বর্ষার প্রেমিক যুগল ॥ লুনা রাহনুমা


‘এমন দিনে তারে বলা যায়…..’ সিডি প্লেয়ারে বাজতে থাকা জয়তী চক্রবর্তীর গলার সাথে মিলিয়ে গুনগুন করে গাইছে মিলা।

এখন সকাল সাড়ে নয়টা বাজে। মিলা সকালের চা বানিয়ে দুটি উলের কাঁটা আর আকাশি রঙের একটা উলের গোলা নিয়ে ড্রয়িংরুমের মেঝেতে বসেছে আধ-ঘণ্টা আগে। পাশের ফ্ল্যাটের কাকিমার কাছে নতুন শিখেছে উলবোনা। শেখার পর প্রথমেই একটি মাফলার বানিয়েছে তানভীরের জন্য। এবার ভাবছে, সাহস করে একটি জাম্পার বানানো শুরু করবে। বরের জন্য মিলার নিজের হাতে বোনা উলের জাম্পার। সারপ্রাইজ গিফট। যদিও বছরের এই সময়টায় কেউ জাম্পার পরে না। তবুও মিলার ইচ্ছে, বিয়েবার্ষিকীর রাতে আচমকা যদি খুব বৃষ্টি নামতো! অথবা সারাদিন সারারাত একটানা বৃষ্টির পর সেদিন হয়তো হালকা শীত শীত লাগবে। তানভীরের শীতল গায়ে ওমের পরশ দিবে মিলার দশটি আঙুলের ছোঁয়া। ভাবতেই মন চলে যায় দুই বছর আগের সেই দিনটিতে।

তখন শ্রাবণের মাঝামাঝি। কয়েকদিন পর কবিগুরুর সত্তরতম মৃত্যুবার্ষিকী। তাই উদযাপনের তোড়জোড় চলছিল পুরো শহরে। সবখানে সাজসাজ রব। বাড়িতে, গাড়িতে, বাসে, মোড়ের দোকানে লাউড স্পিকারে সবাই নিজেকে রবীন্দ্রপ্রেমী পরিচয় দিতে উঠে পড়ে লেগেছে যেন।

মিলাও রবীন্দ্র কন্যাটির মতো সেজে টিএসসির সামনে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। আসলে মিলা যে আবৃত্তি সংগঠনের সাথে যুক্ত। তাদের প্র্যাকটিস ছিল সেদিন। প্র্যাকটিস শেষে বাড়ি ফিরতে রিকশা খুঁজছিলো। কিন্তু ভুতের গলিতে কোনো রিকশাওয়ালা যাবে না। ভেতরে রাস্তা ভাঙা। বৃষ্টির পানি জমে খুব খারাপ অবস্থা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন লাভ হলো না, তখন পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন করতে নামলো মুষলধারে বৃষ্টি।

মিলা দৌড়ে আবার ঢুকে গেলো টিএসসির ভেতর। বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে তখন সে পারলে দেয়ালের ভেতর সেটে ফেলে নিজেকে। এমন সময় চোখ পড়ে তার দিকে। সেও তাকিয়ে দেখছিলো অনেকক্ষণ। চোখাচোখি কিছুক্ষণ। সেই অল্প কিছুক্ষণ হয়ে গেলো সমস্ত জীবনের মতো মিলন মালায় গাঁথা।

‘ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি যুগে যুগে দিনরাত্রি ধরি ….” চারটি নয়নে শুধু মুগ্ধতা আর প্রেম ঝরছিল দুজনের।

গানের সিডিটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাইরে খুব বাতাস বইতে শুরু করেছে এখন। বিদুত্যের লাইন অফ হয়ে জেনারেটর চালু হলো। মিলা উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করলো। মনে হচ্ছে খুব বৃষ্টি হবে আজ সারাদিন।

