, বুকের ভিতর ঝড় উঠেছে। লিরা জানে আজ তার জীবনের সবচাইতে কষ্টের দিন।

লিরা আমি তোকে কিছু বলতে চাই। কিন্তু কীভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। লিরা, আমি চাই তুই টিয়া দিয়ার দায়িত্ব নে ! তুই কি ওদের মা হবি?
হরহর করে কথাগুলো বলে নিয়াজ যেনো হতভম্ব হয়ে গেলো ! যদি লিরা ফিরিয়ে দেয় তাকে? যদি অপমান করে ? লিরা কি সত্যি আমাকে ভালবাসে? আমি কি লিরাকে ভালবাসি? আরো হাজারো ভাবনা দ্বন্দ্ব, আশঙ্কা তার মনে ভাসছে আর ডুবছে !

লিরা খুব শান্তভাবে মুখ তুলল, শান্ত অথচ ভীষণ ব্যথাতুর চোখে নিয়াজের চোখের দিকে তাকালো। লিরার চোখ মুখ ভেজা। ক্রমাগত পানি পড়ছে চোখ থেকে। ‘এরই নাম মনে হয় নিয়তির পরিহাস।
নিয়াজ ভাই, এ কথা সত্যি যে আমি টিয়া দিয়াকে খুব ভালোবাসি। আর এও সত্যি যে আপনি ছাড়া আমি আর কাউকে ভালবাসিনি, হয়তো আর কাউকে ভালোবাসতেও পারবো না। অবশ্য যা আমি ফিল করি তা ভালোবাসা কি না আমি জানিনা। একদিন আপনিই ছিলেন আমার ধ্যান আমার প্রেরণা। কিন্তু আমি খুব বোকা ছিলাম, না নিজের কথা আপনাকে বলতে পারলাম, না আপনার অবজ্ঞা বুঝতে পারলাম। আমি তো আপনার কাছে ছিলাম, কই সেদিন তো আপনি আমাকে ভালোবাসেননি? সেদিন আপনি বুঝার চেষ্টা করেননি আমাকে, কতোখানি ভালোবাসা উপচে পড়ছে চোখে তা চেয়েও দেখেননি । রাইমার সাথে যদি আপনার এফেয়ার থাকতো তাহলেও অন্তত আমি নিজেকে সেদিন কিছু একটা সান্ত্বনা দিতে পারতাম, আজ আপনার মনে হয়েছে যে টিয়া দিয়ার জন্য আমাকে প্রয়োজন ! নিয়াজ ভাই, টিয়া দিয়ার জন্য আপনার একজন মা প্রয়োজন আর আমার প্রয়োজন ছিলো আপনাকে। আমি মা হবার আগে আপনার মনের মানুষ হতে চেয়েছিলাম। অন্যের স্বামী সন্তান সংসারের রক্ষক আমি হতে চাইনি নিয়াজ ভাই। তাও আপনার ! অন্য কোথাও থেকে এমন প্রপোজাল এলেও বোধহয় আমি এতোটা অপমান অসম্মান ফিল করতাম না, যতোটা আজ করলাম। কারণ আমি জানি, আমাকে ভালোবেসে আপনি আসেননি এসেছেন টিয়াদিয়ার জন্য একটা নির্ভরতা, একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে ! কী ভাগ্য আমার দেখুন, ষোলো বছর যাবত যার জন্য ভালোবাসাকে বুকে চাপা দিয়ে রেখেছি, আজ তাকে কাছে পেয়েও গ্রহণ করতে পারছি না।
আমি একা চলতে শিখে নিয়েছি, আর ভালও আজীবন আপনাকেই বাসবো। কিন্তু আমায় ক্ষমা করবেন নিয়াজ ভাই, ভালোবাসাহীন একজন মানুষের সাথে একঘরে থাকতে পারবো না।’
নিয়াজ আহত হলো।বলতে চেয়েছিল বা মনেমনে বলল, ‘লিরা মনের ঘরে তুই প্রবেশ করেছিস আমার অজান্তেই, ভালোবাসারাও তোকে ঘিরে হেসে উঠে নিরবে নিরবে।’ কিন্তু কিছুই বলল না বা বলতে পারল না , চুপচাপ বের হয়ে এলো।

লিরা কাঁদছে অঝরে। ষোল বছরের উপেক্ষা, না পাওয়ার নিঃসঙ্গ বেদনারা আজ বেরিয়ে আসছে শোরগোল করে। লিরা আজ পেরেছে নিজেকে যথাযথ সম্মান দিতে।