মায়াবন বিহারিণী (পর্ব-১৭) ॥ আরিফুর রহমান


আঁকা: সমর মজুমদার

না গো মা, আইজ এইখানে ত’ কোনো এক্সিডেন্ট হয় নাই! তুমারে কে কইল? মনা ছটফট করছে।আমাকে একজন ফোন দিয়েছিল কাকা।সে বলেছে, তার এক্সিডেন্ট হয়েছে এবং আজিজ মাস্টার চত্বরে আছে।
না গো, আমি সকাল সাতটায় আইয়া দোকান খুলছি।কোনোকিছু হইলে আমি দেহুম না, কও?
তাহলে ওগুলো ভাঙা কেন?
ওগলা কাইলকা পুলিশ ভাইঙ্গা দিছে।সরকারি জাগায় অবৈধ দোকান দিছিল।ঐহানে ঘর তুলার পারমিশন নাই ত’।
তাহলে কি অন্য কোথাও হয়েছে কাকা?
হইবার পারে।তোমরা এককাম কর, হসপিটালে যাও।ঐখানে গেলেই খবর পাইবা।

ঠিকাছে কাকা। আপনাকে ধন্যবাদ।
মনা বাইকে উঠতে উঠতে মেহেদীকে বলল, চল্, জেনারেল হসপিটালে খোঁজ নিই।
সাথে সাথে বাইক আজিজ মাস্টার চত্বর থেকে ছুটল উত্তরদিকে।ওদের মাথার ওপরে ফাল্গুনের সূর্য।রোদ ততটা প্রখর নয় আর হাওয়ায় এখনো উত্তুরে টান আছে।তবু উত্তেজনায় দরদর করে ঘামছে মনা।
রাতে তালুকদার বাড়ি থেকে ফেরার পর অনেকবার ফোনে পূরণকে ট্রাই করেছে সে।ফোন বন্ধ ছিল।সকাল দশটার আগে আগে পূরণ নিজেই কল দিয়েছিল মনাকে।ওর কাছ থেকে এক্সিডেন্টের খবর পেয়েই ছুটে এসেছে ওরা।

২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে ওদের জানানো হলো, আজ এখন পর্যন্ত কোনো এক্সিডেন্টাল কেইস আসেনি।
ব্যর্থ মনোরথে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসবার সময় আবারও ফোনে ট্রাই করল মনা।সেই একই অবস্থা, ফোন বন্ধ।বাইক পুলিশ সুপারের কার্যালয় পেরোনোর পরপরই ও মেহেদীকে বলল, ডিসি অফিসে ঢুকে যা।
এবার কিছুটা রেগে গেল মেহেদী। ডিসি অফিসে ঢুকে কী করব? শুধু শুধু ঘুরছি।আরে বুদ্ধু, ও তো এই অফিসেই চাকরি করে।এখান থেকে নিশ্চয়ই কোনো খোঁজ-খবর পাওয়া যাবে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা গেল পূরণ পাশের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় বসে।সংবাদ পড়বার মতো করে তথ্যটি বলল তথ্যকেন্দ্রের মেয়েটি, ভুল এক্সপ্রেশনে। যেন সবকিছুই স্বাভাবিক। মনার চোখে পড়লেও গায়ে মাখল না।ছুটল গন্তব্যে।

একটি রুম পার হতেই বারান্দায় একজনকে পেয়ে গেল মনা। পূরণের নাম বলতেই সামনের রুমটি দেখিয়ে দিল লোকটি। দ্রুত মেহেদীকে নিয়ে ও সেখানে ঢুকল।
তিনটি চেয়ারে তিনজন বসে আছে। মনা দেখল কেউ-ই পূরণ নয়। ও কাঁপা গলায় বলল, পূরণ!
আমি পূরণ। কী বলবেন, বলুন। একজন কিছুটা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল।
না মানে আমি যে পূরণকে…!
আপু, ডিসি অফিসে পূরণ একজনই, আর সেটা আমি।
কিন্তু আমি ওকে চিনি।মানে একবার জে-মার্টে দেখেছি।
একবার দেখেছেন।…. কি আপু, কোনো সমস্যা? মানে ধান্ধাবাজি করে এখানে কোনো কাজ করে দেবে বলে টাকাপয়সা নিয়েছে?
না না! আসলে পূরণের এক্সিডেন্ট….।

