আমার বৃষ্টির দিনগুলি ॥ অলোক আচার্য


বর্ষা মানে রিমঝিম বৃষ্টি। বর্ষা মানে বাঙালির আবেগ, প্রতীক্ষা,অভিমান সব। অন্যসব ঋতুর চেয়ে বর্ষা আমার কাছে একটু আলাদা। এটা কেবল ঋতুগত বৈশিষ্ট্যের কারণেই নয় বরং অন্য কোনো কাকতালীয় কারণে।

বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে আমার বর্ষাপ্রীতি বাড়তে থাকে। আমার প্রথম প্রেমকাহিনি রচিত হয়েছিল এক বর্ষার বৃষ্টির রাতেই। বর্ষার বৃষ্টির সাথে অন্য সময়ের বৃষ্টির পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্য হলো বর্ষায় বৃষ্টির জলের সাথে ভেসে যায় কদমের রেণু। যা অন্য সময় থাকে না। তো কলেজে পা রাখলে একটু বড় বড় মনে হয়। একটু উদাসীনতা ভর করে মনে।আর খুব স্বাভাবিক ভাবেই মনে রোমান্টিকতা জন্ম নেয়।মনে মনে দু এক লাইন যে কবিতা চলে আসে না তাই বা কি করে বলি।

আমাদের ঘরে টিনের চাল দেওয়া । ফলে বৃষ্টি এলেই সেই চালে রিমঝিম শব্দ হয়। এটা এখনো আছে। এই মিউজিকটাকে আমার এত ভালো লাগে মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজেই কোনও বিনা হাতে শব্দ তরঙ্গ তুলছে। আমি মুগ্ধ। পাকা ছাঁদে আর যাই হোক বৃষ্টির শব্দের নিপুণ ঝংকার শোনার উপায় নেই ।

অনেক সময় ঠিক বোঝাই যায় না । তবে আজ সময় বদলেছে। আশেপাশের ডোবা সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকিতির সাথে বৃষ্টির সেই রুপ মনে হয় হারিয়ে গেছে। আপনার হয়তো আমার সাথে একমত হবেন যে ইট কাঠ ঘেরা এই শহুরে বৃষ্টি আর ডোবা পানা পুকুরে বা ধান ক্ষেতে পড়া বৃষ্টি দেখতে একটু ভিন্ন বা আমি বলবো এর স্বাদটাই আলাদা।

হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে দেওয়া আমার অভ্যাস। বৃষ্টির ধারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। কারো জন্য কয়েক যুগ অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হয়। এখন বৃষ্টি এলে কাগজের নৌকা বানিয়ে জলে ভাসাতে পারিনা। এখন যে আমি বড়। বর্ষার আকাশ আমাকে ডাকে। দু এক কলম লিখেও ফেলি। আমি লিখি- আকাশ তোমার দুঃখ কোথায় বল , হাজার নদী সাগর তুমি সঙ্গে নিয়ে চল। যদি কেউ গাজনার বিলের নাম শুনে থাকেন তাহলে জানেন এই সময় বিলের এপার ওপার খালি চোখে ঠাওর করা কঠিন । শুধু জল আর জল। এরকম এক বর্ষাতে আমি একজনের বিয়েতে গিয়েছিলাম ।

যখন ফিরি তখন রাত সাড়ে বারোটা মতন বেজে গেলো। আমার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো কারণ এ সময় একটু ডাকাতের ভয় থাকে। কিন্তু যখন নৌকা ছেড়ে দিলো তখন কোথায় যে ভয় হারিয়ে গেলো । মাথার উপরে পূর্ণিমার চাঁদ। নিচে জল। নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করা হলো। শুধু বৈঠার শব্দ। বর্ষার নতুন রুপ যেন আমাকে মুগ্ধ করে গেলো।

