অনূদিত গল্প ॥ ইন্সতিতুতো ন্যাসিওনালে


অলঙ্করণ: লংরিড

গল্প: ইন্সতিতুতো ন্যাসিওনালে
গল্পকার: আলেহান্দ্রো সামব্রা
ভাবান্তর: নাসরিন জে রানি

আগেই সরি বলছি, কারণ আজকের গল্পের মূল চরিত্রের পুরো নাম বা তার ডাক নাম কিছুই আমার মনে নেই। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। স্যাররা আমাদের নাম না ধরে বরং রোল নম্বর ধরেই কথা বলতেন, পড়া নিতেন। এই কারণেই আমার দুই তিনজন ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ছাড়া অন্যদের নাম আমি জানতাম না। আজকের গল্পের মূল চরিত্রের মানুষটা আমার বন্ধুদের কেউ ছিলো না।

কিন্তু আমার খুব ভালোভাবেই মনে পড়ছে, তার রোল নম্বর ছিলো ৩৪। তার কথা আমার যেমন প্রায়ই মনে পড়ে, কেন যেন আমার মন বলে- সেও আমার কথা ভুলে যায়নি। আমাদের ক্লাস সেভেনে মোট ৪৫ জন ছাত্র ছিলো, এবং আমার রোল নম্বর ছিলো সর্বশেষ।

স্যাররা আমাদের রোল কল করেই প্রতিদিনের হাজিরা খাতাটা বন্ধ করে রাখতেন। ক্লাসের সর্বশেষ ছাত্র হওয়ার একটা অন্যরকম মজা তো আছেই। শুরুর দিকের কেউ না হলেও ১৫ বা ২৭ এর মধ্যবর্তী কোনো রোল নম্বরের সাথে যদি তুলনা করি, আমার কাছে আমার নম্বরটাই ভালো লাগে।

রোল নম্বর ৩৪ যার, সে ছেলেটার কথা প্রথমেই আমার যা মনে পড়ছে, তা হলো- টিফিন পিরিয়ডে খুব যত্ম করে টিফিনবক্স খুলে সে গাজর খেতো। বক্সের ভেতরের দৃশ্য দেখতে দারুণ মনোরম, ভালো লাগত আমার। গাজরগুলোর আবরণ ছিলে সুন্দর টুকরো করে কেটে, বক্সে সাজিয়ে নিয়ে আসত সে, কাজটি হয়তো ছেলেটার মাই করে দিত। খাবারের জন্য টিফিনবক্সটা হাতে নিয়ে খুব সাবধানে চাপ দিয়ে সে বক্সের উপরের কভারটা খুলতো; এই কাজটিতে ছেলেটা এতটা নিপুণ ও দক্ষতা লাভ করেছিলো যে, সে জানত কতটুকু চাপ দিলে উপরের ঢাকনাটা সুন্দর করে খুলে আসবে। তার ভাব দেখে মনে হতো, সে যেন দারুণ কোনো কলা অনুশীলন করছে। কিন্তু দক্ষতার সাথে টিফিনবাটি খুলে গাজর খেলেও সে বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করে ক্লাস সেভেনে থেকে যাওয়া পুরনো ছাত্রদের একজন।

ফেল করে একই ক্লাসে আবার পড়ার ব্যাপারটা আমাদের জন্য প্রচণ্ড খারাপ একটা ঘটনার মতন। তখন আমরা কিশোর ছিলাম, আমাদের সেইসব দিনের শিক্ষা ও জীবনকালের ছোট্ট দিনগুলোতে কখনোই ওই ধরনের ব্যর্থতার মতো কিছুর স্বাদ নেওয়া তো দূরের কথা, ওই রকমের কিছুর মুখোমুখিও হইনি।

শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত স্কুলটাতে ভর্তি হয়েছিলাম আমরা। তাই আমাদের মেধা ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা এবং প্রশ্ন উত্থাপনের কোনো চান্সই ছিলো না। কিন্তু আমাদের শ্রেণিতে ছিলো ওই ছেলেটি, যার রোল ৩৪। আমাদের সাথে তার নিত্য চলাফেরা ও অধ্যয়নের কারণে আমাদের মনে একটা ভীতির সৃষ্টি হলো- যে কেউই ব্যর্থ হতে পারে। এমন কি সেই পরাজয় সহ্য করে, সামনের দিকে পথচলা হয়তো তেমন কঠিন কোনো সমস্যা নয়। আমাদের এই ভীতির মূলে ছিলো- ওই ছেলেটির হাবভাব, সে তার ব্যর্থতাকে কলঙ্ক হিসেবে না নিয়ে, বরং তা নিয়ে গর্ব করার মতন একটা ঘটনা যেনো, সেভাবেই নির্বিকার থেকে এবং একই ক্লাসের বইগুলো আরেকবার পড়ার সুযোগ পেয়েছে, তাই সে যেনো খুব আনন্দিত, এই রকমের কিছুই প্রকাশ করত। প্রায়দিনই কোনো-না-কোনো ক্লাসের স্যাররা তাকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলত ‘তোমার মুখটা বেশ চেনা চেনা লাগছে।’ রোল নম্বর ৩৪ বিনয়ের সাথে জবাব দিত, ‘জি স্যার। এই ক্লাসে গত বছর ফেল করে থেকে যাওয়া একমাত্র ছাত্রটি আমি। কিন্তু এবার আমি অবশ্যই পাস করব এবং আগের তুলনায় ভালো রেজাল্টও করব’।

স্কুলে ভর্তির প্রথমার্ধের মাসগুলোতে আমরা বলতে গেলে প্রচন্ড নরক যন্ত্রনার ভেতর দিয়ে সময় অতিক্রান্ত করছিলাম, স্যাররা যতক্ষন ক্লাস নিত, তাদের পাঠদান পদ্ধতি ও ব্যবহার দিয়ে আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিত- এই রকমের স্বণামধন্য মাধ্যমিক স্কুলটিতে পড়ালেখা করাটা কতটা কঠিন কাজ, এরচেয়ে বরং আমরা যদি নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে শুনে পাড়ার সাধারণ স্কুলে ফিরে যাই, তাহলে পড়ালেখাটা এত কঠিন মনে হবে না। এই রকমের পরামর্শ স্যারদের কেউ না কেউ প্রতিদিনই দিতে লাগল।

কথাগুলো তারা খুব তাচ্ছিল্যের আর অবজ্ঞা ভরে হাসতে হাসতে উপহাসের ছলে বলত। কিন্তু তাদের কথাগুলোর মর্ম বা প্রকৃত অর্থ আমরা ভালো বুঝতে পারতাম না। এবং এসব শুনে শুনে আমাদের মনে ভীষণ ভয় ঢুকে গেল আর ত্রাসের সৃষ্টি হলো।

এতটুকু তো বোঝাই যাচ্ছে, তখনকার স্যারগুলো সত্যিকার অর্থেই ছিল এক একটা ইবলিশ শয়তান। তাদের নামগুলো আমরা ভালোভাবেই জেনেছিলাম। যেমন- অংক স্যার বেরোনার্দ এগুইরো ছিলো একটা আস্ত পিশাচ, খানকির পোলা। কারিগরি শিক্ষা ক্লাসের স্যার এদুয়ার্দো বেনেগাস ছিলো একটা চুতমারানির পুত।

সেইসব বহু পুরনোদিনের স্মৃতি এবং ওই স্কুল থেকে বেড়িয়ে আমরা দূরের বিভিন্ন শহরে চলে এসেছি। স্যারদের আর আমাদের মাঝে ভৌগলিক দূরত্ব বিস্তর এখন, কিন্তু ওই স্যারদের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে একবিন্দুও কমেনি আমার। তারা ছিলো নিষ্ঠুর এবং কসাই চরিত্রের, হতাশাগ্রস্ত, শয়তানের চেলা ও বলদের হাড্ডি, স্বৈরশাসক পিনোচিতের দোসর, বান্দি মাগীর পুত ও প্রচণ্ড ডরপুক।

তবে আজকে আমি এইসব কুত্তা ও বেশ্যার পোলা স্যারদের নিয়ে গল্প বলতে আসিনি। আমি প্রমিজ করছি, আপনার কাছে, ওদের নিয়ে আর কোনো কথাই বলব না, বরং টিফিন বাটি খুলে মজা করে গাজর খাওয়া এবং আগের বছর ফেল করে একই ক্লাসে থেকে যাওয়া আমাদের একমাত্র ক্লাসমেট রোল নম্বর ৩৪ কে নিয়ে আলাপ ও স্মৃতিটুকু বলে যাব।

