খড়খড়ি ॥ মলয় সরকার


মনটা খারাপ করে চুপচাপই বসেছিল সঞ্চিতা। হঠাৎ কি মনে করে উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এল জানালার কাছে। জানালাটার খড়খড়িটা একটু ফাঁক করে তাকাল বাইরের দিকে। কেন যে মাঝে মাঝে মনটা সমস্ত রকম নিয়ন্ত্রণ থেকে বাইরে চলে যায় তখন কোনো কিছুই নিজের হাতে থাকে না।

তখন কি করলে যে ভালো লাগবে সেটা কিছুতেই আর বোঝা যায় না । কোনো কিছুতেই মন বসে না, আবার চুপচাপ বসে থাকতেও ভালো লাগে না । তখন ও অনেক সময়েই এই জানালাটার কাছে চলে আসে। এই জানালাটাকে তার একান্ত আপন মনে হয় যে কোনো প্রতিবাদ করে না , শুধু বাইরের এক আনন্দময় জগতের সাথে ওর পরিচয় ঘটাতে সাহায্য করে। যেকোনো দুঃখ নয় শুধু আনন্দ দিতে জানে। আসলে এইরকম কাউকে ও কখনও পায়নি, যে আনন্দ ছাড়া আর কিছু দিতে জানে না। তাই বিবর্ণ হয়ে যাওয়া হাল্কা সবুজ এই পুরানো কাঠের বেশ বড় পুরানো দিনের জানালাটা ওর এতো আপন।

সেই অনেক দিন আগে যখন এই বাড়িতে আর একজনের হাত ধরে চিরদিনের জন্য পুরানো পরিচিত পরিবেশ, আপনজন, চেনা জিনিসপত্র ছেড়ে এসে উঠেছিল তখন থেকেই ও একটা পরিবর্তন দেখতে পেয়েছিল ওর নিজের মধ্যে। জলের মতো, এক পাত্র থেকে আর এক পাত্রে পড়ে, তাকেই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শিখিয়েছিল সবাই। সবাই বলেছিল শ্বশুর বাড়ির গুরুজনদের কথা মানতে। আর শাশুড়ি অন্য সব কথা শেখানোর সাথে এ বাড়ির জেলখানার নিয়মকানুনগুলো একেবারে ‘কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিয়ে’ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তারই মধ্যে একটা ছিল, যখন তখন বারান্দায় না দাঁড়াতে বা বাইরে বেশি না বেরোতে। ও জিজ্ঞাসা করেছিল , কেন ? শাশুড়ি বলেছিলেন, রাস্তায় কত রকমের লোক থাকে , নতুন বৌকে কে কিভাবে দেখবে কি মন্তব্য করবে , আর তা ছাড়া দিনে-মানে যখন তখন বাইরে বেরোলে পাড়ার লোক কে কি বলবে। তাই বাইরে বেশি না বেরোনোই ভালো।

সেদিন থেকে ও নিজের সীমা রেখাটা বেশ ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল। এই জানালা আর সেটা বন্ধ অবস্থাতেই খড়খড়িটার সরু কাঠটা একটু টেনে একটু ফাঁক করলেই বাকি পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ ওর বড় বড় দুই চোখের মধ্যে দিয়ে। এটাই ওর একমাত্র নিজের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ালো।

এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে কখন, সেটা ওর নিজেরও খেয়ালই ছিল না।

