তেত্রিশ নম্বর জীবন ॥ সাইফ বরকতুল্লাহ


ইশরাত বলল, আমার খুব অবাক লাগছে তোমার দায়িত্ববোধ দেখে!
বারবার বলছি আমার খুব দরকার!
আর তুমি পাত্তাই দিচ্ছো না!
মশিউল- ওকে রোববার আর মিস হবে না। ওয়ার্কলিস্টে তোমার কাজটা এক নম্বরে রাখলাম।
ইশরাত- আজব মানুষ তুমি!
কথা দিয়ে কথা না রাখাটা কি আজকাল ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে?

এ কথার কোনো উত্তর দেয় না মশিউল।
ইশরাত- আমার টাকাটা খু..উ..ব..খুবই দরকার।
-তোমাকে আর কতবার বলবো?

তিন দিন চলে গেছে। এখনো মশিউলের কোনো খবর নাই। খুবই আটপৌরে জীবন ইশরাতের। সাদামাটা সহজ সরল। একমাত্র মেয়ে ইর্শাকে নিয়ে তার সংসার। ওয়াইফের সিজারের সময় পাঁচ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল মশিউল। চার হাজার টাকা পরিশোধও করেছে। হঠাৎ ইশরাতের জ্বর হওয়ায় বাকি এক হাজার টাকাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন দিনেও কোনো খোঁজখবর না দেখে আজ সকালে আবারও ফেসবুক ইনবক্সে খুদেবার্তা দিল ইশরাত-
কি ব্যাপার বলো তো?
তুমি যে কথা বলাই বন্ধ করে দিলা!
ছিঃ
মানুষ এমন হয়!
বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে।
তোমার সমস্যা থাকলে তুমি সেটা নির্দ্বিধায় বললেই পারতে।
আমার বিপদের সময় এভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে চলাটা কি ভালো দেখাচ্ছে?
থাক!
তোমার সাথে আর কথা নাই।
ভালো থেকো।

মশিউল ইশরাত দুজনে খুবই ভালো বন্ধু। চার বছর আগে পরিচয়। মশিউল ভালো গল্প লিখে। লেখালেখির সূত্র ধরেই ফেসবুকে পরিচয় তাদের। ইশরাতও একজন সিরিয়াস পাঠক। লেখালেখি করলেও কখনো প্রকাশ করেনি। করতেও চায় না। যা লিখে তা ডায়রিতেই লিপিবদ্ধ করে রাখে।

সকাল এগারটা। আকাশে সূর্যটা তখন জ্বলজ্বলে। মশিউল সিটি বাসে অফিস যাচ্ছে। বিকেল তিনটায় অফিস হলেও প্রতিদিন সে এই সময়ই বের হয়। হাতে মোবাইল সেটে ফেসবুক লগইন করা ছিল। মশিউল খুদেবার্তা পেয়ে রিপ্লাই দিল- দুইদিন ধরে মোবাইলে ইন্টারনেট লাইন নাই। তাই মেসেজ দেখতে পারিনি। আর টাকাও ব্যাংকে জমা দিতে পারি নাই। কাল দিব ওকে।সরি দেরি করার জন্য।

মশিউল আরও লিখল- জানি, সময় মতো কোনো কিছু না হলে খারাপ লাগে। ভুল বোঝে। আর কিছু কথা কাউকে বলাও যায় না। বুঝানো যায় না। তবুও কী করার। সরি……। উত্তরটা শুনে তবুও বিশ্বাস করতে পারছে না ইশরাত। এভাবে তো কতবারই বলেছে, একবারও দেয়নি। তবুও মনের মধ্যে এক চিলতে আশা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না আজ মশিউলের। রোজ রোজ সকালে উঠে অফিস আর শরীরে সায় দিচ্ছে না। মাথার নিচে বালিশের কাছে থাকা লেখার ডায়রিটা নিয়ে পাতা উল্টিয়ে দেখছে সাম্প্রতিক লেখাগুলো।