রোল নম্বর ৩৪ এর হাবভাব ঠিক ফেল্টুস ছাত্রদের মতন ছিলো না। সাধারণত ধারণা করা হয়, এই ধরনের ফেল করা ছাত্ররা ক্লাসের অন্যান্যদের সাথে মিলতে চায় না, বন্ধুত্ব হয় না এবং তাদের পড়ালেখায় কোনো আগ্রহ নাই। কিন্তু এই ছেলেটা ভিন্ন স্বভাবের ছিল, সে আমাদের সাথে গল্প করতে ভালোবাসত এবং যেকোনো ব্যাপারেই সাহায্য করতে এগিয়ে আসত। কিন্তু এরপরেও মাঝে মাঝে তাকে দুঃখী মনে হতো, যখনই ক্লাসের আগে বা পরে তার পূর্বের ক্লাসের কারো সাথে দেখা হতো, হয়তো তারা তার সাথে মিশতে চাইত না, এড়িয়ে যেত তাকে। তাই মনে হতো আমাদের সেই সময়গুলোতে- ফেল্টুস ছাত্রদের মাঝে এক ধরনের মানসিক যন্ত্রণা থাকে, তাদের এই দুর্ভোগের পেছনে দায়ী যারা তার সাথে এক ধরনের বিরতিশূন্য যুদ্ধে লিপ্ত থাকে তারা, যেন ঘৃণা আর ঘৃণা নিয়ে দিনগুলো কাটে। কিন্তু এসব ব্যপারগুলোর খুব সামান্যই আমরা ওই ফেল্টুস ছেলেটির মাঝে দেখতাম, সে যেন ভুলেই যেত- সে একজন ফেল করা ছাত্র, সে যে নতুনদের সাথে একই ক্লাসে দ্বিতীয়বার পড়ছে। সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য লাগত, এই ভেবে- সে কোনদিন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করত না এবং কাউকে হিংসা করত না। সে আমাদের তেমন ভালো বন্ধু না হলেও, আমাদের জন্য মাঝে মাঝে স্যারদের সাথে কথা বলত, যখন স্যাররা আমাদের নিয়ে অতিরিক্ত ঠাট্টা করত। রোল ৩৪ এর সেসব আলাপ ও কথাবার্তাগুলো ছিলো বেশ মজাদার ও প্রাণবন্ত, যেন স্যারদের সে ভয়ই পেত না এবং খুব বন্ধু কেউ ভাবত। এইদিকে যেসব স্যাররা তাকে ফেল করিয়ে দিয়েছিলো, তাদের সাথেও সে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কথা বলত ও মান্য করে চলতো।

রোল নম্বর ৩৪ যতবারই তার বিচিত্র মেধার পরিচয় দিত, সেই সবকিছু দেখে দেখে আমরা ভয় পেতে পেতে হীনমন্য হয়ে যেতে থাকলাম। সে কখনোই তার জ্ঞান জাহির করত না, বরং বিচিত্র উপায়ে তার চিন্তা-ভাবনাকে প্রকাশ করত এবং বিবিধ বিষয় নিয়ে শলা-পরামর্শ দিতো। সে এমন সব সমস্যা ও বিষয় নিয়ে আলাপ করতো, যা পাঠ্যবইয়ের কোনো চ্যাপ্টারে নেই। এই কারণে আমাদের কাছে সে একজন শ্রদ্ধার পাত্র ও জ্ঞানী এবং বিস্ময়কর কেউ ছিলো। তার এই ক্ষমতাটুকুতে আমাদের চমৎকৃত হওয়ার ব্যাপারটাই আমাদের জন্য কাল হয়েছিল। কারণ, আমরা সারাক্ষণ ভাবতাম, তার মতন মেধাবী ও জ্ঞানী ছাত্র যদি ফেল করে, তবে আমরা যেকেউ এই রকমের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারি।

