ডুবে আছি আজও হিজলবনের মায়ায় ॥ তাহমিনা শিল্পী


বর্ষা এলেই দাদাবাড়ি যেতে মনে কেমন করতো।পানিতে ডুবে যাবার ভয়, সাপখোপের ভয় ইত্যাদি নানা কারণে মায়ের অসম্মতি থাকলেও বাবার সায় ছিল শতভাগ।অতঃপর সপরিবারে নৌকাযোগে রওনা হতাম দাদাবাড়ি।

তখন কুমার নদ বেশ বড় ছিল।বর্ষায় পূর্ণ হত কানায় কানায়।ভেসে বেড়াতো অসংখ্য এক মাল্লাই ছইওয়ালা নৌকা।আমরা তারই একটি রিজার্ভ করে নিতাম।মা-বাবা,ছোটবোন ছইয়ের ভিতরে বসলেও আমি থাকতাম ছইয়ের বাইরে।

আমাদের নৌকা স্রোতের তালে তরতর করে এগিয়ে চলত দাদাবাড়ির পথে।দুচারটে শুশুক পিঠ জাগিয়ে ঢেউয়ের দোলায় নেচে নেচে এগিয়ে চলতো আমাদের নৌকার দুই পাশে।যেন ওরা আমাদের গার্ড অব অনার দিচ্ছে।

নদীতে অনেক জেলে নৌকা থাকতো। জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরতো।জীবন্ত মাছগুলো জালে আটকা পড়ে কেবল ছটফট করতো।দেখে আমার ভারি মায়া হতো।পণ্য পরিবহনকারী বড়বড় নৌকা পাল তুলে চলে যেত দূরের বন্দরে।হাল ধরে বসে থাকা মাঝি মনের সুখে গাইতো গান।

নদীর দুই পাড়ে সারিসারি বাড়ি।সেখানকার বাচ্চারা নির্ভয়ে নদীর জলে খেলতো ডুব-সাঁতার। আর গাঁয়ের বধূরা, স্নান সেরে লাজুক বদনে বড়সর ঘোমটা টেনে ভরা কলশি কাঁখে ফিরতো বাড়ির দিকে।

নদীতে বেশ কিছুক্ষণ যাবার পর শুশুকগুলো আমাদের ছাড়িয়ে এগিয়ে যেতো।আমরা চলে যেতাম বামদিকে।সেখানে মিশেছে একটি খাল।সেটিও বর্ষার জল পেয়ে বেশ ফুলেফেঁপে উঠতো।

খালের একধারে কয়েকঘর কুমার সম্রদায়ের পরিবার বাস করতো।গাঁয়ের লোকেরা ওটাকে পালপাড়া বলত।পালপাড়ার পাশ দিয়ে যখন আমাদের নৌকা যেত কাঁচামাটির সোঁদা গন্ধে অদ্ভুত এক মাদকতায় মন ভরে যেত।

দুই ধারের সবুজ গাছের ছায়ায় খালে এগিয়ে যেতে দেখতাম কেউ ভেসাল পেতে মাছ ধরছে।কেউ খালের জলে কাপড় ধুঁইছে, কেউ আবার মেরামত করছে পুরনো সাঁকো।কোথাও কোথাও সাঁকো থেকে টুপটুপ করে জলে লাফিয়ে পড়ছে দুষ্টু ছেলে-মেয়ের দল।মূলত এসবই ছিল আমার ছোট্ট মনের আনন্দের উপকরণ।

দাদা বাড়িতে আমার সবচেয়ে প্রিয় ও আকর্ষণীয় স্থান ছিল পুকুরঘাট।আমার দাদার বাড়ি যে গ্রামে, সেখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নিজস্ব পুকুর আছে।আমাদেরও ছিল।বেশ বড় পুকুর,শান বাঁধানো ঘাট, প্রশস্ত পাড়।পুকুরপাড়ে সারিসারি হিজল গাছ,যা চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিল গোটা পুকুরটাকে।পুকুরের এক কোণে ছিল একটি বর্ষীয়ান কদমগাছ।আরেক কোণে বেতের ঝাড়।পুকুরের জলে ফুটে থাকতো থোঁকা থোঁকা কচুরিফুল।

যে কয়দিন দাদাবাড়িতে থাকতাম,প্রতিদিন ভোরবেলা আমি পুকুরপাড়ে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতাম।পায়ের নিচে অজস্র লালচে হিজলফুল ছড়িয়ে থাকতো।যেন আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে।কেমন যেন মায়ামায়া অনুভব।সে মায়ার পুলকে দুলেদুলে উঠতো মন।এইভাবে অনেকক্ষণ…..।

এরপর টোপর ভরে মাটির ডেলা কুড়াতাম।একগাদা ডেলা নিয়ে গিয়ে বসতাম পুকুরঘাট।জলের উপর ছড়ানো তখন আরেক স্বর্গীয় রূপ।

পুকুরের জলে হিজলফুল এমন ঘন হয়ে ভেসে আছে, যে কেউ দেখলেই এক মুহূর্তের জন্য হলেও রূপকথার দেশের লাল জলের সরোবর বলে ভুল করবে।আমি শাঁন বাঁধানো ঘাটে, জলে পা ডুবিয়ে বসতাম।তারপর একটা মাটির ডেলা জলের দিকে ছুড়ে মারতাম।ক্রমেই হিজল ফুলগুলো সরে গিয়ে বৃত্তাকারে ভেসে যেত।বৃত্তের মাঝখানে ফাঁকা হয়ে যেত।

খানিকক্ষণ পরেই আবার ফুলগুলো সব কাছাকাছি হতেহতে বৃত্ত ভরাট করে ফেলতো।আমি আরেকটি ডেলা ছুড়ে মারতাম।
এভাবেই…. তিনটে, চারটে,পাঁচটি…..দশটি….তারই সঙ্গে মেতে উঠে পুকুরজলের ছোটছোট তরঙ্গে রুমঝুম রুমঝুম সুর ছড়াতো আমার পায়ের নূপুর।বেতের ঝাড় থেকে বেরিয়ে আসত দূরন্ত ডাহুক।লম্বা লম্বা পা ফেলে কচুরিপানার ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছোটাছুটি করে গম্ভীর স্কুল টিচারের মতো কোয়াক কোয়াক বলে ডাকতো।

এভাবেই, একান্তে হিজলফুলের সাথে জলের সাথে খেলতে খেলতে গড়িয়ে যেত কিছু মগ্ন সকাল,দুপুর ও বিকেল…. আহা! কী মায়া! সেই সকাল দুপুর ও বিকেলগুলোকে থমকে দিতে পারলে বেশ হতো।