বাড়িটা মধ্য কলকাতার এক মাঝারি রাস্তার ওপরে বেশ পুরানো দোতলা একটা বাড়ি। তৈরি বোধ হয় ইংরেজ ভারত ছেড়ে যাওয়ার কিছু আগে আগেই হবে। সেকালের ঢালাই লোহার নকশা করা লোহার গ্রীল দেওয়া বারান্দা, বড় বড় খড়খড়ি দেওয়া জানালা দরজা। মাঝে বোধ হয় একবার রঙ করা হয়েছিল। এখন পূরোপুরি রঙ উঠে না গেলেও রঙ তার উজ্জ্বল্য হারিয়েছে অনেক দিনই। সাধারণ লোকের কথায় পূরানো বনেদী বাড়ি বলা যেতেই পারে। বাড়িতে ঢোকার মুখে ঢালাই লোহার গেট ও ঢুকেই দুপাশে সিমেন্টের তাকিয়া দেওয়া একটা রকবারান্দা মতো করা আছে। ওখানে ছেলেরা বসে তাস পাশা বা রাজা- উজির মারতে পারত। ‘বনেদী বাড়ি’ শব্দটা ও শুনেছে সেই ছোটবেলা থেকে, কিন্তু মানে বুঝত না । বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল একবার। বাবা বলেছিল, বনেদী কথাটা এসেছে বুনিয়াদী থেকে অর্থাৎ যে বাড়ির বা পরিবারের বুনিয়াদ বা ভিত বেশ পুরানো অনেক পোড় খাওয়া, তাদের আচার আচরণ, শিক্ষা-দীক্ষা আর্থিক অবস্থা একটু পোক্ত হয় – এই আর কি। সঞ্চিতাও নিজের মতো করে এরকমই একটা কিছু বুঝেছিল, যে বোঝার সাথে আজকের ধ্যান-ধারণার বা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝার অনেক তফাত হয়ে গেছে।

খড়খড়িটা ফাঁক করে একটু তুলতেই তার চেরা চেরা সরু ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল একটা দোয়েল শিস দিচ্ছে। পাশের থেকে একটা বড় নিম গাছের ডাল খানিকটা হেলে জানালার দিকে এসেছে। সেটাতে মাঝে মাঝে এই নিস্তব্ধ দুপুর বেলায়, যখন সমস্ত অফিসগুলো সরগরম থাকে কিন্তু পাড়ার গলির মধ্যে আলস্য গড়িয়ে বেড়ায় ,কিংবা বিকেলের দিকে, মাঝে মাঝে দু একটা পাখী, কখনো দোয়েল , বা কোকিল কি শালিখ বা নিদেন চড়াই এসে বসে ।ওরাই তার নিঃস্তব্ধ দুপুরের সঙ্গী। ওর হঠাৎ হাসি পায়, বাবা মাঝে মাঝে ওকে ডাকত ‘দোয়েল ‘বলে। আসলে বাবার এই নামটা পছন্দ ছিল। বাবা চেয়েছিল এই নামটা রাখতে। কিন্তু নানা জনের দেওয়া নানা নামের চাপে এটা আর কখনও রাখা হয়নি। তাই বাবা নিজের অপূর্ণ সখ মেটাতে মাঝে মাঝে মেয়েকে ডাকত ‘দোয়েল’ নামে। তাই দোয়েল দেখলেই ওর বাবার কথা মনে পড়ে আর নিজেকে ওই বাঁধনহীন পাখীটার জায়গায় ভাবতে ভালো লাগে।নিজের বাঁধনে পড়া আর ওর বাঁধনহারা জীবনের তুলনাটা বড় বেশি মনে বাজে।

ওর মাঝে মাঝে মনে হয়, ভগবান যদি ওকে লেখিকা আশাপূর্ণা দেবীর মতো প্রতিভা দিয়ে পাঠাতেন তাহলে বোধ হয় এই খড়খড়ির ফাঁক দিয়েই ও বিশ্বজগৎ দেখে সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারত। সে ক্ষমতাও ওর নেই। সেই ভোর বেলা উঠে প্রথম যা মনে হয় তা হল, এই সংসারের চাকায় তেল দেওয়ার জায়গাগুলোতে ঠিক মতো তেল দেওয়ার কথা। গাড়িটা চলতে হবে। কোথাও কোনো বাধা সৃষ্টি হয়ে ক্যাঁচড় ক্যাঁচড় করলেই বিপদ।গাড়িটা শুধু ঠিকমত নির্বিঘ্নে গড়িয়ে গেলেই সবাই নিশ্চিন্ত। সেই কবে যেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটা কবিতায় পড়েছিল,’আমি যেন সেই বাতিওয়ালা ,সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য , নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার। ‘– কোন এক সীমান্তের প্রহরী সীমান্ত থেকে লিখেছিল তার প্রিয়াকে। ওর নিজেকে মনে হয় ও নিজেই সেই প্রহরী, যে সারাজীবন ধরে শুধু পরের জন্য সংসারের চাকায় শুধু তেল দিয়ে এল অথচ তার মনের কোণায় যা অন্ধকারের স্তূপ জমে রইল তা আর সরিয়ে দেখা হল না কোনদিন। সেই অন্ধকারের তল মাপতে সঞ্চিতা তাই যখন কেবল একলা নিজেকে নিয়ে থাকে তখন ছুটে যায় এই জানালার ধারে , মেলে দেয় ছড়িয়ে দেয় বাইরের জগতে।