তার অগোচরে তার ব্যর্থতার বিষয়টা নিয়ে আমরা কারণ অনুসন্ধানে জন্য আলোচনায় মেতে উঠলাম। তাকে নিয়ে গুজব ছড়িয়ে ছিলো- সে হয়ত পারিবারিক কোনো সংকটের কারণে ফেল করছে অথবা বার্ষিক পরীক্ষার আগে আগে কোনো বড় অসুখে পড়েছিল, তাই সে ফেল করেছে। ভালোমত পরীক্ষা না দেওয়ার কারণে, এবং এই ধরনের খারাপ ভাগ্যের শিকার হয়েছে। কিন্তু গুজবকে পাত্তা না দিয়ে বরং পাশ কাটিয়ে আমরা সত্যিটাও সবাই জানতাম যে, তার ব্যর্থতার মূলে অন্যকোনো কিছুই নয় বরং সম্পূর্ণভাবে পড়াশোনা সংক্রান্ত ব্যাপার। এটাও আমাদের মনে ভয় হিসেবে প্রবেশ করে গেড়ে বসল যে, দুইদিন বাদে আমরাও হয়ত তার মতন দুর্ভাগা ও ব্যর্থ ছাত্রে পরিণত হবো।

একদিন পেছনের এক বেঞ্চে তার পাশের সিটে বসেছিলাম আমি। অন্য কোথাও জায়গা না পেয়ে, সেইদিন কোনো কারণে তার মন ভালো ছিল। তাকে দেখে সুখী মনে হচ্ছিল। সে যেন আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। বারবার তাকাতে লাগলো আমার মুখের দিকে। কিন্তু কিছু না বলে বেশ দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলো। দুটো ক্লাসের শেষে পরের ক্লাসের স্যার আসার কিছুক্ষণ আগে সে হঠাৎ করে, ফিসফিস করে হাসিমুখে বলে উঠল-‘তুই দুশ্চিন্তা করিস না, ম্যালাদিন থেকে তোর ওপর আমি নজর রেখেছি, আমি নিশ্চিত যে, তুই পাস করবি’।

রোল ৩৪ এর মুখে এইসব কথা শোনা আমার জন্য স্বস্তিদায়ক একটা ব্যাপার হলো। আমি অনেক হালকা অনুভব করলাম আর সাথে সাথে ভীষণ খুশি হলাম। আমার খুশির মাত্রা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলো। ক্লাসে স্যার থাকার পরেও আমি বেশ জোরে কথা বলছিলাম এই বেঞ্চ থেকে ওই বেঞ্চের বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমি করে। আর থেকে থেকে হেসে উঠছিলাম। যা পুরো ক্লাসের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল। আমার কাছে রোল ৩৪ ছিলো একজন অদ্ভুত ও বিস্ময়কর বালক। তার অভিজ্ঞতা ও মেধার প্রকাশ দেখে দেখে প্রতিবারই আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। তাই এরকম একজনের মুখে আমার ভবিষ্যৎ ভাগ্য-লাভের ব্যাপারে আশ্বাস পেয়ে আমি খুব সুখী হয়েছিলাম। টিফিনের পরে আশেপাশের পরিচিত ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে ঘিরে রাখল এবং আমার ও রোল নম্বর ৩৪ এর মাঝের কথোপকথনের ব্যাপারে পুরো ক্লাস জেনে গেল।

এই ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যে ক্লাসের অন্যান্য সহপাঠীরাও এই বিস্ময় বালকের কাছে তাদের ভাগ্যরেখা ও সাফল্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিয়েছিল। এক সময়ে একটা সন্দেহ ও সোরগোল উঠল যে, রোল ৩৪ আসলে আমাদের সবাইকে মুরগি বানিয়ে মসকরা করেছে। কিন্তু এইখানেই থেমে না থেকে প্রচুর আলোচনা ও তথ্য বিশ্লেষণের পরে আমরা বুঝতে পারলাম, এই ফেল্টুস ছাত্রটি আসলে আমাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারের জন্য এক ধরনের একটা ঘটনা ঘটিয়েছে, এবং এইটা মজার খেলা হিসেবে চালিয়ে গেছে সে।

তার এই উপকারটুকু আমার কাজে লেগেছিল, এতে আমাদের সবার আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল ভীষণ রকম। কারণ আমরা সকলেই অত্যন্ত জটিল এক মানসিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করছিলাম, স্যাররা প্রতিনিয়ত আমাদের অসহ্য মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রাখত, এবং এইসব কারণে আমাদের সবার সাময়িক পরীক্ষার ফলাফল ছিলো ভীষণ বাজে, আমরা সবাই খুব খারাপ একটা অবস্থার মধ্যে ছিলাম, কারো অবস্থাই আশাজনক ছিলো না। সকলে মিলে যেন, সবচেয়ে বড় জাহান্নামের গলিতে প্রবেশ করার যাত্রী হয়েছিলাম।

ক্লাসের ভেতরে প্রচণ্ড আগ্রহের সাথে খোঁজখবর করা হলো- রোল ৩৪ কি সবাইকেই তার ভবিষ্যৎবাণী শুনিয়েছে, নাকি বিশেষভাবে পছন্দ করা গুটি কয়েক সহপাঠীকেই তাদের নিয়তির পূর্বাভাস দিয়েছে?

