রমনার বৈশাখী মেলায় ॥ রেজিনা মনি


ঢাকার ভিআইপি রাস্তা দিয়ে রিকশাটা আপন মনে ছুটে চলছে। তার সাথে দুর্বার গতিতে চলছে দুই কিশোরীর উল্লাসিত মন। খোলা হুডে এলোমেলো বাতাসের দাপট তাদের আনাড়ি হাতের খোঁপার বাঁধন খুলে দিতে চাইছে। এক হাতে রিকশা আর আরেক হাতে শাড়ির আচঁল সামলাতে সামলাতে তারা এগিয়ে যাচ্ছিল রমনার দিকে।

তখন বৈশাখ মানেই অন্যরকম আমেজ। চারিদিকে উৎসবের ছোঁয়া। পাড়ার ছোট্ট মাঠেও দেখা যেত নাগরদোলা, ছোটদের ২/১ টিখেলনার স্টল, রিং ছুঁড়ে মেরে সাবান বা অন্যকিছুকে জিতে নেওয়ার লটারির স্টল, কয়েকটা কাঁচের চুড়ির, বেলুনের পসরা সাজিয়ে একটা কোনায় বেলুনওয়ালা, সাদা, গোলাপী হাওয়াই মিঠাই লাঠিতে ঝুলিয়ে মিঠাইওয়ালা। আর মুড়ি মুরকি, নিমকি, কদমা, বাতাসা, মুরালি হরেক রকম খাবার নিয়ে একটা বড় স্টল নিয়ে এলাকার বৈশাখী মেলা। বিকালে সেই মেলায় স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের নাচ, গানের আয়োজনও হতো। আমাদের তখন একটু বড় বড় ভাব, এলাকার স্কুল ছেড়ে কলেজে গিয়েছি বছর দুই হয়ে যাবে। সামনে এইচএসসি দিব। মনে প্রাণে একটু বড় হওয়ার চেষ্টা।এলাকার এই মেলায় এখন আর যেতে ভালো লাগে না। এগুলো পাড়ার ছোট ছেলে-মেয়েদের আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু।

আমি আর আমার প্রিয় খালাতো বোন রিপা মিলে ঠিক করলাম রমনার বৈশাখী মেলায় যাব। ছোট বেলায় গিয়েছি দু-একবার বড়দের সাথে। গত বছরও আমরা বন্ধুরা মিলে এক বন্ধুর বাবা মার সাথে রমনার বৈশাখী আয়োজন দেখতে গিয়েছিলাম।

তাই অচেনার ভয়টা একটু কম তাছাড়া রিপা সিদ্ধেশরী গার্লসে এইচএসসি প্রথম বর্ষে.. তার শিক্ষকদের বাসায় পড়তে যাবার সুবাধে মোটামুটি পরিচিত জায়গা। আর তেজগাঁও থেকে রমনা পার্ক বেশি দূর নয়।

আমরা সকালের নাস্তা করে দুজনে প্রায় একই রকম লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে বাসা থেকে বের হলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল সহজেই একটা রিকশা পেয়ে গেলাম। সাধারণত মেইন রাস্তায় ওই সময়ে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও বিশেষ বিশেষ দিন ও হরতালের দিনগুলোতে ঢাকা শহরের সব রাস্তায় রিকশা চলাচলের অনুমতি ছিল।

আমাদের রিকশা কোন বাঁধা ছাড়াই সাত রাস্তা, মগবাজার, বেইলীরোড পার হয়ে রমনার দিকে এগুতে লাগল। সাদা লাল শাড়ির ললনাদের দল দেখতে পেলাম বেইলী রোড পার হতেই..ভোরে আসা একদল মানুষ বাড়ি ফেরার পথে, কেউবা দূরে গাড়ি পার্ক করে হেঁটে চলছে রমনার দিকে, সাদা পান্জাবি পরা বাবার হাত ধরে হেলেদুলে হাঁটছে ছোট্ট পরি মেয়েটি। তার শাড়ির আচঁল দুলছে এদিক সেদিক। একটু বসার জায়গা পেয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়েছে ৮-১০ বছরের ছেলেটি। সেও বাবা মার সাথে মিলিয়ে লালসাদা পান্জাবি পরে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে বড্ড ক্লান্ত। তারপরও চোখে মুখে আনন্দের দীপ্তি। গালে একটা একতারা আঁকা। পায়ে মনে হয় ফোসকা পরেছে, মা জুতা খুলে সেখানে একটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন। বেশ গুছানো মনে হল পরিবারটিকে।

রিকশা এগুতে পারছে না। মানুষের জ্যাম। রমনার প্রবেশ মুখটায় মানুষের ঢল। সব রিকশা, গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মধ্যেই ফাঁকফোকর বের করে একটা মোটরসাইকেল এগিয়ে চলছে। এক অপরূপ সুন্দরী বসে আছে চালকের কাঁধে হাত রেখে। সাদা রঙের শাড়িতে তাঁকে অস্পরী লাগছে। খোঁপায় ও হাতে বেলী ফুলের মালা ঝুলছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সদ্য বিবাহিত কাপল। আপন মনে দোলা দিচ্ছিল।

আর চোখে নতুন স্বপ্ন। মনে হলো বিয়ের পর আমিও নিশ্চয়ই এমন করে প্রিয় মানুষের হাত ধরে ভোরের আলো ফুটার আগে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান দেখতে আসব। হাতে ঝুলতে থাকবে সুবাসিত বেলী ফুলের মালা।কপালে বড় একটা লাল টিপ। আব্বু আম্মু কখনো এত সকালে আসায় অনুমতি দেননি। তাই টিভির পর্দাই দেখেছি আজীবন বর্ষবরণ। সেই ইচ্ছেও একদিন পূর্ণ হবে….ইস বড় হলে কত মজা, সবকিছু করা যায় ইচ্ছেমতন।