অ্যালার্ম বাজতেই রুমের দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারে দেখতে পেল গ্রামের কাচাঘর। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল মশিউলের গ্রামের বাড়ির কথা। বাড়ির পাশেই ছিল ধু ধু সবুজ ধানক্ষেত। ধান গাছের কচি শীষগুলোর হালকা বাতাসে দোলা, সবুজ চিরে শুয়ে থাকা ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে ছোট্ট কাচা রাস্তা দিয়ে হাঁটা আর হয় না।

মনে আছে মশিউলের। একবার রাতে খেতে বসেছে সবে। জানালার পর্দাগুলো হাওয়ায় দাপাদাপি শুরু করল। চারদিকে ধুলোয় ধুলো। কালবৈশাখী। ছুটে যায় বারান্দায় সে। মিষ্টি গন্ধটায় মন ভিজে যায়। খাবারে ধুলো আসছে। মায়ের ধমকে দরজা-জানালা বন্ধ করে আবার খেতে বসে মশিউল।

এভাবে স্মৃতির জানালা খোলে বসে বসে ভাবছে মশিউল। জানালায় গিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে। মেঘের ঢাকায় আকাশের নীল রঙটা দেখতে পাচ্ছে না। স্মৃতিগুলো জাপটে ধরে তাকে।

কিন্তু চাইলেই তো আর শুয়ে থাকা যাবে না। অফিসে যেতে হবে। টানাটানির সংসার। বউয়ের সঙ্গে প্রায়ই অভিমান হয়।অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে যা পয়সা আসে তাই দিয়ে তো বউ-ছেলে-সংসার চালাতে হয়। ছোটবেলা থেকেই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে আজ এ পর্যায়ে। দেখতে বিশ বছর বয়সের মনে হলেও তেত্রিশ অতিক্রম করবে এ বছরই।

বিকেলে বাজারে গিয়ে প্রায়ই লাল শাক আর কচু শাক কিনে মশিউল। কিন্তু আজ পকেটে টাকা একদমই কম। ঠান্ডা, জ্বর আর কাশির ওষুধ কিনতে হবে ছেলের জন্য। এরই মধ্যে শিমুর ফোন। হ্যালো, মশিউল- বাজার থেকে আধা কেজি মোটা মসুরের ডাল নিয়ে এসো..তো..।

শিমুর সঙ্গে দীর্ঘদিন প্রেম করে দুই বছর হলো সংসার পেতেছে। বিয়েতে অবশ্য মশিউলের বাবার মত ছিল না। কিন্তু ওই যে এরকম লক্ষ্মী মেয়ে কই পাওয়া যাবে। আজকাল পাত্রীর যা অবস্থা। ছেলের ফ্ল্যাট, গাড়ি, ব্যাংক-ব্যালেন্স ছাড়া কন্যারা রাজিই হয় না। এখানেই শিমু ব্যতিক্রম। বেশি কিছু চাহিদা নেই। নিজের জন্য নেই কোনো চিন্তা। শুধু স্বামী আর একমাত্র ছেলে মনের জন্য সংসারের ঘানি টেনে নিয়ে চলা। সঙ্গে একটুকরো সুখ মনকে ভালো মানুষ হিসেবে বড় করা।

মনের জন্য ওষুধ কিনে কিছু টাকা পকেটে ছিল। কিন্তু পরের দিন অফিসে যাওয়ার ভাড়ার কথা চিন্তা করে ডাল আর কিনল না মশিউল। বাসায় এসে মনকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। এদিকে শিমু রান্না শেষ করে টেবিলে রাতের খাবার রেডি করল।

রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে মশিউল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না। ইশরাতের এক হাজার টাকা, এদিকে বাড়িতে বাবার জন্য তিন হাজার টাকা জরুরি দরকার। কিন্তু কোথায় পাবে। বেতন পেতে আরো দশ বারো দিন বাকি। বাসায় ছেলে অসুস্থ। কয়েকদিন আগে ভাতিজা কাওসার মারা গেছে। কাওসারের বাবা মাইদুর বৃদ্ধ কৃষক। অভাবের সংসার। পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই কাওসারের দুই বোন অবিবাহিত। বৃদ্ধ বাবা-মা শত কষ্টের মঝেও তার লেখাপড়ার খরচ জোগাতে কখনও আপত্তি করেননি। কখনও নিজেদের থাকা ভিটের কিছু অংশ, কখনও একমাত্র গাভী, আবার কখনও বৃদ্ধ মায়ের কানের স্বর্ণালংকার বিক্রি করে ছেলের খরচ চালিয়েছেন। মশিউলও মাঝে মাঝে কিছুটা হেল্প করেছনে।

সেই কাওসার তাদের ভালোবাসার অমর্যাদা করেননি। মন দিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ইচ্ছা ছিল মেডিকেলে ভর্তি হয়ে ডাক্তার হবেন। মানুষকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবেন। দুঃখিনী মা রাইসা খাতুন ও বৃদ্ধ বাবা মাইদুরের মুখে ফোটাবেন সুখের হাসি। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধওে রেক্টাল প্রোলান্সে আক্রান্ত হয়ে অকাল মৃত্যু হয় সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষেও ছাত্র মেধাবী কাওসারের।

এখন ভাইয়ের পরিবার কীভাবে চলবে ভেবে পাগল প্রায় মশিউল।নানা চিন্তায় চোখ দুটো ভারী হয়ে আসল। মশিউলের চোখের দিকে তাকালে যেন মনে হয় বিষণ্ন দৃষ্টি। চৌচির বাতাস। যেন দেয়াল-চাপাদের খোঁজে আরেক দেয়াল ঢাকা পড়েছে মুখে।

মিরপুরের রূপনগরে তিন রুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে পরিবারসহ থাকে মশিউল। ফ্ল্যাটের রুমগুলো অনেক বড় বড়। রয়েছে দুইটি বাথরুম, বারান্দা, কিচেন রুম, ডাইনিং রুম। মন আর শিমু, সিঙ্গেল পরিবার হওয়ায় একটা রুম বলা চলে ব্যবহারই হয়না। তাই সাবলেট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল শিমু। প্রথমে রাজি না হলেও মশিউলও ভাড়া কিছুটা সেভের কথা ভেবে রাজি হয়ে গেলো।

মাসের এক তারিখ। সাবলেট নেওয়া শিবলি, ছেলে শাহেদ আর বউ নাসরিন চলে এসেছে। শিমুর শুরু হলো যৌথ পরিবারের মতো জীবন। বাবার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় শিমু কখনো অভাব বোধটা দেখেনি। বিয়ের পর বুঝতে পারছে সংসার কি রকম।দুই বছর আগের সেই দুঃসময়ের কথা এখনো ভুলতে পাওে না শিমু। সে সময় মশিউল হঠাৎ বেকার হয়ে যায়।একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতো। রাজনীতির কারণে সরকারের সাথে টানাপোড়েনে ওই কোম্পানি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয় মশিউল। এ সময় প্রেগনেন্ট হয় শিমু। একদিকে বেকার অন্যদিকে বউ প্রেগনেন্ট, টেনশনে ঘুম হতো না মশিউলের। এক বড় ভাইকে রিকোয়েস্ট করে বিদেশি এক কোম্পানিতে পার্ট টাইম চাকরি নেয়। সেখান থেকে যে পয়সা পেত তাতে কোনোরকম বাসা ভাড়া দিয়ে দিন চলে যেত।