যারা তখন পর্যন্ত রোল ৩৪ এর ভবিষ্যৎবাণী লাভ করেনি, তারা বেশ ভড়কে গেল। সবচেয়ে দুশ্চিন্তিত ও ডরপুকদের মাঝে অন্যতম ছিলো ৩৭ বা ৩৮ রোল নম্বরধারী (তার রোল নম্বরটা এই দুটো সংখ্যার একটি হবে, আমার নিশ্চিতভাবে মনে নেই), যাই হোক- ভয়ে আধমরা হয়ে, চূড়ান্ত পরাজিত মনোবল নিয়ে, সহ্য করতে না পেরে একদিন সে রোল ৩৪ কে ডেকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল- সে পাস করতে পারবে কি-না?

তার এই আচানক জিজ্ঞাসায় রোল ৩৪ কিছুটা অবাক হলো এবং বিব্রতবোধ করতে লাগল। কিন্তু মনোভাব লুকিয়ে সাথে সাথে স্বাভাবিক একটা মুখ করে বলল, ‘ক্লাসে তোমাদের সবাইকে সেভাবে লক্ষ্য করার সুযোগ পাইনি, আমি সবার দিকে সমানভাবে মনোযোগ দিতে পারিনি। সত্য কথা বলতে কি, তোমার ব্যপারে সেভাবে খেয়াল করতে পারিনি আমি, আমাকে মাফ করে দিও। আর তোমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাকে কতাদিন সময় দাও। তার এই রকমের বিনয়ী কথাবার্তা শুনে কেউই সন্দেহ করতে পারল না যে, সে দুষ্ট,মিথ্যেবাদী কিংবা প্রতারক, তার আচরণ মোটেই সে ধরনের নয় বরং তার কথাবার্তায় যথেষ্ট আগ্রহ ও সরলতার আভাস ছিলো। তার কথাগুলো নিয়ে সন্দেহ করার কোনো সুযোগই নেই। সে তার স্বভাবসুলভ সারল্য থেকেই আমাদের চোখে চোখ রেখে আলাপ করত, কথা বলত, তার প্রতিটি বাক্যের মধ্যেই নতুন কিছু না কিছু বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ছিলো অথবা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় থাকত।

তার কথায় যেন আমাদের জীবনের স্থবির সময়ের মাঝে এক ধরনের ঘণ্টাধ্বনির মতো ঝনঝন করে কিছু বেজে ওঠার মতন একটা ব্যাপার ঘটতো।

একজন ভীতু সহপাঠী যার রোল ছিলো ৩৭ (কিংবা ৩৮), তাকে রোল ৩৪ যে কথাগুলো বলেছিলো- ক্লাসে তোমাদের সংখ্যা অনেক এবং আমি সবার দিকে মনোযোগ দিতে পারিনি, সেভাবে খেয়াল রাখতে পারিনি। – এরকম কথা শোনার পর কেউ আর তার ব্যাপারে ভুলভাল খারাপ কিছু ভাবেনি। আর রোল ৩৪ এর কথাগুলো সবসময় গঠনমূলক ও গোছানো হয়ে থাকে। এবং তার বাচনভঙ্গিটি অদ্ভুত ধরনের। মজার ব্যাপার হলো- নিত্যদিন তার আলাপ শুনে শুনে আমরা ভাবতে শুরু করলাম যে, অদ্ভুত স্টাইল ছাড়া কোনো বস্তুনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা বলা সম্ভব নয়।

