লেখার মাধ্যমে দূরদর্শী হওয়ার এখনই সময় ॥ সৈয়দ ইফতেখার


বিশ্বজুড়ে চলছে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ। নতুন রোগী শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সমানতালে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ইতোমধ্যে দশ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় বদলে গেছে বিশ্ব। বদলেছে মানুষের জীবনযাপন। শিল্প-সংস্কৃতিতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এ নিয়ে যােগসূত্রের এ আয়োজন। এবারের সাক্ষাৎকার পর্বে পড়ুন ছড়াকার, কবি ও সাংবাদিক সৈয়দ ইফতেখারের লেখালেখি নিয়ে।

যোগসূত্র: লকডাউনে কী পড়ছেন, কী লিখছেন?
সৈয়দ ইফতেখার: বিধি-নিষেধ বলি কিংবা লকডাউন, আমরা যারা সাংবাদিকতা করি, বিশেষ করে টেলিভিশন সাংবাদিকতা তাদের ছুটি নেই। উল্টো কাজের পরিধি আর চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে। কারণ অনেক সহকর্মী করোনায় আক্রান্ত থাকায়, তাদের কর্মচাপও তুলে নিতে হচ্ছে কাঁধে। বলে রাখা ভালো, আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে আমি কাজ করি, একটি ২৪ ঘণ্টা সংবাদভিত্তিক স্টেশনে। মানুষকে সচেতন করা, কোভিড-১৯-এর বেশি বেশি খবর প্রচার, সারাবিশ্বের পরিস্থিতি তুলে ধরা, বিভিন্ন দেশের ভ্যাকসিন নিয়ে সর্বশেষ তথ্য দেওয়া এগুলোর কাজ করতে হচ্ছে দিনরাত। আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আছে, কিন্তু কিছু করার নেই (এর আগে ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ভুগেছি)। বাসায় ফিরে পুরোপুরি সঙ্গরোধে না থাকলেও যতটা সম্ভব বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতে হচ্ছে। যতটুকু সময় পাচ্ছি, কয়েকটি ঈদ সংখ্যার জন্য লেখছি। মূলত কবিতা আর শিশুতোষ ছড়া। এছাড়া সমসাময়িক বিষয় নিয়ে কলাম লেখার আহ্বান আছে, সেটা সময় করে উঠতে পারলে বসছি ডেস্কটপে।

আর পড়াশোনা বলতে, বইমেলা থেকে কিছু বই কেনা হয়েছে। সেগুলোর পাঠ চলমান। অনলাইন থেকে আরও কিছু বই কিনবো। অনেক পরিচিতজনের বই এখনও কেনা বাকি। কিছু ইংরেজি সাহিত্যের অনুবাদ করতে চাই, সেগুলোর জন্যও জারি রয়েছে প্রস্তুতি পর্ব। তাছাড়া পেশাগত কাজের জন্য, আন্তর্জাতিক জার্নাল, ভ্যাকসিন নিয়ে বিভিন্ন তথ্য মাথায় নেওয়া, বিশ্ব লকডাউন পরিস্থিতি, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে পড়া রোজকার কাজ। কিন্তু কথা হচ্ছে, চারিদিকে যখন এত মৃত্যুর আওয়াজ- সেখানে মনকে ঠিক রাখা দুঃসাধ্য। করোনায় মানসিক একটা প্রভাব পড়েছে মননে। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়ার অবকাশ নেই।

যোগসূত্র: কীভাবে কাটাচ্ছেন লকডাউনের দিনগুলো?
সৈয়দ ইফতেখার: আমরা অনেক বেশি কঠিন সময় পার করছি। হয়ত মাস দুই-তিনেক পর মহামারির রেশটা একটু কমে আসবে বটে, কিন্তু আবারও বছর শেষে তা বাড়ার শঙ্কা থেকেই যায়। তাই আহ্বান জানাবো, যাদের অতি প্রয়োজন নেই তারা যেন নিয়ম পালন করি বাসায় থেকে। অনর্থন বাজার করা, কেনাকাটা করা এগুলোর সময় এখন নয়। শিক্ষার্থীদের এখন অনেক সময়, তারা চাইলেই বাংলা সাহিত্যের ক্ল্যাসিক লেখাগুলো পড়ে শেষ করে ফেলতে পারে। সাংবাদিক হিসেবে, কাজ থেমে নেই। কিন্তু আমি অন্যান্য পেশার মানুষজনকে একদিক দিয়ে সৌভাগ্যবান মনে করি, তারা পরিবারকে সময় দিতে পারছেন। এই সময় দেওয়ার সুযোগ কজনেরই বা হয়। যা আমি পারছি না। ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছি।