আপনি কোন পূরণের কথা বলছেন জানি না।ডিসি অফিসে আমি একজনই পূরণ, আরফাতুল ইসলাম পূরণ। আর দেখতেই তো পাচ্ছেন আমার কোনো এক্সিডেন্ট-ফ্যাক্সিডেন্ট হয় নাই।
এসব শুনে বারান্দার লোকটি ভেতরে ঢুকে বলল, স্যার, আপায় মনে হয় পূর্ণ স্যার রে খুঁজতে আসছেন।এক্সিডেন্টের কথা বলতেছেন শুনলেন না?
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে আব্দুল ভাই।….আপু, ওনার নাম ছিল পূর্ণ।….পূর্ণ ভাইয়ের পুরা নামটা যেন কী ছিল, আব্দুল ভাই?
স্যার, ওনার নাম ছিল মহিবুল হাসান পূর্ণ।

হ্যাঁ আপু, কাছাকাছি নাম তো, আপনার মতো অনেকেই ভুল করত। আপনার কথা সত্য, উনি গত বছর এই এপ্রিল মাসেই এক্সিডেন্টে মারা গেছেন। অফিসে আসার পথে, এই আজিজ মাস্টার চত্বরেই, একটা ট্রাক ব্রেক ফেল করে ওনার পা দুইটা পিষে দিয়েছিল! হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে ঢাকার পঙ্গুতে রেফার করেছিল ডাক্তার। কিন্তু শহর থেকে একটু দূরের একটা মোড়ে একটা বটগাছ আছে ওখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

মনা বিস্ফারিত নয়নে পূরণ নামের লোকটার কথা শুনছিল।
আরে আপু, আপনি ওভাবে কী দেখছেন? পূর্ণ ভাই….।
মনা দেখছে, লোকটার চেয়ারের পাশে সেই অ্যাডাল্ট ওয়াকার।
তখনই লোকটার সিনিয়র একজন রুমে ঢুকলে সে চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে খুব কষ্টে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল।তার পা দুটো যেন দুমড়ে মুচড়ে যেতে চাইছে।

সাথে সাথে দুলে উঠল মনার পৃথিবী।আর সে টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
আকাশ তালুকদার সকাল সকাল অফিসে চলে এসেছে।
গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে সূর্যোদয়ের পর পর্যন্ত টানা ঘুমিয়ে সকালে বেশ ঝরঝরে লাগছিল ওর। তাই মিতা হককে বলেছিল, মা, শরীর ভালো লাগছে। আজ কোন বার?

ছেলেকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। আজ মঙ্গলবার।তুই সকালে কী খাবি বল।
খুব খিদে পেয়েছে মা।যা করবে তাড়াতাড়ি করো।খেয়ে অফিসে যাব।
অফিসে যাবি এই শরীরে!…. শুনতে পাচ্ছেন? কোথায় গেলেন আপনি?
ছেলের অফিসের কথা শুনে মিতা হকের খুশি উবে গেছিল।গলা বাড়িয়ে স্বামীকে ডেকে এনে সব বলেছিলেন তিনি।অবশ্য আকাশের সাথে কথা বলে ওকে বাধা দেননি আতাউর রহমান তালুকদার।তিনি চাইছিলেন ছেলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাক।তবে মিতা হক কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না।তার যুক্তি ছিল, দ্বিতীয় মেয়াদে বাড়ানো ছুটি যেহেতু আরও মাসখানেক রয়ে গেছে তার অন্তত অর্ধেকটা বাড়িতে কাটিয়ে আকাশ শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে তবেই অফিসে যোগ দিক।কিন্তু আকাশের বাবার যুক্তি ছিল, ছেলের মন চেয়েছে তো সে অফিসে যাক।পরিচিত সবার সাথে মিশুক, কথা বলুক আর যোগদানের আবেদনটাও করে আসুক।তাহলেও তো ও দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

অফিসে গিয়ে খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি আকাশ। সহকর্মীদের নানাবিধ প্রশ্ন ওকে অতিষ্ট করে তুললে দশটার আগে আগেই বের হয়ে এসেছে। বেরিয়েই হঠাৎ মনে হয়েছে, তক্ষুণি তাকে আজিজ মাস্টার চত্বরে যেতে হবে। কেন, সেটা সে ঠিক জানে না! কিন্তু ওর কেবলই মনে হচ্ছিল ওখানে যেতে হবে।