বেশিদিন অপেক্ষা করতে না পেরে রোল ৩৭ (বা ৩৮) একদিন রোল নম্বর ৩৪ কে তার ব্যাপারে কি বোঝা গেল, প্রশ্ন করলে, ৩৪ সে উত্তর এড়িয়ে গেল। অথবা বিরত থাকল, অন্যকিছু নিয়ে আলাপ শুরু করল, ভবিষ্যৎবাণী করল না। তার এই চেষ্টা দেখে আমাদের মনে হলো- সে কষ্টদায়ক কোনো সত্য লুকানোর চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপের শেষে সে রোল ৩৭ (বা ৩৮) কে বলল, ‘আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দাও, আমি এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলার মতন সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারিনি।’

আমরা ধরে নিলাম এই ডরপুক ছেলেটা ফেল করবে। তবে পরীক্ষার কিছুদিন আগ দিয়ে আমাদের সবাইকে বিস্মিত করে, আমাদের প্রিয় বিস্ময় বালক ভবিষ্যৎবক্তা, ওই ডরপুক রোল ৩৭ (অথবা ৩৮) কে ডেকে বলল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি, তুই পাস করবি। আমি তোকে খেয়াল করেছি। এবং আমি নিশ্চিত যে, তুই পাস করবি।’

আমাদের সবার আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে গেলো, ক্লাসের সবাই আলোকপ্রাপ্ত হয়েছি তাই, এই জ্যোতিষীর দ্বারা, তবে তখনও একটা উটকো খটকা মনের কোথাও ঠুকরে চলছে, সেটা হলো ক্লাসের সবাই একযোগে পাস করে যাওয়া কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। প্রচুর অনুসন্ধানের পরে আমরা জেনেছিলাম, এই স্কুলের শত বছরের ইতিহাসে সপ্তম শ্রেণির ৪৫ জন ছাত্রের মাঝে সবাই নিরঙ্কুশ ভাবে পাস করে পরের শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার মতন কোনো ঘটনা ঘটেনি ইতোপূর্বে।

পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে, দিনরাত একাকার করে পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম। তবে, এর মাঝেও মনে মনে আমরা রোল ৩৪ এর ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কে বেশ খানিকটা সন্দেহ করতাম। সে আমাদের হাবভাব দেখে, বিষয়টা আন্দাজ করে ফেলেছিল, কিন্তু আমাদের এই ঠুনকো দ্বিধাকে সে পাত্তা দিত না, এরচেয়ে বরং টিফিন বিরতিতে খুব মজা করে গাজর চিবুতে লাগল প্রায়দিন এবং সময়ে সুযোগে যখন যাকে বাগে পায়, তার সাথেই তার আকর্ষণীয় ও ব্যতিক্রমী ত্বাত্তিক আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যেতে লাগল। পরীক্ষা নিকটবর্তী হওয়ায় আমাদের শ্রেণিকক্ষের সামাজিক মেলামেশায় সামান্য ভাটা পড়েছিল, কিন্তু সে এর মধ্যেই সবার কুশলাদি জিজ্ঞেস করে জেনে নিত, কার কি হাল এবং কি ধরনের অবস্থায় আছে সবাই, তা জানতে তার আগ্রহের কমতি ছিল না।

এভাবেই খুব দ্রুত সময় ফুরিয়ে গিয়ে বার্ষিক পরীক্ষা এসে হাজির হলো। পরীক্ষা শেষে যথাসময়ে স্কুল খুললে, রেজাল্ট হাতে পৌঁছুলে দেখা গেল- রোল নম্বর ৩৪ এর ভবিষ্যৎবাণী যথেষ্ঠ সঠিক ছিল। আমাদের চারজন সহপাঠী তীরে না পৌঁছেই সলিল-সমাধির কোলে ডুবেছেন, এর মধ্যে রোল ৩৭ (অথবা ৩৮) সহ চারজন ছাত্র ছিলো, যারা পরীক্ষাই দেয়নি। বাকি ৪১ জনের মাঝে ৪০ জন পাস করেছিল, ফেল করে ক্লাসে থেকে যাওয়া একমাত্র ছাত্রটি এবারও আর কেউ নয় বরং আমাদের ভবিষ্যৎবক্তা সেই রোল ৩৪।