হ্যাঁ বাইরের জগত বললে হয়তো হাসিই পাবে কারণ বাইরের জগত তো ওই মাঝারি মাপের এক রাস্তার এপাশে ওপাশে যতটা দেখা যায় আর কি। কখনো কিছু ফেরিওয়ালা, কিছু রিকশা আর তাদের সওয়ারী , কিছু হেঁটে যাওয়া মানুষ কখনও কখনও কিছু ট্যাক্সি, এই বেশির ভাগ সময়ের ছবি। এছাড়া যে কিছু নেই এমন নয়। সামনের গাড়ি বারান্দার নীচে এক কোণে একটা কুকুর বাচ্চা দিয়েছে। তাদের খেতে দেয় আবার একটা বুড়ি ভিখারী যে ওদের পাশেই বিছানা পত্তর আর দু একটা থালা- বাসনের সংসার নিয়ে থাকে। মা কুকুরের যত্ন , বাচ্চাগুলোকে সামলে রাখা , তাদের চেটে পরিষ্কার করা , ঠিকমতো খাইয়ে বড় করে তোলার মধ্যে ও একটা পাকা গৃহিনীপনার ছাপ দেখতে পায়। রাত্রে যখন বুড়িটা রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ার আগে কুকুরটার সঙ্গে ভাগ করে নিজের খাবার খায় আবার মাঝে মাঝে বকাঝকাও করে দুষ্টুমি করার জন্য, ঠিক যেন নিজের ছেলে মেয়েকে বলছে’, বেশ লাগে দেখতে সঞ্চিতার। কে জানে ওর কোন সংসার বা ছেলে-মেয়ে ছিল কিনা কোনদিন। কিন্তু যা মায়া ওর ওই এক রাস্তার কুকুরের ওপর, যেন নিজের মেয়ে আর নাতি নাতনীসব,দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। এই নিয়েই ওর ঘরসংসার।

এর বাইরে সঞ্চিতার বাইরের জগত সম্বন্ধে যা ধারণা তা ঐ বই পড়া বা সিনেমা দেখার মতো। কখনো কখনো বরের সঙ্গে বাজার বা টুকটাক এখানে ওখানে যাওয়া। এতে আর কতটা হয়। চারপাশের দৃশ্যগুলো পর্দার ছবির মতো চোখের সামনে দিয়ে চলে চলে পেরিয়ে যায়। মনে যেন কোন ছাপ ফেলে না। সেই কবে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে বাবার ঠিক করা ছেলের হাত ধরে এ বাড়িতে এসে ঢুকেছে, সেই থেকেই বাইরের জগত বলে যে একটা জগত আছে, সেটা প্রায় ভুলেই গেছে।

কোথায় যেন অদৃশ্য এক শিকলে ওকে বেঁধে রাখা হয়েছে। বাইরে বেশি না যাওয়ার জন্য বন্ধু- বান্ধবও তেমন বেশি হয়নি। ওই পুরানো কলেজের কিছু বান্ধবী , বেশিরভাগই সব বিয়ে হয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে। নয়তো সংসার নিয়ে সব এমন ব্যস্ত যে কেউ কারোর সাথে যোগাযোগ করার সময় পায় না। যেমন সাধারণ সব হয় আর কি।কাজেই ওর বেশি করে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ওই কটি লাইন , যা সে নিজের সঙ্গে একেবারে মিলিয়ে নিতে পেরেছে ,’ রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধা, এই চাকাতেই -‘ সারাটা জীবনই মনে হয় যেন চিরদিনের মতো বাঁধা।