এখন চাকরি করলেও বেতন তেমন খুব একটা বেশি পায় না মশিউল। বাসা ভাড়া, অন্যান্য খরচ, মাস শেষে টানাটানি শুরু হয়ে যায়। পাশের রুমে সাবলেটে থাকা শিবলির নিজস্ব ব্যবসা। মাসে ইনকামও ভালো।অবশ্য এ নিয়ে আফসোস নেই শিমুর। সব সময় প্রার্থনা করে মশিউল যেন ভালো একটা চাকরি পায়। এভাবে কাটছে জীবন।

হেমন্তের সকাল। আবছা কুয়াশায় ঢাকা বাসার পাশে মাঠটা। কেন যেন মন ভালো নেই মশিউলের। দিনগুলো সব ক্লান্ত আর বিষণ্ন। দুনিয়ার যত সমস্যা যেন তাকে গ্রাস করে খাচ্ছে।

ভাতিজার মৃত্যু, ভাইয়ের সংসারে দুঃখ, নিজের একটা ভালো চাকরি.., বউয়ের সঙ্গে এসব বিষয়ে প্রায়ই অভিমান হয়। এদিকে বাড়িতে বাবাকেও টাকা ঠিকমতো দিতে না পারায় একদম কথাই বলে না বাবা। সবমিলে চোখে মুখে অন্ধকার। সবকিছু বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে এগোবার চেষ্টা করে সে।একসময় বাইরে যাওয়ার চিন্তা করে। বিদেশ গেলে অনেক টাকা আয় করতে পারবে এ চিন্তা ভেবে শিমুর সঙ্গে কথা বলে। শিমুও সবার সুখের কথা ভেবে সায় দেয়। একদিন মশিউল পত্রিকায় দেখলো কম খরচে মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ। বিজ্ঞাপনটি দেখে সে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। শিমুর বড় ভাই ও বন্ধু জিয়ার কাছ থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে কাগজপত্রসহ জমা দেয়। কিন্তু ভিসা আর হয় না। এভাবে চলতে থাকে দিন,মাস।

দশ বারো দিন ধরে ফ্রিজে মাছ, মাংস কিছুই নেই। মাসের চার তারিখে বেতন পেয়ে এক হাজার টাকার মাছ, মাংস কিনেছিল মশিউল। বাজারের কথা বললেই শিমুর সঙ্গে অভিমান হয়। জীবনটা যে কত কষ্টের হতে পারে তা মাঝে মাঝেই শিমুকে ভাবিয়ে তোলে। বিশেষ করে যখন শশুর টাকা চায়। প্রতি মাসেই শশুরকে মশিউলের বেতন থেকে দুই হাজার টাকা দেবার কথা। কিন্তু প্রতি মাসেই তা সম্ভব হয় না। মনের জন্য খাবার, ঋণ, সংসার..ধীরে ধীরে শিমুর ধৈর্য খিটখিটে হয়ে যায়।

অফিস থেকে বাসায় ফিওে মশিউল। বাজার কিছু না করেই চলে আসে। শিমু বলল- মাছ নিয়ে এসেছো? ছেলেটা মাছ ভাজি ছাড়া ভাতই খেতে চায় না।
মশিউল- আর দুয়েকটা দিন অপেক্ষা কর, কিছু টাকা পাবো, বাজার করবো।
শিমু- তোমার তো তাই, আজ নয়, কাল, পরশু…।
মশিউল- কী আর করবো, জীবন বড় জ্বালাময়।
শিমু- এসব বাদ দাও.. কিছু একটা করো, অভাব অনটন আর ভাল্লাগে না। রাগের সুরে শিমু বলে- ফ্রেস হয়ে আসো, প্লেটে ভাত বারা আছে, খাও।

শিমুর কথা শুনে মশিউলের মাথাটা চক্কর মারল।মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। শিমু কাছে এসে মশিউলের মাথাটা মেসেজ করছে।শিমুর চোখ দিয়ে টলটল পানি পড়ছে।মন ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নামছে।

অলঙ্করণ: নূরুল আসাদ