চত্বরে এসে আকাশ ওর চাচাতো ভাই আসিফের বাইক থেকে হঠাৎই লাফিয়ে নেমে উদ্ভ্রান্তের মতো মেইন রোডে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল! পথচারীরা হৈচৈ করে ছুটে গিয়ে সরিয়ে না নিলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত।
আসিফের মুখ শুকিয়ে গেছিল আতঙ্কে। সে টের পেয়েছিল, আকাশ আর তার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই।

একটু পর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে আকাশ অন্যজনের স্বরে ওকে বলেছিল, চল্, হাসপাতালে যেতে হবে।এক্ষুনি। আসিফ জানত বাধা দিলে ও বেপরোয়া হয়ে যাবে। অগত্যা হাসপাতালের দিকে বাইক ছুটিয়েছিল সে।
ওকে সাথে নিয়ে আকাশ জেনারেল হাসপাতালের পুরো লেবার ওয়ার্ড, প্রত্যেকটি কেবিন তন্নতন্ন করে কাকে যেন খুঁজছিল! না পেয়ে, একসময় ধীরে ধীরে নিচে নেমে এসেছিল।
পুরো সময়টায় ক্রমাগত বিড়বিড় করছিল আকাশ। সেখান থেকে কেবল ডাক্তার, রক্ত, ইনজেকশন, ব্যান্ডেজ, ব্যথা এই শব্দগুলো বুঝতে পেরেছিল আসিফ।

তারপর আকাশকে নিয়ে তারই নির্দেশে সে ঢাকামুখী হাইওয়ে ধরে পূর্বদিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওরা আজিজ মাস্টার চত্বর পেরিয়ে টেনিস ক্লাবের কাছাকাছি যেতেই বঙ্গবন্ধু স্কুলের রাস্তা ধরে এসে চত্বরে নেমেছে মনা ও মেহেদী।

সেই মসজিদের পাশের মোড়ে আসিফকে গাড়ি থামাতে বলেছে আকাশ। তারপর গাড়ি থেকে নেমে খুবই বিমর্ষ চিত্তে পুরো মোড় ঘুরে ঘুরে সে কিছু একটা খুঁজেছে! টানা এবং একমনে। কারোর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, কারোর কোনো উৎকণ্ঠা আমলে না নিয়ে।

শেষ পর্যন্ত আকাশ থেমেছে সাড়ে ১২টার দিকে, যখন জোহরের আযান দেবে বলে মুয়াজ্জিন মাইকে ফুঁ দিয়েছে! তারপর আযান চলা অবস্থাতেই সে আসিফকে নিজের গলায় বলেছে, এই মোড়ে যেহেতু এসেছি, চল, খালামণির সাথে দেখা করে বাড়ি ফিরে যাই।

মনা চোখ খুলল। দেখল, সে নিজের বিছানায় শুয়ে আছে, খান বাড়িতে। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন ময়নামতি! একটু দূরেই চেয়ারে বসে আছেন বড়ো খান সাহেব! তাঁর মুখেও হালকা হাসির আভা ফুটে উঠেছে।
তুমি এত ভয় পাও কেন মা?

ময়নামতির প্রশ্ন শুনে ওর মনে পড়ল, ডিসি অফিসের পূরণ নামের লোকটির পাশে সেই ওয়াকার আর তার পলকা পা দেখে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল! পানির ঝাপটায় জ্ঞান ফিরলেও খুব ঘুম পাচ্ছিল বলে সে আসিফকে বলেছিল, আমি ঘুমাব।আমাকে মেসে দিয়ে আয়।

অবশ্য মনা এটা জানে না যে, আসিফ কতোটা ঝামেলা সয়ে ঘুমন্ত মনাকে মেসে পৌঁছে দিয়েছে এবং ওর বাবা-মাকেও কতোটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে গাড়ি করে ওকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসতে।

মনাকে চিন্তিত দেখে ময়নামতি আবারও প্রশ্ন করলেন, তুমি এত কী চিন্তা করো? এত ভয় কেন পাও? তুমি তো খান বাড়ির মেয়ে, তোমার আরও স্ট্রং পার্সোনালিটি থাকা উচিত।তাই না মা?
না মানে ও মানে পূরণ মানে পূর্ণ!
আর মানে মানে করো না।ওকে ধরে নিয়ে এসেছি।এসো পূর্ণ।হাসতে হাসতে বললেন বড়ো খান সাহেব।