সংসার যন্ত্রটায় সচল রাখতে রাখতে নিজেই যেন কখন একটা যন্ত্রাংশ হয়ে পড়েছে। একটা কোকিল ছিল বাড়িতে পোষা । ও বিয়ে হয়ে আসা পর্যন্ত দেখেছে। পাখীটা সারাদিন তবু একরকম থাকত, কিন্তু বিকাল হলে যেন কেমন আনমনা, অস্থির হয়ে পড়ত । কেবলই ছটফট করত আর ডানা ঝাপটাত । সঞ্চিতা বুঝতে পারত বিকেলে সমস্ত গাছে গাছে যখন অন্য কোকিলেরা গাছের ডালে বসে হলুদ বিকেল কে পঞ্চমে ভরিয়ে দেয়, তখন কেড়ে নেওয়া নীল আকাশকে কাছে পাবার জন্য ওর আকুলতা ওকে অসহিষ্ণু করে তুলেছে। সঞ্চিতা তখন যেন খাঁচায় বাঁধা কোকিলটি হয়ে ওর মনের কথা বুঝতে পারত। মনে মনে ওকে সান্ত্বনা দিত। ওটার দেখভাল, খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব ছিল ওর।

একদিন বিকেলটা হলুদ আলোয় ভরে গেছে। গাছে গাছে নিশ্চয় ফুল ফুটেছিল,মানে এই সময় টায় তেমনই হবার কথা, আর ছিল মন উদাস করা হাল্কা হাল্কা হাওয়া।পাখীটা খুব ডাকছিল। কাছে পিঠে কেউ ছিল না । সঞ্চিতা তাড়াতাড়ি এসে ওর খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে চুপ করে বহুদিনের বন্ধ দরজা টা আস্তে করে খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল পাখীটার মুক্তির আনন্দ। এ আনন্দ ওর মাথা থেকে প্রতিটি শিরায় শিরায় প্রবাহিত হয়ে সারা শরীরে ঠান্ডা জলের স্রোতের মতো ছড়িয়ে ওর মন প্রাণ ভাসিয়ে দিয়েছিল। পরে যখন জানা গেল যে পাখীটা খাঁচা খুলে পালিয়েছে বাড়িতে খুব খানিকটা হৈ চৈ হয়েছিল। কিন্তু ও আর মুখ খোলেনি, কি করে এটা ঘটল। ওর মনে হয়েছিল, পাখীটার মধ্যে দিয়ে ওর নিজের মুক্তির স্বাদ পেয়েছে।

সেদিন কি একটা কারণে ওর বর একটু আগেই বাড়ি ফিরে এসেছিল। এসে বলল, চল একটু ব্যাংকে যেতে হবে। ও খেয়ে একটু শুয়ে ছিল। যাক, ও যখন বলছে তখন নিশ্চয় খুব দরকার আছে। সঞ্চিতা শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিল। হঠাৎ বর বলল, পাশবইটা কোথায় রেখেছ?

-দেখ না, যেখানে থাকে সেখানেই থাকবে, কোথায় আর যাবে?

-সেখানে পাচ্ছি না বলেই তো বলছি।সেদিন তোমাকে যে রাখতে দিলাম–

– হ্যাঁ আমি রেখেছিলাম তো , যতদূর মনে পড়ছে আলমারিতে , ভিতরের ড্রয়ারের মধ্যেই রেখেছি।

-সেখানে থাকলে তো আর সময় নষ্ট করে খুঁজতেও হতো না , আর তোমাকে জিজ্ঞাসাও করতেও তো না ।এদিকে এসে খুঁজে দেখ কোথায় রেখেছ।

ও অনেক চেষ্টা করে সব খুঁজলো। নাঃ কোথাও নেই। একেবারে যেন ভোজবাজীর মত উপে গেছে। মুখটা বেশ কালো হয়ে গেল। ও তো ওখানেই রেখেছিল বেশ মনে আছে। বাড়িতে তো ওখানে হাত দেবার মতো আর কেউ নেই। এক সঞ্চিতা আর ওর বর এই দুজনেই তো আলমারি খোলে ।