:তোমাকে আমার বৃষ্টির মতো লাগে মিলা। কেমন ভেজা ভেজা কিন্তু অনেকটা একসাথে না পেলে ঠিক ভেজাও যায় না, মিলার জন্য তানভীরের ভালোবাসার উচ্চারণগুলো এমনি হৃদয় ছোঁয়া ছিল।
:তুমি কবি, তাই আমাকে এমন করে ভাবতে পারো। আমি অনেক লাকি।
:তুমি আমার শ্রাবণ মাস মিলা। তুমি আমার শ্রাবণের গান। জানো তো শ্রাবণ হলো মনোস্কাম পূর্ণ হবার মাস।
:তোমার বুঝি সব মনোস্কামনা পূর্ণ হয়ে গেলো আমাকে পেয়ে। আর কিছু চাইবার নেই জীবনের কাছে?
: এই শ্রাবণে তুমি ঝরঝর ঝরে পড়ো মিলা। শ্রাবণে হয় বর্ষার সমাপ্তি। যেমন তোমাতে শেষ হয় আমার জাগতিক সকল দুঃখবোধের অনুতাপ।

মিলার মনের ভাবনার সাথে মিলিয়ে আকাশটাও যেন আজ গলা মিলিয়েছে তানভীরের ভাষায়। জানালা খুলে বাইরে হাত বাড়ায় একবার। হালকা বৃষ্টির ছাট এসে ছুঁয়ে দিলো আঙ্গুলগুলো। ঠিক যেন তানভীরের ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে গেলো মিলার করতলে। কানে বেজে উঠলো তানভীরের কণ্ঠস্বর, উৎপল কুমার বসুর কবিতা:
‘মন মানে না বৃষ্টি হলো এত/সমস্ত রাত ডুবো নদীর পাড়ে/আমি তোমার স্বপ্নে পাওয়া আঙুল/স্পর্শ করি জলের অধিকারে।’

সোফার উপরে পা তুলে বসে নিজেকে সুস্থির করতে চেষ্টা করে মিলা। বৃষ্টির সাথে ওর জীবনের সুখের দিনগুলো সব কিভাবে যেন গাঁথা। প্রথম বিয়েবার্ষিকীতে তানভীর মিলাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলো। পথে কোত্থেকে একগুচ্ছ কদম ফুল নিয়ে এসে মিলার সামনে সিনেমার নায়কের মতো হাঁটু গেড়ে বসে গেয়ে উঠেছিল, ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান…’।

নাহ, আজ যেন কিছুতেই মিলা স্মৃতি থেকে ছাড়া পাচ্ছে না। তানভীর অফিসে। মাসের শেষের এইদিন কতক অফিসে ওদের খুব ব্যস্ত থাকে। জেনেও মিলা মোবাইল হাতে নিয়ে তানভীরকে ফোন করলো। একটি রিং পুরোপুরি বাজার আগেই তানভীর কথা বলে উঠলো ওপাশে, আমার মিল-মিল-মিলা, বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। আমি জানতাম তুমি এক্ষুনি ফোন করবে। আমার মতো তোমাকেও ভোগাচ্ছে এই বৃষ্টির জল, জ্বালা। এ তো আমাদের ভালোবাসা। প্রকৃতির জন্য এ শ্রাবণের ধারা আর আমার জন্য তুমি শ্রাবণগাঁথা…..

মুখের খুব কাছে মোবাইল ফোনটি রেখে অনর্গল কথা বলে যায় তানভীর তার প্রেমিকার সাথে। কানের খুব পাশে মোবাইল ফোনটি জোরে চেপে ধরে চোখ বুঁজে থাকে মিলা। ঝরঝর ঝরে পড়ে অশ্রুধারা। এখন শ্রাবণ মাস। নারী ও প্রকৃতি-দুজনেই বিশুদ্ধ জলে সদ্য স্নান করে উঠা।
: কিছু বলবে না?
: না। কিছু বলবো না।
: তাহলে আমি বাড়ি চলে আসি! মুখোমুখী আমরা দুজন চুপ করে বসে থাকি। টেলিফোনে আমি তোমাকে দেখতে পাই না। মিস করি তোমার মুখ।
:তাহলে চলে এসো এখনই।আমি চা বানাচ্ছি।
:কি উপলক্ষে আমি আজ অফিস ফাঁকি দিচ্ছি ম্যাডাম!
: উম, আর মাত্র ১২দিন পর আমাদের পরিচয়-হওয়া বার্ষিকী। এই উপলক্ষে।
: আজকের দিনটাও দেখো সেই সেদিনের মতোই। আকাশ বাতাস ঝাঁপিয়ে তুফান আসছে যেন। টিএসসিতে যাবে?

