করোনার স্ট্রেনগুলোর কাঁটামুখ গেঁথে থাকবে বিভিন্ন লেখায় ॥ রুখসানা কাজল


বিশ্বজুড়ে চলছে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ। নতুন রোগী শনাক্তের হার বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সমানতালে বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ইতোমধ্যে দশ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। করোনায় বদলে গেছে বিশ্ব। বদলেছে মানুষের জীবনযাপন। শিল্প-সংস্কৃতিতেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এ নিয়ে যােগসূত্রের এ আয়োজন। এবারের সাক্ষাৎকার পর্বে পড়ুন কথাসাহিত্যিক রুখসানা কাজলের লেখালেখি নিয়ে।

যোগসূত্র: লকডাউনে কী পড়ছেন, কী লিখছেন?
রুখসানা কাজল: প্রচুর প্রবন্ধ এবং নিবন্ধ পড়ছি। বিভিন্ন নতুন ও পুরাতন পত্রিকা ঘেঁটে প্রবন্ধ এবং নিবন্ধের বিষয়বস্তু, লিখন কৌশল, ভাষাশৈলী নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করছি। এক বন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছি ক্ষিতীশ রায়ের অনুবাদে, কৃষ্ণ কৃপালনীর লেখা, দ্বারকানাথ ঠাকুর সম্পর্কে একটি বই। পড়ছি। সংস্কার আন্দোলনের জোয়ারে কিভাবে সনাতন ধর্মের অনেক কুসংস্কার ভেঙেচুরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, কিভাবে রুদ্ধ হচ্ছে সতীদাহ, কিভাবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে একেশ্বরবাদ আর নতুন ধর্ম হিসেবে আসছে ব্রাম্মধর্ম-তা জেনে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছি। মনের ভেতর আন্দোলন জাগছে। জানতে ইচ্ছে করছে সেই সময়ের সমাজে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা কেমন ছিল ইত্যাদি । দুই বাংলার অন্যদের লেখা গল্প পড়ছি। পাশাপাশি পড়ছি মতুয়াবাদ। মতুয়াবাদও একেশ্বরবাদী। শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া ধর্মে ব্যথিত মুসলমানদের জন্যেও আশ্রয় উন্মোচন করে রেখেছিলেন। নিবন্ধ ধরনের কিছু লেখালিখি করছি। এটাই এখন আমার লক্ষ্য।

যোগসূত্র: কিভাবে কাটাচ্ছেন লক ডাউনের দিনগুলো ?
রুখসানা কাজল: যেহেতু গৃহি মানুষ। হেল্পিং হ্যান্ডকে সপ্তাহে দুদিন আসতে বলেছি। তাই ঘরের কাজকর্ম করছি। আরেকটি কাজ করছি, নিজের পুরনো লেখাগুলোর ঘষামাজা। যদি একটু উন্নত করা যায় সে আশায় ! এর ফাঁকে করোনা সংক্রমণের নির্বিচার থাবা আর সেই থাবাকে আরও সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে মানুষের অবাধ নিয়মভাঙা দেখছি আর আঁতকে উঠছি। মৃত্যু মানে চিরকালের জন্যে বিদায়। আমি মরতে ভয় পাই। ভাবতেও। যদি আজীবন বেঁচে থাকা যেত !

যোগসূত্র: কোভিড-১৯ শিল্প-সংস্কৃতিতে কী প্রভাব ফেলেছে ?
রুখসানা কাজল: প্রভাব তো বিপুলভাবে ফেলেছে। এই তো বইমেলা গুটিয়ে নিতে হলো। লেখক প্রকাশকরা প্রচার এবং বেচাকেনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। স্বল্পপূঁজির প্রকাশনী এবং শিল্পবোদ্ধাদের মিলনস্থল, থিয়েটার, সিনেমা টিভির কাজ প্রায় বন্ধ। নতুন লেখক তার সৃষ্টিকে পাঠকের দরবারে আনতে পারছে না। এরচেয়েও ভয়ঙ্কর প্রকাশনার সাথে যুক্ত প্রান্তিক মানুষদের কাজ না পাওয়া। অনাহার, বেকারত্বের পাশে বেঁচে থাকার ন্যূনতম নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলছে অনেকেই। লকডাউন দিলে সংক্রমণ থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যায় কিন্তু পেটের ক্ষুধা ত মেটে না। শিশু, কিশোর, ছাত্র-ছাত্রীরা অস্থির হয়ে উঠেছে। মৃত্যু যেন ফাতনা ফেলে বর্শি ধরে আছে। এ ও এক আতঙ্ক। এর মাঝেই করোনাকালীন সাহিত্য রচিত হচ্ছে। চিত্রকর্মে ফুটে উঠছে করোনার নিষ্ঠুর আভাস। অনলাইন সাহিত্যের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। সাথে অনলাইন বইপত্রের যোগান। ঘরে বসে সিনেমা দেখছে দর্শক। করোনার তাণ্ডব কবে শেষ হবে কে জানে। তবে শিল্প সংস্কৃতিতে করোনার স্ট্রেনগুলোর কাঁটামুখ গেঁথে থাকবে অনেক লেখকের গল্প, উপন্যাস এবং কবিতাসহ বিভিন্ন ধারায়।

যোগসূত্র: কিভাবে করোনা থেকে উত্তরণ সম্ভব ?
রুখসানা কাজল: করোনা একটি সত্যকে উন্মোচন করে দিয়েছে। আর তা হলো, প্রকৃতিকে ধ্বংস করে মানবসভ্যতা কিছুতেই টিকে থাকতে পারবে না। নগরগুলো ত বৃক্ষশূন্য করে ফেলেছি আমরা। নদি হত্যা করেছি। বন উজাড়। গ্রামগুলো খেয়ে ফেলছে নগর। এগুলো ফিরিয়ে আনতে হবে। এক ইঞ্চি জায়গাতেও যেন গাছ লাগানো হয়। নদিকে মুক্ত করতে হবে। নিয়ম করতে হবে বনের একটি বৃক্ষ কাটলে পাঁচটি বৃক্ষচারা লাগাতে হবে। যন্ত্রের উপর নির্ভরতা কমাতে হবে। সামান্যতম পথ নাগরিক মানুষরা পায়ে হাঁটে না। আমাদের শিশুরা ঘরের দরোজা থেকে রিকশা বা গাড়িতে চড়ে ইশকুলে যায়। আবার ইশকুলের গেট থেকে ঘরে ফিরে আসে। ফার্মের মুরগির মতো একটি নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে না শিখলে প্রকৃতি এই দুর্বল মানুষদের নিয়ে কি করবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর নিজেদের জন্যে করোনামুক্ত পৃথিবী গড়তে আমাদের এখনই সচেষ্ট হতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। হাত ধোয়া, অকারণে আপাতত বাইরে যাওয়া চলবে না। বেঁচে থেকে মানব ইতিহাসকে আরও দীর্ঘতম করে তুলতে হবে।