কোভিড-১৯ বার্তা নিয়ে এসেছে, আমরা যেন এই পৃথিবীকে ভালোবাসি ॥ লুনা রাহনুমা


বিশ্বজুড়ে চলছে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ। নতুন রোগী শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সমানতালে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ইতোমধ্যে দশ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় বদলে গেছে বিশ্ব। বদলেছে মানুষের জীবনযাপন। শিল্প-সংস্কৃতিতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এ নিয়ে যোগসূত্রের এ আয়োজন। এবারের সাক্ষাৎকার পর্বে পড়ুন অনুবাদক ও গল্পকার লুনা রাহনুমার লেখালেখি নিয়ে।

যোগসূত্র: লকডাউনে কী পড়ছেন, কী লিখছেন?
লুনা রাহনুমা: লকডাউনের আমার বেশকিছু বই পড়া হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটির নাম বলা যায়, পূরবী বসুর ‘সেরা দশ গল্প’, ও ‘আমার এ দেহখানি’। পূরবী বসুর লেখা আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে, অন্যরকম আনন্দ পাই তার লেখা পড়ে। এছাড়া পড়েছি নাসরিন জাহান, সেলিনা হোসেন, হুমায়ুন আহমেদ ও আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘সেরা দশ গল্প’। লিখেছি ও পড়েছি পেন্সিল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত পেন্সিল সংকলন ২০২১। যুক্তরাজ্যের লেখিকা আমিনা তাবাস্সুমের প্রথম উপন্যাস ‘মাতৃত্ব’। আর সবচেয়ে বেশি পড়েছি, প্রতিদিনই কম বেশি পড়ি, কয়েকটি অনলাইন সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত লেখকদের সাম্প্রতিক সময়ে লেখা অনেক গল্প, প্রবন্ধ, বুক রিভিউ। পড়ছি প্রখ্যাত সাময়িকী প্যারিস রিভিউতে বিখ্যাত লেখকদের সাক্ষাৎকার। আরও পড়েছি, বিভিন্ন ধারার বেশ কিছু ব্রিটিশ শর্ট স্টোরিজ ও ফ্ল্যাশ ফিকশন।

আমার লেখার কথা বলি। লকডাউনের শুরুতে বেশকিছু মৌলিক গল্প, অনুগল্প, কবিতা লিখেছিলাম। এখন বেশি করছি অনুবাদের কাজ। ছোটগল্প, বড়গল্প অনুবাদ করার পাশাপাশি বেশ কিছু ফ্ল্যাশ ফিকশন অনুবাদ করেছি। ইতালীয় কবি আন্তোনেলা আনেডার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছি। ইচ্ছে আছে অনুবাদের লেখাগুলোকে একসাথে করে ভবিষ্যতে অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশ করার।

লেখা এবং পড়া এই দুটোকে তুলনা করলে বলবো যে আমি নিজে লেখার চেয়েও পড়ছি বেশি। এখন লকডাউনে সময় বেশি পাওয়া যাচ্ছে নিজের জন্য, তাই পছন্দের বইগুলো সংগ্রহ করে পড়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ থেকে কিছু বই আনিয়েছি। সমসাময়িক লেখকদের লেখার সাথে পরিচিত হচ্ছি প্রতিদিনই একটু একটু করে।

যোগসূত্র: কীভাবে কাটাচ্ছেন লকডাউনের দিনগুলো?
লুনা রাহনুমা: আমি ফুলটাইম চাকরি করি। লকডাউন থাকার কারণে, গত এক বছর ধরে আমার ওয়ার্কিং ফ্রম হোম, মানে অফিসে যেতে হচ্ছে না। সকালে মেয়েরা স্কুলে চলে যাওয়ার পর নিজের অফিসরুমেই কাটে দিনের বেশিরভাগ সময়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনলাইনে ঢুঁ মারা। পছন্দের কোনো লেখা দেখলে সেটাকে শনিবার ও রবিবারে আরাম করে পড়ার জন্য তারকা চিহ্ন দিয়ে রাখি।

এখন যেহেতু সামার আসছে সামনে, বাগান করার সময়। আমি কিছু বীজ থেকে ছোট চারা করেছি, যেমন সিম, মরিচ, টমেটো, সন্ধ্যামালতী, ঢেঁড়স, সরিষা ও মেথি শাক, চাইনিজ লাউ ও চাইনিজ পটল। ইংল্যান্ডে আবহাওয়া এখনো বেশ ঠান্ডা, তাই আমার গাছগুলো ছোট ছোট পটে জানালার পাশে রোদে রাখা আছে। আরো মাস দেড়েক পরে এদের বাগানের মাটিতে লাগিয়ে দিব।