:না। তুমি বাড়ি এসো। একা ভালো লাগছে না। তোমাকে মিস করছি।
: হ্যালো হ্যালো হ্যালো।
: শুনছি তো।
: আমি শুনতে পারছি না কেন?
: শুনতে না পারলে শুকে দেখো। গরম পানিতে লিকার দিলাম।
: কী ভীষণ জ্বালায় ফেললে আমাকে মিলা! বললেই কী বাড়ি চলে আসা যায়? অফিসের একটা নিয়ম আছে না?
: নিজের অফিসে বস যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। আমিও যা খুশি আবদার করতে পারি।

খোলা জানালার কপাট সজোরে বন্ধ করে দিলো দমকা ঝড়ের দাপট। ফোনের লাইন কেটে মিলা একটা শাড়ি পরতে গেলো। তানভীরের প্রিয় হালকা বেগুনি রঙা তাঁতের শাড়িটি পরলো। তানভীরের জন্য একটি নতুন পাঞ্জাবি বের করে রাখলো চেয়ারের উপর। খাটের পাশে সাইড টেবিলে ওদের দুজনের যুগল ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বিয়ের সময় তানভীর খুব ঠ্যাঙ্গা পাতলা ছেলে ছিল। মিলার আত্মীয় স্বজনেরা সবাই খুব বিরক্ত হয়েছিল মিলা তানভীরকে বিয়ে করছে বলে। খুব বেমানান দেখাতো তখন মিলার পাশে তানভীরকে। তাছাড়া মেগা সফল ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র সন্তান মিলাকে তানভীরের মতো নিম্নবিত্ত পরিবারের একটি ছেলে বিয়ে করতে পারছে দেখে কেউ কেউ তানভীরকে খোঁটা মেরে বলেছিলো, তুমি তো রাজত্ব আর রাজকন্যা দুইই ছিনিয়ে নিলে। লাকি ম্যান।

মিলার ভালোবাসা শুরু থেকে আজও তেমনি অটুট আছে ওর প্রিয় মানুষটির জন্য। তানভীরের চরিত্রের সহজাত বিনয়, সংযম, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, প্রিয়নারী মিলার প্রতি নিখাদ ভালোবাসা আচ্ছন্ন করে রেখেছে মিলাকে। মিলা জানে, তানভীর ওকে ওর জন্যই ভালোবাসে। মিলা প্রখ্যাত ধনকুবের সরফরাজ চৌধুরীর ওরসে জন্ম নেওয়া সন্তান নয় জেনেও সে মিলার জন্ম পরিচয় নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা পোষণ করেনি কখনো।

মনের ভেতর নানারকম চিন্তা আসা যাওয়া করছে। এর মধ্যেই দরোজায় বেল বেজে উঠলো। তানভীরের গায়ের গন্ধ পাচ্ছে যেন মিলা। দরজা খুলতে যাওয়ার আগে সিডি প্লেয়ারের ভলিউমটা আরোবাড়িয়ে দিলো,
‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ তেমনি করে গাও গো।আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো॥
আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,
তেমনি আমার বুকের মাঝে কাঁদিয়া কাঁদাও গো…।’

এই মুহূর্তে পুরোটা বাড়ির আনাচে কানাচে সবখানে কণিকার কণ্ঠে বেজে চলেছে মিলার মনের গভীর আকুতি। দরজা খুলতেই বাতাসের ঝাপটায় মিলাকে ডুবিয়ে দিলো প্রেমিকের প্রেম। অসময়ের গভীর প্রাপ্তি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে অশ্রুর মতো উঠলে গলে পড়ে খানিকক্ষণ। তানভীর দুষ্টামিভরা কণ্ঠে বলে, ‘এই যা! আজ দেখছি ঘরে-বাইরে সবখানেই ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে। ভিজে গেলাম একেবারে। কই মিলা, দাও তোমার আঁচলখানি, নিজেকে একটু শুষ্ক করি।’

অলঙ্করণ: নূরুল আসাদ