রিকশা আর বেশিদূর আগাতে পারল না। ভাড়া মিটিয়ে আমরা নেমে পরলাম। রমনায় প্রবেশের জন্য বেশ বড় করে জায়গা নিয়ে দুপাশে বাঁশের বাউন্ডারি দিয়ে গেইট পর্যন্ত একটা লম্বা হাঁটার পথ করা হয়েছে। তার আরেক পাশ দিয়ে বের হবার পথ।

আমরাও নেমে গেলাম মানুষের ঢলে। সূর্যের আলো মাথার ওপর। চারিদিকে উচ্ছ্বসিত মানুষ। কেউ ঢোল বাঁজাতে বাঁজাতে হাঁটছে, কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। ছোট ছেলে-মেয়েরা মেলা থেকে মাত্র কেনা ডুগডুগি বাজাচ্ছে। কারো বেলুন হাত থেকে ছুটে আকাশে উড়ে গেলবলে কাঁদছে। জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট দলে মানুষ আনন্দে মেতেছে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দলের আয়োজনে নানান অনুষ্ঠান হচ্ছে আলাদা আলাদা মঞ্চে। কোথাও বাউল সংগীত, কোথাও শিশুদের নৃত্য। আবার কোথাও কবিতা পাঠের আসর।

আমরা সবকিছু দেখতে দেখতে হাঁটছি ছায়ানটের মূল মঞ্চের দিকে। দূর থেকে ভেঁসে আসছে রবীন্দ্রনাথের মঙ্গল ও বারতা…ছায়ানটের বেড়িতে বসে দুজন মিলে গান শুনলাম, সাথে গলা ছেড়ে গাইলাম আমার আপনার চাইতে আপন যেজন..।

যেন সারা বছরের জন্য মনটা ভালোলাগার রসত নিয়ে নিচ্ছে। এত আনন্দ চারিদিকে, এত স্বপ্নজাগানীরা…সত্যি এক অদ্ভুত ভালোলাগায় দুজন বুঁদ হয়ে গেলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগেই আমরা উঠে পড়লাম। ঝালমুড়ি আর ঝালঝাল টকে ডুবিয়ে ফুচকা খেলাম। ঝাল কমানোর জন্য আইসক্রিম নিলাম। দুহাত ভর্তি করে কাঁচের চুড়ি কিনলাম। ডুগডুগিও কিনে ফেললাম দুইটা। ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে আমরা বের হওয়ার গেইট খুঁজছি। সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরতে হবে। অনেকগুলো গেইট রয়েছে পুরো রমনার এলাকা জুড়ে। বেইলী রোডের দিকের গেইটটা খুঁজে পেলাম। গেইটের কাছাকাছি যেতেই দেখলাম বিশাল জটলা গেইটের প্রবেশ মুখে। চারিদিকে এত মানুষ কিন্তু কোথাও এমন বিশৃঙ্খলা দেখিনি। রাজ্যের এলোমেলো আর জটলা কেবল গেইটাকে ঘিরেই মনে হলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আর বুঝার চেস্টা করছিলাম কিভাবে বের হব।দেখলাম প্রবেশ করা আর বের হবার আলাদা করা বাঁশের বেড়াটি ভেঙে ফেলেছে কিছু উৎসাহী মানুষ। তাই যারা বের হতে যাচ্ছে তাদের বিপরীত দিক থেকে ধাক্কাচ্ছে যারা মেলায় প্রবেশ করতে চাচ্ছে। তারপরে বুঝলাম, নানা বয়সি কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ ইচ্ছে করেই গেইটে জটলা বাড়াচ্ছে, তারা বেরও হচ্ছে না আবার ভিতরেও আসছে না। গেইটের মুখেই অযথা ভিড় করছে। বুঝতে বাকি রইল না কি তাদের উদ্দেশ্য ।

আমরা ভয়ে খুঁজতে লাগলাম কাছাকাছি অন্য একটা গেইট। কাছে যেতেই দেখি সেখানেও একই নাটকীয়তা। দেখলাম আমাদের মতো অনেকেই বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আবার অনেক পরিবারকে দেখলাম লোহার গ্রিলের বাউন্ডারি টপকে বের হয়ে যাচ্ছে।

দ্রুত সন্ধ্যা নামছিল। আরও অপেক্ষা করলে রাত হয়ে যাবে। আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। কি করব ভেবে ভয়ে অস্থির লাগছিল। তারপর মস্তিস্কের সিগনাল পেয়ে এগিয়ে গেলাম উঁচু গ্রিলের বাউন্ডারির দিকে। বাড়ির ছোট্ট ওয়ালে কোনদিন উঠতে না পারা আমি কিভাবে সেদিন শাড়ি আর উঁচু হিল ম্যানেজ করে সেই গ্রিলের দেয়াল টপকে ছিলাম জানিনা, শুধু মনে আছে শখ করে কেনা কাঁচের চুড়ির অনেকগুলো ভেঙে আঁচড়ে, কেঁটে কিছুটা রক্তাক্ত হয়েছিল হাত। তবুও প্রশান্তি নিজেদের বাঁচাতে পেরেছিলাম। তারপর কিছুটা হেঁটে রিকশা পেয়ে গেলাম। দুজন দুজনার হাত আঁকড়ে ধরে বসে আছি রিকশায়। সারা দিনের উল্লাস কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, আনন্দের সেই চোখ দুটোতে তখনো আতঙ্ক, হাসিও মিলিয়ে গিয়েছিল, আমরা নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলাম…আর ভাবছিলাম মানুষ কেন এমন হয়?

চিত্রশিল্পী : সমর মজুমদার