রেজাল্ট হাতে পেয়ে আনন্দ শেষে আমরা তার কাছে গেলাম, তাকে সামান্য শান্ত্বনার বাণী শোনাতে। তাকে ভীষণ দুঃখী দেখাচ্ছিল কিন্তু সে নিরব হয়ে বসেছিলো অনেকটা সময় এবং আমাদের কথা শুনেও সে কোনো আহাজারি করছিলো না। একটা সময় সে মুখভাব স্বাভাবিক করে, আমার চোখে চোখ রেখে বলল- এবারও আমি ভিন্ন কোন ফলাফল আশা করিনি। পড়াশোনা একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ, আমি অত মেধাবী নই, এত ভালো স্কুলে আমার থাকা আর ঠিক নয়, আমি বরং অন্য স্কুলে গিয়ে পড়লে, এরচেয়ে ভালো ফল লাভ করতে পারব। কথায় আছে, সোজা পথে চলে সমাধান না পেলে, পথ সামান্য পরিবর্তন করে, ঘোরা পথে যাওয়াই উত্তম। এখন আমার পথ পরিবর্তনের সময় এসে গেছে।

রোল ৩৪ কে হারিয়ে আমরা সবাই দুঃখ পেয়েছিলাম। এত দ্রুত তার সাথে বিচ্ছেদ আমরা কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। তবে পরের সপ্তাহে নতুন বছরের প্রথম ক্লাসে আমরা আবার তাকে দেখতে পেলাম। আমাদের সহপাঠী নয় সে আর, বরং সে আবারও সপ্তম শ্রেণির ছাত্রদের সারিতে এবং সেই পুরনো ক্লাসেই বসেছিল। যদিও আমাদের স্কুলে ফেল করে একই ক্লাসে দুই বছর থেকে যাওয়ার কোনো নিয়ম নেই এবং এসব ক্ষেত্রে ফেল করা ছাত্রদের প্রমোশন দিয়ে পরের ক্লাসের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু রোল ৩৪ এর ক্ষেত্রে আমরা সেই নিয়মের প্রয়োগ দেখলাম না। আমরা শিখেছিলাম, a burnt child always fear fire, অথবা গাছের দশটা ফল থেকে পাতের একটাই ভালো। আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে রোল ৩৪ আবারও একই ক্লাসে আরেকটি নতুন বছর কাটিয়ে দিতে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগল।

একদিন টিফিন বিরতিতে, তার কথা মনে হলো, গেলাম তার ক্লাসে তাকে দেখতে। বন্ধুত্বসুলভ নরম মনে তার সাথে মিশতে চাইলাম, সেও যথেষ্ঠ ভালো ব্যবহার করেছিল, তাকে আগের তুলনায় রোগা লাগছিল এবং চেহারা মলিন হয়ে গেছে।

এই ক্লাসের নতুন সহপাঠীদের তুলনায় তাকে বেশ বয়স্ক লাগছিলো। এবং এই পার্থক্যটা খুব বেশি দৃষ্টিকটু লাগছিল। বেশ অনেকটা সময় চলে গেল যখন, আমার ফিরে আসার কিছুক্ষণ আগে, সে তার স্বভাবসুলভ হাসিমুখে বলে উঠল, আমি এখন আর রোল ৩৪ নই। আমার কথা মনে রেখেছো তাই তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তবে তোমাদের সেই প্রিয় বন্ধু রোল ৩৪ বলে আর কেউ নেই, আমি এখন রোল ২৯ এবং এই ক্লাসের ছাত্রদের সহপাঠী; এই নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতেই হবে আমাকে। তোমাকে আমার মনের কথা বলছি, এই ক্লাসে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে নতুন নতুন বন্ধু তৈরি করা আমার কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অতীত নিয়ে পরে থেকে কি লাভ বলো।

তার কথা আমি সবসময় মুগ্ধ হয়েই শুনেছি। আজো মেনে নিলাম তার যুক্তিগুলো। বিদায়বেলায় সুন্দর হাসি বিনিময় করে যে যার ক্লাসে ফিরে এলাম। মাঝে মাঝে দূর থেকে দেখতাম সে তার নতুন সহপাঠীদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে, বা স্যারদের সাথে কথা বলছে। আমার যতদূর মনে আছে, ওই বছর সে পাস করেছিল, কিন্তু তাকে সেভাবে আর দেখতে পাইনি অনেকদিন। হয়তো আমাদের স্কুল ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলো সে। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পথ পরিবর্তন করে সাফল্যের দেখা পেয়েছিলো সে, সৌভাগ্য ধরা দিয়েছিলো তার কাছে, কারণ সত্যিকার অর্থে সে একজন মেধাবী ও গুণী ছাত্র ছিল।