পূর্ণকে দেখা যাচ্ছে ওয়াকারে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে! ঠিক যেন বড়ো খান সাহেবই।শুধুমাত্র তারচেয়ে বয়সটা বেশ কম।
ময়নামতি মনার চোখে পূর্ণ-র জন্য মুগ্ধতা দেখছেন।বললেন, ও তোমাকে খুব ভালোবাসত।সেই প্রথম যেদিন তোমাকে বিবিএ পরীক্ষা দিয়ে কলেজ থেকে বের হতে দেখেছিল সেদিন থেকেই।কিন্তু দ্বিতীয়বার তোমার সাথে দেখা হওয়ার আগেই ওর এক্সিডেন্ট হয়।তারপর থেকেই ও তোমাকে চোখে হারাত।আর খুঁজত নিজের অবয়ব। কিন্তু তা তো আর হবার নয়, তাই সুযোগ পেয়ে আকাশের শরীরে বসতি গড়েছিল।সেটাও তোমারই জন্য।

কিন্তু আমাদের জগৎ-টা আলাদা, সেটা ও ভুলে গেছিল। ময়নামতির কথার মাঝখানে কথা বলে উঠলেন বড়ো খান সাহেব।ওখানে একক অস্তিত্বের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই।সমষ্টিগত ধারণার মূল্যায়ন করা হয় এবং বাস্তবায়নও।ফলে ইতোমধ্যে ওকে দলছুট ঘোষণা করা হয়েছে।
শুনে, চোখ দুটো ছলছল করে উঠল মনার।মানুষটা আমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসত। এখনো কেমন মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে।

মনার এই ভাবনা ময়নামতিকেও ছুঁয়ে গেল।এখন একমাত্র তুমিই ওকে দলভুক্ত করবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পার।নয়তো ওর মুক্তি নেই, ওকে দলছুট থেকেই এখানে ঘুরে বেড়াতে হবে।

মনা কিছুটা কাঁপা গলায় ওর জ্যেঠিমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি।আমি কীভাবে ওর মুক্তির পথ খুঁজে পাব জ্যেঠিমা?
আমি মুক্তি চাই না! পূর্ণ-র কণ্ঠ থেকে ক্ষোভ ঝরে পড়ল!
তক্ষুণি পাশের রুম থেকে রাহেলা খানমের গলা শোনা গেল।আমার মেয়েটা কী বলছে ওসব? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
দ্রুত হাতে মনার চোখ ছুঁয়ে দিলেন ময়নামতি।

রাহেলা খানম এসে দেখলেন মনা ঘুমিয়ে আছে! দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। কী নিস্পাপ শিশুর মতো ঘুমাচ্ছে মেয়েটা! মাঝে মধ্যে কী হয় ওর? কেন হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যায়? ও কি কোনোকিছু দেখে ভয় পায়? নাকি এটা কোনো রোগ? কেন মনার বাবা আমাকে কিছু বলে না?
প্রশ্নগুলো তার বুক ঠেলে আরও একটি দীর্ঘশ্বাস বের করে আনল।
একটু পর তিনি বেরিয়ে গেলেন আর সাথে সাথে চোখ খুলল মনা! রুমের বাকি তিন সদস্য যে যার জায়গাতেই আছেন।

দেখ মা, তালুকদার বাড়ির ছেলেটিকে খুব ভুগিয়েছে পূর্ণ। হয়ত তোমার মায়া-মমতা আর যত্নই পারবে ওর কাছ থেকে পূর্ণ-র জন্য ক্ষমা এনে দিতে। ওর সাথে আমাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ সূত্র নেই। বললেন বড়ো খান সাহেব। তাঁর কণ্ঠ থেকে কি আকুতি ঝরে পড়ল? অনেকটা যেন তেমনই শোনা গেল।
মনা ফিসফিস করে বলল, ও তো ভীরু আর বেশ স্বার্থপরও!
কিন্তু তোমার চোখে ওর জন্য আগের সেই মায়া গতকালও দেখা গেছে। এবার কথা বললেন ময়নামতি।বর একটু ভীরু হলে তাকে মমতার বাঁধনে বেঁধে সংসার করার তৃপ্তি অন্যরকম, আর স্ট্রং পার্সোনালিটির হলে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়াতেও পরম সুখ! আর স্বার্থপরতার কথা বলছ? সেই রাতে ও বেশ ভয় পেয়েছিল। হয়ত বেশকিছু দিন সেই ভয় থেকে সে বেরোতে পারেনি। তাই তোমার নামে বদনাম ছড়ানোর কোনো প্রতিবাদ করা ওর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