লকডাউন থাকায় আমরা আপাতত সামাজিকতার দায় থেকে মুক্ত। তাই বাড়িতে কারো জন্য রান্না করা বা কোথাও দাওয়াত খেতে যাওয়া নেই একদম। বাচ্চাদের নিয়ে হাঁটতে বের হই প্রায় দিনই। ওরা সাইকেল চালায়, আমি ও আমার হাসব্যান্ড ওদের পেছন পেছন হাঁটি। এতে করে শরীর ভালো থাকে আর সময়টাও পার হয় কিছুটা। এরপর বাড়িতে বসে সিনেমা দেখি, লুডু খেলি, আর আমার প্রিয় কাজ ঘুমানো, সেটিও করি নিয়ম করে। বেশি বেশি।

যোগসূত্র: কোভিড-১৯ শিল্প-সংস্কৃতিতে কী প্রভাব ফেলছে?
লুনা রাহনুমা: কোভিড আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির অনেক অনেক উজ্জ্বল তারকাকে তুলে নিয়ে গেছে অন্যভুবনে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতি।

কোভিডের কারণে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেমন বিপর্যস্ত হয়েছে, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলেছে, একথা অনস্বীকার্য। মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মিটে যাওয়ার পর তারা বিনোদনে আগ্রহী হয়। মৃত্যুর ভয়ে ভীত মানুষেরা স্বভাবতই শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। সাক্ষাতে যে আবৃত্তি-সন্ধ্যা হতো, গানের আসর বসতো, বন্ধুর সাথে বন্ধুর মোলাকাতে যে সাহিত্য আলোচনা বা তর্ক হতো – সেসব এখন থমকে গেছে। চারপাশে শুধু ভয়। মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় এখন আরেকজন মানুষকে।

আবার, কোভিড এসেছে বলে আমরা শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার আরেকটি নতুন উপায় সম্পর্কে জানতে পেরেছি। অনলাইন লাইভ। এত এত অনলাইন লাইভ হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, যা মানুষকে কঠিন এই দুঃসময়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণ বাঁচিয়ে বাচ্চাদের জন্য অনুষ্ঠান, বড়দের জন্য অনুষ্ঠান, সামাজিক সৌজন্যতা রক্ষা করার সব উপায় বাতলে দিয়েছে এই অনলাইন লাইভ। ছোঁয়া যায় না- এটুকুই যা অপূর্ণতা। পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে অনেক মানুষের মিলনমেলা তৈরি করতে পারে একটি লাইভ অনুষ্ঠান।

যোগসূত্র: কীভাবে করোনা থেকে উত্তরণ সম্ভব?
লুনা রাহনুমা: করোনা থেকে উত্তরণ করার উপায় তো পুরো বিশ্বের জ্ঞানী গুণী বিশেষজ্ঞরা খুঁজেই চলছেন এখনো। একের পর এক নতুন রূপে হাজির হওয়া এই ভাইরাসকে নির্মূল করার উপায় আমার জানাই নেই। তবে আমরা একটু সতর্ক থাকতে পারি যেন আমরা এই ভাইরাসটিকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারি, আপাতত। যতদিন পর্যন্ত না একটি কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে।

বাড়ির বাইরে লোকসমাগমে গেলে আমরা সবাই অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবো। সাবান দিয়ে খুব ভালো করে হাত ধুয়ে নেবো। সরকার প্রণীত নিয়মাবলী মেনে চলবো। তাতে আমি নিজে সুস্থ থাকতে পারি আর অন্য আরেকজনের জন্যও আমি হুমকির কারণ হবো না। কোভিড-১৯ আমাদের জন্য একটি চিরকালীন বার্তা নিয়ে এসেছে, আমরা সবাই যেন আমাদের এই পৃথিবীটিকে ভালোবাসি। তার যত্ম করি। প্রকৃতির ওপর অনাচার, খাদ্য ও বস্তুর অপচয়, অসংলগ্ন আচরণ, মেলামেশা থেকে বিরত থাকি। আশা করছি খুব শিঘ্রই আমরা এই অতিমারী ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমাদের পৃথিবীটিকে মুক্ত করতে পারবো।