খুব ছোটবেলা থেকেই আমি বর্ষা ভালোবাসি। বলতে পারেন আষাঢ় মাস কবে শুরু হবে তার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকি। যেমন আষাঢ়ের প্রথম দিন আমি ধরেই নিয়েছি বৃষ্টি হবে। আমার কাটানো বেশীরভাগ আষাঢ়ের প্রথম দিনেই এমন হয়েছে। আমি অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার ডিউটি দিচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে আকাশের পানে দেখছিলাম। তখনো রোদ ছিল । দ্বিতীয় হাফে আমার সিনিয়র এক ম্যাডাম যিনি আমার সাথে ছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করলাম আজ কি বৃষ্টি হবে না? উনি হেসে ফেললেন ।

বললেন হবার তো কথা । এই কথা বলার মিনিট দশেক পড়েই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হলো । উনি আমার দিকে তাকিয়ে আবার হাসলেন । এই হলো আমার অবস্থা ।

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি একমনে। ছোটবেলার বৃষ্টির দিনগুলো খুব মনে পরে এখন। আমি যখন খুব ছোট। মাছ ধরি (অবশ্যই লুকিয়ে )।

আমার বাড়ির পাশে বেশ কয়েকটি পুকুর। বৃষ্টি হলেই একটা গামছা হাতে বেরিয়ে পরতাম। পুকুর গুলো সব জলে পূর্ণ থাকত। আর মাছ গুলো সেই সুযোগে এক পুকুর থেকে আরেক পুকুরে যাবার চেষ্টা করতো। আমারা জলের উজানে গামছা রাখতাম। ফলে ছোট ছোট পুঁটি ,খলশে আমার গামছাতে উঠে আসতো। খলশে মাছ গুলো সব রং বে রঙের। সেই মাছ ধরে এনে একটা সাদা বোতলে জল ভরে তার মধ্য ছেড়ে দিতাম। পুরো বর্ষা এভাবে মাছ ঘরে সাজিয়ে রাখতাম ।এরপর দলবেঁধে মটকাতে যেতাম গোসল করতে। মটকা হল জল যখন এক সাথে এক দিক দিয়ে পরে। আমাদের বাড়ির পাশে শুধু পাটের গুদাম। অনেক দিনের পুরনো। সেখান দিয়ে জল তীব্র বেগে পরত। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিজতাম। কখনও ফুটবল নিয়ে ছুটতাম মাঠে। সবচাইতে মজা পেতাম যদি নদীতে নামার পর বৃষ্টি আসতো। কারণ যখন উপর থেকে বৃষ্টি পরে তখন নদীর জলে গোসল এক অন্য রকম অনুভূতি।

মনে আছে একবার খুব বৃষ্টির মধ্য আমি ফুটবল খেলে ফেরাতে আমার বই খাতা সব মাটিতে ফেলে দিয়েছিলো আমার মা। অনেক বকা শুনেছিলাম সেদিন। কাগজের নৌকা বানাতাম অনেক। আমার বাড়ির ঢাল ধরে যখন বৃষ্টির জল গড়িয়ে যেত তখন ওগুলো ছেড়ে দিতাম। কোনটা ঠিক পথ খুঁজে নিত আবার কোনটা মুখ থুবড়ে পড়ত।

আর প্রকৃতি তখন অপূর্ব সাজে সাজত। আমার বাড়িতে বিরাট কদম গাছ ছিল পাশেই ছিল কূপ। সেই ফুল বর্ষার জলে মিশে যেত বৃষ্টিতে। এছাড়া আমার এই ছোট পাড়াতেও আর কয়েকটা কদম ফুলের গাছ ছিল। বৃষ্টিতে কদমের রেনুগুলো ভিজত আর এক মিষ্টি গন্ধ ছড়াত।

ভিজে শালিক বা কাক দেখতাম জড় হয়ে বসে আছে কোনও ডালে। এভাবে বর্ষাপ্রীতি নিয়ে বড় হয়েছি। আজও সেই বর্ষা প্রীতি আজও আমার মধ্যে রয়ে গেছে।