মনা বেশ লজ্জা পেল। ওর জেঠিমার কথার ইঙ্গিত ও স্পষ্ট বুঝতে পাচ্ছে। শেষ বিকেলের একটু আলো জানালার গ্রিল গলে ওর মুখে পড়ছে।তাতে ওর মুখ আরও লাজুক রাঙা দেখাচ্ছে।সেদিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে পূর্ণ।
লজ্জায় মনার লাল হয়ে ওঠা, দৃষ্টি এড়াল না ময়নামতি ও বড়ো খান সাহেবের।দুজনেই টের পেলেন, বিদায় ঘনিয়ে এসেছে।
কিছুদিন আগে যে অতৃপ্তি নিয়ে চলে যেতে হয়েছিল ময়নামতির।আজ সুদে-আসলে মিটিয়ে নিতেই যেন প্রগাঢ় একটি চুমু এঁকে দিলেন মনার কপালে।

কাশফুলের নরম স্পর্শের স্নিগ্ধতা নিয়ে কয়েক সেকেন্ড চোখ বুঁজে রইল মনা।তারপর কপালের টিপ রাখবার জায়গাটায় সেই স্পর্শানুভূতি নিয়েই চোখ খুলে দেখল, রুমে কেউ নেই।

বেশ ঝরঝরে লাগছে মনার।বিছানা থেকে নেমে সদ্য স্নান সেরে ওঠা পাখির মতো গা ঝেড়ে সে রাহেলা খানমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মা, ওই পাগলটা নাকি আজও ওর ছোটোখালার বাড়ির কাছের মোড়ে গিয়ে নাটক করে এসেছে? বাবাকে এক্ষুনি বলো ওকে আমার মমতার শিকলে বেঁধে ফেলবার ব্যবস্থা করতে এবং সেটা আজই। নয়তো দেখো, ময়না পাখি আবার ফুড়ুৎ! আজ কিন্তু পূর্ণিমা।

মেয়ের চোখে-মুখে দুষ্টুমি নাকি সিরিয়াস ভাব কিছুই বুঝলেন না রাহেলা খানম। ছুটে গেলেন স্বামীর কাছে ফোন করতে।
রাতের ঘড়ি এগারোটা ছুঁই ছুঁই। মকবুল হোসেন খান ও রাহেলা খানম বারান্দায় বসে আছেন। বাইরে উথাল-পাতাল জোছনা। এমন জোছনা যে কেবল মনে পুলক জাগায় তা নয়, কখনো কখনো উদাসীনও করে! কখনো মন ভরিয়ে দেয় বিষাদে! এই যেমন এখন মনার বাবা-মার মনে বিষাদ! হুটহাট করে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল! এখন সে তালুকদার বাড়িতে।

ফাল্গুনের বিকেলটা যখন ছুটে যাচ্ছিল সন্ধ্যার দিকে তখনই রাহেলা খানমের ফোন পেয়েছিলেন মকবুল হোসেন খান।তিনি তখন ছিলেন উপজেলা হাসপাতালের পাশে তার ব্যবসায়িক অফিসে।ফোনের অপর প্রান্ত থেকে রাহেলা খানমের উৎকণ্ঠা মেশানো কথাগুলো শুনে তিনি স্তব্ধ হয়ে গেছিলেন। কাকতালীয়ভাবে তখনই ডা. জব্বার এসেছিলেন সেখানে, সাথে আতাউর রহমান তালুকদার।

ডা. জব্বারের প্রস্তাব এবং তার স্বপক্ষে যুক্তি শুনে তিনি কেবল একটি প্রশ্ন করেছিলেন, তুমি ডাক্তার হয়েও এমন কথা বলো?
ডা. জব্বার একটু হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, সমাজ-সংসারে কেবল ডাক্তারি বিদ্যা-ই কাজে লাগে না বন্ধু, কখনো কখনো সীমানার বাইরেও দু’এক পা হেঁটে আসতে হয়।

আতাউর রহমান তালুকদার হঠাৎ তার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, তুমি আর অমত করো না। দেখ, বন্ধুত্বে সরি থাকতে নেই, তবে তুমি চাইলে আমি তা-ও বলতে রাজি।
চলবে..