যোগসূত্র: কোভিড-১৯ শিল্প-সংস্কৃতিতে কী প্রভাব ফলেছে?
সৈয়দ ইফতেখার: সাধারণত লেখালেখির পাশাপাশি নাটকের চিত্রনাট্য করাসহ আরও কিছু আনুষাঙ্গিক কাজ করে থাকি। এবার ঈদকে ঘিরে বড় পরিকল্পনা ছিল বিনোদন নির্ভর চ্যানেলগুলোর। তারা তা থেকে সরে এসেছে। এতে অনেক নাট্যকার কাজ পাননি। তৈরি হয়নি নতুন অনেক গল্প, স্ক্রিপ্ট, চিত্রনাট্য। লকডাউন আসার আগে অনেকেই বলেছিলেন একটা গল্প দিয়েন, কাজ করতে চাই। কিন্তু তারা করোনার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় পিছিয়ে গেছেন। বাস্তবে পরিস্থিতি যতটা খারাপ তারচেয়েও খারাপ শিল্প-সংস্কৃতির বিষয়টি। আসলে বহু মানুষ দুই বেলাই খেতে পারছে না, সেখানে শিল্প-সংস্কৃতিতে বিনিয়োগ বিলাসিতার মতো শোনায়। তাই আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আমাদের শিল্পাঙ্গন খুব বড় নয়, তাই এখানে আঘাতটাও সহ্য করার শক্তি তত বেশি নয়।

যুগে যুগে সংকটময় মুহূর্তে লেখক, কবি, সাহিত্যিকরা এগিয়ে এসেছে। সমাজ সচেতন করেছেন। এবারও তাদের অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। তবে তারা কি আদৌ পারছেন? প্রশ্ন উঠছে কিন্তু। আমরা এই প্রজন্মের লেখকরা যুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু করোনাকাল দেখছি, আমাদের লেখার মাধ্যমে দূরদর্শী হওয়ার সময় এখনই। টনক আমাদেরই নাড়াতে হবে।

এছাড়া এবার বইমেলায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠা অনেক বেশি কঠিন। মেলা যদি ফেব্রুয়ারিতে সময় মতো হতো, তাও ক্ষতির পাল্লা কম হতো বলে মনে করি। আমরা আসলে দূরদর্শী নই এটাই তার প্রমাণ।

যোগসূত্র: কীভাবে করোনা থেকে উত্তরণ সম্ভব?
সৈয়দ ইফতেখার: আমাদের সচেতনতার অভাব। তাই করোনা থেকে বের হতে পারাটা বাঙালির জন্য সোজা নয়। উদাস কর্তৃপক্ষ, শিক্ষিত সমাজের দায় এড়ানো, সাধারণ মানুষেরও কোনো দায়িত্ব নেই। বছর দেড়েক হয়ে যাচ্ছে, এতদিনে মাস্ক পরার অভ্যাস আমাদের গড়ে ওঠেনি। হাত স্যানিটাইজ করার প্রশ্নই আসে না। লকডাউন ভেঙে গলির মোড়ে আড্ডা দেওয়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে হরহামেশা। আমরা জীবন চলার অর্থ, আর রোজগারের কথা বলি- আড্ডা আর হাসি ঠাট্টায় সময় পার কোন রোজগারের মধ্যে পড়ে তা মাথায় ঢোকে না। এই উদাস ভাব দূর করতে কর্তপক্ষকে কঠোর হতে হবে। আসছে ঈদেও বাড়ি যাওয়ার হিড়িক পড়বে, যেখানে থাকবে না কোনো স্বাস্থ্যবিধি। ঢাকা থেকে নতুন করে বয়ে নিয়ে যাওয়া ভাইরাস গ্রামেও ছড়াবে। এগুলোর সমাধান না হলে, পথ বন্ধুরই থেকে যাবে। পাশাপাশি প্রাপ্ত বয়স্ক অন্তত ১০-১২ কোটি মানুষের জন্য যতদিন না পূর্ণ ডোজ টিকা নিশ্চিত করতে পারছি, ততদিন করোনা থেকে মুক্তি নেই। মানসিক যন্ত্রণা থেকেও নেই রেহাই।