ও কিছুতেই মনে করতে পারলো না আর অন্য কোথাও রেখেছে কিনা।

বরের তো মেজাজই খারাপ হয়ে গেল। এক তো আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি আসাটা ফালতু হয়ে গেল। রোজ বেরোনো যায় না ।আজ আগে থেকে বলে রেখেছিল ম্যানেজারকে, তাও পাশের বনধুকে একটু টেবিলটা দেখতে বলে তবে আসতে পেরেছে। আজ খুব দরকার ছিল টাকাটা তোলার- সেটা তো হবেই না । আবার ব্যাংকে দরখাস্ত কর, বাবুদের সব সময় মেজাজ। আজ নয় কাল, আঠারো মাসে বছর । কবে আবার ডুপ্লিকেট পাশবুক করানো যাবে , তার ওপর অফিস থেকে আগে বেরানো রোজ সম্ভব নয় । সব মিলিয়ে মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেল।গলার আওয়াজ টাও বেশ চড়ে গেল। চেঁচাতে লাগল সে। কথায় কথায় এটা সেটা বলতে লাগল। সঞ্চিতা মুখ নীচু করে চুপ করে সব শুনে যেতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ কানে এলো,
– কি কর সারাদিন ঘরে বসে বসে? বাইরের কোন কাজ তো আর করতে হয় না । চব্বিশ ঘণ্টাই ঘরে রয়েছ, খাচ্ছ-দাচ্ছ আর ঘুমাচ্ছ। একটা জিনিস ঠিক করে রাখবে তা পারবে না। দায়িত্ব বলে কোন জিনিস নেই।

এই কথা শুনে ওর মাথাটা গরম হয়ে উঠল, কান থেকে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ও সারাদিন বসে থাকে ? ভোর থেকে উঠে সংসারে সমস্ত কাজ একা হাতে করার পর এই কি তার পাওনা! আজ ও অফিসে চাকরি করেনা বলেই না ওর এই হেনস্থা। মা -বাবা কোনদিন খাওয়া নিয়ে কোন কথা বলেনি, আজ জীবনের এই এতদিন পরে এত উদয়াস্ত খাটার পরে এটা শুনতে হল যে, ও সারাদিন বসে থাকে। যেহেতু ওর কোন সার্ভিস বুক নেই , মাইনে নেই , ওভারটাইম নেই, তাই এতদিনের সমস্ত কাজ মূল্যহীন হয়ে গেল? তার মানে , এতদিনের সংসারের সব বাঁধন, দায়িত্ব সব মিথ্যে? আজ ওর মনে হল স্ত্রীর পত্রে মৃণাল যে কথা বলতে পেরেছিল ,’তোমাদের চরণাশ্রয়ছিন্ন মৃণাল’ সেটা যদি ও বলতে পারত মুখের ওপর, তার থেকে ভাল বোধ হয় আর কিছু হতো না ।এই বিনা মাইনের অথচ স্বীকৃতিহীন এই যে সারাজীবনের শুধু ভালোবাসাহীন বেগারখাটা আজ সব চোখের সামনে মিথ্যের রঙিন ফানুস হয়ে দুলতে থাকে। সাজানো সংসারটা এক মুহূর্তেই ফোলানো বেলুনে পিন লাগানোর মতো চুপসে যায়। অথচ এমন তো হতেও পারে যে পাশবইটা ওর বরই অন্য কোথাও রেখেছে। এমন কি হতে পারে না? সেটা আর একটু খুঁজেও দেখতে তো পারত।

সেটা না করে একেবারে ওকে এক জ্বলন্ত মিথ্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলো। এর আগে যে ও বলে নি এমন নয়। কিন্তু আজকে যেন কথাগুলো কেটে বসে গেল মনের মধ্যে।

আসলে আজ সকাল থেকেই মনটা ওর খারাপ হয়ে ছিল, হঠাৎ কেন জানি মাকে খুব মনে পড়ছিল। তাই চুপচাপ সমস্ত কাজ সেরে আপন মনে শুয়েছিল। এমন সময় এই ব্যাপার। ওর মনের সমস্ত বাঁধ যেন ভেঙে পড়লো। ও ছুটে গিয়ে জানালাটা ধরে খড়খড়িটা খুলে মুখ চেপে ধরে আঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। এই জানালা আর খড়খড়িটা কে তার মনে হলো তার মা। কতদিন পর যেন মায়ের বুকে মাথা দিয়ে নিজেকে উজাড় করে সমস্ত চোখের জলের বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে দিতে লাগল। তার সমস্ত অপমানকে যেন এই চোখের জলের ধারাতেই ভাসিয়ে নিজেকে হাল্কা হতে চাইল।ঠিক এই সময়েই সামনের গাছটা থেকে যেন সেই ছেড়ে দেওয়া কোকিলটাই পঞ্চম স্বরে ডেকে উঠল, কুউউউ…।

অলঙ্করণ: নূরুল আসাদ
আলোকচিত্র: সাইফ বরকতুল্লাহ